শুরুর আগেঃ

উপরের শব্দটা দেখলেই আমাদের মধ্যে একধরণের দুর্বোধ্যতার অনুভুতি কাজ করে। যেনো আমাদের মাথাতেই Programmed হয়ে আছে যে, শব্দটার মানে এই ইহজনমে বোঝা আমাদের সাধ্য নেই। তার কারন দু’টো। প্রথমত, সংবাদপত্রগুলোতে যেভাবে পুঁজিবাদের নাম করা হয় এবং তার সাথে যে কথাগুলো বলা হয় তার কোনোটাই আমরা বুঝি না আর দ্বিতীয়ত, তোমাদের আঁতেল শ্রেণির বন্ধুরা যখন দেশ জাতি নিয়ে চিন্তা করতে করতে পুঁজিবাদ পুঁজিবাদ করে তখন তোমাদের মনে হয় এসব হয়তো আঁতেলদের জিনিস। তোমার আমার মতো সাধারণদের কাজ না। কিন্তু সত্যি সত্যি, এই পুঁজিবাদ তোমার জীবনেরই একটা অংশ। তুমি কি পড়বে, কি খাবে, কিভাবে চলবে থেকে শুরু করে তোমার দেশ বা সমাজ কিভাবে চলবে সেটি পর্যন্ত ঠিক করে দেয় এই পুঁজিবাদ। কাজেই ফীল করতে পারছ জিনিসটা কি পরিমাণ অসাধারণ একটা ব্যাপার? তাই চলো, কথা না বাড়িয়ে কাজে নেমে পড়ি!

সংজ্ঞাঃ

যে উৎপাদন ব্যবস্থায় সকল উৎপাদন যন্ত্র ব্যক্তিমালিকানাধীন থাকে এবং উৎপাদন পদ্ধতিতে অবাধ মুনাফা অর্জনের সুযোগ প্রতিষ্ঠিত তাকে পুঁজিবাদ বলে।

আশা করি, কিছুই বুঝো নাই! সুতরাং, সামান্য বুঝানোর চেষ্টা করি।

ধরো, তুমি সকালে ঘুম থেকে উঠলে, ফ্রেশ হওয়ার জন্য ওয়াশ-রুমে গেলে এবং দাঁত ব্রাশ করলে। এরপর তুমি নাশতা খেতে বসলে এবং কোনো একটা কোম্পানির জেলি আর পাউরুটি দিয়ে তোমার নাশতা শেষ করলে। স্কুলে যাওয়ার জন্য কোনো একটা নির্দিষ্ট ব্র্যাণ্ডের জুতো পড়লে, তারপর স্কুলে গেলে।
খেয়াল করে দেখো, ঘুম থেকে উঠার এক ঘণ্টার মধ্যেই কিন্তু তুমি বেশ কিছু “পণ্য” ব্যবহার করে ফেলেছো। এখন কথা হচ্ছে, এসবের সাথে আমাদের পুঁজিবাদের কি সম্পর্ক? একটু ধৈর্য ধরো আর আমার কিছু প্রশ্নের উত্তর দাও আগে।

এই যে তুমি কিছু “পণ্য” ব্যবহার করেছো সেসব কোত্থেকে এলো? তুমি বলবে, “এতো খুব সোজা, দোকান থেকে”। এখন আরেকটূ পিছনে যাও। “দোকানদার এসব জিনিস পেলো কোথা থেকে”? তুমি বলবে, “Dealer দের কাছ থেকে”। এবার আমি আবার বললাম, “Dealer রাই বা এগুলো পেলো কোথা থেকে?”তুমি নিশ্চয়ই বলবে, “Industryগুলো থেকে”। আমাদের পুঁজিবাদ শুরু হচ্ছে এই Industryর কাহিনী থেকেই!

আচ্ছা, Industryর যারা মালিক তারাই বা এসব জিনিস পেলো কোথা থেকে? তাদের আসলে অনেক টাকা আর জায়গা-জমি থাকে আর তারা এসব দিয়ে ইন্ডাস্ট্রি বানায় , তারপর শ্রমিকদের-ইঞ্জিনিয়ারদের নিয়োগ দেয়। আর ইঞ্জিনিয়িররা-শ্রমিকরা মিলে ইন্ডাস্ট্রির মালিকদের কথামতো জিনিসপত্র বানায়। তারপর Industrialist বা শিল্পপতিরা তাদের জিনিসপত্র বাজারে বিক্রি করার জন্য নানা রকম ধান্দা করে। এ উদ্দেশ্যে তারা Business School এর গ্র্যাজুয়েটদের নিয়োগ দেয়। আর তারা নানারকম মার্কেটিং-হ্যানো ত্যানো করে বিজ্ঞাপনের কায়দা করে সেসব বাজারে পাঠিয়ে দেয়।

