শিরোনাম দেখেই হয়তো অনেক আঁটকে উঠবেন। ভুরুজোড়া কুচকে জিজ্ঞেস করবেন, কম্প্যুটার সাইন্স ছেড়ে হঠাত অর্থনীতির পিছে লাগলাম কেন? কারণ অর্থনীতি নিয়ে লেখার মতো কাউকে পাওয়া যাচ্ছে না। আর অর্থনীতির মতো মজার একটা বিষয় নিয়ে লেখা থাকবে না, এটা মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে। এখন বলুন তো, অর্থনীতি নিয়ে লেখার জন্য কাউকে পাওয়া যাচ্ছে না কেন? কারণ যারা এটা নিয়ে লিখতে পারবেন, তাঁদের অন্য দশটা কাজ আছে, তাই এখানে সময় দিতে পারবেন না। আর আমরাও গরীব দেখে কাউকে টাকা দিয়ে কন্টেন্ট বানিয়ে নিতে পারছি না। দেখুন না, এখানেও অর্থনীতি ঢুকে বসে আছে!

অর্থনীতি – অর্থের নীতি। নাম শুনেই হয়তো মনে হয় যেন বাপরে, টাকা পয়সার ব্যাপার। আবার যাদের শেয়ার মার্কেটের সাথে পরিচয় আছে, তাঁদের মনে হতে পারে, এটা নিয়ে কাজ করাই অর্থনীতির কাজ। অর্থনীতি কি আমাদের টাকা পয়সা কামাতে সাহায্য করবে? উত্তরটা না, এবং একই সাথে হ্যাঁ।  অর্থনীতি কাজ করে দুইটা প্রশ্ন নিয়েঃ

  • মানুষ কীভাবে অর্থ উপার্জন করছে
  • সে উপার্জিত অর্থ কীভাবে খরচ করছে

আরও সহজ কথায় অর্থনীতি মানুষ এবং তার সিদ্ধান্ত নিয়ে পড়াশোনা করে। [ “Economics is the study of men (and women) in the ordinary business of life. It enquires how he gets his income and how he uses it.” – Alfred Marshal (1890) ]

ব্যাপারটা আরও ভালভাবে বুঝতে চলুন কিছু কেস স্টাডি দেখে আসি।

  • মফিজ মিয়ার আট বিঘা জমি। সে খুব চিন্তায় আছে ধান বুনবে নাকি গম। ধান বুনলে সে তিন মাসেই শস্য উঠাতে পারবে। অন্যদিকে গম বুনলে শস্য তুলতে লাগবে পাঁচ মাস। কিন্তু ধান থেকে সে যে লাভ পাবে, গম থেকে পাবে তার অনেক বেশী। এখন সে ধান বুনবে নাকি গম? তার এই সিদ্ধান্তের পেছনে কোন বিষয়গুলো কাজ করছে, তা নিয়েই কাজ করে অর্থনীতি।
  • জুনায়েদের অনেক ইচ্ছে সে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং পড়বে। কিন্তু সে দেশের সবচেয়ে ভাল বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং-এ চান্স পেল না, চান্স পেল জীববিজ্ঞানে। এখন তার কাছে সুযোগ আছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে কম খরচেই জীববিজ্ঞান পড়ার, যেটা পড়ার তার ইচ্ছে ছিল না। কিংবা সে চাইলে অনেক টাকা খরচ করে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়তে পারে। সে কোনটা বেছে নিবে, এই সিদ্ধান্ত নিয়ে কাজ করে অর্থনীতি।
  • স্যামসাং – ট্যাবলেট বানাবো নাকি স্মার্টফোন? কোনটা মানুষ বেশী ব্যবহার করে? পরবর্তী জেনারেশন কোনটা বেশী ব্যবহার করতে পারে? কোনটা বানানোর খরচ কম? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর পেতে স্যামসাং-এর আশ্রয় নিতে হবে অর্থনীতির।

