বৃত্তাকার গতির ক্ষেত্রে, কেন্দ্রমুখী ও কেন্দ্রবিমুখী বল নিয়ে অনেকেই প্যাচ লাগিয়ে ফেলেন, অধিকাংশেরই মিসকনসেপশন (ভুল ধারণা) আছে এ নিয়ে। এমনকি উচ্চ মাধ্যমিকের দুই-একটা বইতেও এ নিয়ে বিভ্রান্তিকর উপস্থাপন আছে। এসব বিভান্তি দূর করতেই স্বশিক্ষার আজকের আয়োজন, “মিসকনসেপশনঃ কেন্দ্রমুখী ও কেন্দ্রবিমুখী বল”।

মিসকনসেপশনঃ

একটা বস্তু বৃত্তাকার পথে কেন ঘুরে? অনেক ক্ষেত্রে (মিসকনসেপশন) এই ব্যাখ্যাটা দেয়া হয়,

 

ছবি পাওয়া যাচ্ছে না

চিত্র-১ঃ বৃত্তাকার গতি নিয়ে মিসকনসেপশন

 

বৃত্তাকার পথে ঘুর্ণায়মান বস্তুর উপর দুইটি বল কাজ করেঃ কেন্দ্রমুখী বল (Centripetal Force) আর কেন্দ্রবিমুখী বল (Centrifugal Force)। কেন্দ্রমুখী ও কেন্দ্রবিমুখী বল সমান ও বিপরীত। বৃত্তাকার পথের যেকোন বিন্দুতে কেন্দ্রমুখী বল কাজ করে কেন্দ্র বরাবর, আর কেন্দ্রবিমুখী বল কাজ করে কেন্দ্র থেকে বাহিরের দিকে (ঐ বিন্দুগামী ব্যসার্ধ বরাবর)। বস্তুর উপর প্রয়োগকৃত এই দুই বল একে অপরকে নিষ্ক্রিয় করে দেয়। এবং ফলে বস্তু বৃত্তাকার পথে ঘুরতে থাকে।

আসলেই কি তাই?

 

মিসকনসেপশনের ব্যবচ্ছেদঃ 

একে একে দেখা যাক, কি কি ত্রুটি রয়েছে এই ব্যাখ্যায়।

বলা হয়েছে, কেন্দ্রমুখী বল ও কেন্দ্রবিমুখী বল সমান ও বিপরীত। তাহলে, বস্তুর উপর নিট বল কত? শূন্য (০) [চিত্র-১ দ্রষ্টব্য]। যেহেতু নিট বল শূন্য সেহেতু বস্তুর বেগ (মান অথবা দিক) পরিবর্তন হবে না। বস্তু যেই বেগে চলছিল জড়তার কারণে সেই একই বেগেই চলতে থাকবে।

কিন্তু আমরা দেখতে পাই বৃত্তাকার বস্তুর প্রতিমুহুর্তেই দিক পরিবর্তন হচ্ছে, অর্থাৎ প্রতি মুহূর্তেই বেগ পরিবর্তন হচ্ছে (উল্লেখ্য, বেগের মান ও দিক, যেকোন একটি পরিবর্তন হলেই বেগ পরিবর্তিত হয়)। তার মানে এখানে কোথাও ঘাপলা আছে। দেখা যাক, কী ঘাপলা।

আমরা জানি কেন্দ্রমুখী বলের উৎস কেন্দ্রে কী আছে অথবা কীভাবে বস্তু ঘুরানো হচ্ছে তার উপর নির্ভর করে। যেমন, সূর্য, পৃথিবী ইত্যাদির ক্ষেত্রে কেন্দ্রমুখী বলের উৎস মহাকর্ষ বল। নিউক্লিয়াসের ক্ষেত্রে এই বলের উৎস কুলম্ব বল। রশি দিয়ে ইট ঘুরানোর সময়ে এই বলের উৎস যান্ত্রিক বল, যেটা আমরা আঙ্গুল অথবা হাত দিয়ে দেই।

প্রশ্ন হল কেন্দ্রবিমুখী বলের উৎস কোথায়?  চট করে উত্তর দেয়া যায়, কেন্দ্রবিমুখী বল তো হল কেন্দ্রমুখী’র প্রতিক্রিয়া বল (নিউটনের ৩য় সূত্র অনুসারে)।

তাহলে বলুন, ক্রিয়া আর প্রতিক্রিয়া কি কখনও একই বস্তুর উপর কাজ করবে? অবশ্যই না, তাহলে কী করে কেন্দ্রমুখী ও কেন্দ্রবিমুখী বল একই বস্তুর (ঘূর্ণায়মান বস্তু) উপর কাজ করবে? একই বস্তুর উপর কাজ করবে না।

হ্যা, কেন্দ্রমুখী বল কাজ করে ঘুর্ণায়মান বস্তুর উপর, অন্যদিকে কেন্দ্রবিমুখী বল কাজ করে কেন্দ্র বা কেন্দ্রে থাকা বস্তুর উপর। যেমন, সূর্য-পৃথিবীর ক্ষেত্রে পৃথিবীর উপর কাজ করে কেন্দ্রমুখী বল, আর সূর্যের উপর কাজ করে কেন্দ্রবিমুখী বল। রশি দিয়ে ইট ঘুরানোর সময়ে কেন্দ্রমুখী বল কাজ করে ইটের উপর আর কেন্দ্রবিমুখী বল কাজ করে কেন্দ্রে থাকা আমাদের আঙ্গুল অথবা হাতের উপর, যার ফলে হাতে টান অনুভূত হয়।

