“ধ্রুবক নিয়ে বকবক” এর একমাত্র এবং অদ্বিতীয় পর্বে সবাইকে স্বাগতম 😀 এই লেখায় আমাদের চেষ্টা থাকবে বহুল ব্যবহৃত এবং বহুল প্রচলিত ধ্রুবক জিনিসটাকে ভালভাবে চেনা এবং তার নানা নতুন দিক আবিষ্কার। ধ্রুবকের ব্যবহার নিয়ে যাদের মনে ধোঁয়াশা আছে তারাও পরিত্রাণ পেতে পারো নিজেদের কনফিউশন থেকে। শুরু করে দিচ্ছি তবে। 😀

ধ্রুবক এবং চলকের পরিচয় যারা ভালভাবে জানে তাদের এই প্রথম অংশ না পড়লেও চলবে।

ধ্রুবক (Constant)

সহজ করে বললে, ধ্রুবক বা constant হচ্ছে একরকম পরিমাপযোগ্য রাশি যার মান পরিবর্তনশীল নয়। আমরা যেসকল সংখ্যা নিয়ে কাজ করি : 1, 2, 3, 4, ……, 100, ……, 500, ………, 1000000, ……. এরা সবাই একেকটা ধ্রুবক কারণ এদের মানের কোনো পরিবর্তন ঘটে না। তোমার মন খারাপ করা বন্ধু সকালবেলা তোমাকে এসে “এক শালিক দেখেছি” বললে তুমি ঠিক ১টা শালিকই কল্পনা করে নেবে, ৫টা কিংবা ১০টা নয়। এই সংখ্যাগুলো এককবিহীন, একক আছে এমন ধ্রুবক খুঁজে পাওয়াও খুব কঠিন কিছু নয়। এই যেমন ধর 0° সেলসিয়াসে বাতাসে শব্দের বেগ 332 m/s বললে তুমি এই নির্দিষ্ট গতিতেই শব্দকে চলতে কল্পনা করবে। অভিকর্ষজ ত্বরণ g এর মান 9.8 m/s2 বললে বুঝতে হবে অভিকর্ষের কারণে পড়ন্ত বস্তুর প্রতি সেকেন্ডে বেগ বাড়ার পরিমাণ ঠিক 9.8 m/s করে – এখানে নড়চড় হবার সুযোগ নেই।

চলক (Variable)

আলো চিনলে যেমন অন্ধকারকেও চিনতে হয় ঠিক তেমনিভাবে ধ্রুবককে চিনলে চলক বা variable সম্পর্কে না জানা অপরাধ। ধ্রুবকের মত চলকও হল পরিমাপযোগ্য রাশি কিন্তু দুঃখের ব্যাপার হল চলকদের কোনো সুনির্দিষ্ট মান নেই। এরা অনেকটা সন্ন্যাসীদের মত, যখন যেখানে যা পায় সেটাই দু’হাত ভরে গ্রহণ করে। এই যেমন ধর, কোনো ক্লাসে প্রতিদিন উপস্থিতির সংখ্যাটা একটা ভবঘুরে সংখ্যা। ক্লাসের সবাই একসাথে যুক্তি করে না আসলে সংখ্যাটা 0 হতে পারে, পরীক্ষার দিন আসলে আবার দেখা যাবে ক্লাসের সবাই উপস্থিত।ঐ ক্লাসের মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা কিন্তু একটা ধ্রুবকই হবে, কিন্তু দৈনিক উপস্থিতি দিনভেদে পরিবর্তীত হবে। এই “উপস্থিতি” রাশিটাকে তাই আমরা চলক নাম দিতে পারি (থেমে না থেকে চলতে থাকে বলে চলক, vary করে বলেই variable 😀 )।

