আমাদের সবার পরিবার বা বন্ধুমহলয়েই একজন চিকনি চামেলী থাকে যে খাবার দাবার নিয়ে মহা চিন্তিত। বাতাস দিলে উড়ে যাবে তাও তার ধারণা সে মোটা হয়ে যাচ্ছে। ওজন বেড়ে যাওয়ার ভয়ে খায়না, তার উপর ওজন কমানোর জন্য দিনে দুইবার ব্যায়ামও করে। আপাতদৃষ্টিতে চিকনি চামেলীর কার্যকলাপ নিতান্তই ঢং মনে হলেও তা হতে পারে এনরেক্সিয়া নারভসা নামক রোগের লক্ষণ। (রোগের নামটা কী কঠিন! এটা উচ্চারণ করতে হলেও যথেষ্ট পরিমাণ খাওয়াদাওয়া করা উচিৎ :p )

 

অনেকেরই ধারণা এনরেক্সিয়া নারভসা  কোন রোগ নয়, ব্যাক্তিগত ইচ্ছা মাত্র। কিন্তু খাদ্য গ্রহন,  ওজন, শারীরিক আকার নিয়ে অনুক্ষণ চিন্তা করা প্রকৃতপক্ষে এনরেক্সিয়া নারভসার লক্ষণ। এনরেক্সিয়া নারভসা এক ধরণের ইটিং ডিজর্ডার যেটাতে আক্রান্ত ব্যাক্তিরা অত্যন্ত কম ওজনের অধীকারি হলেও নিজেকে স্থূল মনে করে। তারা বার বার নিজের ওজন চেক করে, খুবই নিয়ন্ত্রিত ও অল্প পরিমাণে খাবার গ্রহন করে, প্রয়োজন ছাড়াই ভারী ব্যায়াম করে। images-1
download-1

অন্য যেকোনো মানসিক রোগের তুলনায় এনরেক্সিয়া নারভসায় আক্রান্ত মানুষের মৃত্যুর হার বেশি। কিছু সংখ্যক মানুষ ওজন সংক্রান্ত হতাশার কারণে আত্মহত্যা করে, আবার অন্যরা অনাহার বা অপুষ্টিজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করে। নারীদের মধ্যে অন্য যে কোন রোগের চেয়ে এনরেক্সিয়া নারভসার কারনে আত্মহত্যার হার বেশি।

পুরুষের তুলনায় নারী এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি।  বিশেষ করে অভিনয়, মডেলিং নৃত্যকলা ইত্যাদি পেশার সাথে জড়িত নারীদের। আক্রান্তরা সাধারণত  স্কুল, কর্মক্ষেত্র, খেলাধুলা এবং অন্যান্য কাজে খুব পারদর্শি হয়, সব কিছুকেই নিখুঁতভাবে করার চেষ্টা করে। আর নিখুঁত শারীরিক আকার অর্জন করতে গিয়েই তারা নিজের বারোটা বাজিয়ে ফেলে। রোগটির সূত্রপাত সাধারনত বয়:সন্ধিতে ঘটে তবে এনরেক্সিয়া নারভসার ভূত যে কারো ঘাড়ে বসতে পারে যেকোনো বয়সে।

লক্ষ্যনসমূহের মধ্যে উল্লেখযোগ্যঃ 

  • অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভ্যাস
  • দুর্বলতা
  • ওজন হারানোর নিরন্তর চেষ্টা
  • নরমাল ওজন রাখার অনীহা
  • ওজন বাড়ার ভয়
  • নিজের শারীরিক আকৃতি বিকৃত এমন ধারণা থাকা
  • শারীরিক আকৃতি দ্বারা ব্যাক্তিত্ব প্রভাবিত হয়, এমন ধারণা পোষন করা
  • খাদ্য গ্রহণ করার পর ইচ্ছাকৃতভাবে বমি করা্র চেষ্টা করা