এবার চিন্তা করো, জিনিসপত্র বিক্রি করে-টরে বেশ অনেক লাভ হলো। এখন শিল্পপতিরা তাদের লাভের অংশগুলো দিয়ে শ্রমিক-ইঞ্জিনিয়ার-বিজনেস স্টুডেন্টদের বেতন দেয়। এখন বেতন, কাঁচামাল বাবদ, শিল্পপতিদের নিজের খরচ-টরচ সব বাদ দিয়েও শিল্পপতিদের হাতে বেশ টাকা-পয়সা থাকে। এখন তারা সেসব দিয়ে কি করবে? তারা আরো বেশি লাভের আশায় সেসব আবার তাদের ইন্ডাস্ট্রিতে বিনিয়োগ করে। এভাবে ধরো তার পরের বছর আরো লাভ হলো। এবার শিল্পপতির মনে আরো লোভ ঢুকলো আর সে এবারে আরো টাকা বিনিয়োগ করলো।
আমরা কোথায় যাচ্ছি, বুঝতে পারছো? এভাবে কিন্তু শিল্পপতি নিজের ইচ্ছামতো মুনাফা অর্জনের জন্য ক্রমাগত জিনিসপত্র উৎপাদন করেই যাচ্ছে(গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টটা হলো, পুঁজিবাদের সংজ্ঞাতেই কিন্তু বলা আছে যে, উৎপাদনকারী নিজের ইচ্ছামতো লাভ করতে পারবে। কাজেই, উৎপাদনকারীকে বাধা দেয়ার কেউ নেই।)

কিন্তু এখানে খুব ট্র্যাজিক 😛 একটা ব্যাপার ঘটে। শিল্পপতি না হয় নিজের লাভের জন্য প্রচুর পণ্য উৎপাদন করে বসে থাকলো। কিন্তু সেসব তো কিনতে হবে! নাহলে শিল্পপতি লাভ পাবে কি করে? কিন্তু বাজার তো পণ্যে বোঝাই, মানুষজনও যা কেনার কিনে ফেলেছে। এখন জিনিসগুলো নষ্ট হয়ে যাবে না? আর জিনিসগুলো যদি নষ্ট হয়ে যায় তাহলে তো সর্বনাশের মাথায় বাড়ি! শিল্পপতি বেচারা ব্যবসায়ে লস মেরে বসে থাকবে! এখন উপায়?

উপায় বের করার জন্যই আমরা দেখবো পরে নানা রকম ঝামেলা শুরু হয়। আর এসব ঝামেলাগুলোকে আমরা কঠিন কঠিন দাঁতভাঙ্গা ভাষায় বলি “সাম্রাজ্যবাদ”, “উপনিবেশবাদ”, “ফ্যাসিজম”, “নাৎসিবাদ”! সবই ব্যাখ্যা করবো কিন্তু আগে একটার পর একটা শেষ করি।
তোমরা কিন্তু খালি একজন শিল্পপতিকে নিয়েই চিন্তা করছিলে। কিন্তু দেশে তো আরো শিল্পপতি আছে। তাদেরও তো পণ্য আছে। সেসবও তো বিক্রি করতে হবে। কাজেই তাদের জিনিসপত্রগুলো বিক্রি করার জন্য নতুন “বাজার” লাগে। এই যে নতুন “বাজার” লাগবে সেটা তো আর নিজ দেশে হবে না; তাই তাদের অন্য দেশের খোঁজ করতে হয়। এর পর তারা এইসব দেশের বাজারে ঠিকমতো ব্যবসা-বাণিজ্য করার জন্য সেদেশের মিলিটারি, সরকার এদের হাত করে। উদাহরণ হিসেবে তোমার খুব বেশি দূরে যাওয়ার দরকার নেই। তুমি ভারতবর্ষের দিকে তাকাও। খেয়াল করে দেখো কিভাবে ব্রিটিশরা এদেশে ক্ষমতা বিস্তার করেছে! তাহলেই তুমি পুঁজিবাদের স্বরূপ দেখে যাবে। আর যাদের জানাশোনা আরেকটু ভালো তারা ৫০-৬০ এর দশকের লাতিন আমেরিকার দিকে তাকালে বুঝবে তখন সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র কিভাবে সেসব দেশকে কুক্ষিগত করে রেখেছিলো।

এখন তুমিই বলো, এভাবে আরেকটা দেশকে বশে আনা, তাদের সরকারকে খুশি রাখা, মিলিটারিদের নিজেদের হাতে রাখা এসব করতে তাদের অন্নেক টাকা-পয়সা দরকার হয়, বিভিন্ন গোয়েন্দা বাহিনীর দরকার হয়। নানা ধরণের ছল-চাতুরী করতে হয়। খুব বেশি কষ্ট হলে নবাব সিরাজউদদৌলা নাটক কিংবা ইংরেজদের ইতিহাস তোমাদের সামাজিক বিজ্ঞান বই থেকেই একটু দেখে নাও।
যা বলছিলাম, এই যে, আরেকটা দেশ দখলে নিতে হলো এই জিনিসটাকে আমরা বলি উপনিবেশবাদ(Colonialism) আর যেসব দেশকে দখলে নিলো সেসব দেশকে বলে উপনিবেশ(Colony)। দখলদার দেশগুলো উপনিবেশ দেশগুলোকে শোষণ করে, উপনিবেশ দেশগুলোতে নিজেদের জিনিস বিক্রি করে বেঁচে থাকে।

