হেপাটাইটিস বি (হেপ-বি):
হেপাটাইটিস বি ভাইরাস (হেপ-বি) বিশ্বের মারাত্নক দশটি ভাইরাসের মধ্যে অন্যতম। প্রায় সকল দেশেই এর প্রাদুর্ভাব রয়েছে (চিত্র ১ এবং লিংক ১)। বিশ্বে প্রায় ২৪০ মিলিয়ন মানুষ এইচ আইভি আক্রান্ত, আরেক হিসেব মতে ৩৪০ মিলিয়ন। হেপ-বি এর আক্রমণে হেপাটাইটিস হয় যা পরে লিভার সিরোসিস এবং আরো অবনতিতে লিভার ক্যান্সারে রূপ নিতে পারে; প্রতি বছর প্রায় ৬/৭ লাখের বেশি মানুষ হেপ-বি সংক্রমণঘটিত জটিলতায় ভুক্তভুগী হয়।
হেপাটাইটিস কি:
হেপাটাইটিস হচ্ছে লিভার বা কলিজায় প্রদাহ।
হেপাটাইটিস বি ভাইরাস:
হেপাটাইটিস বি(হেপ-বি) ভাইরাস হচ্ছে ভয়ানক অদ্ভূত সৌন্দর্য্য। ভয়ানক কারণ, মাত্র একটি আক্রমণক্ষম ভাইরাস লিভার কোষকে আক্রমণ করে ভয়াবহ সংক্রমণ করতে সম্ভব। অদ্ভূত কারণ, আবরণীবদ্ধ(এনভেলপড) ভাইরাস কিন্তু তাপ, আর্দ্রতা এবং শুষ্কতা দ্বারা অতটা ক্ষতিগ্রস্ত হয় না। সৌন্দর্য্য কারণ, হেপ-বি এর জীবন-চক্র(সংখ্যাবৃদ্ধি চক্র) অন্তত জটিল। হেপ-বি রিভার্স ট্রান্সক্রিপশন পদ্ধতি ব্যবহার কিন্তু এটি রেট্রোভাইরাস নয়।
রিভার্স ট্রান্সক্রিপশন হচ্ছে আরএনএ থেকে ডিএনএ তৈরি করা যেখানে সকল প্রাণীতে(কিছু ভাইরাস এবং ব্যতিক্রম ব্যতীত) ডিএনএ থেকে আরএনএ এবং পরে আরএনএ থেকে প্রোটিন হয়। এটাকে সেন্ট্রাল ডগমা বা মূল-মতবাদ বলা হয়। কোষের ভিতরে এর জিনোম সিসিসিডিএনএ(কোভেলেন্টলি ক্লোসড সার্কুলার ডিএনএ) হিসেবে থাকে। সংক্ষেপে বলা যায়, হেপ-বি ভাইরাসদের মধ্যেও আজিব যেখানে ভাইরাস নিজেরাই আজিব।এর বিবর্তনও অনেকটাই বোধগম্য নয়। ধারণা করা হয়, মানুষে এই ভাইরাস প্রায় ১৫০০ বছরের আগে বিবর্তিত হয়ে আসে। এভিহেপাডিএনএভাইরাসে(যে হাঁস বা পাখির হেপাটাইটিস ভাইরাস) এইচবিএক্স জিন(হেপাটাইটিস বি- এক্স প্রোটিন) থাকে না যা অর্থোহেপাডিএনএ ভাইরাসে থাকে। এইচবিএক্স প্রোটিন খুব জটিল, দুর্বোধ্য এবং কোষের অনেক কিছু নিয়ন্ত্রণ করে। মজার ব্যাপার হলো, এই প্রোটিন ভাইরাসের সংখ্যাবৃদ্ধির জন্য জরুরী নয় তবুও এই জিন ভাইরাস বহন করে। এই জিনে মিউটেশনের সংখ্যা অনেক বেশি এবং এই প্রোটিন দিয়ে কোষের বিভিন্ন বিপাকীয় ক্রিয়াকৌশল(পাথওয়ে) নিয়ন্ত্রিত হয়। এই জীন মানুষের ডিএনএতেও সংযুক্ত হয়ে যায় যা ধারণা করা হয় লিভার ক্যান্সারের প্রথম দিকের ধাপ হিসেবে কাজ করে।
