দুটি ভিন্ন বিকেলে গুটিবসন্তের ভিন্ন অবস্থা
সময়টা ১৯৬৮ এর বিকেল। ৬ বছর বয়সী মজিদ সারাবিকেল গোল্লাছুট খেলা শেষে ক্লান্ত হয়ে বাড়ির দিকে হাটা দিলো সন্ধায় । পথে দেখা পাগলা কার্তিকের সাথে।কার্তিক ভয়ার্ত আর সন্ত্রস্তকন্ঠে বললো,”পালা মজু! মজু! সব পালারে! ওলা বিবি আইসে! পালা সব পালা!”পাগলা কার্তিক এইরকম কথা প্রায়ই বলে। মজিদ বাড়ি আসতেই তার মা তেড়ে আসলেন। কান টেনে বললেন, “সারাদিন খালি টো টো ঘুরছ! অক্ষন বাসাত আসার সময় হইলো?” মজিদ বললো, “মা, কার্তিক কাকু কইলো ওলা বিবি আইতেছে? ওলা বিবি কিডা?” মজিদের মা মাটিতে থুতু ফেলে বললো, চুপ! হাইঞ্জা(সন্ধ্যা)বেলার বিবির নাম নিবিনা! পুকুরেত্তে হাতপাও ধুইয়া বাংলাঘরে ব! আর ঐ নাম নিস না! মাটিতে থুক দে!” মজিদ ভয়ে মাটিতে থুতু দিলো। মজিদের মা বললো, ঐ নাম এখন নিলে অমঙ্গল হবে! বিবি রাগলে পুরা গাঁও উজার হবে।রাতে মজিদের বাবা আসার পর, তারা সিদ্ধান্ত নিলো তারা মজিদকে নানার বাড়িতে পাঠিয়ে দেবে নানাবাড়িতে মজিদের চমৎকার সময় কেটেছিলো। একদিন দেখলো তার নানী কান্নাকাটি করছে; পরে জানতে পারলো মজিদের বাবা মা দুজনেই গুটিবসন্তে মারা গিয়েছেন। এর একবছর পর মজিদের নানাবাড়ির গ্রামের স্কূলে গুটিবসন্তের টিকা দেবার লোক আসে। তামার পয়সা পুড়িয়ে মজিদের বাহুতে টিকা দেয়া হয়।
সময় এখন ২০১৯ এর বিকেল। মজিদ সেনটু গেঞ্জি পরে হেলান চেয়ারে বসে রঙ চা খাচ্ছে আর খবরের কাগজ পড়ছে। ডায়বেটিসে আক্রান্ত মজিদকে ডাক্তার চিনি দিয়ে চা খেতে নিষেধ করেছে। তার ৪ বছর বয়সী নাতনী বিন্দু বড়ই চঞ্চল। সারাক্ষণ নানাভাইকে অসংখ্য প্রশ্ন করবে। ‘নানাভাই, পাখি আকাশে উড়ে কিভাবে? আমি কেন উড়তে পারি না? নানাভাই বৃষ্টি আকাশে কোথায় থাকে? আকাশের রঙ নীল আর কালো হয় কেন? পিঁপড়ারা কোথায় থাকে?’ ইত্যাদি ইত্যাদি। বিন্দু মজিদের বাহুর উপরে দাগ দেখে জিজ্ঞাসা করে, নানুভাই তোমাকে কে এখানে ছেঁকা দিয়েছে। মজিদ হেসে বলে, “ছেঁকা নয়, এটা হলো টিকা।”। বিন্দু জিজ্ঞাসা করে, “কিসের টিকা নানাভাই? ” মজিদ বলে, এইটা ওলা বিবির রোগ! তুমার মতো বেশি প্রশ্ন করলে ওলা বিবিও তোমাকে ধরবে?” বিন্দু ভয় পেয়ে চলে যায়। একটু পর বিন্দু এসে মজিদকে বলে, ‘নানাভাই তুমি কিস্যু জানো না। গুটিবসন্ত আমাকে ধরবে না। কারণ গুটিবসন্ত আর পৃথিবীতে নাই। আমার আম্মু বলেছে, প্রশ্ন করতে বাঁধা নাই। প্রশ্ন করলে কোন রোগ ধরে না। প্রশ্ন করা বুদ্ধিমানের লক্ষণ!’ বলে খিল খিল করে হাসতে লাগলো বিন্দু। মজিদ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো।
গুটিবসন্ত হচ্ছে একটি ভয়াবহ রোগ যা পূর্বে লাখ লাখ মানুষের মৃত্যুর কারণ ছিলো। আগে গ্রামে এটিকে শীতলা বিবি বা ওলা (ওলাবিবি)উঠা সাথে সম্পর্কিত করা হতো। এটি একটি কুসংস্কার, কোন দেবী বা বিবির সাথে বসন্ত হওয়া বা সুস্থ হবার সম্পর্ক নেই। বরং বিজ্ঞানীদের প্রচেষ্ঠা ও বিশ্ববাসীর সহযোগিতায় এই ভয়াবহ রোগকে বিজ্ঞান হার মানিয়েছে এবং করেছে বিলুপ্ত। আসুন জানি গুটিবসন্ত কি এবং কিভাবে বিজ্ঞানীরা এই ভয়াবহ রোগটিকে পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত করে দিয়েছে।
গুটিবসন্ত কি?
