পৃথিবীর সবচেয়ে কমন মানষিক ব্যাধিগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে ডিপ্রেশন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, পৃথিবীর ৩৫০ মিলিওন মানুষ ডিপ্রেশনে আক্রান্ত। ডিপ্রেশনে আক্রান্ত ব্যক্তি প্রলম্বিত সময়ের জন্য বিষন্ন বোধ করে, হতাশ হয়ে থাকে, ইচ্ছাশক্তি হারিয়ে ফেলে, গোটা পৃথিবীর উপর বিরক্ত হয়ে যায়। ( ডিপ্রেশন সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পড়ে আসুন, ডিপ্রেশন ১০১ ) ডিপ্রেশনের চিকিৎসা করার সবচেয়ে জনপ্রিয় উপায়গুলোর মধ্যে একটি হল এন্টিডিপ্রেসেন্টের ব্যবহার। এ পর্বে আমাদের আলোচনা হবে এন্টিডিপ্রেসেন্টের কার্যপ্রনালী এবং প্রকারভেদ নিয়ে।

এন্টিডিপ্রেসেন্ট কী?

এন্টিডিপ্রেসেন্ট নাম শুনলে মনে হয় এটা ডিপ্রেশনের সাথে ঢাল তলোয়ার দিয়ে যুদ্ধ করে ডিপ্রেশনকে একদম ধ্বংস  করে দেয়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে, এন্টিডিপ্রেসেন্ট একধরণের ড্রাগ যা ডিপ্রেশনের উপসর্গকে উপশম করতে সাহায্য করে। এন্টিডিপ্রেসেন্টের কার্যপদ্ধতি বোঝার আগে আমরা সংক্ষিপ্ত ভাবে নিউরোট্রান্সমিশন বুঝে নিবো। নিউরন (মস্তিষ্কের কোষ) বার্তা আদান প্রদান করে ডেন্ড্রাইটের (গাছের শাখার মত অংশগুলোর) মাধ্যমে।  তারপর সে বার্তাগুলো ইলেক্ট্রিক্যাল সিগনালের রূপে এক্সনের মাধ্যমে পাঠানো হয়। এক্সন পার্শ্ববর্তী নিউরনের সাথে ডেন্ড্রাইটের সাথে মিলিত হয়। কিন্তু এক্সন এবংপার্শ্ববর্তী নিউরনের ডেন্ড্রাইট একে অপরকে স্পর্ষ করেনা। আবার ইলেক্ট্রিক্যাল সিগনাল লাফ দিয়ে এক্সন থেকে ডেন্ড্রাইটে যেতে পারেনা। তাহলে বার্তা এক কোষ থেকে অন্য কোষে স্থানান্তরিত হয় কীভাবে? বার্তা যখন এক্সনের শেষপ্রান্তে এসে পৌছায়, ইলেক্ট্রিকেল সিগনাল ক্যামিকেল সিগনালে পরিণত হয়। এই ক্যামিকেল সিগনালের মাধ্যমে উদ্দীপ্ত (Triggered) হয়ে কোষের কেমিকেল পরিপূর্ন ভেসিকেল নিউরোট্রান্সমিটার নির্গত করে। এবং এ নিউরোট্রান্সমিটারগুলি কোষ মেম্ব্রেনের বাইরে বের হয়ে সিনাপ্যাসে চলে যায়। এভাবে কিছু নিউরোট্রান্সমিটার অপর কোষের কাছে জড়ো হলে সে কোষে ইলেক্ট্রিক্যাল সিগনাল প্রেরিত (transmitted) হয়।

নিউরনের গঠন

নিউরনের গঠন

আজকে আমরা যে এন্টিডিপ্রেসেন্ট নিয়ে আলোচনা করবো, সেটি এই সিনাপ্স স্তরে কাজ করে। ডিপ্রেশন নিজেও এই সিনাপ্সের স্তরে কাজ করে। গবেষণায় দেখা যায়, ডিপ্রেশনের কারণ কম মাত্রার মনোএমিন নিউরোট্রান্সমিটার (সেরোটনিন, নরেপিনেফ্রিন, এপিনেফ্রিন, ডোপামিন)। আজকে আমরা ৩স্তরের এন্টিডিপ্রেসেন্ট নিয়ে কথা বলবো, Monoamine oxidase inhibitors(MAOI), Tricylclic antidepressant(TCA), এবং Selective Serotonin Reuptake Inhibitors(SSRI)। এন্টিডিপ্রেসেন্টগুলো মূলত এ নিউরট্রান্সমিটারগুলোর মাত্রা ঠিক করতে সাহায্য করে।

Monoamine oxidase inhibitors(MAOI)

Monoamine oxidase inhibitors এর নামেই তার পরিচয়। MOAI Monoamine oxidase নামক এনজাইমের কাজকে বাঁধা দেয়। Monoamine oxidase নিউরোট্রান্সমিটারকে ভেঙে দেয়। MOAI এই এনজাইমের কাজকে বাঁধা দেয়ার মাধ্যমে সিনাপ্সে নির্গত হওয়া নিউরট্রনাসিটারের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়। সিনাপ্সে বেশি নিউরোট্রান্সমিটারের উপস্থিতি পরবর্তি নিউরনে ইলেক্ট্রিক্যাল সিগনাল ট্রান্সমিট হওার সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেয়।

