লঞ্চ ডুবে যাওয়া বাংলাদেশে কোনো নতুন ঘটনা নয়। বিগত বছরের দিকে দৃষ্টিপাত করলেই তা দেখা যায়। ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৫, পাটুরিয়া ঘাটের কাছাকাছি কার্গো জাহাজ নার্গিস-১ এর ধাক্কায় পানিতে উল্টে যায় এমভি মোস্তফা কামাল, মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়ে ৭০ জন। ৪ আগস্ট ২০১৪, মাওয়া ঘাট এলাকায় অতিরিক্ত যাত্রী পরিবহন এবং প্রবল স্রোতের কারণে ডুবে যায় ১৯৯১ সালে তৈরি এমএল পিনাক-৬, মৃত্যু বরণ করেন ৪৬ জন, নিখোঁজ হন ৬১ জন। এর মধ্যে এমভি মোস্তফা কামাল কে ২৩ ফেব্রুয়ারি উদ্ধার করা গেলেও এমএল পিনাক-৬ এখনো নদী গর্ভে তলিয়ে আছে।

১৯৭৪ সালে হামজা ও রুস্তম নামে দুটি উদ্ধারকারী জাহাজ প্রথমবারের মত বাংলাদেশে আনা হয় যাদের প্রতিটির ক্ষমতা ছিল ৬০ টন। এরপর দীর্ঘ ৩৮ বছর পর বিআইডব্লিউটিএ’র বহরে নির্ভীক ও প্রত্যয় নামক দুটি নতুন উদ্ধারকারী জাহাজ যুক্ত হয় যাদের মিলিত ক্ষমতা ৫০০ মেট্রিক টন। এছাড়া দক্ষিণ কোরিয়া থেকে দুটি টাগবোটও আমদানি করা হয়।

আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে ডুবে যাওয়া লঞ্চ অথবা অন্য কোনো নৌযান উদ্ধার করতে বাংলাদেশ যথেষ্ট সক্ষম। কিন্তু বাস্তবে পরিস্থিতি এতোটা অনুকূলে নয়। পানিতে নিমজ্জিত কোনো জলযান তখনই উদ্ধার করা সম্ভব যখন সেই নিমজ্জিত জলযান সনাক্ত করা সম্ভব। নিমজ্জিত জলযান শনাক্তকরণে বাংলাদেশ এখনো অনেক পিছিয়ে। ডুবে যাওয়া জলযান শনাক্তকরণের জন্য এখনো আমাদের দেশে চিরাচরিত নিয়ম অনুসরন করা হয়। নদীর তলে নানা প্রতিকুলতা থাকার জন্য ডুবুরিরা তাদের কাজ সঠিক ভাবে পূরন করতে পারছে না যদিও তারা তাদের যথাসাধ্য চেষ্টা করে।

বর্তমান বিশ্বে ড্রোন একটি অতি পরিচিত নাম। ড্রোন মূলত এক ধরনের মনুষ্যবিহীন আকাশযান। ড্রোন এ থাকে সংবেদনশীল যন্ত্র ও ক্যামেরা। ওই ক্যামেরার মাধ্যমে গহীত ভিডিওচিত্র ভূমি থেকে বিমান নিয়ন্ত্রনকারী অপারেটরের কাছে পৌঁছে দেয়া হয়। আকাশসীমায় গুপ্তচরবৃত্তি চালানো, নিজ দেশের আকাশসীমা পাহারা দেয়া, আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ, শত্রুদের বেতার ও রাডার সিস্টেমে ব্যাঘাত ঘটানো, আড়ি পেতে তথ্য যোগাড় করা থেকে শুরু করে প্রয়োজনে আরো ব্যাপক ভূমিকা পালন করতে পারে এই ড্রোন। দিন যত গড়িয়ে যাচ্ছে, ড্রোন এর ব্যবহার ততই বেড়ে যাচ্ছে।

প্রশ্ন একটাই, ড্রোন যদি আকাশে উড়তে পারে তাহলে ড্রোন কেন পানির ভিতর চলতে পারবে না?

সম্প্রতি একটি সংবাদ বার্তায় জানা যায়, রাশিয়া একটি সাবমেরিন ড্রোন তৈরি করতে যাচ্ছে যা পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র অথবা বৈদ্যুতিক স্থাপনায় আঘাত হানতে সক্ষম বোমা পরিবহন করে যুক্তরাষ্ট্রের উপকূলে আঘাত হানতে পারবে। রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে প্রচারিত একটি ডকুমেন্টশন প্রোগ্রামে দেখা যায়, ক্যানিয়ন শত্রু দেশের উপকূলীয় এলাকার ধ্বংস করতে সক্ষম এবং ওই ভূখন্ডের সামরিক, অর্থনৈতিক অথবা অন্যান্য কার্যক্রমকেও দীর্ঘদিনের জন্য অকেজো করে দিতে পারে। বলতে গেলে রাশিয়া প্রযুক্তিগতভাবে অত্যাধুনিক একটি অস্ত্র তৈরি করতে যাচ্ছে যা আমেরিকার উপকূলীয় এলাকাকে মারাত্মক বিপর্যয়ের মুখে ফেলবে।

রাশিয়ার এমন সিদ্ধান্তে একটা বিষয় পাকাপোক্তভাবে জানা যায়, এরূপ ড্রোন বানানো সম্ভব যেটা পানির মধ্য দিয়ে চলতে সক্ষম, যেটা আমাদের পানির তলদেশ সম্পর্কে ধারনা দিবে। সবকিছুরই তো ধ্বংসাত্মক দিক থাকে, তাই না?