অর্থাৎ এখানে ঘাপলা হল, আমরা প্রথম থেকেই কেন্দ্রমুখী ও কেন্দ্রবিমুখী বল দুটোকেই একই বস্তুর উপর প্রয়োগ করে আসছি, বাস্তবে এ ২ টি বলে যথাক্রমে বস্তু ও কেন্দ্রের উপর কাজ করে।

 

শুধু কেন্দ্রমুখী বল কীভাবে বস্তুকে ঘুরায়? 

তাও খুঁতখুঁতানি থেকেই যায় যে, বস্তুর উপর যদি শুধু কেন্দ্রমুখী বলই কাজ করে, তাহলে বস্তু ঘুরে কেমনে? দেখাই যাকঃ

মনে করুন, সবুজ রঙের একটা বল উদ্দেশ্যহীনভাবে ছুটে চলছিল। হটাৎ সবুজ বলটি লাল বর্ণের (ভারী) আরেকটা বলের মহাকর্ষ ক্ষেত্রে পড়ল। ফলে সে এখন ঐ লাল বলের কেন্দ্রমুখী বলের প্রভাবে সবুজ বল এর চারদিকে ঘুরবে।

কেন ঘুরবে, তা জানার জন্যে একটু এভাবে চিন্তা করিঃ

ধরি, কেন্দ্রমুখী বল নেই। অর্থাৎ লাল বল সবুজ বলকে টানবে না, কেন্দ্রমুখী বল প্রয়োগ করবে না এর উপর। তাহলে জড়তার কারণে সবুজ বল আগের মতই তার নিজের বেগে চলতে থাকবে। সবুজ বলের ছুটে চলার দৃশ্যঃ

 

ছবি পাওয়া যাচ্ছে না

চিত্র-২ঃ কেন্দ্রমুখী বল না থাকলে

 

এখন ধরি, কেন্দ্রমুখী বল আছে। তাহলে কী ঘটবে?

সেক্ষেত্রে লাল বলের কেন্দ্রমুখী বলের কারণে সবুজ বলের বেগ পরিবর্তন হবে [চিত্র-৩ দ্রষ্টব্য]। তার সোজা 1,2,3 বরাবর যাওয়ার কথা থাকলেও সে ঈষৎ লাল বলের দিকে বেঁকে 1′ অবস্থানে আসবে। এই 1′ অবস্থানেও লাল বলের কেন্দ্রমুখী বলের প্রভাব বিদ্যমান। এবং এই প্রভাবে সবুজ বল সোজা না গিয়ে আবারও ঈষৎ বেঁকে গিয়ে 2′ অবস্থানে আসবে। একইভাবে 3′ … ইত্যাদি অবস্থানে আসবে, অর্থাৎ বৃত্তাকার পথে চলতে থাকবে। তাহলে কি দেখলাম আমরা? শুধুমাত্র কেন্দ্রমুখী বল দিয়েই কি সুন্দর সবুজ বলটা লাল বলের চারদিকে নিজের অজান্তেই ঘুরতে শুরু করেছে। এই ঘুরার জন্যে কেন্দ্রমুখী বল ছাড়া আর কোন বলের দরকার আছে কি? নাই।

ছবি পাওয়া যাচ্ছে না

চিত্র-৩ঃ কেন্দ্রমুখী বল থাকলে

কেন্দ্রমুখী বলের মানঃ 

কেন্দ্রমুখী বলের মান হবে,

ছবি পাওয়া যাচ্ছে না

এই সূত্রের প্রমাণ এখানে দিয়ে আর মাথা নষ্ট করতে চাই না। উচ্চ মাধ্যমিকের যেকোন পদার্থ বিজ্ঞান বইয়ে এর প্রমাণ দেয়া আছে। তাও কেউ দেখতে চাইলে এখানে প্রমাণ পড়ে দেখতে পারেন, অথবা পড়তে কষ্ট হলে ভিডিও সহ শিখে নিতে পারেন।

তিনটা ফাও পরামর্শঃ 

  • কেন্দ্রমুখী ও কেন্দ্রবিমুখী বল শব্দ দুইটি ব্যবহার করার সময় সাবধান থাকবেন
  • কেন্দ্রমুখী ও কেন্দ্রবিমুখী বল এর বেশী গভীরে যেতে গিয়ে নিউটনের সূত্র খেয়ে ফেলবেন না, নিউটনের সূত্র সহই গভীরে যান
  • আন্ধার মত বই না পড়ে, বা লেকচার না শুনে বুদ্ধি খাটাইয়েন। এই মিসকনসেপশন নিয়ে প্রচুর বই-পু্স্তকেও বেশী একটা ঘাটায় নাই। কিছু বইয়ে ভুলও আছে।

 

আজ এই পর্যন্তই, আগামীতে আবার কোন মিসকনসেপশন নিয়ে আসছি …