গুটিবসন্ত (small pox) হচ্ছে একটি ভাইরাসজনিত ভয়াবস ছোঁয়াছে রোগ যা ভেরিওলা ভাইরাস দিয়ে হয়। সাধারণত ভেরিওলা ভাইরাসে দুটি ভিন্ন ভ্যারিয়েন্ট বা প্রকার দিয়ে হয় থাকে- ১. ভেরিওলা মেজর ২. ভেরিওলা মাইনর। গুটিবসন্ত অত্যন্ত ভয়াবহ একটি রোগ যার মৃত্যুহার ৩০%! গুটিবসন্তে থেকে বেঁচে যাওয়া রোগীর অনেকে অন্ধ, বিকলাঙ্গ হয়ে বেঁচে থাকেন অথবা গুটিবসন্তের ফুঁসকুড়ির ভয়াবহ দাগ মুখে ও শরীরের বিভিন্ন স্থানে নিয়ে বেঁচে থাকেন। প্রকৃতিতে গুটিবসন্ত মানুষ ব্যতীত অন্য কোন প্রাণীকে আক্রান্ত করে না (অধিকাংশ ভাইরাস বিশেষ কোন প্রজাতি বা স্পিসিস নির্দিষ্ট, এমনকি টিস্যু বা কোষ নির্দিষ্ট হতে পারে )। কাছাকাছি রকমের বসন্ত হচ্ছে গোবসন্ত(cowpox), বানরবসন্ত (Monkeypox) মানুষকেও আক্রান্ত করতে পারে। যদিও গোবসন্ত ভয়াবহ নয়, তবে বানরবসন্ত মানুষকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে পারে।
অনেকে ভাববেন জলবসন্ততো এত ভয়াবহ নয়, তবে কেন গুটিবসন্ত ভয়াবহ। কারণ, গুটিবসন্ত ভাইরাস (ভেরিওলা) দিয়ে হয় যা জলবসন্তের ভাইরাস (ভেরিসেলা- হার্পিসগ্রুপ) থেকে অনেকবেশি ভয়ানক। (নোট: গুটিবসন্তের শ্রেণী/ক্লাস ও পর্ব/অর্ডার:ইনসার্টি সেডিস ফ্যামিলি: পক্সভিরিডি, জেনাস: অর্থোপক্সভাইরাস এবং জলবসন্তের শ্রেণী: ইনসার্টি সেডিস পর্ব/অর্ডার: হার্পিসভিরালিস ফ্যামিলি: হার্পিসভিরিডি জেনাস: ভেরিসেলোভাইরাস)। নাম ও লক্ষণের অনেকমিল থাকলেও গুটিবসন্তের ভাইরাসের ভয়াবহতা অনেক বেশি। যেমন, ডেঙ্গু জ্বর ও সর্দিজ্বর ভাইরাসের কারণে হলেও দুটির ভয়াবহতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। নিচের ছবিতে গুটিবসন্তে আক্রান্ত একটি শিশুর ছবি দেখানো হলো (লিংক ১: উইকিপিডিয়া)
গুটিবসন্ত ও জলবসন্তের মধ্যে পার্থক্য কি?
গুটিবসন্ত ও জলবসন্তের প্রাথমিক লক্ষণ একইরকম হলেও রোগের তীব্রতা, ধরণ, বিস্তার ও মৃত্যুহার ভিন্ন। নিচের টেবিলে কয়েকটি প্রধান পার্থক্য তুলে ধরা হলো;
বিষয় |
গুটিবসন্ত |
জলবসন্ত |
ভাইরাস |
ভেরিওলা |
ভেরিসেলা |
ভাইরাসের ধরণ |
ডিএনএ ভাইরাস, ১৯০ কিলোবেসপেয়ার |
ডিএনএ ভাইরাস, ১২৪ কিলোবেসপেয়ার |
জ্বর শুরু হবার সময় |
ফুঁসকুড়ি হবার ২-৪ দিন আগে |
ফুঁসকুড়ি ও জ্বর একই সাথে হয় |
দেহে ফুঁসকুড়ির বিস্তার |
মুখ থেকে হাত ও পা এর দিকে বৃদ্ধি |
মুখ ও বুক বেশি; হাত ও পায়ের দিকে হ্রাস |
পায়ে ফুঁসকুড়ি |
হাত ও পায়ে অনেক থাকে |
হাত ও পায়ে কম বা অনুপস্থিত |
দেহে ফুঁসকুড়ির বিস্তারের গতি |
ধীর |
দ্রুত |
মৃত্যুর হার |
১০-৩০%; ১০০ বছরে ৫০০ মিলিয়ন |
খুব কম, ১০ বছরে ৯০০০ |
গুটিবসন্ত আক্রান্ত রোগী এবং জলবসন্তের রোগীকে খুব সহজেই আলাদা করা যায়
ফুৃঁসকুড়ির ধরণ ও বিস্তার দেখে। গুটিবসন্তের রোগীর ফুঁসকুড়ির বিস্তার হাত, পা ও মুখে অনেকবেশি থাকে, ফুঁসকুড়ি ও জ্বর আসা একসাথে হয় না এবং ফুঁসকুড়ি ধীরে ধীরে সারাদেহে ছড়িয়ে পড়ে। ফুঁসকুড়ি প্রকাশের ৩-৪ সপ্তাহ পড় ফোস্কা(মামড়ি/স্ক্যাব scab) পড়ে যাবে। যদিও প্রথম ২-৫ দিনের দুটি রোগের ফুসকুড়ির মধ্যে পার্থক্য করা মুশকিল হতে পারে, ৫-৭ দিনের মাথায় ফুসকুড়ির ধরণ ও পরিণতি দেখে আলাদা করা যাবে।