হেপ-বি ভাইরাসের জিনোম হচ্ছে বৃত্তাকার(সার্কুলার) এবং প্রায় ৩২০০ নিউক্লিউটাইড নিয়ে গঠিত। যেহেতু চক্রাকার তাই হেপ-বি এর ওআরএফ(প্রোটিন তৈরির দিক এবং শুরুর স্হান) ওভারল্যাপিং (সমাপতিত)। অর্থাৎ একই ডিএনএ সিকুয়েন্সকে(বিন্যাস) বিভিন্নভাবে ব্যবহার করে হেপ-বি অনেক প্রোটিন তৈরি করতে পারে। প্রধানত চারটি জিন থাকে সি(কোর), এস(সারফেস), পি(পলিমারেজ) এবং এক্স (এইচবিএক্স)। সারফেস প্রোটিনের তিনটি ওআফের জন্য তিনিটি ভিন্ন সাইজের প্রোটিন তৈরি হয়, প্রিএস-১, প্রিএস-২ এবং এস। এছাড়াও আর ও কিছু নন কোডিং আরএন এ এলিমেন্টও পাওয়া গেছে।
সংখ্যাবৃদ্ধি কৌশল:
হেপাটাইটিস শুধু লিভার এর কোষ হেপাটোসাইটকে আক্রমণ করে। হেপ-বি ভাইরাস হেপাটোসাইটের বিশেষ রিসেপ্টরে বন্ধন করে কোষে প্রবেশ করে(সম্প্রতি এনটিসিপি রিসেপ্টরকে সনাক্ত করা হয়)। কোষে প্রবেশ করে হেপ-বি এর ডিএনএ কোষে উন্মুক্ত করে। কিন্তু এই ডিএনএ আংশিক দ্বিসূত্রকার থাকে(রিলাক্সড সার্কুলার ডিএনএ=আরসিডিএনএ) থাকে, তাই হেপবি এটাকে দ্বিসূত্রাকার(ডাবল স্ট্র্যান্ডেড) করে। তখন এটাকে বলে সিসিস-ডিএনএ। এই প্রক্রিয়া ঘটে নিউক্লিয়াসে। এই সিসিসি-ডিএনএ বাকি জিনগুলোর জন্য টেমপ্লেট হিসেবে কাজ করে এবং ভাইরাসের পলিমারেজ এই কাজ করে। ভাইরাস প্রোটিন এবং ডিএনএ সেলের সাইটোপ্লাজমে প্যাকেজ হয়। প্যাকেজ হওয়া ভাইরাস আক্রমণক্ষম। যেসব ভাইরাস কোষ থেকে বের হয় তারা নতুন কোষকে আক্রমণ করে আর বের না হলে নিউক্লিয়াসে ফেরত আসে। এর মাধ্যমে আরো নতুন ভাইরাস ভাইরাস তৈরির জোগান দেয়। কিছু আরএনএ(লম্বা) সাইটোপ্লাজমে ফেরত আসে যা ভাইরাসের পলিমারেজ এর রিভার্স ট্রান্সক্রিপশন ক্ষমতার মাধ্যমে ডিএনএ তৈরি করে। এভাবে কোষের ভিতর আক্রমণকারী হেপ-বি ভাইরাস তার সংখ্যাবৃদ্ধি করে।
হেপ-বি ছড়ানোর কৌশল:
হেপাটাইটিস ভাইরাস দেহের বাইরে সাতদিন পর্যন্ত সক্রিয় থাকতে পারে অর্থাৎ সাতদিন খোলা অবস্হায় বাইরে থাকা ভাইরাস সংক্রমণ করতে সক্ষম। আক্রান্ত রক্তের সংস্পর্শে আসলে যদি কোনভাবে ভাইরাস শরীরে প্রবেশ করে তবে তা সংক্রমণ করতে সক্ষম। তাই রক্তের মাধ্যমে এটি ছড়ায়। তবে মশার মাধ্যমে ছড়ায় না। একই সিরিঞ্জ-সূঁচ ব্যবহারে (বিশেষ করে যারা ড্রাগস বা নেশা এভাবে করেন) ছড়ায় যদি আক্রান্ত ব্যক্তি ঐ একই সিরিঞ্জ-সূঁচ ব্যবহার করেন। আক্রান্ত ব্যক্তির সাথে যৌন-সঙ্গম মুখমেহন (ওরালসেক্স), যোনিসঙ্গম(ভ্যাজাইনাল সেক্স), পায়ুসঙ্গম (এনালসেক্স)) এবং মা থেকে বাচ্চাতে ছড়ায় (জন্মের সময় মা থেকে শিশুতে )। আক্রান্ত স্বামী থেকে স্ত্রীতে একই ভাবে