প্রথম পর্বে উল্লেখ করেছিলাম, গ্যাসীয় সিস্টেমের ক্ষেত্রে এর এনট্রপি নির্ভরশীল সিস্টেমের তাপমাত্রা আর আয়তনের উপর। আয়তন বৃদ্ধি কীভাবে এনট্রপি বাড়ায় তার একটা উদাহরণ তাহলে দেখা দরকার। আরেকটা কথা – গত পর্বেই বলেছিলাম গ্যাসীয় সিস্টেমে অণুগুলোর অবস্থানের সাপেক্ষেও মাল্টিপ্লিসিটি পরিবর্তন হয়। আমরা খুব সরল একটা দৃষ্টান্তের মাধ্যমে আয়তন বৃদ্ধির কারণে কীভাবে অণুগুলোর অবস্থানবিন্যাস পরিবর্তন হয় ও ফলশ্রুতিতে  মাল্টিপ্লিসিটি বা এনট্রপি বাড়ে তা দেখে নেবার চেষ্টা করি।

V আয়তনের একটা গ্যাসজার নিই যার ভেতর দু’টি গ্যাস অণু আছে।enলক্ষ্য কর, এই গ্যাস অণুগুলো এই আবদ্ধ জ্যারের বাইরে কোথাও যাবে না। যদিও বা এরা বিভিন্নভাবে এর ভেতর অবস্থান করতে পারে কিন্তু পরিশেষে থাকবে এই V আয়তনের মধ্যেই। সহজীকরণের স্বার্থে আমাদের কাছে এদের এই আয়তনে থাকাটাই বিবেচ্য, এদের আপেক্ষিক অবস্থান নিয়ে মাথা ঘামাবো না আমরা (লাল চিহ্নিত অণু সবুজের উপর থাকলে একরকম বিন্যাস, সবুজ অণু লালের উপরে থাকলে আরেক বিন্যাস হবে – এরকম দাবী করা যাবে না)। তাহলে বলতে পারি, V আয়তনের ভেতর এরা কেবল একভাবেই থাকতে পারে।

এবার গ্যাসজারের আয়তন দ্বিগুণ করে ফেললাম চিত্রের মতen5এখন কোনো মুহূর্তে যদি কাউকে জিজ্ঞাস করা হয় এই বর্ধিত আয়তনের ভিতর গ্যাস অণুরা কীভাবে আছে, তাহলে কিন্তু সে আর নিশ্চিতভাবে বলে দিতে পারবে না যে গ্যাস অণুরা আগের V আয়তনেই আছে। বরং যেটা ঘটবে – নতুন যে V আয়তনের উদ্ভব ঘটেছে, তাতেও অণুগুলোর অবস্থান নেবার সম্ভাবনা তৈরি হবে। আগেই থাকা V আয়তন ও তার সাথে যুক্ত হওয়া নতুন V আয়তনের সাপেক্ষে আমরা এদের অবস্থান ব্যাখা করতে চারটি দৃশ্যের অবতারণা করতে পারি –

সম্ভাবনা ১ : অণু দু'টি গ্যাসজারের বাম অর্ধাংশে আছে সম্ভাবনা ২ : দু'টি অণুই ডান অর্ধাংশে অবস্থান নিয়েছে সম্ভাবনা ৩ : লাল চিহ্নিত অণু বাম অর্ধাংশে ও সবুজ চিহ্নিত অণু ডান অর্ধাংশে সম্ভাবনা ৪ : সম্ভাবনা ৩ এর বিপরীত বিন্যাস

সম্ভাবনা ১ : অণু দু’টি গ্যাসজারের বাম অর্ধাংশে (আদি অবস্থান) আছে
সম্ভাবনা ২ : দু’টি অণুই ডান অর্ধাংশে অবস্থান নিয়েছে
সম্ভাবনা ৩ : লাল চিহ্নিত অণু বাম অর্ধাংশে ও সবুজ চিহ্নিত অণু ডান অর্ধাংশে
সম্ভাবনা ৪ : সম্ভাবনা ৩ এর বিপরীত বিন্যাস

এটা এখন পানির মত পরিষ্কার – আয়তন বাড়ানোর ফলে আমরা অণুগুলোকে নানাভাবে অবস্থান নেওয়ার সুযোগ করে দিলাম। এতে অবধারিতভাবেই বেড়ে গেল অণুগুলোর চলাচল তথা বিশৃংখলা। এনট্রপিও যে তাতে বাড়ছে তা কি আর নতুন করে বলার আছে?

(সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ : V আয়তনে থাকলে মাইক্রোস্টেট একটা তথা মাল্টিপ্লিসিটি ১ এবং 2V আয়তনে মাইক্রোস্টেট চারটা বলে মাল্টিপ্লিসিটি ৪ – এমনটা ঘোষণা করার আগে ভেবে নাও কাজটা কি ঠিক হচ্ছে? আমরা কিন্তু এখানে কেবল অবস্থান ব্যাখ্যা করায় জোর দিতে চেয়েছি, আমরা জানিও না অণুগুলোর গতিশক্তি বা ভরবেগ আগে কেমন ছিল বা পরে কেমন হল। অথচ আগের পর্বেই জানা হয়ে গেছিল, মাল্টিপ্লিসিটি অবস্থান ও গতিশক্তি (আদতে ভরবেগ আমলে নেওয়া হয়) এর সংযোগে পাওয়া রাশি। তাই একদিক দেখেই মাল্টিপ্লিসিটি নিয়ে মন্তব্য করা কিন্তু মোটেও ঠিক হবে না ছোট্ট বন্ধুরা 😛 )

গ্যাস মিক্সিং এর একটা কথাও বলেছিলাম না? যে দু’টো পাত্রে আলাদা আলাদা থাকা গ্যাস অণুরা মিশ্রিত হলে এনট্রপি পরিবর্তন হতে পারে। এরও একটা উদাহরণ প্রত্যক্ষ করা যাক। এই দৃষ্টান্ত থেকে এক ঢিলে দুই পাখি মারা যাবে। মরতে যাওয়া পাখিদের পরিচয় জানার আগে পাখি মারার প্রসেস খেয়াল কর –

নিচের ছবিতে দেখা যাচ্ছে আলাদা দু’টো গ্যাস চেম্বার যার প্রতিটিতে একরকম ভরবেগের দশটি করে অণু লোড করা হচ্ছে এবং শর্ত হল দু’চেম্বারের গ্যাস অণুদের ভরবেগ সমান হবে না। (হঠাৎ ভরবেগ কেন এল তার কারণ এখানেই আগে কোথাও জেনে ফেলা উচিত। তবুও আবার বলছি – ভরবেগ আলাদা হলে গতিশক্তিও আলাদা হয়। আমাদের লক্ষ্য ভিন্ন ভিন্ন গতিশক্তির অণু নিয়ে পরীক্ষণটা করা। ভরবেগ বললে পরিষ্কার শোনায় কেন তা খেয়াল কর – যদি তুমি দুই চেম্বারে একই গ্যাসও রাখো, চেম্বার দু’টিতে আলাদা আলাদা তাপমাত্রা মেইনটেইন করলেই তুমি ভিন্ন ভিন্ন ভরবেগের অণু পেয়ে যাচ্ছ কারণ উচ্চ তাপমাত্রার চেম্বারের অণুদের গতিবেগ বেশি হবে। ফলে আলাদা হয়ে পড়ছে দুই চেম্বারের অণুগুলোর ভরবেগ, গতিশক্তি। আবার দুই চেম্বারে আলাদা দু’টি গ্যাস (বিক্রিয়াহীন) নাও, আরো ভাল! কারণ এবার তাপমাত্রা দু’জায়গায় দু’রকম করার দরকারও পড়বে না, অণুগুলোর ভর ও বেগ ভিন্ন থাকবে বলে ভরবেগ এমনিই আলাদা হয়ে যাবে। এক তাপমাত্রায় দু’ধরণের গ্যাসের অণুর বেগ কেন ভিন্ন হয় চিন্তা কর তো!)