আমরা যদি রাশিয়ার মতো ধ্বংসাত্মক চিন্তা না করে উন্নয়নমূলক চিন্তা করি তাহলে কিন্তু দৃশ্যপট পালটানো সম্ভব। সাবমেরিন ড্রোনকে যদি কোনো শক্তিশালী অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার না করে মানব কল্যানে ব্যবহার করি তাহলে তা বাংলাদেশ এর মতো নদীমাতৃক দেশ এর জন্য একটা বড় পাওনা। এখন প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক, কিভাবে সাবমেরিন ড্রোন বাংলাদেশ এর জন্য বড় পাওনা? উত্তর টা হল, সাবমেরিন ড্রোনকে যদি ডুবে যাওয়া লঞ্চ বা অন্য কোনো নৌযান খুজে পেতে ব্যবহার করা যেত তাহলে বোধ হয় আমরা পিনাক-৬ কে খুজে পেতে অসমর্থ হতাম না। ড্রোন পানির তলদেশে সেই সব স্থানে যেতে সক্ষম যা একজন সাধারন ডুবুরি এর পক্ষে যাওয়া সম্ভব না। ড্রোন এর মাধ্যমে ডুবে যাওয়া জাহাজ এর সঠিক কো-অর্ডিনেট পাওয়া সম্ভব, ড্রোন এর মাধ্যমে অতি দ্রুততার সাথে পানির তলদেশে অবস্থান শনাক্ত করা সম্ভব। এছাড়া ডুবুরিদের বিকল্প হিসাবে ড্রোন ব্যবহার করা হলে ডুবুরিদের জীবনের কোনো ঝুকি থাকে না। এক কথায় বলা যায়, সাবমেরিন ড্রোন বাংলাদেশের জন্য একটা বড় পাওনা।

এখন যে প্রশ্নটা মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে সেটা হল, কি ভাবে সাবমেরিন ড্রোন বানানো যায়? একটা বড় চ্যালেঞ্জ বাংলাদেশ এর মতো উন্নয়নমূলক দেশের জন্য। বাংলাদেশের লোকজন কিন্তু এখন পিছিয়ে নাই। দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় এর শিক্ষার্থীরা নিজেদের জ্ঞান কাজে লাগিয়ে বানিয়েছে ড্রোন, উড়িয়েছে আকাশে, দেখিয়ে দিয়েছে তারাও তাল মিলিয়ে চলতে পারে উন্নত বিশ্বের সাথে। আশা করি অতি শীঘ্রই তারা সাবমেরিন ড্রোন বানাতেও সক্ষম হবে।

সাবমেরিন ড্রোন বানানোর জন্য সর্বসাকুল্যে তিনটি মোটর প্রয়োজন যার মধ্যে দুটি মোটর ড্রোনটিকে সামনে-পিছনে নিবে ও ডানে-বামে ঘুরাবে, অন্য মোটর এর সাহায্যে ড্রোনটিকে উপর দিক উঠানো অথবা নিচের দিকে নামানো যাবে। মোটরগুলার প্রতিটির সাথে প্রোপেলার যুক্ত করা থাকে। ড্রোনটির ডানে অথবা বামে ঘুরা আরো নিখুঁত করতে রাডার সংযুক্ত করা যেতে পারে। যেহেতু ড্রোনটি পানির মধ্য দিয়ে চলবে সেহেতু ড্রোনটি হতে হবে নিরপেক্ষভাবে প্লবমান। যদিও সামান্য ইতিবাচক প্লবমান কয়েক কারণে উপকারী; একটা উপকারী দিক হল, যদি কখনো ড্রোনটির তড়িৎ উৎসে কোনো ব্যঘাত ঘটে তাইলে ইতিবাচক প্লাবতার কারনে ড্রোনটি আপনা-আপনি পানির উপরে উঠে আসবে। অন্য উপকারী দিক হল, যখন ড্রোনটিকে পানির তলদেশে চালানো হবে তখন ইতিবাচক প্লাবতার কারনে ড্রোনটি মাটিতে ঠেকে যাবে না। ড্রোনটি পানির মধ্য দিয়ে চলবে ও ভিডিও ধারন করবে তাই ড্রোনটিতে পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা থাকতে হবে। আলোক উৎস এর জন্য এলইডি ক্লাস্টার ব্যবহার করা যেতে পারে। ড্রোনটিকে পানিতে নিয়ন্ত্রন করার জন্য প্রয়োজন  এমন একটি নিয়ন্ত্রক যাতে একটি লাইভ ভিডিও ফিড ক্যামেরা, একটি জয়স্টিক, একটি চাপ সেন্সর ডিজিটাল মিটার এবং একটি হেডলাইট টগল সুইচ যুক্ত আছে। সবশেষে ড্রোনটিকে সচল রাখার জন্য লাগবে মেরিন ব্যাটারী।

সাবমেরিন ড্রোন বর্তমান বাংলাদেশ এর প্রেক্ষাপটে একটা নতুন শব্দ। আশা করি আগামী বছরগুলাতে এই খাতে বাংলাদেশ অনেকটা এগিয়ে যাবে। তখন হয়তো আর কোনো জাহাজ বা লঞ্চ কে এমএল  পিনাক-৬ এর মতো পরিনতি নিয়ে নদীর বুকে তলিয়ে থাকতে হবে না।