পাটীগণিত থেকে বীজগণিতে স্থানান্তরিত হলে একটা ব্যাপার খুব চোখে বাধে। সেটা হল – পাটিগণিতে যেখানে কেবলই সংখ্যার খেলা বীজগণিত সেখানে সংখ্যা তো বটেই, প্রতীক (symbol) নিয়েও কারিকুরি করে। a, b, c, d, ……., x, y, z ছাড়াও গ্রিক কিংবা ল্যাটিন কত অক্ষরের সমাহার এখানে। বীজগণিতের এই ভোল পাল্টানোর কারণটা মূলত চলক আর ধ্রুবককে কেন্দ্র করেই। আগেই বলেছি, পাটিগণিতে নিরীহদর্শন সব সংখ্যা নিয়ে কাজ করা হয়, এবং সকল সংখ্যারই মান নির্দিষ্ট বলে তারা ধ্রুবক। বীজগণিত বুদ্ধি করল, সে পাটিগণিতের মত রেখে দেবে সব সংখ্যা, তাই 1, 2, 3, 4, … সবই থাকল এখানে। সে আরো বলে দিল আমি x, y, z ইত্যাদির ব্যবহার করব চলক রাখার জন্য এবং a, b, c, d দের অন্যান্য ধ্রুবক রাখার জন্য।

এতেই বাঁধল যত গোল। কি ঝামেলা রে বাবা! অক্ষর দিয়ে চলক আর ধ্রুবক বোঝায় কী করে? একটা উদাহরণ দিয়ে পরিষ্কার হওয়া যাক।

ধরা যাক, তুমি কিছু ইউএস ডলার (USD) বাংলাদেশী টাকায় রূপান্তর করতে চাও, রূপান্তরটা আমি করে দেব। আমি জানি না তুমি কত ডলার আনবে, ধরে নিলাম তুমি আমাকে যে ডলার দেবে তার পরিমাণ x। যেহেতু সঠিক এমাউন্ট জানি না তাই সংখ্যার বদলে একটা প্রতীক দিয়ে এটাকে প্রকাশ করে দিলাম। তুমি আজ যত ডলার আনছ কাল তত ডলার নাও আনতে পারো। সুতরাং x এর মান একেকদিন একেকটা হবে সেটাই স্বাভাবিক। দিনে দিনে বদলে যেতে পারে বলে x তাই আমাদের চলক। ধরে নাও, আমি সবসময়ই তোমাকে এক ডলারের জন্য 80 টাকা করে দেব। তাহলে তুমি x পরিমাণ USD এর জন্য পাবে 80x বাংলাদেশী টাকা। খেয়াল কর, ভিন্ন ভিন্ন x দিলে আমি কিন্তু তোমাকে প্রতিবার ভিন্ন এমাউন্টের বাংলাদেশী টাকা দেব, সুতরাং এই এমাউন্টটাও একটা চলক হয়ে যায় বৈ কি! এই চলকের জন্য প্রতীক ঠিক করলাম y। তাহলে y এর মান হবে সবসময় x এর 80 গুণ। y আর x মধ্যে তাহলে এমন একটা সম্পর্ক তৈরি করে ফেললে কেমন হয়?

y = 80x

আমরা আসলে এই সমীকরণটা লেখার সাথে সাথে ডলারকে বাংলাদেশী টাকায় রূপান্তর করার একটা ম্যাশিন পেয়ে গেছি। ডানপক্ষে আমাদের খুশিমত x দিলেই বামপক্ষের y আমাদের বলে দেবে কত y পাব। x, y হাবিজাবি হতে থাকলেও এখানে 80 কিন্তু একদম ফিক্সড।এজন্যই x, y হল চলক আর 80 হল ধ্রুবক। দুই চলকের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপনকারী এই ম্যাশিনটাকে গণিতের ভাষায় কঠিন করে আমরা ফাংশনও ডেকে ফেলতে পারি। একইসাথে আমরা দৈনন্দিন জীবনের সমস্যাভিত্তিক একটা বীজগাণিতিক সমীকরণও প্রতিষ্ঠা করতে পারলাম এখানে (তোমরা যারা বল এসব বীজগণিত পড়ে কী হবে?!)।

ইচ্ছামূলক ধ্রুবক (Arbitary constant)

একটা কথা ভাবো, যদি আমি ম্যাশিনটাকে কেবল USD টু বাংলাদেশী টাকা কনভার্সনের জন্য ব্যবহার না করে যেকোনো বৈদেশিক মুদ্রা থেকে টাকা কনভার্সনের জন্য ব্যবহার করতে চাই তবে ঐ সমীকরণে আর 80 ব্যবহার করা যাবে না। 80 না থাকলে তাবে থাকবেটা কী? নতুন একটা চেহারা দিই সমীকরণের।

y = ax

আবার একটা a! একটা অক্ষর! আরেকটা চলক??????