গ্যাস চেম্বারের বাঁয়ের অংশে থাকা সবুজ চিহ্নিত অণুগুলোর ভরবেগ কম, ডানে থাকা লালরঙ্গা অণুদের ভরবেগ বেশি

গ্যাস চেম্বারের বাঁয়ের অংশে থাকা সবুজ চিহ্নিত অণুগুলোর ভরবেগ কম, ডানে থাকা লালরঙা অণুদের ভরবেগ বেশি

এমতাবস্থায় আমরা গ্যাস চেম্বারের মাঝে যে পৃথক করার জন্য দেয়াল নিয়েছিলাম তা নষ্ট করে ফেলব। কি বিতিকিচ্ছিরি অবস্থা হবে এখন তা সহজেই অনুমেয়। গ্যাসের অণুগুলো এদিক ওদিক ছোটাছুটি করে মিশ্রিত হবে ও একে অপরের সাথে অনবরত ধাক্কা খেয়ে ভরবেগ মাঝামাঝি একটা মানে ব্যালেন্স করে ফেলবে খুব দ্রুতই।en4

এবার এই উদাহরণ থেকে আমরা কী শিখলাম তার উপর আলোকপাত করি (যে দুইটা লক্ষ্য টার্গেট করেছিলাম তাদের কথা বলা শুরু করছি)। প্রথমত এখানে যে শক্তির বিনিময় ঘটল তা আর না বললেও চলছে। উচ্চ ভরবেগ ও কম ভরবেগের অণুর মিশে গড় একটা ভরবেগ অর্জন কি তাই ইঙ্গিত করে না? এই ঘটনা যেন আমাদের আবার লেকের দুই উচ্চতার পানির মিশ খেয়ে যাওয়া মনে করিয়ে দেয়। পুরনো স্মৃতি বুঝি বারবার এভাবেই ফিরে আসে আমাদের জীবনে 🙁

দ্বিতীয় কথা, এখানে বিশৃংখলার পরিমাণও বাড়ল। কীভাবে? প্রথম অবস্থায় বাঁ দিকে কেবল এক ধরণের ভরবেগের অণুই ছিল, ডানদিকেও ছিল একইরকম অবস্থা। চেম্বারের ডিভাইডার ছিদ্র করে ফেললেও কোনো সমস্যা ছিল না যদি এরকম একজাতীয় ভরবেগের অণুরা তাদের পাশ মেইনটেইন করে সুন্দর সজ্জায় থাকত। কিন্তু এই সুশৃংখলা তো তাদের পছন্দ হলই না, উল্টো অধিক ভরবেগের অণুরা কম ভরবেগের অণুদের মধ্যে শক্তি সঞ্চালন করা শুরু করল। হ্যাঁ, সিস্টেমের মোট শক্তি এতে বাড়ে নি, কিন্তু  শক্তির এই বন্টনে সবুজ অণুরা উচ্চ ভরবেগে ছোটার লাইসেন্স লাভ করল, লালরঙাদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাপিয়ে বেড়ানো শুরু করল পুরো আয়তনজুড়ে। তাই বাড়ল পুরো সিস্টেম জুড়ে অস্থিতিশীলতাও। (কথাটা এখনো হজম করতে কষ্ট হলে একটা সমাবেশের কথা ভাবতে থাকো যার মঞ্চে উপবিষ্ট আছে হাই প্রোফাইলের লোকজন ও নিচে বসা সাধারণ মানুষ। সভার আনুষ্ঠানিকতা চলছে এবং এটাই তাদেরকে নিজ নিজ অবস্থানে ধরে রাখছে, কেউ গন্ডগোল করছে না। অনেকক্ষণ এসবের পর ক্ষুধা পেয়ে গেল সবার, লাঞ্চের প্যাকেটসমূহও এনে রাখা হল মঞ্চের নিচের খালি স্থানে। লাঞ্চ ব্রেক দিলে আর কে থাকে কার জায়গায়? ক্ষুধার চোটে সবাই হামলে পড়বে খাবারের উপর, মিশে যাবে সকল গণ্যমান্য ও সাধারণ লোকজন – তাই নয় কি? 😛 ) (চলবে)

এনট্রপি ও শক্তিহীন শক্তির গল্প ৪