কোনো একটা বস্তুর গতি নিয়ে আলোচনা আমাদের শুরু হয় এসএসসির সময় থেকে। পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের বিশাল একটা অংশ জুড়ে থাকে আমাদের এই গতি বিষয়ক আলোচনা। এখন কেউ হয়তো প্রশ্ন করতে পারো, গতি জিনিসটা এতোটা গুরুত্বপূর্ন ক্যানো। সেটা নিয়ে অন্য কোনোদিন আলোচনা করা যাবে। তবে আজকে আমাদের কথা বলার বিষয় গতি বিষয়ক আলোচনার একটা গুরুত্বপূর্ণ সূত্র “Newton’s Third Law”!

এইমাত্র সবাই লাফিয়ে উঠছো যে, এই সূত্র তোমরা সবাই কম-বেশি জানো। মুখস্থ করে তোতাপাখির মতো বলে দিতে পারবে, “প্রত্যেক ক্রিয়ার একটি সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে”! কিন্তু এতেই কি সূত্রটাকে জানা হয়ে গেলো? মোটেও না, বরং কোনো একটা সূত্রকে জানা মানে এই না যে তুমি তার বিবৃতিটা গড়গড় করে বলে দিলে। সূত্র নিয়ে তখনই তুমি নিজের দক্ষতা প্রমাণিত করবে যখন তুমি তোমার আশপাশকে সূত্র দিয়ে ব্যাখ্যা করতে শিখবে এবং গাণিতিক সমস্যাবলির উপর দক্ষতা অর্জন করবে।

তো যাই হোক, আমাদের আজকের আলোচনা শুরু করার আগে তোমাদের বিজ্ঞানী স্যার আইজাক নিউটনের গতির দ্বিতীয় এবং তৃতীয় সূত্রের বিবৃতিটা একটু লিখে দিই।

দ্বিতীয় সুত্রঃ কোনো বস্তুর ভরবেগের পরিবর্তনের হার এর উপর প্রযুক্ত বলের সমানুপাতিক এবং বস্তুর ভরবেগের পরিবর্তন বল যেদিকে ক্রিয়া করে সেদিকে পরিবর্তিত হয়।

তৃতীয় সূত্রঃ প্রত্যেক ক্রিয়ার একটি সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে। (খুবই বস্তাপচা বিবৃতি যদিও! :P)

এখন চলে আসি এই তৃতীয় সূত্র সম্পর্কিত কোন উদাহরণটি নিয়ে আমাদের মধ্যে সন্দেহ দানা বাঁধে এবং প্রত্যেক লেখকের বইয়ে ধরে নেয়া হয় এই জিনিসটা আমরা পারি তাই আর এর পরিপূর্ণ ব্যাখা দেয়া হয় না। ফলে আমাদের মধ্যে নানা ধরণের Misconception তৈরি হয়। আর সেই কালজয়ী 😛 উদাহরণটা হলো টেবিলের উপর বস্তুর স্থির থাকা বিষয়ক উদাহরণ! তো চলো দেখে নেয়া যাক, কোন জিনিসটা নিয়ে আমরা Deal করছি।

ধরো, তোমার টেবিলে একটা বই রাখা আছে। কাজেই বই টেবিলের উপর আছে এবং টেবিলের উপর mg পরিমাণ একটা বল প্রয়োগ করছে!(যদি ধরে নিই, বইয়ের ওজন m. আর পৃথিবী তাকে টানছে g ত্বরণে। আশা করি, খুবই বেসিক এই জিনিসগুলো তুমি বোঝো!). অর্থাৎ বই টেবিলকে বল প্রয়োগ করছে mg পরিমাণ। এখন নিউটনের তৃতীয় সূত্র মতে টেবিলও একটা প্রতিক্রিয়া দিবে। আর সেটা কতো নিশ্চয় বুঝতে পারছো। সেটা হলো mg পরিমাণ। আর বলা হয়ে থাকে এতেই বস্তুটা স্থির থাকে। এখন এ পরিস্থিতিতে একটা Conceptual সমস্যা arise করে। কারণ এ কথা পরিষ্কার করে জেনে রাখো, যে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া কখনো একই বস্তুর উপর ক্রিয়া করে না! তাহলে সমস্যাটা কোথায় হয় দেখো।

১। বই টেবিলকে বল দিলো mg পরিমাণ।
২। যেহেতু বই টেবিলকে mg বল দিলো, টেবিলও বইকে কতো দিবে? অবশ্যই mg.

