আগের পর্ব

আগের পর্বে আমরা এই সিরিজ সম্পর্কে জেনেছি। আমরা এ-ও জেনেছি যে, এখানে আমরা মূলত বিতর্ক “শিখবো”! কিন্তু তাতে ছোট্ট একটা ঝামেলা আছে। তোমাদের মনে হতেই পারে যে, এতো সময় নষ্ট করে বিতর্ক শিখবো ক্যানো! পরীক্ষার খাতায় কতো লিখে এসেছি, “Time is money”। আর সেই সময় নামের টাকাকে নষ্ট করে ক্যানো বিতর্ক শিখতে হবে। তাই এই পর্বে আমাদের আলোচ্য বিষয় “ক্যানো বিতর্ক করবো” 😀

আমরা সবাই তার্কিক আমাদের এই তর্কের রাজত্বেঃ

কি শহর বলো-কি গ্রাম বলো, বাংলাদেশের সবখানে সবজায়গায় একটা দৃশ্য দেখা যায়। সেটা হলো, খুব সকাল বেলা রাস্তার পাশের চা-দোকানে বসে মানুষজন হাতে চায়ের কাপ নিয়ে তুমুল তর্ক করছে! তর্কের বিষয়বস্তু অবশ্য নানা রকমের। বাংলাদেশের রাজনীতি থেকে শুরু করে সাড়ে আট হাজার মাইল দূরের ডোনাল্ড ট্রাম্প সাহেব কেউই তাদের হাত থেকে রক্ষা পান না! 😛 আসলে কি করেন তারা? তারা একই বিষয়ের উপর নানা মত দেন। কেউ এটা বলেন তো আরেকজন সেটা বলেন।

আবার দেখো, তোমরা বন্ধুরা মিলে মেসি-রোনালদো কিংবা রিয়াল-বার্সা তর্ক করছো! কোনোদিন কি খেয়াল করে দেখেছো যে, কিভাবে তোমরা তর্ক করো! প্রথমে তোমরা একটা অবস্থান নাও তারপর নিজেদের যুক্তির পিছনে নানা উদাহরণ দাঁড়া করাও, তারপর বিগত বছরে কার কেমন পারফরম্যান্স ছিলো তার ফিরিস্তি দিতে থাকো।

উপরের দুইটা ঘটনা গুলোকে একটু বিশ্লেষণ করে দেখো, দেখবে, ঘটনাগুলোর সাথে বিতর্ক করার তেমন বড় কোনো পার্থক্য নেই! বিতার্কিকরাও কিন্তু ঠিক একই কাজই করেন! তারাও একটা অবস্থান নেন, তারপর সে অবস্থানের উপর নিজের মতামত দেয়া শুরু করেন, সেজন্য তারা যুক্তির আশ্রয় নেন আর সেসব যুক্তির সপক্ষে নানা রকমের তথ্য-উপাত্ত দিতে থাকেন! বুঝতেই পারছো, আমরা সবাই জন্ম থেকেই কিন্তু একজন তার্কিক! নিজেকে ঘষে-মেজে একটু পরিষ্কার করে নিতে পারলেই কিন্তু পুরোদমে “তার্কিক” থেকে “বিতার্কিক” পদে প্রমোশন পেয়ে যাবো! 😀 কাজেই, এরকম সহজ যে কাজ তা না করার কি কোনো কারণ থাকতে পারে?

তর্ক-বিতর্ক-কুতর্কঃ

একটু আগের লাইনেই তুমি দেখে এসেছো যে আমি তর্ক আর বিতর্ক শব্দদুইটিকে দুইটি ভিন্ন অর্থে ব্যবহার করেছি। তাহলে কি শব্দ দুইটা ভিন্ন? কিংবা শব্দ দুইটার মধ্যে পার্থক্যই বা কি! খুব ছোট্ট একটা উদাহরণ দিই। তোমরা বন্ধুরা যখন মেসি ভালো খেলোয়াড় নাকি রোনালদো ভালো খেলোয়াড় এ নিয়ে তর্ক করো দেখা যায় কিছুক্ষণের মধ্যে আলোচনার বিষয়বস্তু পালটে যায়! দেখা যায় কে সেরা তার তর্ক করতে করতে তোমরা চলে আসো কার ফিফা খেলার দক্ষতা ভালো তা নিয়ে। আবার চায়ের দোকানে বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে তর্ক শুরু হলে তা একসময় পরিণত হয় হিলারি ক্লিনটন ভালো নাকিও ডোনাল্ড ট্রাম্প ভালো তা নিয়ে।
এখানে একটা জিনিস খেয়াল করেছো, যে, আলোচনা বা তর্ক যা-ই বলি না ক্যানো তা কিন্তু আর একটা নির্দিষ্ট বিষয়ে সীমাবদ্ধ থাকছে না; কারো বক্তব্যই গঠনমূলক হচ্ছে না! কাজেই দিনশেষে দেখা যায়, লাভের লাভ কিছুই হলো না। বিতর্ক এখানেই তোমাকে সেই সুবিধাটুকু এনে দিবে। তোমাকে একটা “নির্দিষ্ট” বিষয়ে গঠনমূলক কথা বলতে শিখিয়ে দিবে। কাজেই রাস্তার মোড়ে দাঁড়ানো তর্কপ্রিয় মানুষদের থেকে তুমি আলাদা হয়ে যাবে। তখনই তুমি “তার্কিক” থেকে “বিতার্কিক” হয়ে যাবে। এতে করে তোমার মানসিক পরিপক্বতাও যাবে বেড়ে!

