সুবারেক ও আইজুদ্দি মিয়া বই লিখেছে। অনেক জনপ্রিয়। জনপ্রিয়তা ‘৩০ দিনে জাপানী ভাষা শিখুন‘ বইয়ের চাইতেও বেশি। তারা অদ্ভূত সব তথ্য দিচ্ছে, ব্রেকিং নিউজ দিচ্ছে, যা জীবনে ভাবেননি সেটাও বলতেছে। পাবলিক পানি ছাড়াই বই গিলছে, কেউ গিলতে না পেরে হেঁচকি খাচ্ছে তবুও গিলছে। তারপর আমার মতো বিজ্ঞানের ছাত্রদের কানাপট্টিতে বনচটকানা মেরে বলতেছে, “এইচআইভি ভাইরাস বুঝরকি!”, “গ্রাভিটি থাকলে পাখি কেমনে উড়ে!”, “পৃথিবী থালার মতো চ্যাপ্টা, গোল হইলো আমরা পড়ে যেতাম”, “চাঁদের বুকে কার চেহারা ভাসে আর চাঁদে কিসব শব্দ শুনে”, “টিকা বা ভ্যাকসিনে অটিজম নাকি ঘটে”। প্রতিবাদ করলেই ঠুয়া মেরে বলে, ‘এইত্যা নাকি বিজ্ঞানীরাই বলছে’।  কোন বিজ্ঞানী তাদের নাম জানে না, কোন বিজ্ঞান গবেষণা জার্নালে বিজ্ঞানীরা লিখেছে সেটাও জানে না, কবে বের করেছে সেটাও জানে না- তবে কানটা টেনে বলে ‘সুবারেক ও আইজুদ্দি মিয়ার বই’ আসল বিজ্ঞান বই বাকিসব ভূয়া!!

শুরুতেই বলে রাখি, এটা পড়ার পর অনেকে গালি দিবার জন্য তৈরি হবেন। কারণ আপনি এটার পর বুঝতে পারবেন কেন আপনার দাবিকৃত গ্রন্হটি কেন বিজ্ঞানসম্মত নয় বা কেন বিজ্ঞানীদের কাছে মূল্যহীন! আপনার কাছে কাছে একটি বই বা গ্রন্হ সত্য হবার সাথে সেটা বিজ্ঞানসম্মত হবার কিছু নাই বা বিজ্ঞানবই দাবি করারও কিছু নাই। এটা যদি বুঝতে কষ্ট হয় একটু কষ্ট করে পড়ে নিন।  

বিজ্ঞান আসলে কি? বিজ্ঞান কি শুধু সত্যের লিপিবদ্ধতা না কি অন্য কিছু। ইতিহাস বইয়েও সত্য থাকে, তবে কি ইতিহাস বই বিজ্ঞানবই? অবশ্যই না। খবরপত্র বা ম্যাগাজিনেও সত্যখবর থাকে, তবে কি সেটাও বিজ্ঞানবই? অবশ্যই না। কোস্টগার্ডের লগবুকেও সত্য থাকে তবে কি সেটা বিজ্ঞানবই? অবশ্যই না। আপনার ডাইরিতেও সত্য লিখা থাকে তবে কি সেটা বিজ্ঞানবই? অবশ্যই না।

তাহলে বিজ্ঞানবই বা সায়েন্টিফিক বুক কি?

