রিভার্স সাইকোলজি (Riverse Psychology) 

“বিনা অনুমতিতে প্রবেশ নিষেধ”!

কি? এরকম লেখা দেখলেই ইচ্ছে করে না যে, “ঢুকেই দেখি না, কী আছে এর ভিতরে?”। ছোটবেলা হলে তো কথাই নেই, অবশ্যই ঢুকতাম ভিতরে।   

“এখানে প্রসাব করা নিষেধ, করলেই দন্ড”!

দেয়ালের এইটাইপ লেখার আশেপাশে নজর দিলেই দেখা যায়, কেউই দন্ডের পরোয়া করে নি। বরং আশেপাশের জায়গা বাদ দিয়ে বরং এখানেই আরও বেশি করে মূত্র বিসর্জন করেছে কথিত ভদ্রলোকেরা।

 

“বাস থামানো নিষেধ”!

ঠিক সেখানেই বাস এসে দাঁড়াবে, অথচ একটু সামনেই হয়ত বাস স্ট্যান্ড/বাস বে।

“পার্কিং নিষেধ”!

দেখা যায়,  রাজ্যের গাড়ি সব সেখানেই পার্ক করা।

”Don’t try this at home” -WWE

আমার মনে আছে, যেদিন প্রথম রেসলিং এর সতর্কবাণীটার ইনার মিনিং ধরতে পারি, সেদিনই প্রথম আমার ছোটভাইকে ধরে আন্ডারটেকার এর আছাড়’টা দেই (অবশ্যই বিছানার উপরে)।

ঘরের কেনা আমের চেয়ে, গাছের চুরি করা আমটাই আমাদের বেশী প্রিয়। কারণ তাতে যে নিষেধ ভাঙ্গার উত্তেজনা আছে।

আমাদের সবার সাইকোলজিই এমনই। আমাদেরকে যেই কাজটা করতে নিষেধ করা হবে, এট এনি কস্ট, সেটা করা লাগবেই। আমাদের এইরকম অদ্ভুত মনোবৃত্তির নামই – রিভার্স সাইকোলজি (Reverse Psychology)। আজকে আমরা এই নিয়েই গালগল্প করব।

 

শুরু কোথায়?

আচ্ছা, রিভার্স সাইকোলজির শুরু কোথায়? ধর্মীয় তত্ত্বানুযায়ী, এর শুরু একেবারে সৃষ্টির শুরু থেকে – The Original Sin এর কথা মনে আছে না? যেই বৃক্ষের ফল খাইতে খেতে নিষেধ করা হইছিল, ঘুরেফিরে ঠিক সেই বৃক্ষেরই ফল খাওয়া লাগল। ফলাফল – “Paradise Lost”।

ধর্মীয় ব্যাখ্যা বাদ দিয়ে রিভার্স সাইকোলজি নিয়ে একটা এক্সপেরিমেন্ট এর কথা বলি।

 

একটি এক্সপেরিমেন্টঃ 

“কীভাবে রিভার্স সাইকোলজি কাজ করে?” তাই নিয়ে ১৯৮২ সালে উইলসন আর ল্যাসিস্টার একটা এক্সপেরিমেন্ট করেন।

তারা একদল বাচ্চাকে অনেকগুলো খেলনা ধরায়ে দিয়ে, বসে বসে তাদের অবসার্ভ করতে লাগলেন। দেখা গেল, সব গুলো খেলনার মধ্যে কিছু খেলনা বাচ্চাদের বেশী পছন্দ হইছে, সেগুলা নিয়েই তারা বেশি খেলতেছে। আবার কিছু খেলনা কম পছন্দনীয় বাচ্চাদের কাছে। তার মধ্য থেকে উইলসন আর ল্যাসিস্টার সবচেয়ে অনাকর্ষণীয় খেলনাটা খুঁজে বের করলেন, যেটা মোটেই বাচ্চাদের পাত্তা পাচ্ছিল না।

তারপর বাচ্চাদের দুইটা গ্রুপে ভাগ করলেন। একটা গ্রুপকে আগের মতই যেকোন খেলনা নিয়ে খেলার স্বাধীনতা দিলেন। আরেকটা গ্রুপকে বললেন, “তোমরা সব খেলনা নিয়েই খেলতে পার, তবে এই খেলনাটা (সবচেয়ে ফালতু খেলনাটা) বাদে।”

একটু পর দেখা গেল ২য় গ্রুপের বাচ্চারা সেই “ফালতু খেলনা” নিয়েই উঠে পড়ে লেগেছে। তারা আগের চেয়ে ৩ গুণ বেশী সময় নিয়ে সেই ফালতু খেলনা দিয়ে খেলছে।

ইন্টারেস্টিং না? একদম দুধের বাচ্চার মধ্যে কী করে রিভার্স সাইকোলজি’র প্রভাব পড়ল? তবে কি এইটা আমাদের জেনেটিক?