একটু আলাদা হতে কে না চায়ঃ

ধরলাম তুমি কোনো একটা হাই-স্কুলে বা কলেজে লেখাপড়া করছো। আর তার পাশাপাশি তুমি বিতর্কও করো। আর তোমার সাথেরই আরেকজন বিতর্ক জাতীয় কিছুই করে না। এখন যখন তুমি তার সাথে নিজেকে তুলনা করবে, তখন খেয়াল করে দেখবে, তুমি তার চেয়ে অনেক বেশি স্মার্ট। কিভাবে? কারণ, বিতর্কে তুমি পুরো বিশ্ব নিয়ে আলোচনা করছো, কোথায় কি ঘটছে তা তোমার বিতর্কের খাতিরে জেনে নিতে হচ্ছে, তুমি বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে চিন্তা-ভাবনা শুরু করে দিয়েছো এ সময় থেকেই! কাজেই আমি কি বলতে পারি না, তুমি তোমার পাশের জনের কাছ থেকে অনেকখানি আলাদা, অনেকখানি পরিণত?

ভূত-ভবিষৎ

বিতর্কে খুব ইন্টারেস্টিং একটা ব্যাপার আছে। সেটা হলো কি, প্রতিপক্ষ যখন কোনো কথা বলে তখন সাথেসাথে এ নিয়ে তোমাকে প্রতিযুক্তি(Counter Logic) দিতে হয়। তৎক্ষণাৎ তোমাকে কথা সাজাতে হয়, বিচারককে মুগ্ধ করতে তোমাকে নানা কায়দা করে সাজিয়ে কথা বলতে হয়! ব্যাপারটা কি জানো, যে, তোমার মস্তিষ্ক এভাবে করে অনেক দিনের প্র্যাক্টিসে গুছিয়ে কথা বলতে শিখে যায়। ফলে যখন তোমাকে স্যারের কাছে ভাইভা দিতে যেতে হয় কিংবা ক্লাসে কোনো প্রেজেন্টেশানে যেতে হয় তুমি আর ভয় পাবে না আর এসব তুমি উতরে যাবে সহজেই। কোনো ইন্টারভিউ বোর্ডেও তুমি কুপোকাত হবে না! কারন বিতর্কে তুমি একশজনের সামনে গলা উঁচিয়ে তোমার নিজের কথা বলতে শিখে গেছো!

রসকষহীন বইয়ের আনন্দ

ধরো, তুমি সামাজিক সমস্যামূলক একটা বিতর্ক করছো কিংবা অর্থনীতি নিয়ে বিতর্ক করছো! এখন তোমার Information লাগবে! কিন্তু Information পাওয়ার জন্য তুমি যদি তোমার সামাজিক বিজ্ঞান মানে কিনা, বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় বইটা নাড়া-চাড়া করতে থাকো দেখবে তোমার ক্লাসের পড়াও হয়ে গিয়েছে! এক ঢিলে একেবারে দুই পাখির মতো না ব্যাপারটা?

ওহ! আরো বলি, ধরো, খুব বোরিং একটা ব্যাপার হল রচনা লেখা কিংবা সৃজনশীল প্রশ্নগুলোর উত্তর লেখা। কিন্তু তুমি যেহেতু গুছিয়ে কথা বলতে শিখে যাচ্ছো কাজেই প্রশ্নের উত্তর লেখা তোমার কাছে আর কোনো বিষয় হয়েই দাঁড়াবে না! বুঝতে পারছো তো, যে, তোমার রসকষহীন বইগুলো কতো আনন্দ নিয়ে তোমার সামনে হাজির হচ্ছে!

বড়দের ভাষায় কিছু কথাঃ

অনেকক্ষণ তো হালকা চালে কথা হলো। এবার একটু গুরুগম্ভীর আলোচনায় আসি!

যারা বিতর্ক করেন তারা বলেন হয়তো ৫-৬ মিনিট কিন্তু তাদের শুনতে হয় বলার সময়ের ৫ গুণ। কাজেই বিতার্কিকরা শুধু ভালো বক্তা নন, তারা খুব ভালো শ্রোতাও। তোমাকে অন্যের মতামত মনোযোগ দিয়ে শুনতে হবে, তাদের বক্তব্যকে শ্রদ্ধা করতে জানতে হবে। এতে করে তোমার মধ্যে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ গড়ে উঠবে আর তুমি নিজের অজান্তেই একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে বেড়ে উঠবে!

যাই হোক, এতোক্ষণ তো বকর-বকর করে তোমাদের মাথা ধরিয়ে দিলাম! যেটা বুঝানোর চেষ্টা করেছি তা হলো বিতর্ক কিভাবে তোমাকে এক অন্য তুমিতে পরিণত করে দিবে তা নিয়ে!

আয়নায় নিজেকে অন্যভাবে দেখে নেয়া যাক তাহলে! 😀