জ্যামে বসে আছো। এয়ারপোর্ট রোডের জ্যাম। ঠিক তোমার বিপরীত পাশের রাস্তা দিয়ে সাইরেন বাজাতে বাজাতে একটি এম্বুলেন্স তেঁড়ে আসছে! তুমি মনে মনে দোয়া করছো যে-ই থাকুক না কেন এম্বুলেন্সটার ভিতরে,সে যেন জলদি হাসপাতালে পৌঁছুতে পারে। 🙁

কিন্তু এম্বুলেন্সটা যত তোমার কাছাকাছি চলে আসছে,তত এর সাইরেনের আওয়াজ তোমার কাছে বিরক্তিকর মনে হচ্ছে! যখন একেবারে তোমার পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছিলো এম্বুলেন্সটা,তখন মনে হচ্ছিলো যে কান বুঝি এবার শেষ! তোমাকে অতিক্রম করে যাওয়ার পর থেকে এই অস্বস্তিটা কমতে শুরু করলো,তারপর খানিকবাদে আর এমনটা হলো না। কেন এমন হলো? কি জন্যে হলো? এগুলোর উত্তর দেবার জন্যেই পদার্থবিজ্ঞানের ডপলার ইফেক্টের আজকের আলোচনা।

এই যে এম্বুলেন্সটা তোমার কাছে সাইরেন বাজাতে বাজাতে আসছিলো,ব্যাপারটি কিন্তু এমন না যে যতই এটি তোমার কাছে আসছে ততই স্পিকার থেকে জোরে বা তীব্র কম্পাংকের শব্দ বের হচ্ছে! এরা কিন্তু অপরিবর্তিতই থাকছে! কিন্তু তবুও তুমি জোরালো এবং তীক্ষ্ণ শব্দ শুনতে পাচ্ছো কেবল এর আপাত কম্পাংকের বৃদ্ধির কারণে। 🙂 এবং শ্রোতা(তুমি) এবং উৎস(এম্বুলেন্সটার উপরে লাগানো সাইরেন) এর আপেক্ষিক বেগের দরুণ এই যে শব্দ তরঙ্গের কম্পাংকের আপাত পরিবর্তন অনুভূত হয়,এটিই ডপলার ইফেক্ট! এই ডপলার ইফেক্ট শুধু শব্দের ক্ষেত্রেই দেখা যায় তা কিন্তু নয়! যেকোনো তরঙ্গের ক্ষেত্রেই ইহা প্রযোজ্য। 🙂

প্রথমে আমরা শব্দ তরঙ্গের ক্ষেত্রে ব্যাপারটি কিভাবে কাজ করে তা দেখে আসি। তারপর কিছু উদাহরণের মাধ্যমে অন্য তরঙ্গের ক্ষেত্রেও এর উদাহরণ দেখে আসবো।

শব্দের ক্ষেত্রে ডপলারঃ

প্রথমেই ধরে নিই একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলে একটি মাধ্যম ( যে শব্দ তরঙ্গ উৎপন্ন করবে ) আর একজন শ্রোতা উপস্থিত। দুইজন একটি নির্দিষ্ট দূরত্বে বসে আছে,চিত্রের মতো করেঃ

ডপলার ইফেক্ট হওয়ার আগে

চিত্রঃ একটা ব্যক্তি আর সাইরেনসহ একটি গাড়ি ( ধর এম্বুলেন্স :p )

এখন চিত্রের মতো করে গাড়িটি ( এম্বুলেন্স শব্দটি বাদ ) শব্দ করতে থাকলো জায়গায় থেকেই। তুমিও তোমার জায়গায় স্থির আছো। তাহলে তোমাদের মাঝে কোনো আপাত বেগ নেই,মানে তোমরা দুইজন দুইজনের সাপেক্ষে স্থির আছো বলে ধরে নিলাম। চিত্রের মতো করেই শব্দ শুনতে পাবে। শব্দ তরঙ্গ এভাবে বৃত্তাকার পথে আগাতে থাকবে চারপাশে,এভাবেই তোমার কান পর্যন্ত আসলে তুমি শব্দানুভূতি পাবে।
দুইটি বৃত্তের পরিধির উপর যদি আমরা দুইটি পরপর বিন্দু নিই,তাহলে এই দুই বিন্দুর মধ্যবর্তী দূরত্ব শব্দ তরঙ্গের তরঙ্গ দৈর্ঘ্য নির্দেশ করবে। খুব সিম্পল কথা।

তরঙ্গ দৈর্ঘ্য

চিত্রঃ তরঙ্গ দৈর্ঘ্য যেটা

যারা বুঝো নি তাদের জন্য উপরের চিত্রে তরঙ্গ দৈর্ঘ্য কোনটা হবে তা দেখিয়ে দিলাম। এখানে ”d” হচ্ছে তরঙ্গদৈর্ঘ্য।

