দ্বিতীয় আর তৃতীয় পর্বে অনেক কথা হয়েছে গ্যাসীয় সিস্টেমের মাইক্রোস্টেট ও মাল্টিপ্লিসিটি নিয়ে। এবার একটু কঠিন আর তরল নিয়ে আলোচনায় যাই?

আমরা দ্বিতীয় পর্বে উল্লেখ করেছিলাম, কোনো নির্দিষ্ট ম্যাক্রোস্টেটের অধীনে একটি সিস্টেমের অসংখ্য ও মানুষের কল্পনার অতীত মাইক্রোস্টেট পাওয়া সম্ভব। এটার উদাহরণ তাহলে কী হতে পারে? বেশি কিছু নয়, এক মোল পানি যদি আমরা শূন্য ডিগ্রি সেলসিয়াস আর স্বাভাবিক চাপে নিই তবে তার ভিন্ন ভিন্ন মাইক্রোস্টেট থাকতে পারে 101,991,000,000,000,000,000,000,000 টি!! (সংখ্যাটার বিশালতা বুঝা যাবে এই তথ্যে – মহাবিশ্বে মোট পরমাণুর সংখ্যাই গণনা করা হয়েছে 1078 ~ 1082 টি!)

তাহলে বল তো একই অবস্থায় এক মোল বরফের জন্য কয়টা মাইক্রোস্টেট পাওয়া যেতে পারে? হয়ত ভাবছ, সারাজীবন যেহেতু বরফকে আমরা সুশৃংখল অবস্থা বলে জেনে এসেছি তাহলে এর আবার একগাদা মাইক্রোস্টেট থাকতে যাবে কেন? এর মাল্টিপ্লিসিটি তো 1…কিন্তু উত্তরটা সম্পূর্ণ ভুল! এক মোল বরফেরও শূন্য ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় আর স্বাভাবিক চাপে 101,299,000,000,000,000,000,000,000 টা আলাদা আলাদা মাইক্রোস্টেট আছে!! তারমানে বরফ হোক আর পানিই হোক, বিশৃংখলার মাত্রা কিন্তু আকাশ পাতাল তফাৎ হচ্ছে না। যে বরফের সুন্দর ক্রিস্টালের সাপেক্ষে আমরা পানিকে তরল ও বিশৃংখল থাকার দোষ দিই, তার নিজের মাল্টিপ্লিসিটিও অকল্পনীয়। সুতরাং স্বাভাবিক তাপমাত্রায় একটা পদার্থকে সুশৃংখল ধরে তার সাথে অপর একটা পদার্থকে তুলনা করে তাকে বিশৃংখল বলে দেওয়া খুব কাজের কথা নয়। আদতে সকলেই কম বেশি বিশৃংখল।

একমাত্র যাকে সুশৃংখল বলা চলে, তা হল পরম শূন্য তাপমাত্রায় (0 K) তাপমাত্রায় থাকা কোনো বস্তু। ধরে নেওয়া হয়, এই তাপমাত্রায় সকল বস্তুর এনট্রপি থাকে শুন্য, মাইক্রোস্টেট হয় কেবল এবং কেবলমাত্র একটিই। তাপগতিবিদ্যার তৃতীয় সূত্র বলে যা আছে তা এই স্বীকার্য ছাড়া আর কিছুই নয়। 0 K এ বস্তুর এনট্রপি শূন্য ধরেই অন্যান্য তাপমাত্রায় এনট্রপি এর মান হিসাব করা হয়। কিন্তু পরম শূন্য তাপমাত্রায় যাওয়া আজও আমাদের পক্ষে সম্ভব হয় নি। মহাবিশ্বের গড় যে তাপমাত্রা, তাও 2.73 K, পরম শূন্যের কিছু উপরে।

মাল্টিপ্লিসিটির সাথে এই যে এনট্রপির এত সম্পর্ক, তা ব্যাখ্যার জন্য একটা সমীকরণ আছে বলেছিলাম। সমীকরণটা এত সুন্দর যে এ সংক্রান্ত আলোচনায় সেটার উল্লেখ না করা রীতিমত অপরাধ। সমীকরণটা হল : S = k lnW

