“Learn to teach, Learn to help.”

যেকোন সমস্যা সমাধানেই সবেচেয়ে প্রথমে প্রয়োজন সমস্যার সঠিক আইডেন্টিফিকেশন, বা নির্ণয়। এই নির্ণয় টাকেই আমরা বলি ডায়াগনসিস। আপনার সমস্যা, বা আপনার বন্ধুর সাহায্যে আপনি আসতে পারবেন কি না, তা সম্পূর্ণ ভাবে নির্ভর করছে একটি সঠিক ডায়াগনসিস এর ওপর।
তাই আজকে, আমরা শিখবো Mental Illness Categorization বা মানসিক অসুস্থতার প্রকারভেদ ।

নেট এ, বইপত্রে যেসকল প্রকারভেদ দেয়া আছে সেগুলো খুবই কঠিন ভাষায় মেডিক্যাল টার্মিনলজি সহকারে দেয়া আছে। কেউ আগ্রহী হলে খুঁজে দেখতে পারেন, বা এই সিরিজের শেষে আমি গ্লসারি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করে দিতে পারি। প্রাথমিকভাবে, আমরা খুবই সহজ ভাষায় যেকারো সমস্যা কে একটা ছকে ফেলা শিখবো।

Mental Health Words

Mental Health Problems.

 

আমাদের টেকনিকটা হবে দুটো শব্দ কে ঘিরে – Disorder Or Disease.
অর্থাৎ, মানসিক অসুস্থতা টা কি শুধুই অস্বাভাবিকতা নাকি ব্যাধি। ঠিক এই নির্ণয়ের পর থেকেই সম্পূর্ণ ভিন্ন ভিন্ন উপায়ে আপনি মানসিকভাবে অসুস্থ ব্যক্তিকে সাহায্যে নেমে পড়তে পারবেন।

এবার আসি একটু কঠিন, এবং একাডেমিক প্রকার ভেদে। মানসিক অসুস্থতা দু’প্রকার-
১/ নিউরোটিক। (Disorder)
২/ সাইকোটিক। (Disease)

নিউরোটিক অসুস্থতা গুলো বেশিরভাগই আবেগ এর সাথে জড়িত। একজন মানুষের ইমোশোন, ফিলিংস সম্পর্কিত সমস্যা গুলো কে আমরা নিউরোটিক মেন্টাল কন্ডিশন বলে থাকি। আমাদের চারপাশের বেশিরভাগ ব্যক্তি নিউরোটিক মেন্টাল কন্ডিশন এ ভুগছে। ( সামনে থেকে, নিউরোটিক মেন্টাল কন্ডিশন কে আমরা NMC বলে নির্দেশ করবো।)
NMC অন্তর্ভুক্ত মানসিক সমস্যা গুলো হচ্ছে – ডিপ্রেশন, এংগার ম্যানেজমেন্ট সমস্যা, স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট সমস্যা, যেকোন ধরণের ফোবিয়া, অত্যাধিক দ্বিধা, হীনমন্যতায় ভোগা,  অবসেশন বা আসক্তি, OCD বা অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিসর্ডার, OCPD, ICD, নেতিবাচকতা বা নেগেটিভিটি বা পেসিমিজম, প্যানিক এটাক বা অস্বাভাবিক অশান্তি, পোস্ট ট্রমাটিক ডিসর্ডার বা দূর্ঘটনা-পরবর্তী অস্বাভাবিকতা।

অর্থাৎ, NMC নির্ধারণের সবচেয়ে সহজ উপায় হচ্ছে সমস্যা টা সামনে রেখে প্রশ্ন করা-
এই সমস্যা কি আবেগ সংক্রান্ত জটিলতা? এটা কি আবেগের বাহুল্য, আবেগের স্বল্পতা বা আবেগ এর অস্বাভাবিকতা নির্দেশ করে?
যদি উত্তর ইতিবাচক হয় তবে এই সমস্যাটা একটি NMC.