বিজ্ঞানবই বা সায়েন্টিফিক বুক হচ্ছে কল্পকাহিনী বা ফিকশনবিহীন বই যা কোন বিজ্ঞানী/গবেষক/প্রফেসর কর্তৃক লিখে থাকেন যা বিজ্ঞানের কঠিন বিষয়গুলো সাধারণ বিজ্ঞানজানা লোকদের জন্য সহজবোধ্য। কারণ আসল গবেষণাপত্র বুঝতে হলে আপনাকে একাডেমিক প্রশিক্ষণ ও ঐ বিষয়ে অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। কখনো কখনো বিজ্ঞানী নন এমনে ব্যক্তিও লিখতে পারে যদি তিনি বিজ্ঞানের কঠিন উপাত্ত এবং উৎঘাটনকে সহজ করে লিখে দেন। সাধারণত বিজ্ঞানীরা গবেষণাজার্নালে তাদের গবেষণাপত্র প্রকাশ করে যা একই বিষয়ে গবেষণা করা অন্য গবেষকরা পুরোপুরি বুঝলেও ঐ বিষয়ের বাইরের লোকদের জন্য সহজ নয়। এই ধরনের বিজ্ঞানবই ঐ বিষয়ের অভিজ্ঞ ব্যক্তিরা পড়ে ঐ বই কতটা ভালো সেটাও জানান। বিজ্ঞানবই বিজ্ঞানের টেক্সটবুক থেকে আরো সহজবোধ্য এবং কোন একটি বিষয়ে প্রতি অধিক জোর দিয়ে লিখা। উদাহরণ: নিউটনের ফিলোসফি ন্যাচারালিস প্রিন্সিপিয়া ম্যাথমেটিকা, ডারউইনের অরিজিন অব স্পিসিস, আইনস্টাইনের রিলেটিভিট: দ্যা স্টেশাল এন্ড দ্যা জ্যানেরাল থিউরি, স্টিফেন হকিংসের এ ব্রিফ হিস্টরি অব টাইম, রিচার্ড ডকিংসের দ্যা সেলফিস জিন, সিদ্ধার্থ মুখার্জির দ্যা জিন: এন ইন্টিমেট হিস্টরি, নিল ডিগ্রাস টাইসনের এস্ট্রোফিজিক্স ফর পিপল ইন হারি ইত্যাদি।

৩০ দিনে মুভিতে রোল পাবেন বইয়ের মেকি ছবি। দয়া করে কেউ কিনে প্রচারিত হবেন না।

কোন বিজ্ঞানীর সাফল্য বা সে কতটা ঐ বিষয়ে জানে সেটা তার গবেষণাপত্র(রিসার্চ আর্টিকেল) ও পৃথিবীর অন্যপ্রান্তে কতজন সেই একই কাজের পুনরাবৃত্তি বা ধারাবাহিকতা খুঁজে পান সেটার উপর নির্ভর করে। যেমন আপনারা আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা তত্ত্ব জানেন, সবাই মানেন তিনি বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানীদের একজন। কিন্তু কতজন জানেন যে ঠিক কি কারণে তার আপেক্ষিকতা তত্ত্ব সত্যি? বা ধরুন, বিজ্ঞানী নিউটনও মাধ্যাকর্ষণ তত্ত্ব দিয়েছেন (তিনি মাধ্যাকর্ষণ সূত্রও দিয়েছেন) যেখানে তিনি বস্তুর ভর ও দূরত্বে কারণে মাধ্যাকর্ষণ শক্তির প্রভাব বর্ণনা করেন। সেটা কেন সত্যি? মাধ্যাকর্ষণ নিয়ে বহু থিওরি রয়েছে, যেটা ক্যালটেক ইউনিভার্সিটির এই লিংকে পড়তে পারেন। (লিংক: )

এখন আপনি নিজেই চিন্তাকরুন, ঠিক ঐ বিষয়ে আপনি কজন বিজ্ঞানীর নাম জানেন বা কজনের থিওরি জানেন। কিন্তু আপনি নিউটন ও আইনস্টাইনের নাম ঠিকই জানেন। কারণটা কি? কারণ হলো ঐ বিষয়ে গবেষণা করা অধিকাংশ বিজ্ঞানী তাদের কাজকে সমর্থন ও তাদের কাজের ধারাবাহিকতা করতে পেরেছে। যেমন, ধরুন লিওনার্দো ডি ক্যাপ্রিও বা টম হ্যাংক বা শাহরুখ খান বা সালমান খান বা সালমান শাহ বা ইলিয়াস কাঞ্চন যদি ছায়াছবিতে কিভাবে অভিনয় করতে হয় সেটা নিয়ে একটা বই লিখেন আর আমি যদি “৩০ দিনে কিভাবে মুভিতে রোল পাবেন” বই লিখি, তবে কোন বই অধিক গ্রহণযোগ্য। অবশ্য আমার বইয়ের বিক্রি হয়তো বেশি হবে কারণ মূল্য মাত্র দশটাকা তবে কোম্পানির প্রচারের জন্য ৫ টাকা!! 