তো বোঝায় যাচ্ছে, অর্থনীতি বিরক্তিকর কিছু নয়। বরং অর্থনীতি এমন কিছু, যা দিয়ে মানুষের আচার-আচরণ ব্যাখ্যা করে দেওয়া যায়! আপনি এখন যে এই লেখাটি পড়ছেন, এর পেছনেও আছে অর্থনীতি। আপনার মনে হতে পারে, আরে এটা তো ফ্রি! স্বশিক্ষায় লেখা পড়তে আবার টাকা দেওয়া লাগে নাকি! কিন্তু ভেবে দেখেন, এই লেখা পড়তে গিয়ে আপনার আর ১০ টা কাজ থেমে থাকছে, আপনার কিছু সময় এতে ব্যয় করতে হচ্ছে।  আপনি হয়তো চাইলে এই সময়ে ইউটিউবে মজার মজার ভিডিও দেখতে পারতেন, কিংবা এল ক্লাসিকো। চাইলে Rantages কিংবা Classical Art Memes-এর পোস্ট দেখতে পারতেন। আর কিছু না হোক, ফেসবুকে বসে মানুষজনের সাথে কথা বলতে পারতেন। তা না করে এই লেখা আপনি পড়ছেন কেন? কারণ আপনার মনে হয়েছে, এই লেখাটা পড়ে আপনার কোনো লাভ হবে, এবং সে লাভের আশায় আপনি কিছু একটা স্যাক্রিফাইস করতে রাজি।অর্থনীতির ভাষায় একে বলে অপরচুনিটি কস্ট।

অপরচুনিটি কস্ট (Opportunity Cost):  যখন আপনি অনেকগুলো বিকল্পের মাঝে একটিকে বেছে নিবেন, তখন আপনার অন্য যে সুযোগগুলো হারাতে হবে, সেই কস্টটাই হল অপরচুনিটি কস্ট।

যেমন ধরা যাক, আমি বিএসসি শেষ করে পিএইচডি করতে পারি। কিন্তু তা না করে আমি সফটওয়ার ফার্মে অনেক টাকা বেতনে চাকরি নিয়ে নিলাম। অনেকের মনে হতে পারে সঠিক সিদ্ধান্ত, এতগুলো টাকা! কিন্তু এখানে চাকরি নেওয়ার জন্য আমাকে একটা স্যাক্রিফাইস করতে হল। আর এই চাকরি নেওয়ার অপরচুনিটি কস্ট হল পিএইচডি ডিগ্রি!

অপরচুনিটি কস্ট অর্থনীতির একেবারে মৌলিক একটি ধারণা। সবকিছুরই একটা অপরচুনিটি কস্ট থাকে। অন্য কথায় কেউ চাইলেই একসাথে সব পেতে পারে না। তাকে কিছু পেতে হলে অন্য কিছু পাওয়ার সুযোগ হারাতে হয়। এটা খুব ভালভাবে বুঝানো যায় সরকারের বাজেট ঘোষণার মধ্য দিয়ে। সরকার চাইলে মিলিটারি খাতে বাজেটের ৫০% খরচ হতে পারে। কিন্তু আমাদের দেশে তো হাজার হাজার মানুষ না খেয়ে থাকছে। সরকার কি পারে না মিলিটারি খাতে কম দিয়ে বরং মানুষকে ভরপেট রাখতে? এখানে দেখা যাচ্ছে মিলিটারি খাতে ব্যয় করার একটা অপরচুনিটি কস্ট আছে, এবং তা হল হাজার হাজার মানুষের না খেয়ে থাকা!

এখন মিলিটারি খাত নাকি হিউম্যানিটারিয়ান সেক্টর – কোনটি বেশী গুরুত্বপূর্ণ – এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায়িত্ব সরকারের পলিসি মেকারদের। আর তাঁদের এই সিদ্ধান্ত নিয়েই কাজ করে অর্থনীতি। সরকারের প্রতিটি সিদ্ধান্তের পেছনেই থাকে এমন অনেকগুলো কস্ট-বেনিফিট এনালাইসিস।