৫-৭ দিন: গুটিবসন্ত রুগীর ফুসকুড়ি সাধারণত বড়, ৫-১০ মিলিমিটার দৈর্ঘের, শক্ত এবং ফুসকুড়ি শুকিয় যাবে না এবং শরীরের অন্যান্য স্থানে ছড়াবে। অন্যদিকে, জলবসন্তের ফুঁসকুড়ি ছোট, ১-৫মিমি, সুপারফিসিয়াল (চামড়ার উপরে!), ৭ দিনের মাথায় শুকিয়া যাওয়া শুরু করবে এবং মামড়ি (স্ক্যাব scab) প্রকাশ করবে। জলবসন্তের ৩-৪ দিনেও মামড়ি দেখা যেতে পারে। (মামড়ি (স্ক্যাব scab): চামড়ার ক্ষতস্থানে শুকিয়ে যাওয়া ফোস্কার কালো বা গাঢ় রঙের মামড়ি))
১০-১৪ দিন: গুটিবসন্তের ১০ দিনের মাথায় ফুঁসকুড়িতে পুঁজ আসবে। ১৩- ১৪ দিনের মাথায় ফুঁসকুড়ি শুকাতে শুরু করবে। ১০ দিনের জলবসন্তের অধিকাংশ মামড়ি পড়ে যাবে।
গুটিবসন্তের উৎপত্তি ও বিবর্তন
গুটিবসন্তের উৎপত্তি কোথায় প্রথম তা জানতে বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন সময় গুটিবসন্তের ভাইরাসের বিবর্তন বুঝার চেষ্টা করেন। বিজ্ঞানীরা গুটিবসন্তের সাথে সম্পর্কিত ভাইরাসগুলো জিনোম থেকে বিবর্তনের ইতিহাস বের করতে পারে এবং বের করতে পারেন ভাইরাসের উৎপত্তিকাল! মলিক্যুলার ক্লক মেথডে ভাইরাসের মিউটেশনের হার ও বিভিন্ন সময়ে প্রাপ্ত গুটিবসন্তের ভাইরাসের নমুনা থেকে বিজ্ঞানীরা গুটিবসন্তের ভাইরাস ভেরিওলার উৎপত্তিস্থান ও সময় বের করেন। ২০১২ সালে বিজ্ঞানী বাবকিন ও বাবকিনা অর্থোপক্সভাইরাসের বিভিন্ন স্ট্রেইনের (গোবসন্ত, বানরবসন্ত, উটবসন্ত ইত্যাদি) উপর মলিক্যুলার ক্লক মেথড ব্যবহার করে গুটিবসন্তের ভাইরাসের উৎপত্তি ৩০০০-৪০০০ বছর আগে পূর্ব আফ্রিকায় হয়েছে দাবি করেন। তারা শুধু ভাইরাসের জিনোমের মিউটেশন হারই( কনজার্ভড রেজিওন) নয়, ঐসব ভাইরাস স্ট্রেইন ধারণক্ষম প্রাণীদের উৎপত্তির তথ্য হিসেবে রাখেন। তারা যে সময়ের কথা বলেছেন, ঐ সময় পৃথিবীর ইতিহাসে ঘটা অন্যতম বড় আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাত ( মিনোয়ান অগ্নৎপাত বা শেষ ব্রঞ্জ যুগের অগ্নৎপাত) এর কারণে ঐ অঞ্চলে প্রাণীদের দেশান্তরের ঘটনা ঘটে। সম্ভবত, ঐসময়ে বিভিন্ন প্রাণীর ভাইরাসের সম্মিলন থেকে গুটিবসন্তের ভাইরাসের পূর্বপুরুষের(এনসেস্টর) এর উৎপত্তি হয় (এটা প্রমাণ নয়, অনুমান!)। নিচের ছবিতে গুটিবসন্তের বিবর্তনের চিত্র দেয়া হলো:
গুটিবসন্তের ইতিহাস (ভারত উপমহাদেশ, মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ ও আমেরিকা)
গুটিবসন্ত একটি প্রাচীন রোগ। গুটিবসন্তের বর্ণনা অনেক ধর্মগ্রন্থেও পাওয়া যায় (বাইবেল (ইঞ্জিল), তালমুড(তাওরাত))। এই রোগ এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকাতে মহামারীর কারণ ছিলো। এমনকি মিশরের মমিতেও (রামসেস ৫-মৃত্যু খৃষ্টপূর্ব ১১৫৭) গুটিবসন্তের লক্ষণের (ক্ষতের দাগ) নিদর্শন রয়েছে। প্রাচীন ভারতের চিকিৎসাগ্রন্থ (আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা) চক্র সম্মিতা ও শুশ্রুষা সম্মিতায় (বইয়ের শেষ নাম ভুল হতে পারে) গুটিবসন্তের বর্ণনা রয়েছে, যা প্রমাণ করে গুটিবসন্ত ভারতে খৃষ্টের জন্মের অনেক আগে থেকেই বর্তমান (সম্ভবত খৃষ্টপূর্ব ১৫০০ এর আগেও)। ধারণা করা হয়, মিসর থেকে আসা বণিকদের দ্বারা ভারত-উপমহাদেশে গুটিবসন্ত ছড়ায়। খৃষ্টপূর্ব ১১০০ সালে আগে থাকা বিভিন্ন পুথি ও প্রমাণাদিতে চীনে এই রোগের বিস্তার জানা যায়। প্রাচীন গ্রীসে খৃষ্টপূর্ব ৪৩০ এথেন্সের মহামারীর বর্ণনায় গ্রীসে গুটিবসন্তের আগমন পাওয়া যায়।
