“গুজব বাতাসের আগে ছড়ায়।“- প্রচলিত একটি কথা, যা বাস্তব জীবনে সত্য। আধুনিক যুগে ইন্টারনেটের কল্যাণে এক নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। এখন বলতে হবে, “গুজব আলোর আগে চলে।” অসংখ্য ভাইরাল ভিডিও, লিঙ্ক, নিউজ কোন রকম চিন্তা না করেই শেয়ার দিয়ে অনেকে সমাজে বিশাল ভূমিকা পালন করেছে বলে মনে করে। যদি ভুলটি ধরিয়ে দেন, তবে উত্তর আসে, ‘যদি সত্যি হয়/কখনো হয় নাই, যদি হয়/ আরেহ! মিথ্যা হলেও বিষয়ডাতো সচেতনতামূলক/ হু, বুঝলাম এইডা মিথ্যা, এইভাবে হয় না, তবু এইডা কইয়া যদি মানুষজনরে দূরে রাখা যায়, খারাপ কি/ খুব পাকনামি দেখাও, বেশি বুঝো ইত্যাদি’। ছোটবেলার জুজুর ভয় দেখানোর প্রভাব এখন বড়বেলাতেও। এসব গুজব যে কম লেখাপড়া জানা লোকজন ছড়াচ্ছে তা কিন্তু না, অনেক লেখাপড়া জানা লোকজন কোন যাচাই বাছাই না করে শেয়ার দিচ্ছে। শেয়ার দিয়েই ‘যাক বাবা! আমার অনলাইন নাগরিক দায়িত্ব পালন করতে পারলুম অবশেষে‘ ভাব নিয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে। একবার চিন্তা করে দেখুন, নিজেকে কোন জায়গায় নামিয়ে দিচ্ছেন।
নিচের লিঙ্কটি শ্রদ্ধেয় সিনিয়রের কাছে থেকে পাওয়া।(১) কলাতে নাকি এইডস এর জীবাণু(এইচ আই ভি) মিশানো হচ্ছে, তাই কলার মাঝে নাকি লাল রঙ থাকলে খাওয়া উচিত না।
এইচ আই ভি কিভাবে ছড়ায়: এইচ আই ভি রক্ত, বীর্য/কামরস, একই সিরিঞ্জ ব্যবহার, মায়ের দুধ ইত্যাদির মাধ্যমে ছড়ায়। মায়ের দুধের মাধ্যমে ছড়ায় দেখে অনেকে ভাবতে পারেন, খাবারে মাধ্যমেও ছড়াতে পারে। এটা সম্পূর্ণ ভূল। এইচ আই ভি, খুবই দূর্বল ভাইরাস। দূর্বল ভাইরাস বলতে বুঝাচ্ছি যে, বিশেষ প্রক্রিয়া বা অবস্হা ছাড়া এই ভাইরাস বাঁচে না। এই ভাইরাস, মানবদেহের বাইরে খুব অল্প সময় বাঁচে। এরা তাপ, অম্ল-ক্ষার এবং শুষ্কতার প্রতি অনেক অনেক সংবেদী। দেহের বাইরে মানেই তাপমাত্রা ভিন্ন, দেহের ভিতর একটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রা বজায় থাকে। দেহের অম্ল-ক্ষার অবস্হা এর সূচক ৭.৪। যেটা দেহের বাইরে পাওয়ার সম্ভাবনা একে বারে নেই বললেই চলে। তাছাড়া দেহের ভিতরে থাকলে শুষ্কতা নাই, কিন্তু দেহের বাইরে গেলেই শুষ্কতা। গবেষণার কাজে যখন এইচ আই ভি ভাইরাস নিয়ে কাজ করা হয়, তখন এই ব্যাপারগুলো সতর্কভাবে দেখা হয়। সাধারণ তাপমাত্রায় আনলে অধিকাংশ মানব ভাইরাসই ধ্বংস বা অক্ষম হয়ে যায়।
এখন, আপনি প্রশ্ন করতে পারেন, তাহলে এইচ আই ভি কেন এতো মারাত্নক? দেহের ভিতর সে বিশেষ এক কোষকে(দেহরক্ষী কোষ- সিডি৪+) আক্রমণ করে ধ্বংস করতে পারে বলেই সে মারাত্নক। বিস্তারিত জানতে এটা পড়ুন। (২ এবং ৩)
তারমানে কি এইচ আই ভি ওলা রোগীর রক্ত নিরাপদ? মোটেই না। এমনকি যেকোন সুস্থ মানুষের রক্তের স্পর্শ থেকে দূরে থাকা উচিত। রক্ত অনেক জীবাণু ছড়ানোর খুব সহজ মাধ্যম। তাই, রক্ত থেকে সতর্কতা থাকা উচিত। (এমনকি পশু-পাখির রক্তও)।
এবার আসি, কলা কেন লাল হয়ে যায়?