স্ত্রী থেকে স্বামীতে ছড়ায়। এমনকি থুতু(একই টুথব্রাশ-ব্যবহার) বা পিরিয়ডে রক্ত থেকেও ছড়াতে পারে। একই ব্লেড বা রেজরে(যদি হেপ-বি এর রক্ত থাকে তবে) ছড়াতে পারে। দাঁতের ডাক্তারের যন্ত্রপাতি যদি হেপ-বি আক্রান্ত রক্ত দ্বারা দূষিত থাকে তবে ছড়াতে পারবে। এখানে বলে রাখা ভালো, একই বাসন-কোসন ব্যবহার করা, পানি, জড়ানো বা চুমু খাওয়া, স্পর্শতে হেপ-বি ছড়ায় না। থুতু বা বুকের দুধে হেপাটাইটিস বি(ই এন্টিজেন) অল্প পরিমাণে পাওয়া গেলেও এভাবে কখনো ছড়ানোর ইতিহাস নাই। তাই থুতু বা বুকের দুধের মাধ্যমে ছড়ানো সম্ভবনা অনেক অনেক কম।
বাংলাদেশে হেপাটাইটিস বি:
বাংলাদেশে অধিকাংশ মানুষ মনে করে লিভার ক্যান্সার বা সিরোসিস একমাত্র মদ্যপানের কারণে হয়ে থাকে। হেপাটাইটিস বি সম্পর্কে সচেতনতা কম এবং টিকার দাম বেশি হওয়ায় টিকা নিতে অধিকাংশ অনিচ্ছুক। ২০০৮ সালের এক গবেষণায় ১০১৮ জনের মধ্যে ৫.৫% হেপাটাইটিস বি পজিটিভ পাওয়া যায় (লিংক ২)। ১৬ কোটি মানুষের মধ্যে আরো বেশি হবে আশা করা যায়। প্র্ধান কারণ হিসেবে একই সূচ/ব্লেড ব্যবহার এবং কবিরাজদের(যারা ভন্ড) মাধ্যমে অপচিকিৎসা। মুসলমানী করানোর জন্য যারা হাজম দিয়ে করান তাদের সম্ভাবনা বেশি আক্রান্ত হবার। বেশি পুরুষ হেপ-বি পজিটিভ দেখা যায় (জীবন-যাপন পদ্ধতির জন্য)। পরিশেষে, বাংলাদেশে হেপাটাইটিস বি নিয়ে সচেতনতা বাড়ুক এই আশা করি। বাচ্চা জন্ম নিবার পর হেপাটাইটিস বি এর টিকা নিয়ে সন্তানকে সুরক্ষিত করুন।
লিংক: ১ (এখানে ক্লিক করুন)
লিংক :২ (এখানে ক্লিক করুন)
কাভার চিত্র: ইউনিভার্সিটি অব উইনকনসিন-মেডিসনের ওয়েবসাইট থেকে
পুনশ্চ:
- ১. সহজভাবে বোঝানোর জন্য সহজ ভাষায় লিখার চেষ্টা করেছি। অনেক সায়েন্টিফিক টার্ম বাদ দিয়েছি। যথাসম্ভব বাংলায় লিখার চেষ্টা করেছি।
- ২. আরো প্রশ্ন থাকলে কমেন্ট সেকশনে করতে পারেন বা মেসেজ জানাতে পারেন। জানার জন্য কোন লজ্জা বা ভয় থাকা উচিত না।
- ৩. বড় পোষ্টের জন্য দু:খিত। আশা করি, অধিকাংশ ভুল ধারণা দূর হবে।
- ৪. ভুল-ত্রুটি কমেন্টে উল্লেখ করলে খুবই খুশি হবো।
- ৫. ব্যকরণগত ত্রুটি এবং ভুল শব্দের প্রয়োগ থাকতে পারে।
ধন্যবাদ
মীর মুবাশ্বির খালিদ
গ্রাজুয়েট স্টুডেন্ট, দি জে. ডেভিড গ্লাডস্টোন ইন্সটিটিউট, সান-ফ্রান্সিসকো, ইউনাইটেড স্টেটস অব আমেরিকা।
পিএইচডি ক্যান্ডিডেট, ইরাসমাস মেডিকেল সেন্টার, দি নেদারল্যান্ডস।
হেপাটাইটিস বি ভাইরাস ইনফেকশনের চিকিৎসা কি