উঁহু! এখানে a কে ঠিক চলক বলা যাচ্ছে না। a এখনও একটা ধ্রুবক। দেখ সংখ্যা দিয়েও আমি ধ্রুবককে প্রকাশ করতে পারছি। এই রকম ধ্রুবকদের বলে ইছামূলক ধ্রুবক বা arbitary constant। মানে হল, তোমার যেমন ইচ্ছা তুমি এই ধ্রুবকের মান নির্ধারণ করতে পারবে। USD থেকে টাকায় রূপান্তরের জন্য a কে 80 হিসাবে সেট করে ম্যাশিন চালাবে, সৌদি রিয়াল থেকে কনভার্ট করতে হলে a কে 20 ধরে নেবে অথবা অস্ট্রেলিয়ান ডলার থেকে টাকা হিসাব করতে a কে 60 বানিয়ে নেবে। কিন্তু একটা নির্দিষ্ট কনভার্সনের জন্য a এর মান থাকবে নির্দিষ্ট। সুতরাং a চলক হয়ে যায় নি, সে ধ্রুবকই।

সমানুপাতিক ধ্রুবক (Proportionality constant)

ধ্রুবক চলকদের সাথে পরিচিত হবার পর আলোচনাটা এবার একটু এগিয়ে নিতে চাই। এখন একটা ভিন্ন উদাহরণ টানব আমি – দোকান থেকে কেনা কলমের সংখ্যা, আর তাদের মোট দাম নিয়ে।

খুব কঠিন একটা কথা বলব এখন, সেটা শোনার জন্য প্রস্তুত হও।

কথাটা হল : কলমের মোট দাম কয়টা কলম কেনা হল সেই  সংখ্যার উপর নির্ভরশীল। বেশি কলম কিনলে দাম দিতে হবে বেশি, কম কলম কিনলে দাম হবে কম। কী? কঠিন না?

কলম প্রতি পিস 6 টাকা করে। তুমি কিনলে 5 টা, দাম দিলে 30 টাকা। তোমার পাশেই আরেকজন 8 টা কলম কিনে দিল 48 টাকা, খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার।

তুমি যদি কলমের মোট দাম y ধর আর x সংখ্যক কলম কেনো তাহলে এই বাড়লে বাড়ে, কমলে কমে সম্পর্কটাকে এভাবে লেখা যায়,

y ∝ x

∝ কে বলে সমানুপাতিক চিহ্ন (proportionality symbol) এবং সম্পর্কটাকে পড়তে হয় y, x এর সমানুপাতিক (y is proportional to x)। সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ : সমানুপাতিক চিহ্ন ∝, α বা আলফা এবং ∞ বা অসীম চিহ্ন এরা প্রত্যেকে কিন্তু আলাদা!

যাই হোক, এই সম্পর্ক থেকে তুমি কেবল এটাই বুঝাতে পারছ যে x বাড়লে y বাড়বে, x কমলে y কমবে। কিন্তু তুমি কলমের সংখ্যা থেকে কলমের মোট দাম বের করতে পারে এমন কোনো সমীকরণ বানাতে পারো নি। এটা করতে হলে আমাদের “∝” চিহ্নকে “=” চিহ্ন দিয়ে প্রতিস্থাপন করতে হবে। তাই নয় কি?