NMC এর কারণ সমস্যা এবং ব্যক্তি ভেদে ভিন্ন হয়। এটা হতে পারে পরিবেশ এর কারণে, সমসাময়িক কিংবা বহু পুরনো কোন ঘটনার জের ধরে, অথবা একাকিত্ব কিংবা অতিরিক্ত ক্রাউডেড এনভায়রনমেন্ট এ থাকার কারণে। বেশিরভাগ NMC তৈরি হয় তার পরিবেশ এর কারণে। তাই, আপনার চারপাশে যদি কোন NMC পেশেন্ট থাকে যাকে আপনি সাহায্য করতে চান, সবার প্রথমে তার চারপাশের বর্তমান ও অতীত পরিবেশ, বেড়ে ওঠা, পরিবার, বন্ধু বান্ধবের সংখ্যা ও সম্পর্কের ধরণ, কোন উল্লেখ্যযোগ্য দূর্ঘটনা ইত্যাদি জেনে নিতে হবে। সাথে এটাও জেনে নেয়া প্রয়োজন তার বেশিরভাগ দিনের একটি নমুনা, যাতে আপনি একটা ধারণা নিতে পারেন সে দিনের কতটা সময় একা থাকছে, বা আদৌ কতটা সময় সে নিজেকে দিতে পারছে। তবে এই পরিবেশ সম্পর্কে ধারণা নেয়াই শেষ কথা নয়। কিছু নিউরোটিক ডিসর্ডার আসে বয়সের সাথে – যেমন বয়ঃসন্ধি বা প্রৌঢ়ত্ব, আসে হরমোনের সাথে, আসে প্রেগ্ন্যান্সির সাথে, যেমন পোস্ট পার্টাম ডিপ্রেশন, আসে দীর্ঘমেয়াদী রোগ বালাই এর সাথে, আসে কিছু মেডিকেশন সেবনের সাইড এফেক্ট হিসেবে। এছাড়াও, কিছু ব্যাধি যেমন হাইপো-থাইরয়েডিজম বা মাইট্রাল ভালভ প্রোল্যাপ্স জাতীয় অসুখ ও নিউরোটিক মেন্টাল কন্ডিশনের অন্যতম কারণ। এসব বিবেচনাও আপনার তার সমস্যা সমাধান এ অপরিহার্য। এবং এতকিছু জানা, বোঝার কারণেই সঠিক ডায়াগনসিস এতো কঠিন একটা জিনিস।
তবে বলাই বাহুল্য যে এসব জেনে নেয়া এত সহজ হবেনা, যে কারণে আপনার মধ্যে তার একটা নির্ভরতার স্থান তৈরি করতে হবে, একটা কম্ফোরট জোন তৈরি করতে হবে। অবশ্যই, সামনে যখন আমরা স্পেসিফিক রোগ গুলো সম্পর্কে আরো বিস্তারিত জানবো, তখন ব্যক্তি এবং জায়গাভেদে রোগীর সাথে সহজ সম্পর্ক গড়ে তোলার অনুশীলন করবো।

NMC অন্তর্ভুক্ত সমস্যাগুলো খেয়াল করলে দেখা যায়, আমাদের চারপাশের বেশিরভাগ মানুষই নিজের অজান্তে মানসিক অসুস্থতায় ভুগছে। হয়তো কেউ এসব কাটিয়ে উঠতে সক্ষম, আর কেউ অপেক্ষা করছে একটি বাড়িয়ে দেয়া হাত এর।

কেইস স্টাডি (২):

আনিস (ছদ্মনাম) একজন ১৯ বছরের তরুণ। রোড এক্সিডেন্ট এ তার মা মারা যাওয়ার পর থেকে সে দিনের বেশিরভাগ সময় একা থাকে, এবং বিষন্নতায় ভুগে। প্রায় ৪ মাস এই অবস্থা অপরিবর্তিত থাকায়, তার বাবা তাকে একজন কাউন্সিলর “ক” এর সাথে পরিচয় করিয়ে দেন তাঁর বন্ধু হিসেবে, গোপন রাখেন তার প্রকৃত পরিচয় ও উদ্দ্যেশ্য।
ক সাহেব ধীরে ধীরে আনিস কে তার সাথে সহজ করে তোলেন, ধীরে ধীরে আনিসের নিজস্ব জগতে প্রবেশাধিকার অর্জন করে নেন। আনিস ক সাহেব এর সাথে তার মা কে নিয়ে গল্প করে ও কাঁপতে কাঁপতে তার কষ্টের কথা জানায়। সে জানায় তার অন্ধকার ভয় লাগে ও রাতে ঘুমুতে পারেনা। আনিস কথা বলতে বলতে একেকসময় খুব ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে সবকিছুর ওপর এবং পরে সামলে ওঠে খুব কুন্ঠিত ভাবে ক সাহেব এর কাছে পানি খেতে চায়। ক সাহেব তাকে পানি দিয়ে শান্ত করেন।
এভাবেই একদিন ক সাহেব এর ডায়াগনসিস সম্পূর্ন হয় এবং তা নিম্নরূপ:
১. পোস্ট ট্রমাটিক ডিসর্ডার
২.  ডার্কনেস ফোবিয়া
৩. স্লিপ ডিসর্ডার
৪. এংগার ম্যানেজমেন্ট প্রবলেম।