গ্রামের পর গ্রাম, শহরের পর শহর গুটিবসন্তের ভয়াবহতায় মানুষশুন্য হয়ে যেতো কিন্তু অন্য পশুপাখির কিছু হতো দেখে মানুষ মনে করতো স্রষ্টার শাস্তি বা আক্রোশ। সে কারণেই বাংলাদেশের গ্রাম সহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন দেবদেবী বা সাধু-সন্তকে পূজা বা প্রার্থনা করা হতো রোগের নিরাময় হিসেবে। ভারত উপমহাদেশে শীতলা মাতা বা দেবী, চীনের নিয়াং-নিংয়াং দেবী, নাইজেরিয়ায় স্বাপনা দেব ও রোমান ক্যাথলিকরা সেইন্ট নিকেসের কাছে গুটিবসন্ত থেকে রোগমুক্তির প্রার্থনা করতো।
খ্রিস্টপূর্ব ৪৩০ সালে এথেন্স থেকে প্রাপ্ত গুটিবসন্তের বর্ণনা দেন বিখ্যাত গ্রিক চিকিৎসক গ্যালেন। পরবর্তীতে ৪৫১ খ্রিস্টাব্দে বর্বর হানসদের আক্রমণ থেকে গুটিবসন্তের বর্ণনা পাওয়া যা। হানসরা খ্রিস্টান সন্ত(সেইন্ট) নিকেইস শিরোচ্ছেদ করে। সন্ত নিকেইস আগের বছর স্রষ্টার কাছে প্রার্থনা করে গুটিবসন্ত থেকে আরোগ্য লাভ করেছিলেন জনশ্রুতি ছিলো। কথিত রয়েছে, তার মাথা কাটার পর তিনি কাটা মাথা নিয়ে চার্চ বা গির্জা পর্যন্ত হেঁটে গিয়েছিলেন। একইসময় হানসরা দূর্ভিক্ষ ও মহামারীর কারণে ইতালি ও গল থেকে পালাতে বাধ্য হয়। সেই কারণে মধ্যযুগের ক্যাথলিক খ্রিস্টানরা সন্ত নিকেসকে গুটিবসন্তের সন্ত বলে মানতো এবং প্রার্থনায় তার নাম নিয়ে স্রষ্টার কাছে আরোগ্য চাইতো। ৫৬৮-৫৭০ খ্রিস্টাব্দে মক্কায় ইথিওপিয়ার সেনাবাহিনী কর্তৃক “হাতির যুদ্ধে” পরাজয়ের কারণ হিসেবে ঐতিহাসিকরা গুটিবসন্তকে দায়ী করেন। পরবর্তীতে ৮০০-১০০০ খ্রিস্টাব্দে আরবদের আক্রমণ দক্ষিণ আফ্রিকা ও স্পেনে গুটিবসন্ত ছড়িয়ে দেয়। যদিও আলেকজান্দ্রিয়ার খ্রিস্টান চিকিৎসক অহরুন(হারুন!) হাম ও গুটিবসন্তের পার্থক্যের ও রোগের ধরণ বর্ণনা দেন, গুটিবসন্তের প্রথম চমৎকার ও সম্পূর্ণ সনাক্তকারী বর্ণনা পাওয়া যায় পারস্যের চিকিৎসক আল রাজীর কাছে ৯১০ খ্রিস্টাব্দে। তিনি তার বই ‘কিতাব ফি আল জাদারি ফি হাসাবাহ (গুটিবসন্ত ও হামের বই)’ তে গুটিবসন্তকে হাম ও জলবসন্ত থেকে আলাদা করার সনাক্তকারী বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করেন। তার বই অনুদিত হয়ে ইউরোপীয় চিকিৎসকদের জনপ্রিয় হয় (এমনকি ১৭০০ সাল পর্যন্ত)। আরেক পারস্যের চিকিৎসক ইবনে সিনাও গুটিবসন্তকে বর্ণনা করেন। ইবনে সিনা রচিত “আল কানুন ফি আল টিবব” ছিলো ইউরোপে জনপ্রিয় চিকিৎসাবিদ্যার এনসাইক্লোপিডিয়া যেখানে গ্রিক চিকিৎসক গেলেনের কাজ, পারস্য ও ভারতীয় চিকিৎসাজ্ঞানের সংক্ষিপ্ত কিন্তু চমৎকারভাবে বর্ণিত থাকে। ইউরোপে গুটিবসন্তের মহামারী গ্রিক চিকিৎসক গেলেন বর্ণনা করেছেন আগেই উল্লেখ করছি। পরবর্তীতে ১২২০ সালে চিকিৎসক গিলবার্ট ইংল্যান্ডের গুটিবসন্তের ধরণ বর্ণনা করেন মধ্যযুগে ক্রসেডাররা মধ্যপ্রাচ্য থেকে ইউরোপে ফেরত আসার সময় বারবার গুটিবসন্তের মহামারীকে নিয়ে আসে। ১৪৩৮ শতাব্দিতে ফ্রান্সে গুটিবসন্ত মহামারী আকারে দেখা দেয়। ১৬২৩ সালে রাশিয়াতে প্রথম গুটিবসন্তের বর্ণনা পাওয়া যায়।
যে জনগোষ্ঠী আগে কখন গুটিবসন্ত দ্বারা আক্রান্ত হয়নি অর্থাৎ যে জনসংখ্যায় গুটিবসন্তের বিরুদ্ধে কারও কোন রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা(ইমিউনিটি) নাই, সে জনসংখ্যায় গুটিবসন্ত আরও বেশি ভয়াবহ ধারণ করতো। এর উদাহরণ পাওয়া যায়, যখন ইউরোপীয়ানরা প্রথম আমেরিকা মহাদেশে আগমন করে। যেহেতু আমেরিকা মহাদেশের মানুষ(আদিবাসীরা) আগে এই রোগের সংস্পর্শে আসেনি, সেহেতু গুটিবসন্ত ইউরোপীয়ানদের আমেরিকা জয়ে এক বিশাল সাহায্য হয়ে দাড়ায়। এজটেক রাজ্য উপর্যোপুরি স্প্যানিশদের আক্রমণের সাথে ভয়াবহ গুটিবসন্তের পাল্লা দিতে না পেরে সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায়।