আচ্ছা,এবার ঠিক পরের মুহূর্তের কথা চিন্তা করো। গাড়িকে তো তোমার সামনে স্থির দাঁড়িয়ে থাকার জন্য তৈরি করা হয়নি রাইট? এবার গাড়িটি একটি নির্দিষ্ট গতি ”v” তে চলতে শুরু করলো সামনের দিকে,মানে তোমার থেকে দূরে যেতে থাকবে গাড়িটি ”v” বেগে। অথবা আরো precisely বললে,তোমার আর গাড়ির মধ্যে একটি আপাত বেগের সৃষ্টি হলো,যার মান ”v”. এবার ঘটনাটি কেমন হবে?
গাড়িটি আওয়াজ করতে করতে এগিয়ে যাবে সামনের দিকে ঠিকই! কিন্তু এর কম্পাংকে একটা আপাত পরিবর্তন দেখা দিবে। ব্যাপারটি দেখাইঃ

আমি এখানে ডপলার ইফেক্ট এর যেই সূত্রটি আছে,তা প্রমাণ করে দেখালাম না। সূত্রের প্রমাণ এমনিতেই কিঞ্চিৎ বিরক্তির উদ্রেক ঘটাবে! সব বইতেই এইসব প্রমাণ দেয়া থাকে,তবে ইউটিউবে সুন্দর সুন্দর সূত্রের প্রমাণ আছে ডপলার ইফেক্টের,আমি এই টপিকের শেষে সেগুলো দিয়ে দিবো।তোমরা সেখান থেকে দেখে নিতে পারবে। 😀

Doppler

চিত্রঃ বাম পাশের ছবিটি উৎস টি যখন *স্থির* , আর ডানপাশের চিত্রটি উৎসটি যখন ডানদিকে একটি বেগে *গতিশীল*।

তো,উপরের চিত্রে ফিরে যাই। মনোযোগ দিয়ে দেখো,গাড়িটি যখন হর্ন/সাইরেন বাজাতে বাজাতে তোমার কাছে চলে আসছে,তখন তার তরঙ্গদৈর্ঘ্যে কিন্তু ব্যাপক পরিবর্তন আসছে! পরিবর্তন টা হচ্ছে,সে সাইজে ছোট হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু মূল তরঙ্গ”বেগ” কিন্তু পাল্টাচ্ছেনা। তাই সেজন্যে বেচারা কম্পাংককেও বেড়ে যেতে হচ্ছে! 🙁 একটি সমীকরণ যখন হয় এমন যে তরংগবেগ=কম্পাংকxতরঙ্গদৈর্ঘ্য , তখন তরঙ্গদৈর্ঘ্য যদি কমে যায়,তরংগবেগটাকে ধ্রুব রাখতে হলে অবশ্যই কম্পাংকে বেড়ে যেতে হবে। এই যে কম্পাংক বা তরঙ্গদৈর্ঘ্য বাড়া কমার কথা আমরা বলছি,এইটা কিন্তু ”আপাত”,যে তরঙ্গ উৎপন্ন করে এগিয়ে যাচ্ছে,তার কাছে কিন্তু কম্পাংক বা তরঙ্গদৈর্ঘ্য শুরুতে যা ছিলো,ঠিক তাই আছে। এই ব্যাপারে যেন তাল গোল পেঁচিয়ে না ফেলি! 🙂

উপরের চিত্রটি এঁকেছি ক্রমান্বয়ে ফোটা এঁকে এঁকে বৃত্ত এঁকে। বাম পাশের চিত্রে উৎস ( এখানে কালো ডটটি সেটি নির্দেশ করে ) স্থির,ডান পাশে সেটি ডানদিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে। ফলে উৎসের নতুন নতুন অবস্থানকেও নতুন নতুন ফোঁটা দ্বারা চিহ্নিত করা হয়েছে। দেখো,জ্যামিতিকভাবেই ব্যাপারটা কতোটা স্পষ্টভাবে বোঝা যাচ্ছে! উৎসটি যখন একটি দিকে এগিয়ে যাবে,তখন তরঙ্গের এই গোলকীয় বিস্তার আর ”বৃত্তাকার” থাকবেনা,এটি ”উপবৃত্তাকার” হয়ে যাবে। 😀

যখন শ্রোতা উৎসের দিকে আর উৎস শ্রোতার দিকে দু’টি বেগে এগিয়ে আসে,তখন আমরা সেই উৎস হতে নির্গত শব্দের কম্পাংকের একটি আপাত বৃদ্ধি  লক্ষ করে থাকি। দুইজন দুইদিকের আগানো এই ব্যাপারটাকেই আমরা আমাদের আজকের টপিকের basement ধরে নিচ্ছি,মানে এটিই আমাদের সকল সূত্রের আদর্শ পরিমাপক! এই আপাত কম্পাংকের মান যদি হয় f’,তাহলে আমরা লিখি এইভাবেঃ

ডপলার

সেই ইকুয়েশন!