আসলে লাল নয়, বাদামী হয়। একই অবস্হা আপনি আপেল, পেয়ারাতে দেখবেন। কলা যে কারণে বাদামী হয় সেটা হলো পাকার কারণে। ফল পাকার একটি উপায় হলো ইথাইলিন তৈরি, যা হচ্ছে গাছের একটি হরমোন (জ্বি গাছেরও হরমোন আছে)। কিছু কিছু ফল ইথাইলিন তৈরি করে এবং নি:স্বরণ করে। এতে আশে-পাশের ফল পাকার সংকেত পায়। যেমন, আম গাছে একটা ফল পাকলে বাকিগুলোও পাকা শুরু করে। শুধু তাই নয়, তাপমাত্রা কিছুটা বাড়লে কলা তাড়াতাড়ি পেঁকে যায়। আবার কলার কোন আঘাত পেলে, ঐ জায়গা বাদামী হবে। কলা পাকা দেরি করাতে চাইলে, কলার বোঁটা পলিথিন দিয়ে ভাল করে মুড়ে রাখুন।
এবার আসি, কলাতে যদি এভাবে এইচ আই ভি সম্পন্ন রক্ত দেয়া হয় তাহলে কি হবে?
আগেই বলেছি এইচ আই ভি দেহের বাইরে অনেক দূর্বল ভাইরাস। এখন তাকে আপনি কলাতে দিচ্ছেন। প্রতিটি ফল ভিন্ন ভিন্ন অম্ল-ক্ষার অবস্হায় থাকে। যেমন তেঁতুল অনেক অম্ল। যেহেতু এইচ আই ভি দেহের বাইরে (রক্তে থাকলে বেশিক্ষণ বাঁচার সম্ভাবনা), তার উপর আপনি তাকে দিচ্ছেন ভিন্ন অম্ল-ক্ষার অবস্হায়, তাপমাত্রা ভিন্ন এবং কলা সংরক্ষণ করছেন (অন্তত এক দিন)। এইচ আই ভি ধ্বংস হয়ে যাবার কথা। সিরিঙের রক্তে অনেক সময়(সব সময় না) নির্দিষ্ট তাপমাত্রা এবং শুষ্ক না হলে, এইচ আই ভি অনেকক্ষণ বেঁচে থাকে, কিন্তু আপনি যদি এভাবে কলাতে দেন তাহলে বাঁচার সম্ভাবনা নাই।
ধরে নিলাম, বেঁচে গেল কোন ভাবে, আপনি যখন কলা খাবেন, কলা যাবে পেটে। আপনার পাকস্থলিতে অন্যতম শক্তিশালী এসিড/অম্ল হাইড্রোক্লোরিক এসিড নি:সরণ হয়। এটা এতটাই শক্তিশালী, কোনভাবে আপনার সম্পূর্ণ হাত যদি আপনি মুখের ভিতর দিয়ে পাকস্থলিতে প্রবেশ করিয়ে কয়েকমিনিট রাখেন, শুধু হাড় অবশিষ্ট থাকবে। সুতরাং ঐ কলাতে থাকা এইচ আই ভি পাকস্হলীতে ধ্বংস হবে। এই কারণে এইচ আই ভি খাবার বা পানির মাধ্যমে ছড়াতে পারে না।
এবার আসি সাধারণ জ্ঞান বা বুদ্ধি খাঁটানোতে, একজন এইচ আই ভি আক্রান্ত রোগীর কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তার রক্ত। কারণ, এইচ আই ভি তার রক্তের এক বিশেষ কোষ ধ্বংস করে ফেলছে। তাতে সে অন্য যে কোন সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা বেড়ে যাবে। আপনার কমন সেন্সে কি মনে হয়, একজন এইচ আই ভি রোগী বসে বসে লিটার লিটার রক্ত দিবে কলার মধ্যে পুষ করার জন্যে?
তাও ধরে নিলাম, এইচ আই ভি রোগীটি এটা করলো, কলা বিক্রেতার লাভ কি? বসে বসে কলাতে এইচ আই ভি রোগীর রক্ত পুষ করার চাইতে, ফরমালিন পুষ করা তার জন্যে লাভজনক। সে ভাল করেই জানে, যদি ক্রেতা দেখে কলার মধ্যে সমস্যা তার ব্যবসা লাটে উঠবে। আর ভাবুন, আপনার খেয়ে দেয়ে কাজ নাই, নিজের ব্যবসায় বাতি জ্বালানো ধান্ধা?