Tricyclic antidepressant(TCA)

Tricyclic antidepressant এর নাম থেকে তার কার্যপদ্ধতির ধারণা পাওয়া না গেলে তার আকার সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। এ এন্টিডিপ্রেসেন্টগুলো তিনটি রিং দ্বারা গঠিত। এটি নেরএপ্রিফিন এবং সেরোটোনিন নামক নিউরোট্রান্সমিটারের উপর কাজ করে। ভেসিকেল নিউরোট্রান্সমিটার নিরগত করার পরই তা সিনাপ্সে ছেড়ে দেয়না। প্রিসিনাপ্টিক স্তর থেকে কিছু পরিমাণ নিউরোট্রান্সমিটার আবার ভেতরে শোষণ করে নেয়। এ প্রক্রিয়াকে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় বলে Reuptake। TCA  রিয়াপটেক প্রক্রিয়াকে বাঁধা দেয় এবং সিনাপ্সে সর্বোচ্চ পরিমাণ নিউরোট্রান্সমিটারের উপস্থিতি নিশ্চিত করে।

Tricyclic antidepressant

Tricyclic antidepressant

Selective Serotonin Reuptake Inhibitors(SSRI)

Selective Serotonin Reuptake Inhibitors(SSRI) TCAর মতই রিয়াপটেক প্রক্রিয়াকে বাঁধা দেয়। তবে SSRI সেরোটনিন এবং নেরোএপ্রিফিনের পরিবর্তে কেবল সেরোটনিনের রিয়াপটেকে বাঁধা প্রদান করে। এভাবে সিনাপ্টিক স্তরে সেরোটনিনের উপস্থিতি বাড়িয়ে দিয়ে পরবর্তি নিউরনে ইলেক্ট্রিক্যাল সিগনাল ট্রান্সমিট হওার সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেয়। সুতরাং, MAOIএর মত SSRI এর নাম থেকেও তার কার্যপদ্ধতির বিবরণ পাওয়া যায়। অন্য দুই ধরণের এন্টিডিপ্রেসেন্তের চেয়ে SSRI আমাদের কাছে অধিক পরিচিত।

এন্টিডিপ্রেসেন্টের প্রকারভেদ এবং কার্যপদ্ধতি জানার পর প্রশ্ন আসতে পারে, একজন ডাক্তার কীসের ভিত্তিতে রোগীকে ওষুধ নির্ধারণ করবেন? উত্তর খুবই সহজঃ যেটা সবচেয়ে ভালো কাজ করে সেটা। কিন্তু সবগুলো  এন্টিডিপ্রেসেন্টের কার্যকারিতাই সমান। তাই কার্যকারিতা নয়, বরং পার্শ্বপ্রতক্রিয়ার ভিত্তিতে এন্টিডিপ্রেসেন্টগুলোর মধ্যে পার্থক্য করা হয়। MAOI এবং TCA অনেক পুরাতন এন্টিডিপ্রেসেন্ট। এগুলোকে বলা হয় ফার্স্ট জেনারেশন এন্টিডিপ্রেসেন্ট। পুরাতন হওয়ার কারণে তাদের পার্শ্বপ্রতক্রিয়া ও বেশি। MOAI গ্রহন করার সময় মানুষ অন্য অনেক ধরণের ওষুধ গ্রহন করতে পারেনা।  আবার অনেক সময়, ফলমূল, দুগ্ধজাতীয় সাধারন খাদ্যও গ্রহন করতে পারেনা। এ পার্শ্বপ্রতক্রিয়াগুলোর জন্যই এখন MOAI ব্যবহার করার পরামর্শ সাধারণত দেয়া হয়না। TCAর পার্শ্বপ্রতক্রিয়া তুলনামূলক কম। এটি সেবনকারী রোগীকে সবসময় ক্লান্ত করে রাখে। এছাড়াও এটি বেশ বিষাক্ত। TCA সেবনকারী রোগীর কার্ডিয়াক এরেস্ট হওার সম্ভাবনা থাকে। রইল বাকি SSRI। যেকোন এন্টিডিপ্রেসেন্টের মতই এটিও পার্শ্বপ্রতক্রিয়াহীন নয়। SSRI এর পার্শ্বপ্রতক্রিয়াগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল, ঘুমের সমস্যা, ওজন লাভ করা এবং যৌন ত্রুটি। কিন্তু অন্য দুই প্রকারের এন্টিডিপ্রেসেন্টের চেয়ে এটির পার্শ্বপ্রতক্রিয়া কম বিধায়, সাধারণত এটি ব্যবহার করার পরামর্শ দেয়া হয়।

Reference 

Khan Academy

Healthline.com

Nuzhat Tabassum Prova

Nuzhat Tabassum Prova