তাকায় দেখো,শ্রোতা এবং উৎস দুইজনেই যদি নিজেদের দিকে আগায় আসে,তাহলে কম্পাংক বাড়তে থাকবে সবচেয়ে বেশি গতিতে। :v সমীকরণে একটা ভগ্নাংশ পার্ট আছে,বেগের অংশটাই হচ্ছে সেটা। f হচ্ছে আদি কম্পাংক,মানে মূল কম্পাংক যেটা সেটা,তাই এর তো চেঞ্জ হচ্ছেনা,এ ধ্রুব ই থাকবে। v হচ্ছে শব্দের বেগ। v(o) হচ্ছে শ্রোতার বেগ,আর v(s) হচ্ছে উৎসের বেগ। এরাই শুধু চেঞ্জ হয়। যেহেতু,শ্রোতা এবং উৎস দুইজনেই যদি নিজেদের দিকে আগায় আসে,তাহলে কম্পাংক বাড়তে থাকবে সবচেয়ে বেশি গতিতে,   তাই এদের মানটাও পাল্টাবে সেভাবে যাতে ভগ্নাংশের মানটাও সর্বোচ্চ হয়! এবং সেটা তখনই সম্ভব,যখন লবে কিছু যোগ করে হরটাকে আরো ছোট করে দেয়া হয়। 😀 এভাবে এই ইকুয়েশনটা মনে রাখা যায়। কয়েকটা কেইস নিয়ে তোমাদের প্রায়শয়ই ঝামেলা বাঁধে। আমি একেবারে এক এক করে সবগুলো ক্লিয়ার করার চেষ্টা করছিঃ

১) শ্রোতা স্থির,উৎস শ্রোতার দিকে গতিশীলঃ

এই ক্ষেত্রে আমাদের একেবারে উপরের সমীকরণটির দিকে তাকাও। শ্রোতা স্থির,মানে v(o) = ০ , তাই উপরের সমীকরণে শুধু v(o) = 0 বসিয়ে দিলেই এই কেসের সূত্রটি পেয়ে যাচ্ছোঃ

ডপলার

যখন শ্রোতা স্থির

২) শ্রোতা স্থির,উৎস শ্রোতার বিপরীত দিকে গতিশীলঃ

এই ক্ষেত্রে আমাদের একেবারে উপরের সমীকরণটির দিকে তাকাও। শ্রোতা স্থির,মানে v(o) = ০ , তাই উপরের সমীকরণে শুধু v(o) = 0 বসিয়ে দিতে হবে। আবার দেখো,উৎস কিন্তু এবার নিজের যেইদিকে চলার কথা তার বিপরীত দিকে চলছে,মানে এর বেগের দিকটা এবার উল্টাদিকে! আমরা সবাই জানি বেগ একটি ভেক্টর রাশি,তাই এবার v(s) এর জায়গায় বসাতে হবে -v(s) ! ব্যস! কাজ শেষ!

Doppler

শ্রোতা স্থির, উৎস দৌড়ায় উলটা দিকে!

৩) উৎস স্থির,শ্রোতা উৎসের দিকে গতিশীলঃ

এই ক্ষেত্রে আমাদের একেবারে উপরের সমীকরণটির দিকে তাকাও। উৎস স্থির,মানে v(s) = ০ , তাই উপরের সমীকরণে শুধু v(s) = 0 বসিয়ে দিলেই এই কেসের সূত্রটি পেয়ে যাচ্ছোঃ

f f'

উৎস স্থির,শ্রোতা উৎসের দিকে গতিশীল

৪) উৎস স্থির,শ্রোতা উৎসের বিপরীত দিকে গতিশীলঃ

এই ক্ষেত্রে আমাদের একেবারে উপরের সমীকরণটির দিকে তাকাও। উৎস স্থির,মানে v(s) = ০ , তাই উপরের সমীকরণে শুধু v(s) = 0 বসিয়ে দিতে হবে। আবার দেখো,শ্রোতা কিন্তু এবার নিজের যেইদিকে চলার কথা তার বিপরীত দিকে চলছে,মানে এর বেগের দিকটা এবার উল্টাদিকে! আমরা সবাই জানি বেগ একটি ভেক্টর রাশি,তাই এবার v(o) এর জায়গায় বসাতে হবে -v(o) ! ব্যস! কাজ শেষ!