গুটিবসন্তের আরেক ঐতিহাসিক ঘটনা হলো, যুক্তরাস্ট্রের ষোলতম রাষ্ট্রপতি আব্রাহান লিংকনের বিখ্যাত গেটিসবার্গ ভাষণ যা যুক্তরাস্ট্রের ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ট ভাষণ। ১৮৫৩ সালের ১৯ নভেম্বর ভাষণ দিবার কিছুক্ষণ আগে তিনি প্রচন্ড মাথাব্যাথা অনুভব করেন। আগের রাতে তিনি ভাষণের শেষ অর্ধেক খসড়া তৈরি করেছিলেন। এরপরই তিনি গুটিবসন্তে আক্রান্ত হন। তিনি আরোগ্য লাভ করলেও তার ব্যক্তিগত ভৃত্য উইলিয়াম জনসন এরপর গুটিবসন্তে মারা যান। গেটিসবার্গের দুদিন আগেও যদি তিনি আক্রান্ত হতেন বা গুটিবসন্তে মারা যেতেন, তাহলে যুক্তরাস্ট্রের ইতিহাস হয়তো ভিন্ন হতো।
গুটিবসন্তের বিরুদ্ধে বিজ্ঞানের জয় (ভ্যাকসিনেশন বা টিকা আবিষ্কার)
১৭৯৮ সালে ব্রিটিশ চিকিৎসক এডওয়ার্ড জেনার প্রথম ভ্যাকসিনেশন(টিকা) বর্ণনা করেন এবং একটি বালকের উপর প্রয়োগ করে প্রমাণ করেন টিকা গুটিবসন্ত থেকে রক্ষা করে। এটা প্রচলিত ছিলো যে, গোয়ালিনীরা গুটিবসন্তে আক্রান্ত হয় না। চিকিৎসক এডওয়ার্ড জেনার ভাবলেন, সম্ভবত গোয়ালিনীরা গোবসন্ত আক্রান্ত হয় যা তাদের গুটিবসন্ত থেকে রক্ষা করে। গোবসন্তের ধরণ গুটি বসন্তের মতো হলেও তা এতো ভয়ানক নয়। তিনি গোবসন্তে আক্রান্ত গোয়ালিনী সারাহ এর হাতের ক্ষতের পুঁজের কিছু অংশ বাগানের মালির আট বছর বয়সী ছেলে ফিলিপসের বাহুতে ইনোকুলেট(সুঁচ দিয়ে ক্ষত তৈরি করে তাতে বাইরের কিছু ক্ষতস্থানে প্রদান) করেন। ফিলিপস হালকা জ্বরে আক্রান্ত হয় এবং পরে সেরে উঠে যা গোবসন্তে আক্রান্ত হবার লক্ষণ। এরপর তিনি ফিলিপসকে গুটিবসন্তের আক্রান্ত রোগীর মামড়ি(ভাইরাস বিদ্যমান) দ্বারা আক্রান্ত করেন। ফিলিপস গুটিবসন্ত দ্বারা আক্রান্ত হয় নি। ফিলিপস ছিলো জেনারের ১৭তম পরিক্ষা। জেনার তার এই পর্যবেক্ষণ পেপার(গবেষণাপত্র) আকারে লিখে রয়াল সোসাইটিতে জানান কিন্তু তারা তা প্রকাশ করে না। তারপর জেনার আরো পরিক্ষা করেন, এমনকি তার ১১ মাস বয়সী নিজের পুত্রের উপর পরীক্ষা করেন। তিনি আবার গবেষণাপত্র লিখেন ও রয়াল সোসাইটিতে জমা দেন প্রকাশের জন্য এবং রয়াল সোসাইটি তার কাজকে স্বীকৃতি দেন। তার এই আবিষ্কারের কথা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। এরপর ভ্যাকসিনেশন বা টিকা দেয়া সারা ইউরোপ ও পরে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। এডওয়ার্ড জেনারকে বলায় ফাদার অব ইমিউনোলজি (রোগপ্রতিরক্ষাবিদ্যার পিতা)। যদিও ভ্যাকসিনেশন পদ্ধতির মতই কিছু পদ্ধতি যেমন ভ্যারিওলেশন, ইনোকুলেশন চিন ও ইংল্যান্ডে অল্প প্রচলিত ছিল, সেগুলো এডওয়ার্ড জেনার ভেকসিনেশনের মতো কার্যকরী ও মৃত্যু প্রতিরোধী ছিলো না। জেনার দাবি করে বিজ্ঞানীরা পরবর্তী একশবছর ধরে গুটিবসন্ত ও ভ্যাকসিনেশন নিয়ে গবেষণা করেন এবং সাফল্য পান। পরবর্তীতে ১৯৫০ থেকে গুটিবসন্তকে পৃথিবী উৎখাত করার জন্য দু:সাহসিক পদক্ষেপ নিতে চান বিজ্ঞানীরা। সেই ধারায় বিশ্বস্বাস্থ্যসংস্থা ১৯৮০ সালে পৃথিবী গুটিবসন্তমুক্ত ঘোষণা করেন (প্রাকৃতিকভাবে গুটিবসন্ত আক্রান্ত কোন রোগী আর পাওয়া যায় নি!)। এর পরে গবাদি-পশুর রিন্ডারপেস্ট নামক ভয়াবহ রোগ ভ্যাকসিনেশনের মাধ্যমে দূর করা হয়। পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন হওয়া জীবাণু হলো এই দুটিই। পরবর্তী ভাইরাস নিশ্চিহ্ন হবে সম্ভবত পলিও।
