সম্ভাবনা বা Probability নিয়ে একটা প্রচলিত কৌতুক আছে, এক ব্যক্তি কখনোই বিমানপথে ভ্রমন করতে চান না। তার যুক্তি, কোনো প্লেনে একটা বোমা থাকার সম্ভাবনা ০.১% , এতটা ঝুকি নিয়ে প্লেনে ওঠার কোনো মানে হয়না। তো একদিন দেখা গেলো  ভদ্রলোক বেশ নিশ্চিন্ত মনে প্লেনে উঠে বসে আছেন। তার পরিচিত একজন তাকে প্লেনে দেখে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, “আরে ভাইসাহেব, কোপা আমেরিকার ফাইনালটা দেখেছেন??”

তো যাই হোক,  কোপা নিয়ে আলোচনা শেষ হবার পর পরিচিত ব্যক্তি আবার জিজ্ঞেস  করলো, “ব্যাপার কি? আপনি হঠাৎ বোমার ভয় ভুলে প্লেনে উঠলেন যে?”
ভদ্রলোক আনন্দে ডগমগ হয়ে উত্তর দিলেন, “বুঝলেন ভাই, যদিও প্লেনে একটা বোমা থাকার সম্ভাবনা অনেক, প্রায় ০.১%। কিন্তু দুটো বোমা থাকার সম্ভাবনা খুবই কম- মাত্র ০.০০০১%। আর আমি তো একটা বোমা আমার সাথে করেই নিয়ে এসেছি, একই প্লেনে আরেকটা থাকার প্রশ্নই ওঠে না! 😎 “

বোঝাই যাচ্ছে লজিকে কোথাও একটা বড় গোলমাল হয়ে গিয়েছে, কিন্তু গোলমালটা কোথায়?


তো গোলমাল গোলমালের জায়গায় থাকুক, আমরা সম্ভাব্যতা নিয়ে কথাবার্তা বলতে শুরু করি। সম্ভাব্যতা শব্দটা শুনতে যত কঠিন কঠিন লাগে আসলে কিন্তু তত কঠিন কিছু নয়। সত্যি বলতে আমরা আমাদের প্রতিদিনকার জীবনেই এই শব্দটি অসংখ্যবার ব্যবহার করি। যেমন “আজকে বৃষ্টি হবার সম্ভাবনা কত?” জাতীয় প্রশ্ন আমরা সবসময়েই করি। উত্তরগুলোও আমাদের পরিচিত,
“শতভাগ! কারন এখনি বৃষ্টি হচ্ছে -_- ।”
অথবা
“মোটামুটি, আকাশে তো ভালই মেঘ আছে দেখা যায়” ।

গণিতেও সম্ভাব্যতা ঠিক একই অর্থে ব্যবহৃত হয়, পার্থক্য হল গণিতে “মোটামুটি” বা  “হতে পারে” জাতীয় উত্তরের কোনো দাম নাই, কাজেই আমাদের সুনির্দিষ্ট একটা উত্তর বের করতে হবে যা নিখুঁতভাবে কোনো একটি ঘটনা ঘটতে পারে কিনা তার সম্ভাব্যতাটি প্রকাশ করবে।

সম্ভাব্যতা নির্ণয় করার একেবারে বেসিক সূত্র একটাই, সহজ ভাষায় সেটাকে আমরা বলতে পারিঃ