কাউকে ছোট করছিনা। আপনি বলবেন, ‘তো কি হয়েছে দিলাম না হয় একটা নিউজ শেয়ার। তাতে কি মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে গেছে।’ শুদ্ধ-অশুদ্ধের প্রশ্ন আসছে না। তবে যা হয়েছে আপনার মতো শিক্ষিত লোকের এই কান্ডজ্ঞানহীনতা একজন কমজানা লোককে পুরোপুরি ভূল পথে নিয়ে যাবে। এবং সেটার দায় আপনি এড়াতে পারবেন না।
ধন্যবাদ।
১. যদি ভাইরাস/রোগের কারণতত্ত্ব/জীব-বিজ্ঞান বিষয়ক কোন গুজব দেখলে, ইনবক্সে জানালে উপকৃত হবো। সময় ও সুযোগমত নোট লিখে গুজবের উত্তর দিতে পারবো আশা করি। (ফেসবুক আইডিতে)
২. কোন প্রশ্ন থাকলে ইনবক্সে জানাতে পারেন। (ফেসবুক আইডিতে)
৩. কোন ভুল তথ্য বা অসঙ্গতি দেখে থাকলে কমেন্টে জানানো অনুরোধ করছি। তাতে বাকিরাও উপকৃত হবে।
আক্রান্ত ব্যক্তির মুখের থুথু বা লালা কথা বলার সময়, অন্য কারো মুখে গেলে এইচ আই ভি হবে?
na.
আমি একজন মহিলাকে জড়িয়ে ধরেছিলাম এবং তার পিঠ, বুক এবং গলায় চুমু খেয়েছিলাম ডিপলি। তবে স্তনের বোটায় বা ঠোঁটে চুমু খায়নি। এখন ভয় করছে মহিলার কোন রোগ থাকলে কি আমারও হতে পারে? জানাবেন প্লিজ।
মহিলার কোন ছোঁয়াচে রোগ আছে কিনা জিজ্ঞাসা করুন। আপনার বর্ণনানুসারে কোন রোগ ছড়াবার কথা নয়।
আমাকে আসলে অযথা টেনসন হচ্ছে। আপনার সব গুলো পোষ্ট এবং কমেন্ট পড়ে অনেকটা কনফিডেন্স পেয়েছি। ধন্যবাদ আপনাকে।
যাইহোক, সেদিন আমার ঠোঁটে হালকা ঘা ছিল কিন্তু সেটা একদম শুকিয়ে গিয়েছিল। আমার ভয় হচ্ছে মহিলার গায়ে কোথাও যদি কাটা বা ঘা থাকে অফ আমার ঠোঁটে স্পর্শ হয়ে থাকে তবে কি আমার শরীরে hiv বা হেপাটাইটিস ছড়াতে পারে?
প্লিজ উত্তর দিয়ে আমার দুশ্চিন্তা দূর করবেন। আল্লাহ আপনাকে ভালো রাখুন।
ঠোঁটে হালকা ঘা ছিল। ঠিক ঘা নয়, শীতের দিনে যেটা ফাটে। ওই অবস্থায় একটা মেয়েকে চুমু খেয়েছিলাম। এবং গলাতে চাটাচাটি করে ছিলাম। লিপ কিস করিনি। এরকম অবস্থায় কোন ভাইরাস কি ঠোঁটের মাধ্যমে আমার শরীরে আস্তে পারে?
এইচআইভি এভাবে ছড়ায় না। আর কোন ভাইরাস ছড়ায় কিনা বলতে পারছি না; সম্ভাবনা কম। প্রতিটি মানুষের শরীরে প্রতিনিয়ত বহু ভাইরাস শরীরে প্রবেশ করে, আপনি যদি নি:শ্বাস নিন, কোন কিছু খান বা পান করেন, কোন কিছু স্পর্শ করেন আপনার শরীরের ভাইরাস আসতে পারে- যদিও অধিকাংশ রোগাকান্ত করতে পারে না। ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া আপনার শরীরে আছে, থাকবে- এটাতে ভয় পাবার কিছু নাই। তবে রোগাক্রান্তকারী ভাইরাস প্রবেশ করে আক্রান্ত করলে চিন্তার ব্যাপার।
২০১২ সালের হিসেবে কমপক্ষে ২০০ এর বেশি মানুষকে আক্রান্তকারী ভাইরাস রয়েছে। নতুন নতুন ভাইরাস প্রতিনিয়তই আবিষ্কার হচ্ছে। ভাইরাস সবচেয়ে বিবর্তিত (ইভলব্ড) এবং একই প্রজাতির (স্পিসিস) ভাইরাসের অনেকসময় ১০ বারোটা সাবটাইপ থাকে; সাথে সাথে মানুষকে আক্রান্ত করে ধাপে ধাপে নতুন ভাইরাস আবির্ভাব হতে পারে। অনেক ভাইরাস বিবর্তনের মাধ্যমে নতুন বৈশিষ্ট বা আক্রান্ত করার কৌশল বের করে। তাই নতুন কোন ভাইরাস এভাবে ছড়াতে পারে কিনা জানা নাই।