টিকাবিমুখিতা ও রোগের প্রাদুর্ভাব
এডওয়ার্ড জেনারকে বলা হয়, পৃথিবীর সেই মানুষ যার কারণে সবচেয়ে মানুষ মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে গেছে এবং বাঁচবে। আজ জেনারের ভ্যাকসিনেশনের জয়জয়াকার, সকল মেডিকেল পড়ুয়া ছাত্র-ছাত্রী , সকল মাইক্রোবায়োলজি পড়ুয়া ছাত্র-ছাত্রী তার আবিষ্কারের কথা পড়ে। আমি জিন প্রকৌশল ও জীবপ্রযুক্তি পড়ুয়া ছাত্র তার কথা পড়ি। আর ভাবি আহা, জেনার নিশ্চয়ই ঐ সময়ে সমাজের কাছে সুপারহিরো ছিলেন। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন ছিলো। তার আবিষ্কারে খুশি হবার বদলে অনেক বিজ্ঞানবিমুখ ও গোঁড়া কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষজন তার উপর ক্ষেপে যায়। তারা দাবি করেন জেনার শরীরে বিষ ঢুকাচ্ছে (জেনার গোবসন্তের পুঁজ শরীরে দেন; এটাকে অপবিত্র এবং অশুচি গণ্য করে ময়লা দিয়ে ময়লা সারানো যায় না তারা দাবি করেন ), এটা কার্যকরী নয় (যেহেতু টিকা দিবার পর আক্রান্ত ব্যক্তি গোবসন্তে আক্রান্ত হয়, সেহেতু তারা ভেবেছেন জেনারে ভ্যাকসিনেশন কাজ করে না), টিকা স্রষ্টা উপর খবরদারি করা (তাদের দাবি গুটিবসন্ত স্রষ্টা দেন, বাঁচা-মরা তিনি নির্ধারণ করবেন তাই মানুষ সেটা কে বাধা দেয়া ধর্মাবননা)। নিজ দেশে জেনার এইসব মানুষের কাছে হাস্যরস, তাচ্ছিল্য ও ঘৃণার শিকার হোন।
বিজ্ঞানীদের হেয় করা বা অপদস্থ ইতিহাসে নতুন কিছু নয়, আগুনে পোড়ানো ( ব্রোনো ও সেরেভেটাস), অন্ধ করা ( আল রাজি), রাসায়নিকভাবে খোঁজাকরণ ( টুরিং), পদচ্যুত করা (আইনস্টাইন ও জাকি) জেলে ভরা(ইবনে সিনা ও গ্যালিলিও ) বানর বলে ব্যঙ্গ করা (ডারউইন ও স্টিফেন হকিং) করার ইতিহাস রয়েছে। সাধারণ মানুষ তাদের ধ্যান-ধারণা বা বিশ্বাসের বাইরের কোন কিছু বুঝতে চায় না বা বুঝে না, তাই এখনও প্রায় ২০০ বছর পরেও ভ্যাকসিনেশন বা টিকার বিমুখী (এন্টিভেকস) লোকের সংখ্যা এখনো অনেক। এইসব লোকেরা নির্ভরযোগ্য তথ্যের চাইতে উড়ো কন্সপাইরেসি থিওরী বা ষড়যন্ত্রের কথা বেশি বিশ্বাস করে। সাথে চরমপন্থীদের উত্থান টিকা কার্যক্রমকে করছে ব্যাহত। ঠিক এমনটি ঘটছে পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও নাইজারে। ২০১৫ সালে পৃথিবীতে মাত্র তিনটি দেশ পলিওমুক্ত নয়, বাকিসব পলিওমুক্ত। বাংলাদেশ(২০১৪) ও ভারত(২০১১) পলিওমুক্ত হলেও, পাকিস্তান ও আফগানিস্থানে টিকাবিমুখিতা ও জঙ্গিদের চরমপন্থী মনোভাবের কারণ পলিও নির্মূল সম্ভব হচ্ছে না। কুয়েত ভিত্তিক সংবাদসংস্থা আলজাজিরা ২০১৫ সালে রিপোর্ট প্রকাশ করে যেখানে তারা দাবি করে পাকিস্তানে চরমপন্থী তালেবানরা টিকাপ্রদানকারী ব্যক্তিদের টার্গেট করে আক্রমণ করায় আফগান ও পাকিস্তান সীমান্তে পলিওর সংখ্যা বিদ্যমান। তালেবান সহ অনেক লোকের ধারণা টিকা নিয়ে বাচ্চা হবে না বাচ্চাদের পোলিও আক্রান্ত করা হচ্ছে বা ধর্ম চলে যাবে। এগুলো মসজিদসহ অনেক ইমাম-আলেম ছড়াচ্ছেন বলে রিপোর্টে আসে। বিজ্ঞানবিমুখ ও কমশিক্ষিত এইসব লোককে টিকার উপকারিতা বুঝানো মুশকিল। এমনকি পলিও টিকা প্রদানকারী লোকজন ফতোয়ার বই হাতে বা সাথে মসজিদের ইমামকে সাথে নিয়ে বুঝাতে হয় যে টিকা নিলে ধর্মের কোন ক্ষতি হবে না। অন্যদিকে ইউরোপ আমেরিকার মতো উন্নত দেশে “চিকিৎসাবিজ্ঞান/জীববিজ্ঞানে উচ্চতর পড়াশুনা না করেও ডাক্তার-বিজ্ঞানী আর সবাত্তে বেশি বুঝি” টিকাবিমুখী মানুষদের জন্য হামের মতো রোগ কয়েকবছর পর পর হানা দেয়। এইসব বাবা-মা ইন্টারনেটে উল্টাপাল্টা লিংক পড়ে, লোকের উড়ো কথা শুনে ও চিকিৎসাবিদ্যার কোন ধারণা না থাকায় টিকাকে অটিজমের কারণ ভাবে। ইউরোপে গোঁড়ামানুষ অধ্যুষ্যিত এলাকা “বাইবেল বেল্ট” বলে যেখানে অনেক মানুষ ধর্মীয় কারণে টিকা নেয় না। অথচ বাংলাদেশের মত দরিদ্র ও অনুন্নত অবকাঠামোর দেশে হামের টিকা ও প্রতিরক্ষার হার ঐসব দেশের তুলনায় ঈর্ষনীয়।
