সেকালের কবিরা ছন্দে ছন্দে রাধা কৃষ্ণের কাহিনী বলতেন। ভাষার সৌন্দর্য নিয়ে তারা মাথা ঘামাতেন না। কিন্তু বিদ্যাপতি যে তাদের চে’ আলাদা। কেবল ছন্দে ছন্দে রাধা কৃষ্ণের গল্প বেঁধেই  ক্ষান্ত হলেননা। মানুষের অদৃশ্য সব অনুভুতিকে তিনি দৃশ্যমান করলেন রুপকের সাহায্যে। ভাবকে দিলেন মাধুর্য, রুপক উপমা দিয়ে ভাষাকে সাজিয়ে দিলেন এক অপরুপ রুপে। আর কাব্যের সে রুপসুধা পান করতেই বাংলার পিপাসু ছেলেরা ছুটে যেত সুদূর মিথিলায়, বুক ভরে  বাংলায় নিয়ে আসত জাদু মাখা অপূর্ব সব পঙক্তি। এভাবেই, বাংলায় না লিখেও বাংলার কবি হয়ে গেলেন বিদ্যাপতি।
কবি লিখতেন ব্রজবুলি নামের এক মধুর ভাষায়। কঠিন শব্দগুলো  সে ভাষায় বদলে গিয়ে লাভ করে সহজ, সুন্দর রূপ। বাংলা, হিন্দি আর প্রাকৃত ভাষার সহজ সহজ শব্দে ভরপুর  ভাষা ব্রজবুলি। সে ভাষায় বিদ্যুৎ হয়েছে বিজুরি, রেখা হয়েছে রেহা, বেলা হয়েছে বেলি। বিদ্যাপতি বিদায় নেয়ার অনেক বছর পর, তার ব্রজবুলি ভাষায় ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলি লিখলেন আমাদের রবিঠাকুর, বাংলা উপন্যাসের জনক বংকিমচন্দ্র ব্রজবুলির মাধুরী ঢাললেন নিজের রচনায়।
কবিতাকে রুপক উপমায় অলংকৃত করার রীতির জন্ম দেয়া এ কবি জন্ম নিয়েছিলেন আনুমানিক ১৩৫২ শতাব্দিতে। বিদ্যাপতির বাবার নাম ছিল শ্রী গণপতি ঠাকুর। বর্তমান ভারতের মধুবনি জেলার বিসফি গ্রামে কবির জন্ম, পরবর্তিতে হলেন বর্তমান নেপালের মিথিলার রাজসভার কবি। তখন মিথিলার রাজার নাম ছিল শিবসিংহ। কবির রচনায় বিমুগ্ধ রাজা কবিকে দিয়েছিলেন এক চমৎকার উপাধি, কবিকন্ঠহার
কবিকন্ঠহার ছিলেন শিবের অনুরক্ত ভক্ত। তার উদ্দ্যেশ্যে তিনি যেসব প্রার্থনা সংগীত লিখেছিলেন, সেগুলো আজো লোকসংগীত হিসেবে বয়ে বেড়ায় মিথিলার মানুষের মুখে। বিদ্যাপতিকে নিয়ে প্রচলিত রয়েছে এক কিংবদন্তি। লোকগাথা বলে কবির ভক্তি, উপাসনা দেখে মুগ্ধ হয়ে শিব নেমে এলেন পৃথিবীতে।অসহায় এতিম উগ্নার  রূপ নিয়ে আশ্রয় চাইলেন কবির ঘরে। দয়ালু কবি তাঁকে গৃহপরিচারক হিশেবে নিযুক্ত করলেন। একবার রাজার নিমন্ত্রণে  বিদ্যাপতি গিয়েছিলেন রাজধানীতে। সাথে ছিল পরিচারকরুপী শিব। ফেরার পথে এক বিরাণভূমিতে এসে কবির খুব তেষ্টা পেল, কবি ছদ্মবেশী শিবকে পানি এনে দিতে বললে শিব তার অপারগতা প্রকাশ করল। পানির অভাবে কবি অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলেন। শিব তার অলৌকিক ক্ষমতাবলে কবির জ্ঞান ফিরিয়ে দিলেন। এভাবেই আরো অনেকবার কবিকে সাহায্য করতেন ছদ্মবেশী শিব।
লোকমুখে বয়ে বেড়ানো কিংবদন্তি ছাড়াও বহুল জনপ্রিয় এ কবিকে নিয়ে ১৯৩৭ সালে নির্মিত হয়েছিল বিদ্যাপতি চলচ্চিত্র। সিনেমায় কবির ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন পাহাড়ি সান্যাল।
বিদ্যাপতি কেবল রাধাকৃষ্ণ,শিবের গীত বেঁধেই ক্ষান্ত হননি। আঞ্চলিক ভূগোলবিদ্যা লিপিবদ্ধ করেছেন ভূপরিক্রমায়, লেখালেখির কৌশল বলেছেন লিখনবলী গ্রন্থে। সংস্কৃত ভাষায় কবি লিখেছেন পুরুষপরীক্ষা, কীর্তিলতা, গঙ্গাবাক্যাবলী। নিজের গতিময় জীবনকে বর্ণের স্থীর শৃঙ্খলে বেঁধেছেন আত্মজীবনীগ্রন্থ বিভাগসারে।
আজ থেকে ৬শ’ বছর আগে রূপক উপমার ভেতর দিয়ে কবি সেকালের মানুষকে দিয়েছিলেন অনুভূতিকে অবলোকন করার সুযোগ।বিদ্যাপতির এক কবিতায় রাধা মুখে কৃষ্ণের পরিচয় দিল ঃ
হাথক দরপণ মাথক ফুল |
নয়নক অঞ্জন মুখক তাম্বুল
হৃদয়ক মৃগমদ গীমক হার |
দেহক সরবস গেহক সার
পাখীক পাখ মীনক পানি |
জীবক জীবন হাম ঐছে জানি
তুহু কৈছে মাধব কহ তুহুঁ মোয় |
বিদ্যাপতি কহ দুহু দোহাঁ হোয়
কবিতায় কবি ব্যবহার করেছেন রুপকের পরে রূপক।আবেগ সিক্ত, রূপক অলংকৃত করে করে রাধা বলছে, কৃষ্ণ তাঁর হাতের আয়না, যাতে সে নিজেকে দেখতে পায়, মাথার শোভা বাড়িয়ে দেয়া ফুল। চোখের কাজল, মুখের লালিমা, দেহের সৌরভ, ঘরের সার । অবিরাম বলে যায় রাধা, পাখির যেমন পাখা, মাছের  যেমন পানি অপরিহার্য, তেমনি কৃষ্ণ তাঁর। এত কিছু বলার পরেও রাধা তৃপ্তি পায়না, সে ঈশ্বরকে  জিজ্ঞেস করে  কৃষ্ণ আসলে তাঁর কে হয়, বিদ্যাপতি তখন উত্তরে দিলেন এক অমিয় বাণী, তিনি বললেন, তোমরা দু’জনেই দু’জনের 🙂
কালের প্রবাহে আমাদের হৃদয়পটে ফিকে হয়ে গেছে বিদ্যাপতির ছবি, তবু আমাদের মনের কথার প্রতিচ্ছবি ঠিকই খুঁজে পাই বিদ্যাপতির রচিত চরণে ।
                                                           এ সখি হামারি দুখের নাহি ওর
                                                                        এ ভরা বাদর মাহ ভাদর
                                                           শূন্য মন্দির মোর।।
Nuzhat Tabassum Prova

Nuzhat Tabassum Prova