সম্ভাব্যতা = যেসব ফল পেলে আমার ভাল লাগবে/মোট যতগুলো ফল আসতে পারে

Probability

যেমন ধরি এখন ক্রিকেট বিশ্বকাপ শুরু হল যেখানে বাংলাদেশ সহ ১৬টা দেশ অংশ নিচ্ছে। এখন যদি এখানে আর কোনো ফ্যাক্টর কাজ না করে, অর্থাৎ সবগুলো দেশ যদি সব দিক দিয়েই সমান সমান হয়, তাহলে বাংলাদেশ এর বিশ্বকাপ জেতার সম্ভাবনা কতটুকু?
*
প্রথমের দেখা যাক কি কি ঘটতে পারে,
বাংলাদেশ বিশ্বকাপ জিততে পারে, অস্ট্রেলিয়া জিততে পারে, পাপুয়া নিউগিনিও জিততে পারে (ওরাও খেলায় আছে :3 )। সোজা কথা ১৬টা দেশের যে কেউ জিততে পারে। অর্থাৎ মোট ১৬টা ভিন্ন ভিন্ন রেজাল্ট আমরা পেতে পারি।
কিন্তু কোন রেজাল্টটা  আমরা খুঁজছি?
যেহেতু আমরা বাংলাদেশের সম্ভাবনা বের করছি, কাজেই বাংলাদেশ জিতলেই আমাদের ভাল লাগবে। সুতরাং ১৬টা সম্ভাব্য আউটকাম এর  মধ্যে আমাদের কাঙ্ক্ষিত হচ্ছে শুধু মাত্র ১টি আউটকাম। সুতরাং বাংলাদেশের বিশ্বকাপ জেতার সম্ভাবনা হল ১/১৬
*
এখন যদি আমরা বের করতে চাই বাংলাদেশ অথবা পাপুয়া নিউগিনির বিশ্বকাপ জেতার সম্ভাবনা কত, তাহলে কী হবে?
দেখা যাচ্ছে মোট সম্ভাব্য ফলাফলের সংখ্যায় কোনো পরিবর্তন হয়নি, এখনো ১৬টা ভিন্ন ভিন্ন ফলাফল আমরা পেতে পারি।
কিন্তু, এখন শুধু বাংলাদেশ না, পাপুয়া নিউগিনি বিশ্বকাপ জিতলেও আমরা খুশি থাকব কাজেই আমাদের ভাললাগার ফলাফলের সংখ্যা ১টি থেকে বেড়ে হয়ে গিয়েছে ২টি।
সুতরাং বাংলাদেশ অথবা পাপুয়া নিউগিনির বিশ্বকাপ জেতার সম্ভাবনা = ২/১৬ = ১/৮।  😀
*
আচ্ছা এবার আমরা চাই বাংলাদেশ আর পাপুয়া নিউগিনি দুই দলই বিশ্বকাপ জিতুক। তাহলে সেটার সম্ভাবনা কত?
সেটার সম্ভাবনা হবে শূন্য। কারন এখন আমরা ছোট বাচ্চাদের মত অসম্ভব জিনিস চাচ্ছি। যেহেতু দুই দল একই সাথে ট্রফি জিততে পারেনা (আমরা ধরে নিচ্ছি ফাইনাল টাই হবে না) তাই আমরা কখনোই আমাদের পছন্দমত রেজাল্ট পাবো না। সুতরাং সম্ভাবনা = ০/১৬ = ০ 
এ জাতীয় ঘটনাগুলোকে বলা হয় অসম্ভব ঘটনা। 
*
এখন আমরা একটু উদার মানসিকতা ধারন করে দাবী করলাম যে আমাদের কোনো নির্দিষ্ট দলের প্রতি সমর্থন নাই, ঐ ১৬টা দলের যেকোনো একটা দল বিশ্বকাপ জিতলেই আমরা খুশি। তো এমনটা হবার সম্ভাবনা কত?
এখনো আমাদের সম্ভাব্য মোট ফলাফলের সংখ্যা ১৬। এবং এই ১৬টি ফলাফলের কোনোটা নিয়েই আমাদের কোনো সমস্যা নাই, যেহেতু সবগুলোই আমাদের শর্ত পূরণ করে ( সত্যি বলতে আমরা কোনো শর্তই দেইনি, একটা দল জিতলেই হলো)।
সুতরাং নির্ণেয় সম্ভাবনা ১৬/১৬ = ১।
এই জাতীয় ঘটনাগুলোকে বলা হয় নিশ্চিত ঘটনা।

 

[সাইডনোটঃ এই পর্যায়ে এসে আমাদের কিছু থিওরীর কচকচানি পড়া উচিত। সম্ভাব্যতার ওপর মুন্তাসির-এর লেখা আরেকটি আর্টিকেল-এ বিভিন্ন থিওরেটিক্যাল টার্ম ও সংজ্ঞা কাভার করা হয়েছে যেগুলো সম্ভাব্যতা ভাল করে বোঝার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। আর্টিকেলটি এখানে ক্লিক করলে পড়া যাবে। ]


সম্ভাব্যতার চারটি সূত্র আছে। এগুলো অবশ্য একটু চিন্তা করলে এমনিতেই বুঝতে পারা যায়, কাজেই সূত্র হিসেবে মনে রাখার প্রয়োজন নেই।

০১. নিশ্চিত ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা “১” 
যেমন একটি ক্রিকেট ম্যাচে বাংলাদেশের হারার অথবা জেতার অথবা ড্র করার সম্ভাবনা কত? এটি একটি নিশ্চিত ঘটনা, যেহেতু জেতা অথবা হারা অথবা ড্র করা ছাড়া আর কোনো ফলাফল নেই। ম্যাচের ফলাফল যা ই হোক না কেন, ফলাফলটি আমাদের শর্তকে সন্তুষ্ট করবে। এক্ষেত্রেঃ-  “মোট যেসব ফলাফল আসতে পারে = যেসব ফলাফল আসলে আমরা খুশি হব”।