বাংলাদেশে গুটিবসন্ত ও টিকার(ভ্যাকসিন) সফলতার নজির
বাংলাদেশেও গুটিবসন্তের ভয়াবহ ছোবল প্রাণ নিয়েছে লাখো মানুষের। গুটিবসন্তের সবচেয়ে ভয়াবহ মহামারী দেখা দেয় ১৯৫৮ সালে যেখানে প্রায় ৫৯ হাজার মানুষ মারা যায়। ১৯৬১ সালে গুটিবসন্তের টিকার কর্মসূচি শুরু হলে গুটিবসন্তের মৃত্যুহার কমতে থাকে। পরবর্তী দশবছরে মৃত্যুহার অনেকগুণ কমে আসে। ১৯৭১ সালে গুটিবসন্তের কার্যক্রম চালু থাকলেও বাংলাদেশে স্বাধীনতা যুদ্ধে বাধাপ্রাপ্ত ও শরণার্থীদের স্থানান্তরিত হবার কারণ ১৯৭২ সালে গুটিবসন্ত আবার ফিরে আসে। স্বাধীনতা যুদ্ধে লাখ লাখ মানুষ ভারতে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নেয়। শরণার্থী শিবিরের ঘনবসতিপূর্ণ ও নোংরা পরিবেশ যেকোন সংক্রামক রোগ ছড়ানোর জন্য যেকোন যুদ্ধ বা অন্যদেশে লোকজন স্থানান্তর/দেশে প্রর্তাবর্তন রোগ নতুন করে ফেরত আনতে পারে। যেমন, বাংলাদেশ উপমহাদেশের মধ্যে পলিওমুক্ত হয় ২০১৪ সালে যা বাংলাদেশকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অন্য দশটি দেশের সাথে যুক্ত করে। ১৯৭১ সালে স্বাধীন হওয়া বিশাল জনসংখ্যা ও ঘনবসতির একটি দেশ, বাংলাদেশের জন্য পলিওমুক্ত একটি বিশাল চ্যালঞ্জ ছিলো। এটি সম্ভব হয় সরকারকর্তৃক শক্তিশালী টিকা প্রদান কর্মসূচি ও প্রচার, জনগণের টিকা নিবার জন্য আগ্রহ ও অংশগ্রহণ, বাড়ি বাড়ি গিয়ে স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রচেষ্ঠা এবং স্থানীয় প্রতিষ্ঠান স্কুল-কলেজকে টিকা সেন্টারে পরিণত করা। ২০০৬ সালে বাংলাদেশ পলিওমুক্ত হলেও বাইরের দেশ যেমন ভারত থেকে আগত মানুষের মাধ্যমে পলিও হবার ঘটনা ঘটে। সম্প্রতি বাংলাদেশে আগত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের টিকা প্রদানের জন্য ২০১৭ সালে সরকার পদক্ষেপ নেয়। আগত রোহিঙ্গা শিশুদের প্রায় দেড়লাখ শিশুদের হাম, রুবেলা ও পলিও সহ অন্যান্য টিকা দেয়া হবে। কারণ, আগত শরণার্থীরা পলিও নতুন করে বাংলাদেশে নিয়ে আসতে পারে। এইরকম শক্তিশালী টিকা প্রদান প্রোগ্রাম ১৯৭৫ সালে তৎকালীন সরকার গ্রহণ করে গুটিবসন্তের বিরুদ্ধে। ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশকে গুটিবসন্তমুক্ত ঘোষণা করা হয়। বাংলাদেশ টিকা বা ভ্যাকসিনেশন সফলতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। দেশের জনগণ টিকা দিতে আগ্রহী এবং সরকারও এ ব্যাপারে সহযোগী। ভবিষ্যতে এইরকম বজায় থাকলে বাংলাদেশ আরো অনেকরোগমুক্ত হবে।
গুটিবসন্ত নিশ্চিহ্ন হইয়া প্রমাণ করিলো সে নিশ্চিহ্ন হয় নাই