এই সমীকরণের নাম প্ল্যাঙ্ক-বোল্টজম্যান এনট্রপি ফর্মুলা (Boltzmann Entropy Formula). সমীকরণে S মানে এনট্রপি বোঝা গেল, বাকীদের পরিচয় কী? এখানে k হল অণুপ্রতি গ্যাস ধ্রুবকের মান বা বোল্টজম্যান ধ্রুবক (1.38 x 10-23  J/K) এবং W হল যে অবস্থায় বা যে ম্যাক্রোস্টেটে আমরা এনট্রপি হিসাব করতে চাচ্ছি সেই অবস্থায় মাল্টিপ্লিসিটি এর মান। W এসেছে জার্মান শব্দ Wahrscheinlichkeit ( দাঁত ভাঙ্গার আগে এটা ট্রাই কর var-shine-leash-kite) এর প্রথম অক্ষর হিসেবে যার অর্থ সম্ভাব্যতা (Probability). এই সমীকরণ থেকে দুইটি ভিন্ন অবস্থায় এনট্রপির পার্থক্য বলে দেওয়া সম্ভব ঐ দুই অবস্থায় সিস্টেমের মাল্টিপ্লিসিটিগুলো জানলেই (ΔS = k ln WFinal / WInitial ). যেমন : পরম শূন্য তাপমাত্রায় এক মোল নাইট্রোজেন গ্যাসের মাল্টিপ্লিসিটি মাত্র 1 (WInitial = 1), ফলশ্রুতিতে এনট্রপির মানও শূন্য। সুতরাং, আমরা যদি নাইট্রোজেন গ্যাসের 0 K থেকে 273 K হওয়ার জন্য এনট্রপির পার্থক্য বের করতে পারি তবে সেটাই হবে 273 K এ এনট্রপির মান। এই তাপমাত্রায় মাল্টিপ্লিসিটির পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায়106,027,000,000,000,000,000,000,000   এ (এটাই WFinal)। তাহলে এনট্রপি ঝটপট এই W দের অনুপাতের সাথে k গুণ করে বের করে ফেলি? কিন্তু ক্যালকুলেটর দিয়ে এই হিসাব করতে গেলে যে Math Error দেখায়! বুঝতেই পারছ, যে সংখ্যা মানুষের চিন্তাজগতের বাইরে তা নিয়ে কাজ করতে তো বুদ্ধিহীন ক্যালকুলেটরেরও বেগ পাওয়া উচিত। যা হোক, সমীকরণে সব মান ঠিকঠাক বসালে উত্তর আসা উচিত 191.6 J/K. এটাকে নাইট্রোজেনের স্ট্যান্ডার্ড এনট্রপি বলে (Standard Entropy) যাকে S0 দ্বারা প্রকাশ করা হয়। কোনো পদার্থের এক মোলের জন্য 1 atm ও 273 K এ এনট্রপির মানই হল তার স্ট্যান্ডার্ড এনট্রপি।

এই সমীকরণ প্রতিপাদন করেছিলেন পদার্থবিজ্ঞানী ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক, ১৯০০ সালে। বিজ্ঞানী বোল্টজম্যান যদিও ডিজঅর্ডার আর এনট্রপির মাঝে সেতুবন্ধন স্থাপনে পথিকৃৎ ছিলেন, কিন্তু কোনো প্রমাণ নেই যে তিনি এই সম্পর্ক জানতেন বা কখনো এনট্রপি পরিমাপ করতে পেরেছিলেন। বোল্টজম্যানের মৃত্যু হয় ১৯০৬ সালে, ঐ বছরেই এই সমীকরণটি প্রথমবারের মত মুদ্রিত হয়। প্ল্যাঙ্ক বোল্টজম্যানের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতে তার সমীকরণে থাকা ধ্রুবককে (k) বোল্টজম্যান ধ্রুবক নামকরণ করেন যা আমরা আজও ব্যবহার করি। শুধু তাই নয়, বোল্টজম্যানের সমাধির প্রস্তরফলকে পর্যন্ত এই সমীকরণ খোদাই করে দেওয়া হয় এবং তা এখনো টিকে আছে। প্ল্যাঙ্কের এই উৎসর্গ সত্যিই তুলনাহীন, যে মনোভাব আজকের বিজ্ঞানীদের মাঝে খুঁজে পাওয়া প্রায় অসম্ভব।