ক সাহেব রোজ তার সাথে গল্প করেন এবং গল্পচ্ছলে তার কাউন্সিলিং করেন। আনিস এর বাবার সাহায্যে তিনি ৬ মাস তাকে নার্ভ রিল্যাক্সেন ও ঘুমের ওষুধ খাওয়ান।
একসময় আনিস এই দীর্ঘ ডিপ্রেশন কাটিয়ে ওঠে। তবে কোথাও যেন তার বিষন্নতা থেকে যায়, এবং তার সামনের বছরগুলো কাটে তীব্র হীনমন্যতা এবং সিদ্ধান্তহীনতায়।

পর্যালোচনা:

ক সাহেব সম্পূর্ন কেইস টিকে আনিসের মায়ের মৃত্যুর চারপাশে সাজিয়েছেন, তিনি চোখটাকে বড় করে দেখেন নি। তিনি ধরেই নিয়েছেন ছেলেটার সম্পূর্ন সমস্যা মায়ের মৃত্যুর পর থেকে শুরু। এখানেই সবচেয়ে প্রথম ভুল – Assumption.
ক সাহেব একটু খেয়াল করলে দেখতে পেতেন, আনিসের হাতে ও ঠোঁটে কালো ছোপ, অর্থাৎ পুরনো সিগারেট অভ্যাসের দাগ। সিগারেট বা যেকোন মাদক এধরণের রোগ গুলোর ওষুধের প্রতি রেস্পন্স কমিয়ে দেয় যার কারণে তাদের ওষুধ দিতে হয় হাই পাওয়ার।
ক সাহেব যদি আনিস এর সাথে আরেকটু বন্ধু ভাবাপন্ন হয়ে তার অতীত দুর্ঘটনা সম্পর্কে খোঁজ নিতেন, তাহলে দেখতেন আনিসের ছোটবেলায় তার মামিও একইভাবে মারা যান, যার দুঃখের জের এতদিন ধরে আনিস টেনে এসেছে এবং এতদিনে তার প্রকাশ ঘটেছে।
আনিস এর কুন্ঠিত ভাবে পানি চাওয়া তার দ্বিধাদন্দ্ব ও হীনমন্যতার আভাস দেয়। এই ধরনের পার্সনালিটি প্রবলেম যদি প্রাথমিক অবস্থাতেই গোড়া উৎপাটন না করা হয়, তবে পরবর্তীতে মহামারি আকার ধারণ করে।
সবশেষে, ক সাহেব আনিস এর বয়স এবং একাকিত্ব কে এড়িয়ে গেছেন। টিনেজ বয়স এ এই ধরনের ট্রমা যে কি ধরনের ডিপ্রেশন বয়ে আনতে পারে সেই ব্যাপারে তিনি সতর্ক হন নি।

অর্থাৎ, ডায়াগনসিস এর সময় রোগির বডি ল্যাংগুএজ এবং প্রতিটি অভিব্যক্তি লক্ষ্য করতে হবে। একজন মানুষের কথা বলার ধরণ, আত্মবিশ্বাস বা কুন্ঠা, হাত পা নড়াচড়া থেকে অনেক ধরনের ধারণা পাওয়া যায়, যার ভিত্তিতে প্রশ্ন করে সেই ব্যক্তির বর্তমান মানসিক অবস্থা সম্পর্কে একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া সম্ভব হয়।
একটি ভুল ডায়াগনসিস, আপনাকে শুধু অন্ধকারে নয়, বরং একটি অন্ধকার কূপে ঠেলে দিবে। ডায়াগনসিস সবচেয়ে ভাইটাল ও গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যার ওপর নির্ভর করছে গোটা ভবিষ্যত।
তাই একটি নির্ভুল ডায়াগনসিস এর জন্যে প্রয়োজন অনেক ধৈর্য, আগ্রহ ও পড়াশোনা।
অবশ্যই, ডায়াগনসিস নিয়ে এ সিরিজে একটি বিস্তারিত পর্ব থাকবে।