বিজ্ঞান বইয়ের শর্ত হলো গাঁজাখুড়ি বা কল্পনীয় বা অতিপ্রাকৃতিক যুক্তি ইত্যাদি থাকতে পারবে না। কেন? কারণ বিজ্ঞানের কাজই হলো সুনির্দিষ্ট পদ্ধতিতে কোন অবজারভেশন বা পর্যবেক্ষণ থেকে সুনির্দিষ্ট হাইপোথিসিস বা অনুসিদ্ধান্তের মাধ্যমে পরীক্ষা করা বা অনুমান করা, এবং সেই পরীক্ষার ফলাফল বা অনুমান দিয়ে পরবর্তী পর্যবেক্ষণের সত্যতা বের করা। আর তা শুরু হয় প্রশ্ন দিয়ে? তবে এ প্রশ্ন আপনার আমার মতো তিল কেন তাল নয় এমন প্রশ্ন নয় বরং সুনির্দিষ্ট উত্তরের জন্য প্রশ্ন যা আরো অন্য প্রশ্নের সমাধান দিবে। সুতরাং বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীকে বিজ্ঞান ভেবে বগল-বাজানোর কিছু নাই।

এখানে প্রথমেই বলে রাখা ভালো, হাইপোথিসিস গ্রহন করার সময় আপনার নিরপেক্ষ থাকতে হবে। অর্থাৎ নাল হাইপোথিসিস( যেটা আপনার দাবিকে সত্য বলে গ্রহণ করে) এবং অল্টারনেটিভ হাইপোথিসিস(যেটা আপনার দাবিকে সম্পূর্ণ মিথ্যা বলে গ্রহণ করে)। আর আপনি যা ফলাফল পাবেন সেটাকে সত্য ধরে পরবর্তী প্রশ্নের গুলোর উত্তর সঠিক কিনা সেটাও পরীক্ষা করতে হবে। ব্যাপারটা খুব কঠিন? মোটেও না।

“ধরুন, একটা লাল ব্যাগ ক্লাসে পড়ে আছে। আপনি আর শ্যামল ক্লাসে ঢুকলেন। শ্যামল নিজেকে লাল ব্যাগের মালিক বলে দাবি করলো। তাহলে,

নাল হাইপোথিসিস: ব্যাগটা শ্যামলের।

অল্টারনেটিভ হাইপোথিসিস: ব্যাগটা শ্যামলের না।

এই গেল হাইপোথিসিস তৈরি করা এখন হচ্ছে আপনার পরীক্ষা বা এক্সপেরিমেন্ট নকশা করা। কিভাবে প্রমাণ করা যায় যে ব্যাগটা শ্যামলের? বা শ্যামলের না?শ্যামল যদি ব্যাগের মালিক হয়, তবে ব্যাগের ভিতর কি আছে বা ব্যাগটি কেমন সেটা শ্যামল ভালো জানার কথা। ঠিক?

শ্যামল বললো, ব্যাগটি লাল। ফলাফল: ব্যাগটি লাল। কিন্তু ব্যাগটি লাল সেটা শ্যামল দেখতেই পাচ্ছে। সুতরাং এই তথ্য আগেই থেকে জানা এবং এ তথ্য থেকে শ্যামলের দাবি পুরোপুরি গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ আপনিও জানেন ব্যাগটি লাল।

পরবর্তী পরীক্ষায় বলা হলো, ব্যাগের ভিতর কি আছে?

শ্যামল বললো, ভিতরে বই আছে। ফলাফল: ব্যাগের ভিতরে বই আছে। কিন্তু তাতে কি শ্যামলের দাবি গ্রহণযোগ্য হয়। অবশ্যই না। কারণ একটা ব্যাগ যদি ক্লাসের মধ্যে থাকে তবে সেটাতে বইপত্র থাকা অনুমান করা কঠিন কিছু না।

পরবর্তী পরীক্ষায় বলা হলো, আরো বিস্তারিত এবং সুনির্দিষ্টভাবে বলতে হবে।

শ্যামল বললো, ব্যাগের ভিতরে তার একটা পদার্থ বই, তিনটা খাতা আর দুটি কালো কলম আছে। যার উপরে তার নাম, রোল লিখা আছে । সাথে তার আইডিও আছে।”