বোল্টজম্যানের সমাধিসৌধ

বোল্টজম্যানের সমাধিসৌধ

মাল্টিপ্লিসিটির গল্প শেষ করে আবার ফিরে যাই শক্তির সাথে এনট্রপির সংযোগস্থলে। প্রথম পর্বে বলেছিলাম, শক্তির কাজই হল ছড়িয়ে পড়া ও শক্তির অপ্রাপ্যতা বাড়ানো। শক্তির এই আদানপ্রদানের কারণে এনট্রপি বাড়ে এটা তো পুরনো খবর। যে তাপশক্তি গ্রহন করল তার বিশৃংখলা তথা এনট্রপি বাড়ল – এটা না হয় ঠিক আছে, কিন্তু যে শক্তি হারাল তার তো এনট্রপি কমা উচিত। হ্যাঁ, তাপের যে উৎস তার এনট্রপি কমে ঠিকই, কিন্তু সিস্টেমে থাকা প্রত্যেকের (তাপের উৎস ও তাপের গ্রহীতা) এনট্রপির পরিবর্তনের যোগফল শেষমেশ একটা ধনাত্মক সংখ্যাই হয়। একটা বদ্ধ সিস্টেমে এই ঘটনা বেশ ভালভাবে প্রত্যক্ষ করা যায়। ধরা যাক 293 K তাপমাত্রার একটা বদ্ধ ঘরে 273 K এর এক টুকরা বরফ রাখা হয়েছে। টুকরাটি Q পরিমান তাপ শোষণ করে 273 K এর পানি হয়ে গেল। ঘরের বাতাস এখানে তাপ উৎস এবং তাপ যোগানোর পরও তার তাপমাত্রার পরিবর্তন নগণ্যই বলা চলে। ফলে ধ্রুব তাপমাত্রায় তাপ হারানোর কারণে কক্ষের বাতাসের এনট্রপির পরিবর্তন হল = তাপের পরিবর্তন/তাপমাত্রা = -Q/293. একইভাবে বরফের এনট্রপি পরিবর্তন হল = Q/273. এই দুই পরিবর্তনের সমষ্টি আমরা পাই = (-Q/293) + (Q/273)। বলে দিতে হবে না, Q/273 ভগ্নাংশটি Q/293 অপেক্ষা বড়। সুতরাং বড় থেকে ছোট জিনিসই এখানে বিয়োগ হচ্ছে। সুতরাং সিস্টেমের সার্বিক এনট্রপির পরিবর্তন ধনাত্মক না হয়ে যাবে কোথায়?

এই একই ঘটনা ঘটে রেফ্রিজারেটরে – যেখানে রেফ্রিজারেটরের প্রকোষ্ঠ তাপ হারায় এবং এনট্রপি কমে কিন্তু ফ্রিজের দেহের তাপ বেড়ে যায় ও তা পরিবেশে বিকিরিত হয়ে পরিবেশের এনট্রপি বাড়িয়ে দেয়। এই ঘটনা ঘটছে আমাদের মহাবিশ্বেও, এই বদ্ধ সিস্টেমে উচ্চ তাপমাত্রার বস্তুগুলো ক্রমশ শক্তি বিকিরণ করে যাচ্ছে ও এগিয়ে চলছে এক তাপীয় সাম্যাবস্থা প্রতিষ্ঠায়। এই তাপীয় সাম্যাবস্থা প্রতিষ্ঠিত হলে নক্ষত্রগুলো আমাদের শক্তি দেবে কীভাবে? আমরাই বা সূর্য ছাড়া কীভাবে টিকে থাকব? তাপের সকল সঞ্চালন বন্ধ হয়ে যাবার পর এই নিশ্চল, শক্তিহীন শক্তিতে পূর্ণ (কারণ জগতের মোট শক্তি তখনো একই থাকবে, কিন্তু কাজ করার সামর্থ্য আর থাকবে না কারোই) মহাবিশ্বের তাপীয় মৃত্যু (Thermal Death of Universe) ঘোষিত হবে তখন।