ফিরে যাই আজকের মূল বিষয়বস্তুতে। মেন্টাল ইলনেস এর আরেকটি প্রকার হচ্ছে Psychotic Mental Condition অর্থাৎ PMC.
সাইকোটিক মেন্টাল কন্ডিশন হচ্ছে সেই অসুস্থতা গুলো যেগুলো রোগির মনে বাস্তব এবং অবাস্তবের মাঝের পর্দাগুলো সাময়িক সময়ের জন্যে হলেও তুলে দেয়। এই অবাস্তবতার সম্মুখীন হওয়া কে বলা হয় হেলুসিনেট করা  এবং প্রক্রিয়া টাকে বলা হয় হেলুসিনেশন। PMC এর রোগিদের চিকিৎসায় একই সাথে মেডিকেশন এবং কাউন্সিলিং চালু রাখতে হয়। Acute PMC এর ক্ষেত্রে আরো কিছু থেরাপি যেমন শক থেরাপি থেকে শুরু করে, কোয়ারেন্টাইন বা আলাদা করে ফেলার প্রয়োজন ও পড়তে পারে।
আমরা সাধারণ ভাষায় যাদের পাগল বলে থাকি, তারা আসলে সাইকোটিক মেন্টাল কন্ডিশনে ভোগা রোগি।
সাইকোটিক মেন্টাল কন্ডিশন চেনার মূল কৌশল হচ্ছে প্রশ্ন করা –
রোগি কি বাস্তব এবং অবাস্তবতার মাঝামাঝি বাস করছে? সে কি কাল্পনিক কোন চরিত্র বা ঘটনা বা সময় ঘিরে আবর্তন করছে?
যদি উত্তর ইতিবাচক হয়, তবে সে PMC Patient.

তবে এসব বাদেও কিছু কিছু রোগ কে PMC তে অন্তর্ভুক্ত করা হয় যেমন – Eating Disorder.
PMC এর ক্ষেত্রে একজন নন প্রফেশনাল হিসেবে আসলে তেমন কিছু করা সম্ভব হয়না। তবে বৈচিত্র্য ও কেইসের ভান্ডার এই কন্ডিশন নিয়ে এই সিরিজে আশা করছি অন্তত একটি ইনফর্মেটিভ পোস্ট রাখতে পারবো।

আজকে আমরা বেসিক ক্যাটেগরাইজেশন ও টাইপ ডায়াগনসিস শিখলাম। আগামী পর্বে আমরা আরেকটু গভীর এ যাবো, আরো কাছ থেকে দেখবো মনের নানান বাঁক, হাজারো রহস্য আর অদ্ভুত নিপুণতায় সাজানো মনের গাঁথুনি।

আপাতত রেখে যাচ্ছি একটি অনুশীলন। নিচের কেইস টি ভালভাবে পড়ে তাতে ইংগিত করা সকল মানসিক সমস্যা বা কন্ডিশন কে চিহ্নিত করতে হবে, ডায়াগনোস করতে হবে। নিচে কমেন্ট সেকশনে লিখে যেতে পারেন অথবা নিজের কাছেই লিখে রাখতে পারেন।
সামনের পর্বে আমরা বিশ্লেষণ সহ পুরো ডায়াগনসিস টা নিয়ে আলোচনা করবো।

“দিনকে দিন মেয়েটা কেমন জানি চুপচাপ হয়ে যাচ্ছে। রিমা’র মা তো ভেবেই পাচ্ছেন না, মেয়েটার হলো তো হলো টা কি! খাওয়া দাওয়া এক প্রকার বন্ধ বললেই চলে, দরজা খুলে ঘরে ঢুকলেই ঘর  অন্ধকার করে বসে আছে! সেদিন কিসের জন্যে জানি আসতে ১৫  মিনিট দেরী হলো, ওমা! মেয়ে দেখি আমাকে নিয়ে ভয়েই অস্থির! কেমন করে যেন তাকাচ্ছে, চোখে একরাশ দুশ্চিন্তা আর ভয়! একা রাস্তায় বেরোতে চায় না, পরীক্ষা গুলোও খারাপ হচ্ছে। কি জানি হলো! বয়স মোটে ১৭ তে পড়লো, এই বয়সেই এত বিষন্নতা গ্রাস করলে চলবে! রিমা’র মা ভাবেন আর ভয় পান, কি হলো মেয়েটার? এখন উনি কি করবেন? রিমা’র বাবা যদি আজ থাকতেন!”

এই সিরিজ থেকে যেকোন প্রত্যাশা, প্রশ্ন বা অভিযোগ মেইল করতে পারেন এই এড্রেস এ: [email protected]