আপনি ব্যাগের ভিতর দেখলেন এসবই আছে। এ পদ্ধতি হলো বিজ্ঞানপ্রশ্ন খোঁজার মতো (পুরোপুরি বললাম না)।

এখানে প্রথমেই আপনি শ্যামলের দাবির বিরুদ্ধে অবিশ্বাস বা সন্দেহ করেছেন। এটাই বিজ্ঞান। বিজ্ঞান প্রশ্ন করবে বিজ্ঞান উত্তর খুঁজবে। শ্যামল আপনার জিগড়ি দোস্ত বা আপন ভাই হলেও আপনি তার প্রশ্নবিদ্ধ করে সঠিক উত্তর বের করেছেন এটাকে বিজ্ঞানমনস্ক লোক বাহবা দিবে। ল্যাবে আমার প্রফেসর যা বলে, তা আমি জ্বি হুজুর বলে স্বীকার করি না বা আমার দাবি সব বস মেনে নেয় না। দুজন মিলে আমরা সঠিক প্রশ্ন বের করি, কিভাবে প্রশ্নের উত্তর বের করবো সেই পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করি এবং যা ফলাফল আসবে সেটাকে সত্য ধরে পরের ধাপে যাবো। তাতে আমি এবং আমার প্রফেসর কাউকে অসম্মান করা হয়েছে এটা ভাবি না। বরং নিজের হাইপোথিসিস মিললে ভালো চিন্তা করতে পারি তাতে খুশি হই সাথে সাথে এটাও আশা করি অন্য গবেষকরা যদি একই রকম ফলাফল পায়। যদি আরো অনেক গবেষক একই ঘটনায় একই ফলাফলে পুরাবৃত্তি দেখে তখন আমার প্রফেসর উনি ঐ ঘটনার কোন একটি অংশকে ব্যাখ্যার জন্য থিওরি দিবেন। যখন এই থিওরি বার নির্ভুল প্রমাণিত হবে বা একই ধরনের পর্যবেক্ষণের সবচেয়ে যৌক্তিক উত্তর হবে, সেটা বিজ্ঞানীরা ফ্যাক্ট হিসেবে মেনে নিবে।

চিত্র: বিজ্ঞানপদ্ধতি।

চিত্র: বিজ্ঞানপদ্ধতি।

বিজ্ঞানগ্রন্হ বা বিজ্ঞান বই বা বিজ্ঞানসম্মত(!!?) বই কোন একটি ঘটনার ব্যাখ্যা গুলো বিভিন্ন প্রশ্নের মাধ্যমে উত্তর খুজবে এবং উত্তর পাবার পর ঐ উত্তরগুলি সত্য হলে আর কি কি সত্য হবে তা অনুমান করবে। আর যদি সম্ভাব্য উত্তর অনুমান করে তবে ঐ অনুমান সত্য হবার জন্য কি কি উপাত্ত লাগবে তা বর্ণনা করবে। যারা বিজ্ঞান বিষয়ে মাস্টার্স করেছেন(গবেষণা বা প্রাকটিকাল) তাদের গবেষণার শুরুতে একটি এইম বা লক্ষ্য থাকে একটি কেন্দ্রিয় হাইপোথিসিস থাকে বা কোন একটি পর্যবেক্ষণ করার সম্পাদনা থাকে। আপনি গবেষণা করে উপাত্ত তৈরি করেন, সেই উপাত্তকে বিশ্লেষণ বা এনালিসিস করে সিদ্ধান্তে আসেন, সেই সিদ্ধান্তের পর আপনি বলেন ভবিষ্যতে কি কি করা উচিত বা কি কি করা লাগবে বা কি কি করা যায়। এই কি কি করা লাগবে, এটার মানে পরবর্তীতে যে আপনার গবেষণায় হাত লাগাবে সে দিক নির্দেশনা পাবে। বিজ্ঞান একটা রিলে রেসের মতো এইখানে এই কি কি করা বলে দেয়া, বাটনটা সামনের যাত্রীর জন্য। কিন্তু সে নিজেই দৌড়াবে।