পঞ্চাশে শুরু হওয়া গুটিবসন্তের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার পর ১৯৮০ সালে বিশ্ব জানলো ভয়াবহ গুটিবসন্ত আর নাই। মানব ইতিহাসে তা ছিলো প্রথম কোন রোগের বিরুদ্ধে প্রথম ১০০% সাফল্য। যেহেতু প্রকৃতিতে (মানুষের মধ্যে) কোন গুটিবসন্তের জীবাণু নাই তাই বিজ্ঞানীরা গবেষণাগারে সংরক্ষিত গুটিবসন্তের নমুনা ধ্বংস করা শুরু করলো। কারণ, যতদিন পৃথিবীর কোথাও না কোথাও গুটিবসন্তের জীবাণু বা নমুনা থাকে গুটিবসন্ত মহামারী আকারে চলে আসার সুযোগ থাকবে। বিশ্বব্যাপী গুটিবসন্তের নমুনা ধ্বংস শুরু হলো। কিন্তু সেখানে বাধা হয়ে দাড়ালো অনেক কিছু। কিছু বিজ্ঞানী যুক্তি দাবি করলেন, গুটিবসন্ত নিয়ে আরো গবেষণা করা দরকার যেখানে প্রকৃতিতে গোবসন্ত, বানরবসন্ত রয়েছে। বিজ্ঞানীরা জানেন, ভাইরাসের বিবর্তন সবচেয়ে দ্রুত এবং নতুন গুটিবসন্তের কাছাকাছি অন্য ভাইরাস চলে আসতে পারে, সেক্ষেত্রে আগের ভাইরাসের নমুনা ধ্বংস করা হবে বোকামি।অন্যদিকে স্নায়ুযুদ্ধ শুরু হলো রাশিয়া তাদের গুটিবসন্তের সব নমুনা ধ্বংসে রাজি হলো না। সেই যুক্তিতে যুক্তরাস্ট্রও তাদের কিছু নমুনা রেখে দিলো বায়োটেরোরিজমের ভয়ে। সোভিয়েট ইউনিয়নের পতনের পর, খবর আসলো রাশিয়ায় পরিত্যক্ত একটি ল্যাবের গুটিবসন্তের সংরক্ষিত কিছু নমুনার হদিস অজানা। এদিকে যুক্তরাস্ট্রে এক ল্যাবে আরেক বিজ্ঞানী নমুনা ঘাটতে ঘাটতে তিনি গুটিবসন্তের কিছু নমুনার সন্ধান পান যেগুলো ভুলে ধ্বংস করা হয় নি (আরেক বিজ্ঞানীর)। তার সাথে গ্লোবাল ওয়ার্মিং বা বৈশ্বিক উষ্ণতায় উত্তর মেরু ও সাইবেরিয়ার পার্মাফ্রস্ট হাজার বছর আগে গলে জমে যাওয়া মানুষের লাশ থেকে নতুন করে আবার গুটিবসন্ত আসতে পারে বলে ভাইরাসবিদরা মত দেন। ২০১৬ সালে জমে যাওয়া এক হরিণের(রেইনডিয়ার) লাশ থেকে এনথ্রাক্স নামের ব্যাকটেরিয়া হরিণে ছড়িয়ে গেছে বলে খবরে মতামত দেন বিশেষজ্ঞরা। বিজ্ঞানীরা পার্মাফ্রস্টে বহু আদিম ভাইরাস বহাল তবিয়তে ভাল থাকে সেটার বহু প্রমাণ পেয়েছেন। বর্তমানে যুক্তরাস্ট্র ও রাশিয়া দুটি দেশের কাছে গুটিবসন্তের ভাইরাস রয়েছে। যদি নতুনভাবে গুটিবসন্তের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়, তবে তারা খুব দ্রুত ভ্যাকিসিন তৈরি করে পৃথিবীর জনসংখ্যা রক্ষা করবে।
পরিশেষে,
ভেরিওলা বা গুটিবসন্তকে হার মানিয়েছে বিজ্ঞান। গত কয়েক শতাব্দী চিকিৎসাবিজ্ঞানের অবদানে সংক্রামক ব্যধির মৃত্যুহার কমেছে। সংক্রামক ব্যাধির সাথে যুদ্ধে বিজয়ের একটি মাইলফলক হচ্ছে গুটিবসন্ত। গপ্পোটা শুরু করেছিলাম একটি কুসংস্কার দিয়ে। মজিদ জানতো ওলাবিবির কথা জানে আর বিন্দু জানে গুটিবসন্তের কথা। মজিদ হয়তো এখনো বিশ্বাস করবে ওলাবিবিকে, অনেকদিনের পুরোন বিশ্বাস ছাড়ানো মুশকিল ঠিক গুটিবসন্তের দাগের মতো। রোগ চলে গেলেও দাগ থাকবে। বিন্দু ওলাবিবির কথা বললে হাসবে, ওলাবিবির ভয়ে সে মাটিতে থুঁতু ফেলবে না, টোলপড়া হাসি দিয়ে বলবে, “নানাভাই, তুমি কিস্যু জানো না”। মজিদ না জানুক, না বুঝুক, আপনিতো জানলেন, বুঝলেন। গালে টোল না পড়লেও হাসতে পারেন। কারণ, আপনার, আমার ,কারও হাসি আর গুটিবসন্তে কেড়ে নিবে না।
“দয়া করে আপনার স্বাস্থ্যসমস্যা নিয়ে আমাকে ইমেইল বা টেক্সট করবেন না। আমি চিকিৎসক নই এবং আমার চিকিৎসা সংক্রান্ত ব্যাপারে উপদেশ দেয়া অনুচিত! প্রশ্ন থাকলে পোস্টে কমেন্ট করুন, সময় সুযোগ মত উত্তর দিবো। 🙂 “
ধন্যবাদ
মীর মুবাশ্বির খালিদ (২০১৯)
গ্রাজুয়েট স্টুডেন্ট (ভিজিটিং রিসার্চ স্কলার), গ্লাডস্টোন ইন্সস্টিটিউটস অব ভাইরোলজি ও ইমিউনোলজি (অট ল্যাব), গ্লাডস্টোন ইন্সস্টিটিউটস, সান ফ্রান্সিসকো, যুক্তরাস্ট্র
পিএইচডি ক্যান্ডিডেট, ডি. অব বায়োকেমিস্ট্রি (মাহমুদি ল্যাব), ইরাসমাস এমসি, রটারদাম, দি নেদারল্যান্ডস