সুতরাং সম্ভাবনা = ১।

০২. অসম্ভব ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা শূন্যঃ 
অসম্ভব ঘটনার ক্ষেত্রে কখনোই আমাদের কাঙ্ক্ষিত শর্ত পূরন হবে না। অর্থাৎ “যেসব ফলাফল আসলে আমরা খুশি হব = ০”, কাজেই সম্ভাবনাও শূন্য
যেমন ক্রিকেট বিশ্বকাপে বাংলাদেশের ৬ গোল দেয়ার সম্ভাবনা শূন্য।  😐

০৩. কোনো ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা ০ থেকে কম নয় এবং ১ এর থেকে বেশি নয়ঃ
ফলাফলের সংখ্যা যেহেতু ঋণাত্মক হতে পারে না, কাজেই কোনো ঘটনা ঘটার সম্ভাবনাও ঋণাত্মক হবে না। কাজেই সম্ভাবনার সর্বনিম্ন মান ০ (অসম্ভব ঘটনার ক্ষেত্রে)। আবার কাঙ্ক্ষিত ফলাফল এর সংখ্যা বড়জোর সম্ভাব্য মোট ফলাফলের সমান হতে পারে, কিন্তু মোট ফলাফলের সংখ্যার চেয়ে বেশি হতে পারে না। তাই সম্ভাবনার সর্বোচ্চ মান ১।

০৪. কোনো ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা X এবং না ঘটার সম্ভাবনা Y হলে X+Y=১ঃ
এটার প্রমাণটা খুবই সোজা, প্রমাণ করে ফেলি। ধরলাম কোনো একটি ঘটনায় মোট Pটা ভিন্ন ভিন্ন ফলাফল আসতে পারে  এবং এই Pটার মধ্যে Qটা নির্দিষ্ট ফলাফল আমাদের কাঙ্ক্ষিত ফলাফল। তার মানে অবশ্যই বাকি যে (P-Q)টি ফলাফল রয়েছে সেগুলো আমাদের কাঙ্ক্ষিত নয়।
এখন আমাদের সম্ভাব্যতা নির্ণয়ের সূত্র অনুসারে, কাঙ্ক্ষিত ফলাফল আসার সম্ভাবনা X = Q/P
এবং কাঙ্খিত ফলাফল না আসার সম্ভাবনা Y = (P-Q)/P
X এবং Y যোগ করে পাই X + Y = (Q+P-Q)/P = (P/P) = ১

এ জাতীয় ঘটনাগুলোকে বলা হয় পরিপূরক(Complementary) ঘটনা, যাদের সম্ভাবনার যোগফল এক। এখানে X এবং Y পরিপূরক।

একটা উদাহরণও দেয়া যাক। মনে করি একটা ট্রে তে লাল, নীল, হলুদ এই তিন রঙ এর তিনটা কাচের মগ আছে। একটা বাচ্চা চোখ বন্ধ করে যদি একটা মগ নিয়ে আছাড় মেরে ভেঙ্গে ফেলতে চায়, তাহলে তার লাল মগটা ভাঙ্গার সম্ভাবনা কতো?
আমাদের প্রথম কাজ হলো সম্ভাব্য ফলাফলগুলো কী কী তা দেখা।
এখানে সম্ভাব্য ফল তিনটাঃ হয় লাল মগ ভাংবে, নাহয় নীল, নাহয় হলুদ। এই তিনটা ফলাফল এর মাঝে একটি ফলাফল আমাদের পছন্দ (যেটাতে লাল মগ ভাংবে) , এবং দুটো ফলাফল আমাদের পছন্দ না (যে দুটাতে হলুদ আর নীল মগ ভাংবে )।
কাজেই লাল মগটা ভেংগে যাবার সম্ভাবনা  = ১/৩ এবং না ভাঙ্গার সম্ভাবনা ( অর্থাৎ হলুদ বা নীল মগ ভাঙ্গার সম্ভাবনা) = ২/৩
এখন (১/৩) + (২/৩) = ১।

আশা করি বোঝাতে পেরেছি। 😀


এখানেই প্রথম পর্বের সমাপ্তি। 😀
সামনের পর্বগুলোতে আমরা আরেকটু শেখার চেষ্টা করবো, এবং সমস্যা সমাধান করতে শুরু করব। 😀