একই ঘটনা এতদূর গড়াতো না। যদি আপনি শ্যামলের কথা সাথে সাথে বিশ্বাস করতেন। এটাকে বলে বিশ্বাস, বিজ্ঞান নয়। যদিও ব্যাগটা শ্যামলের- ঘটনাটি সত্য কিন্তু আপনার যৌক্তিক প্রস্তাবনা বিজ্ঞান সম্মত ছিলো না। যদিও আপনি বিশ্বাস করলে, উপরের যা যা ঘটনা বের করেছেন সবই সত্য হতো, তারপরও এটা বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি নয়।

এখন নিজেই প্রশ্ন করুন, যখন আপনি দাবি করেন আপনার গ্রন্থটি বিজ্ঞানসম্মত তখন কি আপনি ঐ দুই হাইপোথিসিস চিন্তা করেন ( যার একটি বলবে আপনার গ্রন্হ সম্পূর্ণ মিথ্যা)? কোন ঘটনা বর্ণনা করাই বিজ্ঞান নয়, এটা বুঝতে না পারার কথা না। আর কোন ঘটনা ব্যাখ্যা কতটা সুনির্দিষ্টভাবে এবং সুস্পষ্টভাবে আবারো বলছি সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে তা নিজেই বিচার করুন। যেকোন বিজ্ঞান গবেষণাপত্রে কতটুকু আপনি গবেষণা করে উত্তর বের করেছেন সেটা সুস্পষ্ট বলতে হবে। হালকার উপ্রে ঝাপসা দিয়ে বিজ্ঞান চলে না। আপনি যদি বলেন ও আগে আমরা বুঝি নাই বা অর্থটা এমন হবে, তাহলে যে কোন লাল ব্যাগ দেখেই বলা আগে কালারটার নাম জানতাম না এখন জানি।

গাছ থেকে আপেল পড়ে সেটা নিউটনও দেখেছে আর নিউটনের আগে আরো বহু আম-জনতা এবং বহু বিজ্ঞানীও দেখেছে। এটা যে আকর্ষণ সেটাও লোকজন বুঝতে পেরেছে। কিন্তু দুটি বস্তুর ভর আর দূরত্বের সাথে মাধ্যাকর্ষণ সম্পর্কে আছে সেটা কেউ কি ব্যাখ্যা করতে পেরেছে। আর এই থিওরি থেকে পরবর্তীতে গ্রহের ভরও বের করা হয়েছে। খন যদি নিউটনের আগের লোকজন যদি বলে, “আমি আগেই জানতাম এইখানে একটা আকর্ষণ আছে, কেমনে আছে জানি না বা কমু না, তোমরা খালি বিশ্বাস কইরা লও” সেটা কি বিজ্ঞানসম্মত বা যুক্তিযুক্ত হবে? এখানে বলে রাখা ভালো, আজ থেকে প্রায় ১৬০০ বছর আগে ভারতীয় বিজ্ঞানী আর্যভট্ট মাধ্যাকর্ষণ নিয়ে কাজ করে গিয়েছিলেন। নিউটনের আগে গ্যালিলিও কাজ করেছেন। পরবর্তীতে আলবার্ট আইনস্টাইন তার সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্বের মাধ্যাকর্ষণে মহাকাশসময়ের বক্রতা(স্পেস টাইম কার্ভেচার- বাংলা জানি না) সম্পর্ক বের করেছেন। থিওরি দিয়েই বিজ্ঞান শেষ হয়ে যায় না, বাটনটা সামনের যাত্রী পরের যাত্রীর কাছে পৌছে দিতে থাকে। তাই এইটার উপর কোন প্রশ্ন করা যাবে না বা জ্ঞানের কোন শেষ নাই- প্রশ্ন করা বৃথা বলা বিজ্ঞানসম্মত নয়।