ডপলার

উৎস স্থির,শ্রোতা উৎসের বিপরীত দিকে গতিশীল

৫) উৎস এবং শ্রোতা পরস্পরের দিকে গতিশীলঃ

একেবারে শুরুর সমীকরণটায় এবার কি বসবে নিজেরাই বলে দিতে পারবে। 😀 সমীকরণ যা আছে তাই থাকবেঃ

ডপলার

উৎস এবং শ্রোতা পরস্পরের দিকে গতিশীল

৬) উৎস এবং শ্রোতা পরস্পরের বিপরীতদিকে গতিশীলঃ

এইবার আমাদের মেইন ইকুয়েশনটায় বেগের দিকগুলো শুধু উলটে যাবে,মানে বেগগুলোর আগে একটি নেগেটিভ সাইন বসবে। এতে মূল সমীকরণের চেহারা যা দাঁড়াবে তা নিম্নরুপঃ

ডপলার

উৎস এবং শ্রোতা পরস্পরের বিপরীতদিকে গতিশীল

আমার আসল উদ্দেশ্যটাি ছিলো যাতে সমীকরণ নিয়ে কারো কোনো রকম গণ্ডগোল না বাঁধে,যাতে সবাই এগুলো সহজেই আত্মস্থ করতে পারে! ৬টা আলাদা আলাদা কেইসের ক্ষেত্রে সমীকরণগুলো আসলে কেমন হবে তা একটি সমীকরণ মনে রাখলে আর বেগ যে ভেক্টর রাশি তা মনে রাখলেই হয়ে যায়,বাড়তি মুখস্থ করার কোনো ঝামেলায় যেতে হয়না।

কয়েকটা গুরুত্বপূর্ণ কথাঃ

১) ডপলার ইফেক্ট সেইদিকেই অনুভূত হবে,শ্রোতা বা উৎসের যেদিকে আপাত বেগ বিদ্যমান। একটি এম্বুলেন্স সাইরেন বাজাতে বাজাতে পূর্ব দিকে এগিয়ে যাচ্ছে,তুমি এম্বুলেন্সের উপর দাঁড়িয়ে লাফাচ্ছো ধরো। তোমার লাফের দিক অবশ্যই এখানে উত্তরদিক বরাবরই হবে। যেহেতু উৎস আর শ্রোতার বেগের মাঝে কোণের তফাৎ ৯০ ডিগ্রী,তাই এখানে ডপলার ইফেক্ট খাটবেনা।

২) শ্রোতার বেগের চাইতে উৎস থেকে উৎপন্ন শব্দের বেগ কম হলে ডপলার ইফেক্ট খাটবেনা।

৩) লোহিত ভ্রংশের নাম শুনেছো নিশ্চয়ই। এটি আলোর ডপলার ইফেক্ট ছাড়া আর কিছুই না। চিত্রটা দেখোঃ

লোহিত ভ্রংশ

ছবি কৃতজ্ঞতাঃ গুগল

চেপে যাচ্ছে যে পাশে তরঙ্গটা,সেপাশে আলোর রং হয়ে যাবে নীল ( নীল আলোর তরঙ্গ দৈর্ঘ্য সবচেয়ে কম ) । আর যে পাশে আলোক তরঙ্গটা সবচেয়ে বেশি বেড়ে গেছে,মানে টেনে বড় করে দেয়া হয়েছে ( ডানপাশে ) , সেই পাশটার আলো দেখা যাবে লাল ( লাল আলোর তরঙ্গ দৈর্ঘ্য সবচেয়ে বেশি ) । তাই আমরা যদি দেখি আমাদের পৃথিবীর সাথে কোনো নক্ষত্র বা যেকোনোকিছুর আপেক্ষিক বেগ মাপার সময় যে নির্গত তরঙ্গের আলোটা লাল ধরণের,তাহলে বুঝতে হবে যে নক্ষত্রটি আমাদের পৃথিবী থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। আর উল্টোটা হলে নীল আলোই দেখতে পাবো। ( আমাদের জন্য এটি ভয়ানক,তাই না? 😐 )

৪) উৎস যদি তার নিজের সৃষ্ট তরঙ্গের বেগেই শ্রোতার কাছে এগিয়ে আসলে আপাত কম্পাংক হবে অসীম

কিছু লিংকঃ

১) https://www.youtube.com/watch?v=dc7l7Qqa8xk

২) https://www.youtube.com/watch?v=h4OnBYrbCjY

ডপলার ইফেক্টের দরূণ প্রকৃতিতে অনেক সুন্দর সুন্দর ঘটনা ঘটে চলেছে। ইন্টারনেটের যুগে এগুলোর কিছুই এখন অজানা নয়। তোমরাও এই জগত থেকে নিজেদের বঞ্চিত রেখো না। জানার জগতে,শেখার জগতে সবাই সুখী থেকো।