সরকার কেন একইসাথে মিলিটারি এবং সব মানুষকে খাওয়াতে পারে না? কারণ এজন্য সরকারের সীমাহীন সম্পদের প্রয়োজন হবে। সম্পদের অপ্রাতুল্যতা অর্থনীতির আরেকটি মৌলিক বিষয়।

সম্পদের অপ্রাতুল্যতা (Scarcity of Resource): মানুষের চাহিদা সীমাহীন। কিন্তু রিসোর্স সীমিত। সীমাহীন চাহিদা এবং সীমিত সম্পদ – এ থেকেই আসে সম্পদ অপ্রাতুল্যতা।

এবং এই কারণেই মানুষকে সিদ্ধান্ত নিতে হয় দুই বা ততোধিক বিকল্পের মাঝে। এই সিদ্ধান্ত গ্রহণে আর যে বিষয়টি তাকে উদ্দুব্ধ করে, তা হল ইনসেন্টিভ।

ইনসেন্টিভ (Incentive): একজন মানুষকে কোনো একটি কাজ করতে উদ্দুব্ধ করে যা, তাই ইনসেন্টিভ।

যেমন ধরা যাক, বাংলাদেশে হঠাৎ ঘোষণা দেওয়া হল যে,

  • যে স্কুলে যত বেশী শিক্ষার্থী ভর্তি করানো হবে, তাকে তত বেশী টাকা দেওয়া হবে। তখন দেখা যাবে সব স্কুল হুমড়ি খেয়ে পড়লো বেশী করে শিক্ষার্থী নিতে। তাঁরা তখন শিক্ষার্থী নিতেই বেশী ব্যস্ত হয়ে পড়বে, তাদের শিক্ষিত করার দিকে তাঁদের আর মনোযোগ থাকবে না।
  • তো এই চিন্তা থেকে সরকার ঠিক করলো যে, না, এভাবে চলবে না, এখন থেকে যে স্কুল থেকে যত বেশী হারে জিপিএ ৫ পাবে, তাকে তত বেশী টাকা দেওয়া হবে। তো এই সিদ্ধান্ত বেশ কাজে লাগতে পারে, কয়েক বছরেই হয়তো দেখা যাবে প্রতিটা স্কুল শিক্ষার্থীদের পেছনে অনেক সময় দিচ্ছে। কিন্তু এও হতে পারে যে, স্কুলগুলো বেছে বেছে শুধু ভাল রেজাল্টওয়ালা শিক্ষার্থীদের ভর্তি করাচ্ছে। কিংবা এও হতে পারে যে, স্কুলগুলো রেজাল্ট ভাল করানোর জন্য সবাই একজোট হয়ে পরীক্ষা ব্যবস্থা শিথিল করে দিল।

ঠিক এমনটাই আমরা দেখেছিলাম ২০১৫ সালের জিডিজি বাংলার একটা ক্যাম্পেইনে। তখন বলা হয়েছিল গুগল ট্রান্সলেটে ১০০০ অনুবাদ করে দিলে সার্টিফিকেট দেওয়া হবে। মানুষ যথারীতি হুমড়ি খেয়ে পড়লো। কিন্তু দেখা গেল এর মাঝে কয়েকজন আজেবাজে অনুবাদ করে দিয়ে রাখছে, “I have to attend a meeting tomorrow”-র অনুবাদ করে দিয়ে রাখছে “কখগঘ”! তো দেখা যাচ্ছে, যে কোনো কাজের ক্ষেত্রে যথাযথ ইনসেন্টিভ ঠিক করাও অনেক গুরুত্বপূর্ণ।

 

আজ এ পর্যন্তই। অল্প জেনেই অনেক কিছু নিয়ে বকবক করে ফেলেছি! আগামী দিনগুলোতে অর্থনীতির আরও কিছু মৌলিক বিষয় নিয়ে কথা বলবো। ততদিন পর্যন্ত বিদায়!

রেফারেন্স

  • Crash Course
  • Introduction to Economic Analysis (R. Preston McAfee)
Muntasir Wahed

Muntasir Wahed

System Administrator at স্বশিক্ষা.com
Jack of all trades, master of none.
Muntasir Wahed
Muntasir Wahed