আপনার গ্রন্হ সত্য না মিথ্যা সেটা নিয়ে কোন বিতর্ক নেই। সত্য অনেকক্ষেত্রেই আপেক্ষিক হতে পারে। যেমন, আমার মা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মা এটা আমার কাছে যেমন সত্য তেমনি আপনার মা আপনার মতে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ। সেটা কি বৈজ্ঞানিক সত্য? বৈজ্ঞানিক সত্য বা ফ্যাক্ট হতে হলে বিশ্বের অন্য সকল মায়ের সাথে নির্ধারিত কিছু বৈশিষ্ট্যের তুলনা হবে আপনার এবং আমার মা এর ক্ষেত্রে। সেক্ষেত্রে আমার বা আপনার মা যদি শ্রেষ্ঠ প্রমাণিত হয় তবে কি আপনি মেনে নিবেন? যদি প্রমাণ ও পরীক্ষার পরেও আপনার দাবির পরিবর্তন না ঘটে সেটা বিশ্বাস, বিজ্ঞান নয়।

সব কিছুতেই বিজ্ঞানের লেবেল লাগাতে হবে কেন সেটা আমার বোধগম্য নয়। বইয়ের চাইতে চিন্তাভাবনায় বিজ্ঞানের লেবেল লাগান আর বিজ্ঞানীদের কাছ থেকে বিজ্ঞান শিখুন। ডাক্তারের কাছে থেকে যেমন আপনি যেমন ইঞ্জিনিয়ারিং এর জ্ঞান আশা করেন না তেমনি ইঞ্জিনিয়ারের কাছেও আপনি ডাক্তারি জ্ঞান আশা করেন না। আর ডাক্তারকে ইঞ্জিনিয়ার আর ইঞ্জিনিয়ারকে ডাক্তার লেবেল দেন না আশা করি।

বিজ্ঞান আপনার বিশ্বাস বা দাবিকে অবজ্ঞা বা হেয় করবে না, বলবে না আপনি এটা বিশ্বাস বা দাবি ধ্বংস হবেন। বরং বিজ্ঞান আপনার যুক্তিযুক্ত প্রশ্নকে সমর্থন দিবে, আপনাকে প্রশ্ন করে আপনার দাবি কতটুকু যুক্তিযুক্ত সেটা বুঝার চেষ্টা করবে। তবে কোন কিছুকে বিজ্ঞানসম্মত দাবি করলে বিজ্ঞানীদের কাছ থেকে সব ধরনের প্রশ্ন পাবেন আশা রাখবেন। আপনি সঠিক পদ্ধতিতে যদি বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে যদি তালগাছকে তিল গাছের(!!!??) সাথে সম্পর্ক দাঁড় করাতে পারেন এবং অন্যান্য বিজ্ঞানীরা আপনার ফলাফল পুরাবৃত্তি করতে পারে তবে আপনি “তালকে তিলকারক” হতে পারবেন। আর হ্যাঁ সেটা আপনাকে পিয়াররিভিউড বিজ্ঞানজার্নালেই প্রকাশিত বা পাবলিশ করতে হবে। আপনি ব্লগে আর ফেসবুকে হাতিঘোড়া মারেন আর চাঁদে শব্দ শুনেন তাতে বিজ্ঞানের কিছু আসে যায় না। আর যেটা বিজ্ঞানীরা একমত পোষণ করে সেটাকে বিজ্ঞান বলে প্রচার করুন, “ওয়ার্কিং এট ফেসবুকে” এর ব্লগারের বিজ্ঞানজ্ঞান বিজ্ঞান না। জ্বি আমার কথাকেও বিজ্ঞান না ভেবে বিজ্ঞানবই থেকে বিজ্ঞান শিখুন। বিজ্ঞান বই হচ্ছে যে একজন বিজ্ঞানী/গবেষক/প্রফেসর লিখেছেন যার এই বিষয়ে দক্ষতা আছে। এমন বিজ্ঞানী/গবেষক/প্রফেসর যিনি তার বিষয়ে অভিজ্ঞ অন্যান্য বিজ্ঞানী/গবেষক/প্রফেসর কাছে বিতর্কিত নন।বাংলা বিষয়ে প্রশ্ন থাকলে যদি ভাষাবিদের বই পড়তে পারেন, ভাষাবিদের কথাকে যদি  সঠিক ভাবেন তবে বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে কেন বিজ্ঞানীদের কথা( যেটাতে অধিকাংশ বিজ্ঞানী একই মত প্রকাশ করেছেন) বিজ্ঞান প্রচার করতে দ্বিধা কেন? আপনি নিশ্চয়ই একজন বিজ্ঞানী যদি বলে ‘বাংলা’ শব্দে ‘ব’ কে “ভ” বলতে হবে, তা নিশ্চয়ই অনুসরণ করবেন না! বা যদি একজন ভাষাবিদ একই দাবি করে আর বাকিরা না বলে, সেটা বিশ্বাস করবেন না। আর বাংলার আসল উচ্চারণ কি হবে সেটা নিশ্চয়ই বাংলা অভিধান দেখবেন। তেমনি বিজ্ঞানের কোন বিষয়ে আপনার প্রশ্ন বা বিভ্রান্তি থাকলে বিজ্ঞানের টেক্সবুক (যেগুলো অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো হয়, যেটা বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের পড়ানো হয়) সেটা পড়ুন। সুবারেক বা আইজুদ্দি মিয়ার বুজরকি বিজ্ঞানের বই কিনে টাকা, সময় ও বুদ্ধি নষ্ট হবে।   