এ ছাড়াও, সময়ের সাথে সাথে আরো কিছু শারীরিক পরিবর্তন দেখা যেতে পারে। যেমনঃ  

  • হাড় সরু হয়ে যাওয়া(osteopenia or osteoporosis)
  • এনিমিয়া (রক্তশূন্যতা)
  • দুর্বল পেশি
  • ভঙ্গুর নখ এবং চুল
  • সারা শরীরে চুল গজানো (lanugo)
  • কোষ্ঠকাঠিন্য
  • নিম্ন রক্তচাপ
  • শ্বাস প্রশ্বাস ধীর গতিতে হওয়া
  • হৃদপিন্ডের স্বাভাবিক আকার ও ক্রিয়া বিঘ্নিত হওয়া
  • মস্তিষ্কের ক্ষতি হওয়া
  • বিভিন্ন অঙ্গের ক্ষতি হওয়া
  • শরীরের আভ্যন্তরিন তাপমাত্রা নেমে যাওয়ার কারণে ব্যাক্তি সবসময় ঠান্ডা অনুভব করা
  • সবসময় ক্লান্ত অনুভব করা
  • বন্ধ্যাত্ব
  • নারীর ক্ষেত্রে অনিয়মিত ঋতুস্রাব

আক্রান্ত প্রতিটি ব্যাক্তির চিকিৎসা নেয়া উচিত। চিকিৎসায় ডাক্তার দেখানো এবং নিয়মিত কাউন্সেলিং করানো হয়, ইটিং ডিজর্ডারের কারনে শারীরিক অসুস্থতা বা ওজন অতিরিক্ত কমে গেলে হাসপাতালের ভর্তি হওয়ার প্রয়োজন হতে পারে। এনরেক্সিয়া নারভসার চিকিৎসা তিনটি ধাপে হতে পারে।

অনাহার বা অপুষ্টি যদি আক্রান্ত ব্যাক্তির শরীরকে দুর্বল করে দেয়, তবে তার চিকিৎসা নেয়া আবশ্যক। এনরেক্সিয়া নারভসার কারণে যদি osteoporosis, হৃদপিণ্ডে সমস্যা বা বিষন্নতা জাতীয় রোগের সূত্রপাত ঘটে থাকে, তবে ডাক্তার প্রথমে সেগুলোর চিকিৎসা করবেন। সেরে উঠা শুরু করলে ডাক্তার আক্রান্ত ব্যাক্তির স্বাস্থ্য ও ওজন ফলোআপ করবেন।

একজন রেজিস্টার্ড পুষ্টিবিদ আক্রান্ত ব্যাক্তির খাদ্যাভ্যাস নিয়ন্ত্রনে সাহায্য কবেন। তিনি যেন পরিমিত, পুষ্টিকর খাবার গ্রহন করেন তা নিশ্চিত করবেন।

পরিশেষে একজন থেরাপিস্ট আক্রান্ত ব্যাক্তির চিন্তাধারার ত্রুটিগুলো শুধরে দিবেন। আক্রান্ত ব্যাক্তি সমাজে নিজের প্রতিষ্ঠা বা গ্রহণযোগ্যতার পেছনে সৌন্দর্যের ভূমিকা কতটুকু মনে করেন, তা কেন মনে করেন; খাদ্য গ্রহনের পেছনে তার অনীহার কারণগুলো নিয়ে প্রয়োজনীয় আলোচনা করবেন।

এনরেক্সিয়া নারভসা ঠিক কেন হয়, সে তথ্য এখনো অজানা। ধারণা করা হয়, জিনগত কারণ, জৈবিক ত্রুটি যেমন Neuroendocrine dysregulation, Gastrointestinal diseases ইত্যাদি , সৌন্দর্যের প্রচলিত ব্যাখ্যা, মিডিয়ার প্রচারনা ইত্যাদি রোগটির সূত্রপাতে সাহায্য করে।

শারীরিক কাঠামো সৌন্দর্যের সংজ্ঞা নয়। সৌন্দর্য মানে ভাল ব্যবহার, নিজেকে এবং পরিজনকে ভালবাসা, আত্মিক প্রশান্তি অনুভব করা। তাই নিজেকে বঞ্চিত করে প্রথাগত ‘সুন্দর’ হওয়ার কোন মানে নেই।

eating-disorders-14-2-healthyplace

 কৃতজ্ঞতাঃ

উয়িকিপিডিয়া

Mayo Clinic

Nuzhat Tabassum Prova

Nuzhat Tabassum Prova