1

এখন তোমাদের অনেকেই বলবে। হয়েই তো গেলো। যেহেতু সমান পরিমাণ বল কাজেই mg, mg কাটাকাটি- বস্তু স্থির। কিন্তু তুমি দেখো, নিউটনের তৃতীয় সূত্র মতে, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া একই বস্তুর উপর ক্রিয়া করে না। কাজেই দুইটা mg একই বস্তুর উপর ক্রিয়া করবে না। আর যদি দুইটা বল একই বস্তুর উপর ক্রিয়াই না করে তাহলে একজন আরেকজনকে কাটাকাটি করে দেয় কিভাবে? এখন কি বুঝতে পারছো সমস্যাটা কোথায়? নিচের ছবিটা দেখোঃ

2

এখন তোমাকে জানিয়ে দিই, তুমি যখন কোনো একটা বস্তুর অবস্থা হিসেব করবে তখন খালি ওই বস্তুকেই কনসিডারেশনে আনবে; দেখবে শুধু ঐ বস্তুটির উপরেই কি কি বল কাজ করছে। চিত্র ২ খেয়াল করে দেখো, বইয়ের উপর আপাতদৃষ্টিতে শুধুমাত্র একটি বলই ক্রিয়াশীল আর তা হলো টেবিলের প্রতিক্রিয়া বল mg! এখন তোমার কমন সেন্স কি বলে? একটা বস্তুর উপর শুধুমাত্র(আপাতদৃষ্টিতে) একটি বল উপরের দিকে ক্রিয়াশীল, তাহলে খুব সোজা কথায়, বস্তুটা উপরের দিকে উঠে যাওয়ার কথা না? দ্বিতীয় সূত্রটা কিন্তু তা-ই বলে। কিন্তু তুমি তো দেখছো, বস্তু স্থির। এরপরই নানা উল্টোপাল্টা explanation দেয়াটা শুরু হয়। কিন্তু আমরা এসব উলটাপালটা ব্যাখ্যা দিবো না। Methodically Approach করবো।
প্রথমেই খেয়াল করো, বস্তু স্থির। আর উপরের দিকে একটা প্রতিক্রিয়া বল। কাজেই স্থির থাকতে হলে নিচের দিকে আরেকটা বল ক্রিয়া করতেই হবে। কিন্তু সেই নিচের দিকে আরেকটা বল কোথায়? তুমি হয়তো বলবে, “ক্যানো, ভাইয়া, ক্রিয়া বল নিচে কাজ করবে”? কিন্তু সাবধান! ক্রিয়া বলটা কিন্তু অনুভব করছে টেবিল। আর আমরা চিন্তা করছি বই নিয়ে! কাজেই টেবিলের উপর কি কি বল কাজ করবে তা নিয়ে আমাদের মাথা-ব্যথা নাই! আমাদের মাথা-ব্যথা বইয়ের উপর প্রযুক্ত বল নিয়ে। তাহলে উপায়?

উপায় খুঁজে পেতে হাহাকার করতে হবে না! এখন দেখো, বস্তুর ওজন mg সবসময়ই কাজ করছে। কে টান দিচ্ছে? আরে, পৃথিবী ছাড়া আর কে? কাজেই তুমি নিচের দিকে একটা Force পেয়ে যাচ্ছো। এখন তুমি উপরের প্রতিক্রিয়া mg বল পাচ্ছো আর আর নিচে তার ওজনের জন্য সৃষ্ট mg. একই বস্তুর উপর উপরে নিচে দুইটা বল। কাজেই এখন তুমি বলতে পারবে কাটাকাটি করে দুইটা বল Neutral হয়ে গেলো। আর বস্তুটাকে আমরা এখন স্থির বলতে পারবো! নিচের ছবিটা দেখে নাও।

এইবার কিন্তু বস্তু ভারসাম্যে কারণ প্রতিক্রিয়া উপরে কাজ করছে। আর, একই বস্তুর উপর আমি আবারো বলছি, একই বস্তুর উপর নিচে ক্রিয়া নয় বরং ওজন mg কাজ করছে!

এইবার কিন্তু বস্তু ভারসাম্যে কারণ প্রতিক্রিয়া উপরে কাজ করছে। আর, একই বস্তুর উপর আমি আবারো বলছি, একই বস্তুর উপর নিচে ক্রিয়া নয় বরং ওজন mg কাজ করছে!

কাজেই আমরা কয়েকটা জিনিস শিখলামঃ

১. ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া কখনোই একই বস্তুর উপর কাজ করে না।

২. কোনো একটা বস্তু স্থির না গতিশীল তা বিবেচনা করতে গেলে ওই বস্তুর উপর ক্রিয়াশীল বলগুলোকে Analysis করতে হবে। আর কিছু নিয়ে মাথা-ব্যথা না করলেও চলবে! একে আমরা Force Analysis বলি। এই ফাঁকে বলে রাখি, এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ জিনিস। যখনই এরকম কোনো সমস্যায় পড়বে তখনই ওই বস্তুর উপর ক্রিয়াশীল Force গুলো Analyze করে নিবে!

৩. এখন থেকে আমরা তৃতীয় সূত্রকে এভাবে বলবো, “যখন একটি বস্তু অন্য একটি বস্তুর উপর বল প্রয়োগ করে তখন সেই বস্তুটিও প্রথম বস্তুটির উপর বিপরীত দিকে সমান বল প্রয়োগ করে!”
-পদার্থবিজ্ঞানের প্রথম পাঠ(মুহম্মদ জাফর ইকবাল)

তৃতীয় সূত্র নিয়ে স্বশিক্ষায় আছে অসাধারণ এক লেখা!দেখে নিতে পারো

কৃতজ্ঞতাঃ
১. পদার্থবিজ্ঞানের প্রথম পাঠ(মুহম্মদ জাফর ইকবাল)
২. জুলফিকার সবুজ ভাইয়া
৩. বন্ধুবর সার্জিল আরাফাত চৌধুরী(ছবিগুলো তারই আঁকা)