অর্থাৎ এ ব্যাপারে আমরা নিশ্চিত হতে পারলাম যে বদ্ধ সিস্টেমে সর্বদাই এনট্রপি বাড়ে। এনট্রপি কমার উদাহরণ তাহলে কি নেই? সেটাও আছে, কিন্তু তার উদাহরণ তুলনামূলক অনেক কম। ফ্রিজের উদাহরণ বা এককভাবে তাপ উৎসের কথাগুলোই যেমন বলছিলাম। তাছাড়া প্রাকৃতিকভাবেই আমরা অনেক পদার্থের ল্যাটিস তৈরি হতে দেখি (যেমন হীরক), এটা এনট্রপি হ্রাসের একটি উদাহরণ। অনেক রাসায়নিক বিক্রিয়া আছে যাতে এনট্রপি হ্রাস পায়, যেমন – নাইট্রোজেন ও হাইড্রোজেন গ্যাস থেকে অ্যামোনিয়া তৈরি (এখানে এনট্রপি কমে কারণ তিন অণু হাইড্রোজেন ও এক অণু নাইট্রোজেন থেকে মাত্র দুই অণু অ্যামোনিয়া তৈরি হয়, অণুর সংখ্যা কমে যায়। কম সংখ্যক অণু দিয়ে তৈরি সিস্টেমের মাইক্রোস্টেটের সংখ্যাও কম হয়)। প্রশ্ন হতে পারে, এনট্রপি যখন কমে যাচ্ছে তখন এরকম বিক্রিয়া স্বতঃস্ফূর্ত হচ্ছে কেন? বস্তুত, বিক্রিয়ার স্বতঃস্ফূর্ততা কেবল এনট্রপি নয়, নির্ভর করে মুক্ত শক্তি (Free energy) এর উপর। মুক্ত শক্তি ΔG হলে, ΔG=ΔH-TΔS লেখা যায় যেখানে ΔH = বিক্রিয়ায় এনথালপির পরিবর্তন ও T = বিক্রিয়া পাত্রের তাপমাত্রা। এই মুক্ত শক্তি ঋণাত্মক হলেই কেবল বিক্রিয়া স্বতঃস্ফূর্ত হয়। অ্যামোনিয়া উৎপাদনের বিক্রিয়ায় তাই TΔS রাশিটি ঋনাত্মক হলেও ΔH আরো বেশি ঋণাত্মক হয়। ফলে যোগ বিয়োগ করে ΔG ঋণাত্মকই আসে যা বিক্রিয়ার স্বতঃস্ফূর্ততা নির্দেশ করে।

আমাদের জীবনের সাধাসিধে ঘটনাগুলোতেও এনট্রপি যেন ধাপে ধাপে জড়িয়ে আছে। এনট্রপি আছে বলেই মোটর বাইকের কম্বাশন চেম্বারে দগ্ধ হওয়া গ্যাস পশ্চাদগামী হয়ে জ্বালানী তৈরি করে ফেলতে পারে না। মানুষের তৈরি সুউচ্চ স্থাপনা, ইমারত – এসবকিছুই শৃংখল থাকার একটা মিথ্যা চেষ্টা কারণ প্রকৃতি নিজেই বিশৃংখলাকে খুঁজে নেয়। ভয়াবহ কোনো ভূমিকম্পের পর তাই তো ইটের স্তূপে পরিণত হওয়াই হল দালানকোঠাগুলোর নিয়তি। টাকা যদিও প্রত্যক্ষভাবে শক্তি নয়, কিন্তু এর আচরণ শক্তির মতই। অর্থ উপার্জন করে নিজের কাছে পুঞ্জীভূত করার ব্যাপারটা হয়ত অর্থের নিজেরই পছন্দ নয়; তাই তো অর্থ কঠিন শ্রমলব্ধ, কিন্তু আয়েশ করলেই এর ব্যয়ের পথ স্বরচিত হয়। বিগ ব্যাং এর সাথে সাথেই শুরু মহাবিশ্বের সম্প্রসারণের, সেই সাথে শুরু হয়েছে সময়ও। বিজ্ঞানীরা মহাবিশ্বের বস্তুসমূহের সম্প্রসারণ বা ছড়িয়ে পড়া তথা বিশৃংখল হবার সাথে সময়ের যোগসূত্র খুঁজে পেয়েছেন। সময় একটা ছুটে চলা তীরের মত, এই তীর যেদিকে যাচ্ছে মহাবিশ্বের ছুটে চলাও হচ্ছে সেই পথেই। সময়ই আমাদের নিয়ে যাচ্ছে এনট্রপি সর্বোচ্চ হবার বিন্দুতে। এই বিপরীত স্রোতকে বাঁধা দিয়ে টাইম ট্রাভেল বা কাল পরিভ্রমণ করা প্রাকৃতিক নিয়মের কাছে নতজানু মানুষের এক অলীক কল্পনা ব্যতীত আর কী? (শেষ)

সহায়ক ওয়েবসাইট ও রিসোর্স লিঙ্ক :

www.eoht.info/m/page/S+=+k+ln+W

electron6.phys.utk.edu/101/CH8/entropy.htm

www.rationality.net/entropy.htm

https://www.chem.tamu.edu/class/majors/tutorialnotefiles/entropy.htm

http://chemwiki.ucdavis.edu/Physical_Chemistry/Thermodynamics/State_Functions/Entropy

http://hydrogen.physik.uni-wuppertal.de/hyperphysics/hyperphysics/hbase/therm/entrop2.html

এবং এমন আরো অনেক বই,  স্লাইড কিংবা নিদেনপক্ষে ছোট্ট একটি লাইন যা আমাকে এই পুরো সিরিজটি লিখতে সাহায্য করেছে। 🙂