 

কেন রিভার্স সাইকোলজি?

রিয়্যাকটেন্স থিওরি বলে, মানুষ যখন অনুভব করে করে যে, তার সেন্স অফ কন্ট্রোল অথবা মানসিক স্বাধীনতা ছিনিয়ে নেয়া হচ্ছে, তখন মানুষ চেষ্টা করে তা প্রতিরোধ করতে। এর জন্যে তাকে যা করতে বলা হয়, সে তা না করতে, তার বিপরীতটা করতে বদ্ধপরিকর হয়।

মানুষ নিজের ফ্রি উইলশ অনুযায়ী কাজ করতে বেশী পছন্দ করে। যখনই মানুষের ফ্রি-উইল টাকে শর্ত-আরোপ করে বেধে ফেলার চেষ্টা করা হয়। তখনই মানুষ অবচেতন মনে এর বিরুদ্ধে যাওয়ার চেষ্টা করে।

 

কাদের উপর বেশী কাজ করে?

কি? আপনার উপর কাজ করে রিভার্স সাইকোলজি?

রিভার্স সাইকোলজি বেশি কাজ করে খুব অল্পতেই রেগে যাওয়া, ইগোস্টিক, আবেগী, একরোখা, আত্ম-প্রবণ, ইনডিসিশনে ভোগা মানুষদের উপর। এবং দৈনন্দিন জীবনে তারা রিভার্স সাইকোলজির ফাঁদে পড়ে বিপদগ্রস্থ হয় প্রায়ই। অন্যদিকে মেন্টালি স্টেবল মানুষদের এ নিয়ে খুব বেশি ভুগতে হয় না রিয়েল লাইফে। তারা হুট করে ডিসিশন নিয়ে নেয় না।

 

রিভার্স সাইকোলজির ব্যবহারঃ

আচ্ছা, কাউকে দিয়ে কোন কাজ করিয়ে নিতে চাইলে কি আমরা রিভার্স সাইকোলজি ব্যবহার করতে পারি না? হ্যা, পারি, এবং এই কাজটাই মানুষ হরহামেশা করে থাকে। যেমন, বাচ্চাকালের কিছু টিচার আছে, যারা খালি ক্রিটিসাইজ করে স্টুডেন্টদের, খালি বলতে থাকে,

“তোমাকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না?”, “তুমি এটা পারবা না”, “তুই বরং পড়ালেখা বাদ দিয়ে হাল চষ।”  …ইত্যাদি

এসব টিচার কিন্তু অবচেতনমনে আমাদের উপর রিভার্স সাইকোলজিই ব্যবহার করে। আমাদের ভেতরের সত্ত্বাটাকে জাগিয়ে দিতে চায় রিভার্স সাইকোলজির মাধ্যমে, “তোমাকে দিয়ে হবে না”। আর আমাদের ভেতর থেকে উঠে আসে, “আমাকে পারতেই হবে”।

নাহ, এই প্রসেস অবশ্য সবার জন্যে কাজ করে না। কিছু ফাঁকিবাজ এবং অতি চালাক’রা আগে থেকেই টিচারের এই রিভার্স সাইকোলজি পলিসি আগেভাগেই ধরে ফেলে। তারা স্যারের এসব গায়ে ছুড়ে মারা বাণের মত কথা গুলো তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেয়, গায়ে লাগায়ই না।

এদের জন্যেও তরিকা আছে …  “রিভার্স-রিভার্স-সাইকলজি”। কিন্তু সেসবের ধার না ধেরে টিচার’রা নগদে মাইর শুরু করে দেয়।

যাই হোক, রিভার্স সাইকোলজি আমরা অহরহ ব্যবহার করি দৈনন্দিন জীবনে। বিশেষকরে শিশু-কিশোরদের উপর অনেক বেশী ব্যবহৃত হয় রিভার্স সাইকোলজি।

এছাড়াও মার্কেটিং এও প্রচুর ব্যবহার হয় রিভার্স সাইকোলজি। “৫ কোটি টাকার ফেয়ার এন্ড লাভলী চ্যালেঞ্জ” কিংবা “ভিম এর চ্যালেঞ্জ” এর পাল্লায় পড়ে সহজ সরল মানুষ মোটিভেটেড হচ্ছে, রিভার্স সাইকোলজির ফাঁদে পড়ছে।

রিভার্স সাইকোলজি ব্যবহার করা যে খারাপ এমন কিন্তু না। যে এটা ইউজ করতে পারে সে তো ইউজ করবেই। আর আপনি যদি মানসিকভাবে শক্তিশালী না হন, তাহলে রিভার্স সাইকোলজির কাছে হেরে যাবেন। মাইন্ড গেইমে হার-জিত তো হবেই।