আর বিজ্ঞানকে জানুন শ্রদ্ধা করুন। আপনি যদি ভ্যাকসিনের জন্য আজকে বেঁচে থাকেন, বাসে-ট্রেনে-গাড়িতে-রিকশায় চড়ে বাসায় আসেন, ফ্যান-এসি ছেড়ে স্বস্তি পান, মোবাইলে ইন্টারনেট দিয়ে ফেসবুকে ঢুকে আমার পোস্ট দেখেন, তারপর তেলে-বেগুনে জ্বলে গালি দিবার প্রিপারেশন নেন- তবে বিজ্ঞানকে ধন্যবাদ দিন। আপনার তেলে-বেগুনে জ্বলার উঠাটা সম্ভব হয়েছে মাতৃমৃত্যুহার কমিয়ে এবং টিকা(ভ্যাকসিন) দিয়ে জীবাণু থেকে সুরক্ষা করে। আর হ্যাঁ টয়লেট থেকে আসার পর হাত এবং গালি দিবার পর মুখ সাবান দিয়ে ধুবেন আশা করি(পরেরটা সারকাজম)।

পুনশ্চ:
১. আমার কথাকে বিজ্ঞান ভাবারও কোন কারণ নাই। আমার কথা যদি যুক্তিযুক্ত হয় এবং সত্যিকারের তথ্যপ্রমাণাদির সাথে সম্পর্কযুক্ত হয় তবেই মানুন।
২. এই লেখাটি সাধারণ মানুষের সচেতনার জন্য। অনেকেই উল্টাপাল্টা বই পড়ে বিজ্ঞান সম্পর্কে ভুল শিখেন এবং জানেন। আশাকরি এ পোস্ট পড়ার পর কোন বই বা দাবিটি বিজ্ঞানসম্মত তা বুঝার উপায় নিজে নিজেই বের করতে পারবেন।
৩. পোস্টে কোথাও ভুল মনে হলে জানাবেন।

Mir Mubashir Khalid

Mir Mubashir Khalid

Graduate Student
Research Interests & experience: Virology (HIV, HBV, HCV, ZIKV), Molecular Biology, Chromatin Biology (mSWI/SNF, PRC), Adult Stem cell(aSC) Organoids (Liver & Intestinal(Hans Clever protocol), Immunogenic population based SNP study (GBS). HIV Latency. Involved in Research(Molecular biology) since 2011. Education: 2016-Present: Graduate Student, GIVI, Gladstone Institutes (UCSF), San Francisco, USA; PhD Candidate, MGC program, Dept. of Biochemistry, ErasmusMC (EUR), The Netherlands. 2013-2015: MSc(Research Master) on Infection & Immunity, ErasmusMC (EUR), The Netherlands 2007-2012: M.S. & B.S. on Genetic Engineering & Biotechnology, University of Dhaka, Bangladesh. (DU Batch:2006) Job: 2016-Present: Visiting Research Scholar (Graduate Student), Ott Lab, Gladstone Institutes of Virology & Immunology, Gladstone Institutes, SF, USA. 2015-2016: Research Analyst, Mahmoudi Lab, ErasmusMC, The Netherlands. 2012-2013: Research Officer, Emerging Diseases & Immunobiology, Islam lab, iccdr,b, Bangladesh.
Mir Mubashir Khalid