কিন্তু তুমি শুধু  y = x লিখে বসতে পারবে না। কারণ কলমের দাম মোট কলমের সমান নয়, হলে কি 5 টা কলম কিনতে 30 টাকা লাগত? বুঝতেই পারছ = চিহ্ন বসালে এখানে x কে প্রতি পিস কলমের দাম দিয়ে গুন করতে হবে। সম্পর্কটা তখন দাঁড়াবে :

y = 6x

এই যে পিসপ্রতি কলমের ধ্রুব দামটাকে সমানুপাতিক সম্পর্কে আনতে হল, এটাকেই বলে সমানুপাতিক ধ্রুবক (proportionality constant)।

আমাদের পাগলাটে ফিজিক্স বইগুলোতে ঠিক এই কাজটাই করে। পার্থক্য শুধু তারা যেভাবে করে সেটা আমাদের বুকে কাঁপুনি ধরিয়ে দেয় (এতটুকু না করতে পারলে ফিজিক্স বই আর ফিজিক্স বই হতে যাবে কেন? 😛 )। তারা হলে খুব একটা ঢং করে কলমের দাম y আর কলমের সংখ্যা x এর মাঝে এমন সম্পর্ক লিখত প্রথমে,

y = kx, যেখানে k একটি সমানুপাতিক ধ্রুবক (সাইডনোটে ইহা থাকা বাঞ্ছনীয় 😛 )

∴ k = y/x

তারপর?

x = 1টি কলম, y = 1টি কলমের দাম = 6 টাকা বসিয়ে পাই,

k = 6 টাকা/1টি কলম

যেই লাউ সেই কদু, এত স্টাইল করে যে সমানুপাতিক ধ্রুবক k নির্ণয় করলাম সেটা তো ঐ একটা কলমের দামই। যেহেতু,

y = kx

 ⇒ y = (6 টাকা / পিস) x

F = GMm/d2 থেকে G এর মান বের করার যে অভিনব কায়দা আসলে পড়ি আমরা তা ঠিক এই একই জিনিস। একবার G এর মান জানলে ইচ্ছামত M, m বা d বসিয়ে F পাওয়া যাবে ঠিক যেমন k এর মান জানার পর আমরা এখন ইচ্ছামত কলম নিয়ে তার দাম বলে দিতে পারব। 😉

“y = 6x” লেখা আর “y = (6 টাকা / পিস) x” লেখার মধ্যে পার্থক্যটা ধরতেই পারছ। প্রথমটায় সমানুপাতিক ধ্রুবকের একক নেই, দ্বিতীয়টায় আছে। দ্বিতীয়টাই আসলে সঠিক প্রকাশ। এর কারণ হল তুমি x বলে যা দেখছ তা কিন্তু সিম্পলি কোনো সংখ্যা রিপ্রেজেন্ট করে না। সেটা কেবলই একটা অক্ষর যা কলমের পরিমাণবিষয়ক তথ্য বহন করে। x = 5 পিস, 8 পিস এমন হয়। সুতরাং, x এর মধ্যেই আছে সংখ্যা (5, 8) এবং একক “পিস” কথাটা। তুমি যদি সমীকরণে x = 10 পিস বসাও তবে এমনটা পাবে,

y = (6 টাকা / পিস) * (10 পিস)

⇒ y = 60 টাকা

দেখ, y এর মানে অটোমেটিক দামসূচক সংখ্যা 60 তো বটেই, একক টাকাও চলে এসেছে। সমীকরণে এককসহ রাশিগুলোকে লিখে সমস্যা সমাধান করা একটা সুকুমার চর্চা। এটা এখানে করেছি বলেই y = 60 আসবে না আর তোমাকে পিছন ফিরে দেখতেও হবে না দামের হিসাব টাকায় ছিল না ডলারে। একই গল্প কিন্তু ঐ USD টু টাকা কনভার্সনের ব্যাপারটাতেও প্রযোজ্য। এখন থেকে কোনো গাণিতিক সমস্যা সমাধানে তাই “ধরি, দূরত্ব =d মিটার” কিংবা “ঘনমাত্রা = C mol/L” লিখার অভ্যাস বন্ধ করবে। দূরত্ব = d, ঘনমাত্রা = C ধরে মূল সমীকরণে অন্যান্য রাশির মান এককসহ বসালেই পেয়ে যাবে d অথবা C এর এককসহ প্রকৃত মান।

আজ এটুকুই। তোমাদের জন্য অনেক অনেক শুভকামনা 😀