এবার তোমাকে আরেকটু গভীরে নিয়ে যাই। আচ্ছা, এরকম পুঁজিবাদী দখলদার দেশ তো খালি একটা-দুইটা না। অনেকগুলোই আছে। তাহলে তাদের জন্য Colony লাগবে না? এবার কলোনীর দখল নিতে পুঁজিবাদী দেশগুলোর মারামারি লেগে যায় যাকে আমরা ডাকি “যুদ্ধ”। এই যুদ্ধ করে করে পুঁজিবাদী দেশগুলো কলোনী দখল করতে সচেষ্ট হয়। এই যে, কলোনী দখল, নিজেদের সাম্রাজ্য বিস্তারের চেষ্টা একে আমরা বলি “সাম্রাজ্যবাদ”। আর এইসব সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর মধ্যে যখন যুদ্ধ হয় তখন আমরা একে বলি “বিশ্বযুদ্ধ”। এই যে তোমরা প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এইসব নিয়ে চিন্তা করো- এসব যুদ্ধের মূল কারণ কিন্তু এই পুঁজিবাদই! বলে রাখা ভালো, “ফ্যাসিবাদ”, “উপনিবেশবাদ” আর “সাম্রাজ্যবাদ”র মাঝামাঝি একটা পর্যায়। সেটা নিয়ে পরে আলোচনা করা যাবে।

এবার তোমরা সেই দুর্বোধ্য সংজ্ঞাটার দিকে তাকাও। দেখো, পুঁজিবাদের প্রথমেই সংজ্ঞায়নে ছিলো “উৎপাদন যন্ত্রে ব্যক্তিগত মালিকানা স্বীকৃত”। এখন তুমিই বলো মালিকানাগুলো যদি ব্যক্তির কাছে না থাকতো তাহলে কি সে নিজের ইচ্ছামতো কলকারখানা বানাতে পারতো? আর সংজ্ঞায়নের আরেকটা জায়গায় বলা আছে “ব্যক্তিগত মুনাফা অর্জনের সুযোগ অবাধ”। আবারো দেখো, যদি অবাধ মুনাফা অর্জনের সুবিধা না-ই থাকতো তাহলে কি আর শিল্পপতিরা নিজেদের লোভ হাসিলের জন্য ক্রমাগত বিনিয়োগ করে যেতো। আর সেই বিনিয়োগ না হলে কি আর বাজারে এতো পণ্য আসতো। সেসব পণ্যে বাজার ভর্তি না হলে কি আর নতুন বাজার খোঁজা লাগতো? আর বাজারের দরকার না পড়লে কি আর উপনিবেশ খুঁজতে হতো? এবার শেষবারের মতো চিন্তা করে বলো 😛 আর উপনিবেশেরই বা দরকার না হলে কি আর উপনিবেশ বাগানোর জন্য যুদ্ধ করতে হতো?

কাজেই তোমরা দেখতে পাচ্ছো, তোমার জীবনের সাথে যেসব জিনিস অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত কিংবা খুব সামান্য কিছু জিনিস এসব নিয়েই কিন্তু তোমার পুঁজিবাদের শুরু আর সেসবের পরিণতিতেই কিন্তু এই যে সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ, ফ্যাসিবাদ, যুদ্ধ এসবের জন্ম হয়।

পুনশ্চ১: এই লেখায় আমি তোমাদের শুধুমাত্র প্রাথমিক ধারণাটা দেবার চেষ্টা করেছি। বিষয়টা আসলে অনেক ব্যাপক। কনসেপ্টটা আমাদের কঠিন লাগে দেখেই আমি চেষ্টা করেছি সেই ভয়টা কাটানোর

পুনশ্চ২: উপরে তোমরা যে পুঁজিবাদের রূপ দেখলে সেটা পুঁজিবাদের এক্কেবারে আদিম রূপ। পুঁজিবাদীরা এখন আরো অনেক চালাক হয়েছে। নিজেদের মুনাফার জন্য, নিজেদের লাভের জন্য তারা নিত্যনতুন কৌশল আবিষ্কার করে চলেছে। আর অর্থনীতিবিদেরা সেসব বের করার চেষ্টায় আছেন। আর এজন্যই তোমরা পুঁজিবাদের Basic আলোচনা পড়ে থাকো সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ের “অর্থনীতি” অংশে।
আশা করি এখন থেকে নিজেরা এ বিষয়ে আরেকটু ঘাঁটাঘাঁটি করবে। জ্ঞানের এই সুবিশাল রাজ্যে তোমাদের নিমন্ত্রণ। ভালো থাকবে সবাই!