এইচএসসি পরীক্ষা শেষ, এর রেজাল্ট ঘিরে উৎকণ্ঠা এখন পরীক্ষার্থীদের মাঝে যতটা না প্রকট, তার চেয়ে বেশি দুশ্চিন্তা সম্মুখের আরেকটি মহারণ নিয়ে। সে মহাযুদ্ধের নাম ভর্তি পরীক্ষা। এর আগে কী করব, কীভাবে পড়ব এসব বুঝে উঠতে উঠতেই গলদঘর্ম হতে হচ্ছে সকলকে। যারা নিজেদের করণীয় নিয়ে এখনো খানিকটা দ্বিধান্বিত, কিংবা ভাবছ কিছু সস্তা টিপস পেলে মন্দ হত না – তাদের জন্যই এই আর্টিকেলটা লেখা।

উল্লেখ্য, বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের বিজ্ঞান অনুষদ, ইঞ্জিনিয়ারিং, কিংবা মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার জন্য যারা লড়তে যাচ্ছ তারাই কিছু মানসিক ও স্ট্র্যাটেজি সম্বন্ধীয় সাহায্য পাবে এখান থেকে।

ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি কীভাবে নেওয়া উচিত – এ চিন্তা মাথায় আসলেই সবার আগে যে কমন প্রশ্নটা সবাই করে সেটা হল দৈনিক কতক্ষণ পড়ব? অনেকেই এর উত্তরে সোজা দশ বারো ঘন্টা বলে দেন। উত্তরটা খারাপ নয়, কিন্তু এখানো আরো অনেক কিছু ব্যাখ্যা করার আছে। তুমি আসলে পড়বে বা নির্দিষ্ট করে বললে শিখবে ততক্ষণই যতক্ষণ না একটা টপিক সম্পর্কে তোমার স্বচ্ছ ধারণা তৈরি হয়। তুমি যদি বেশ ফাঁকি দিয়ে আসো কলেজে, তবে তোমার অনেকটা সময় যাবে নতুন জিনিসগুলো আত্মস্থ করার পিছনে, আর যদি আগে থেকেই মোটামুটি ভাল রকম ধারণা থাকে সবকিছুর উপর, তুমি চেষ্টা করবে সেই ধারণাকে নতুন নতুন সমস্যা ফেস করার মাধ্যমে আরও পাকাপোক্ত আর বদ্ধমূল করতে। মোটকথা, তুমি ততক্ষণই নিজেকে পড়াশোনায় ব্যস্ত রাখবে যতটুকু সময় দিলে তুমি একটা টপিক বা অধ্যায় সম্পর্কে  নিজের দক্ষতায় আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠতে পারবে, কোনোরকম কনফিউশন তোমার মনে কাজ করবে না। এজন্য ছয় ঘন্টা লাগলে তাই ছয় ঘন্টাই পড়বে, ষোল ঘন্টা লাগলে ষোল ঘন্টা পড়বে। যারা পিছিয়ে আছ বলে মনে করছ, তাদের হাল না ছেড়ে কষ্ট করতে হবে আরো বেশি। অতি আত্মবিশ্বাসীরা অনেক সহজ প্রবলেম হয়ত দেখেই “পারব” বলে স্কিপ করে যাবে, কিন্তু তোমাকে শুরু করতে হবে বেজমেন্ট থেকেই। পরীক্ষায় সেরকম একটা সমস্যা আসলে তুমি খুশি হবে কারণ সেটা তোমার কমন, কিন্তু সুপার আত্মবিশ্বাসী ছেলেটা খটকা খাবে কারণ এটা দেখে সে এড়িয়ে গেছে, সে কিছুটা বাঁধবে তা সমাধানের সময়। সুতরাং, অতশত না ভেবে নিজের রাস্তা যথাসম্ভব মসৃণ করার দিকে মনোযোগ দিতে হবে।

অনেকেই এসময় অসহায় চেহারা করে বলে, অমুক জায়গার অমুক পরীক্ষাগুলোতে তো ভাল করতে পারছি না, তাহলে আমি কি পারব? এর উত্তর হল, তুমি কী পারবে বা পারবে না এটার সিদ্ধান্ত নেবার সময় কি তোমার হাতে এখনই এসে গেছে? যে প্রশ্নে তুমি আজ পরীক্ষা দিচ্ছ, তা তোমার চলমান ত্যাগস্বীকারকে মূল্যায়ন করতে পারছে এমনটা তো নয়। এই পরীক্ষাগুলোকে তাই চর্চা হিসেবেই নাও, নিজেকে পরখ করার আয়না হিসেবে নয়। অনেক হোঁচট খাবে, তা থেকে শিখবে – এর হাত ধরেই আসবে যথার্থ যে ফল, সেটা। সুতরাং চেষ্টার আগে এখনই ফলাফলকে স্থান দিও না। কারণ হতাশা একবার মনে ঢুকে গেলে, এ থেকে নিস্তার পাওয়া খুবই কঠিন।

যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিতে যাচ্ছ, তাদের জন্য বেশ ভাল একটা উপায় হতে পারে শুরুতেই কলেজের পাঠ্যবইগুলো আবার রিভিউ করে নেওয়া। রিভিউ অর্থ এই নয় যে পরীক্ষার আগের রাতে যেরকম রিভিশন দিতাম তেমন। বইয়ের অনুশীলনীর প্রবলেমগুলো কি সব করেছিলে কলেজ জীবনে? না করে থাকলে একটা একটা করে সেগুলোর সামনে আবার দাঁড়াও। একদিন বা দুইদিন সময় নিয়েই হোক – সেগুলোর উত্তর খোঁজার চেষ্টা কর চ্যাপ্টার ওয়াইজ। এলিমেন্টারি এই কাজগুলো সফলতার সাথে শেষ করতে পারলে অনেক আত্মবিশ্বাস বাড়বে। অনেকে বলবে, এত সময় কোথায় এসব করার? সময় আছে, এবং সময় তোমাকেই বানিয়ে নিতে হবে। এসময় একটা রুটিন থাকা ভাল। যদি এদিকটা একেবারেই মিনিমাইজ না করলেই নয় অবস্থা দাঁড়ায় – তবে একটা একটা স্কিপ করে সলভ কর। ৩ এর পর ৫ কর, ৫ এর পর ৭ ধর। তবে মনে রাখবে যত বেশি প্রবলেম দেখবে, চর্চা হবে তত বেশি আর অভিজ্ঞতা বাড়বে।

অমুক জায়গা থেকে এত্তগুলা লেকচার শিট পেয়েছি, এগুলা দেখব না? এগুলো দেখা সম্পূর্ণ তোমার ইচ্ছা। যদি তোমার ধারণক্ষমতা ভাল হয়, গো ফর ইট। বিশেষ করে যারা ইঞ্জিনিয়ারিং এর জন্য পড়ছ, তাদের এই জিনিস থেকে বেশ লাভ হতে পারে। তবে কঠিন কঠিন জিনিস চর্চা করতে গিয়ে তোমার চিন্তার সিমপ্লিসিটি নষ্ট করে ফেলো না। অনেক তুখোড় ছেলেই সহজ সমস্যাকে পেঁচিয়ে নিজের জন্য ফাঁদ রচনা করে কেবল উচ্চমাত্রার চিন্তাশক্তির প্রতিফলন ঘটানোর জন্য। তোমাকে বুঝতে হবে, সবসময় বেসিকটা আঁকড়ে থাকাই বেস্ট। বেসিক মনে থাকলে তুমি সবকিছু সহজ দেখবে, একসময় দেখবে প্রবলেমই তোমাকে বলে দিচ্ছে কী করতে হবে। সুতরাং তুমি দুর্বল? বেসিক সর্বাগ্রে স্ট্রং কর। তুমি সবল? বেসিক আবার দেখ, তা ভুলে যেও না, যে বন্ধুটার সাথে প্রতিদিন ক্লাস করতে যাও, তাকে শেখানোর চেষ্টা করে দেখ তো, তুমি কতটা ফ্লুয়েন্ট এতে।

সবকিছুর উত্তর যে পরীক্ষার হলে তোমার কাছে থাকবে – এমনটা ভাবা ভুল। মনে রাখতে হবে, প্রশ্ন ভুল দাগিয়ে আসার চেয়ে তা ছেড়ে আসা অনেক কার্যকর। প্রশ্নকে শ্রদ্ধা করে তাকে ছেড়ে আসলে তোমার মর্যাদা কমবে না। বুয়েটে যখন ১২০ মার্কস এর অবজেকটিভ পরীক্ষা হত, তখনকার এক গল্প বলি। আমার পরিচিত এক ভাই ১২০ এর ভেতর ৯০টার উত্তর করতে পেরেছিলেন। পরীক্ষা শেষ হবার পর, সামনের ছেলেকে পরীক্ষা কেমন হয়েছে জিজ্ঞাস করতেই তার আক্কেল গুড়ুম, সে বান্দা ১১৮ টা উত্তর করেছে। খানিকটা বিষণ্ন হয়ে তিনি হাত মেলালেন বুয়েটে ফার্স্ট হতে যাওয়া সেই ছেলের সঙ্গে, সেই সাথে কায়দা করে তার রোলটাও জিনি আসলেন যাতে রেজাল্ট দেখতে পারেন। রেজাল্টের দিন সেই ছেলের নাম মেরিট লিস্টে খুঁজে পাওয়া যায় নি, পরিচিত ঐ ভাই কিন্তু ঠিকই টিকেছিলেন। কিংবা নিজের পাগলামির কথাও আমি বলতে পারি, মেডিকেল পরীক্ষার প্রথম ৫৭ মিনিটে আমি প্রশ্ন দাগিয়েছিলাম ৮২টা, শেষ ৩ মিনিটে হঠাৎই কি মনে হওয়ায় আন্দাজে আরো ১৬টা দাগিয়ে দিয়ে আসি এটা ভেবে যে এর ভেতর অন্তত চারটা হলেও তো আমার মার্কস কমছে না বরং বাড়ছে। বাসায় এসে দেখলাম, ঐ ষোলটার একটাও হয় নি। এখানে আমার চার মার্কস কমে যায়, আমি টিকেছিলাম সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজে যেখানে আমার চেয়ে এক বেশি পাওয়া সহপাঠী ডিএমসিতে পড়ছে।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথাটা এখনই আসবে। সেটা হল বিগত বছরের প্রশ্নপত্র সমাধান। তুমি যাতে যাতে পরীক্ষা দিতে চাও, সে জায়গাগুলোর প্রশ্ন সমাধান করে ফেলবে যে সাল পর্যন্ত প্রশ্ন তোমার হাতের কাছে থাকে। এতে ওখানকার প্রশ্নের ধরণ সম্পর্কে তুমি ওয়াকিবহাল হবে, তোমার ভেতর কনফিডেন্স কাজ করবে। আর এটা করা যাবে তখনই যখন তুমি বই ভালভাবে পড়ে শেষ করেছ বলে মনে করবে। সবকিছুর খুঁটিনাটি রপ্ত করার পর এই কাজ আরম্ভ করলে তুমি তোমার বিস্ময়কর অগ্রগতি লক্ষ্য করবে। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া বাংলাদেশের প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়েই ভর্তি পরীক্ষায় ষাট থেকে সত্তর শতাংশ মার্কস পেতে হয় নিদেনপক্ষে মেধাক্রমে স্থান নিশ্চিত করার জন্য। কাজটা আর অসম্ভব বলে বোধ হবে না যদি এটা করে ফেল।

যারা মেডিকেল পরীক্ষা দিচ্ছ, তারা অবশ্যই সবচেয়ে জোর পড়াশোনা করছ। তাদের তাই উপদেশ দেওয়ার আগে একটা অনুরোধ করে নেওয়া ভাল। তা হল, তোমরা কোনো অবস্থাতেই গণিত বা পদার্থের বেসিক যে জ্ঞান তা খেয়ে বসে থেকো না। মেমোরাইজিং, টেকনিক – হ্যানত্যান শেখার চাপ থাকবেই, কিন্তু তাই বলে সোজাসাপ্টা জিনিসপত্র ভুলে সিলিন্ডারের আয়তন সংক্রান্ত সমস্যাও সমাধান করতে পারবে না – এটা মেনে নেওয়া কষ্টকর। মেডিকেল পরীক্ষার্থীদের এই গণিতভীতি এবং ম্যাথমেটিক্যাল প্রবলেম আসলেই বেসামাল হয়ে পড়া ঠেকানো সবার আগে প্রয়োজন। তাই তোমাদের জন্য সহায়ক পদ্ধতি হল তুমুল না হলেও নিয়মিতভাবে বায়োলজির পাশাপাশি অন্য সাবজেক্টগুলোর যত্ন নেওয়া। তাতে যদি মেডিকেলের বাইরেও অন্য কোথাও পরীক্ষা দিতে চাও, নিজের কষ্টের ফল নিজেই বুঝে পাবে।

একটা ভর্তি পরীক্ষার রেজাল্ট দেওয়ার পর কখনো “কিছুদিনের জন্য গা এলিয়ে বসে থাকাই যায়” টাইপ মানসিকতা রাখবে না। যদি নিজের একাধিক ইচ্ছা বা লক্ষ্য থেকে থাকে, তবে নিয়মিত পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়াটা খুবই জরুরি। রিল্যাক্স করবে একেবারে সর্বশেষ পরীক্ষার শেষেই। তা না হলে অনেককিছু তোমার মনমত হতে নাও পারে। উদাহরণ দেখ – কুয়েটে আমার মেধাস্থান ছিল ১৭, আর তার বিশ দিন পর বুয়েট পরীক্ষা ছিল। আমি এই বিশ দিনের শেষ চার দিনই কেবল পড়েছিলাম। হলও তেমন রেজাল্ট, আমার র‍্যাঙ্ক ২৫০ এর পরে চলে গিয়েছিল।

পরিশেষে যা দরকার তা হলে নিজের উপর বিশ্বাস এবং অন্যদের অনেক কিছু দেখে ভাবিত হওয়ার অভ্যাস বাদ দেওয়া। এখানে যা যা বলা হল, তা ফলো করার চেষ্টা কর, চেষ্টা কর নিজের কোয়ালিটি বাড়িয়ে তুলতে এবং আত্মবিশ্বাসের লেভেল বাড়াতে। তবে অবশ্যই অতি আত্মবিশ্বাসী হয়ে গা ছেড়ে দেবে না। এই কয় মাস নিজের প্রতি মনোযোগ দিলে একসময় নিজেই আবিষ্কার করবে অপেক্ষা আর পরিশ্রমের নিশীথ ঠেলে সাফল্যের সূর্য তোমার উপর কিরণ ছড়াতে শুরু করেছে।

সেই ভোর আনতে তবে আর দেরি কেন?