প্রথম পর্বঃ শুরুর কথা

দ্বিতীয় পর্বঃ শ্রেণিবিন্যাস খায় না মাথায় দেয়

তৃতীয় পর্বঃ ভ্রূণের ইতিবৃত্ত

চতুর্থ পর্বঃ বিবর্তন এবং বিবর্তনের আয়নায় আমাদের প্রাণিজগৎ

আমরা কিভাবে আমাদের আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছিলাম তা তোমাদের একটু মনে করিয়ে দিই। আমরা একটা একটা করে Evolutional Benchmark নিয়ে আলোচনা করছিলাম আর একটা একটা করে পর্বকে ব্যাখা করছিলাম।

গত পর্বে আমরা সিলোম পর্যন্ত আলোচনা করে এসেছিলাম। আর cover করেছিলাম Mollusca পর্ব পর্যন্ত।

চলো, একটু রিভিউ দিয়ে নেয়া যাক। তোমাদের বইয়ে একটা জিনিস দেখবে যে, কাউকে বলা হয় “কোষীয় মাত্রার”, কাউকে বলা হয় “কোষ-টিস্যু মাত্রার”, কাউকে কিংবা “টিস্যু-অঙ্গ মাত্রার”, আবার কাউকে “অঙ্গ- তন্ত্র মাত্রার”। এখানে তোমাদের বলে রাখি, ওই যে আমরা পড়েছিলাম না, যে, গ্যাস্ট্রুলেশনে কোষের স্তর তৈরি হয়। ওই কোষের স্তর থেকেই কিন্তু পরবর্তীতে অর্গানোজেনেসিস(Organogenesis) প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আমাদের অঙ্গ গঠিত হয়। (Organ মানে অঙ্গ আর Genesis শব্দটা “সৃষ্টি” হওয়াকে নির্দেশ করে। কাজেই নামের সার্থকতা বুঝতে পারছো তো?) তারপর আবার এদের মধ্যে কিছু অঙ্গ আবার একত্রিত হয়ে তন্ত্র তৈরি করে।

এবারে ধরো, একটা অফিসে একজন অফিসার। তার অনেক অনেক কাজ। সে সব কাজ একা সামলাতে পারে না, ফ্যামিলির কিংবা অফিসের ছোটোখাটো ব্যাপারগুলো সে ভুলে যায়। ফলে তার একজন এসিসট্যান্ট দরকার না? কিন্তু একজন এসিসট্যান্টে তার পোষালো না। তাই সে আরো একজন এসিসট্যান্ট নিয়োগ দিলো। একজন তার পার্সোনাল ব্যাপার দেখবে, আরেকজন অফিসের কাজগুলো দেখবে। আবার ধরো, এসিসট্যান্ট না হয় ছোটোখাটো কাজ করলো, কিন্তু তার কাজ এতোটা বিস্তৃত, তার একজন সাব-অর্ডিনেট অফিসার না হলে একেবারেই চলে না। ফলে সে আরেকজন সাব-অর্ডিনেট অফিসার নিয়োগ দিলো। এবার ধরো যাকে নিয়োগ করা হলো তারও এতোই কাজের প্রেশার যে তারও একজন এসিসট্যান্ট দরকার। কাজেই কি বুঝলে? সবচেয়ে বড় অফিসার তার দুইজন এসিসট্যান্ট নিয়ে একটা “সিস্টেম”। আবার সাব-অর্ডিনেট অফিসার আর তার একজন এসিসট্যান্ট নিয়ে আরেকটা “সিস্টেম”। এখন এই যে একজনের জন্য, শুধুমাত্র একজন অফিসারের জন্য এতোগুলো “সিস্টেমের” দরকার পড়লো ক্যানো? কারণ হয়তো সে অনেক বড় কাজ করে! ঠিক তেমনি একটা প্রাণি যতো “উন্নত” হতে থাকে ততোই কিন্তু এরকম “সিস্টেম” তৈরি হতে থাকে। প্রথম সিস্টেমকে আমরা বলি “টিস্যু”(এসএসসি তে পড়ে আসা টিস্যুর সংজ্ঞা মনে করে দেখো তো! আমার কথার মিল খুঁজে পাও কি না! )। আবার সেইসব টিস্যুগুলো মিলে তৈরি করবে একেকটা “অঙ্গ”, আবার সেসব অঙ্গ মিলে তৈরি করবে একেকটা “তন্ত্র”! কাজেই এখন উপরের অফিসারের কাহিনীর সাথে প্রাণির উন্নত হওয়ার মিল খুঁজে পাচ্ছো তো? যদি পেয়েই থাকো তাহলে মলাস্কা পর্যন্ত প্রাণিদের তুমি নিজেই শ্রেণিবিন্যাস করে বলে ফেলো কে কোন গ্রুপে পড়ে! (এই কাজটা তোমরা নিজেরা নিজেরা করতে পারলে তোমরা কিন্তু অনেকদূর এগিয়ে গেছো। আর না পারলে আবার চিন্তা করতে থাকো। না পারলে হাল ছেড়ে দিও না, কারণ তুমি যদি না-ও পারো অথচ চিন্তা করতে পারো- এটাই কিন্তু অনেক বড় জিনিস! Trust me, I can guarantee you!)

তো যাই হোক, Mollusca পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা নিশ্চিন্ত ছিলেন। কিন্তু তারপরের প্রাণিগুলোকে কিভাবে শ্রেণি বিন্যস্ত করা যায়? এবার তারা আরেকটা Evolutional Benchmark পেয়ে গেলেন। সেটা হলো Segmentation(খণ্ডকায়ন)। শব্দটা থেকেই বুঝতে পারছো এই বৈশিষ্ট্যটা কোনো কিছু খণ্ড খণ্ড হয়ে যাওয়াকে নির্দেশ করছে। এখান থেকে কিন্তু একটা ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে যে, প্রাণিরা উন্নত হচ্ছে কারণ তাদের দৈনন্দিন দৈহিক কাজ চালাতে আমাদের গল্পের অফিসারের মতো খণ্ড খণ্ড ডিপার্টমেন্টের দরকার হচ্ছে। আর এই বৈশিষ্ট্যটা দেখা যাচ্ছে, Annelida পর্বের প্রাণিদের মধ্যে।

এখন হয়তো তোমাদের জানতে ইচ্ছা করছে, তারপরের Evolutional Benchmark কি! এরপরেরটাকে আমরা বলি “Tagmatization”(অঞ্চলায়ন)। এটি আর কিছুই না। এটি সেগমেন্টেশনের আরেকটু Upper Version! Annelid প্রাণিরা খালি খণ্ড খণ্ড বিভক্ত হয়েই পড়ে ছিলো কিন্তু Arthropod প্রাণিরা আরেকটু স্মার্ট। তারা যেহেতু Annelidদের চেয়ে উন্নত কাজেই তারা কয়েকটা খণ্ড মিলে একটা পার্ট, আবার কয়েকটা খণ্ড মিলে আরেকটা পার্ট-এরকম তৈরি করে থাকে। আর এরকম একেকটা পার্টকে আমরা বলি “Tagmata”. আর তুমিই এখন বলো, Tagmata তৈরি হওয়ার প্রসেসকে Tagmatazition না বলে উপায় আছে?
ঠিক এ পর্যন্ত কিন্তু আমরা সুন্দরমতো কাহিনী এগিয়ে নিচ্ছিলাম। কিন্তু এ পর্বে এসে একটু ছেদ পড়বে। কারণ Arthropod দের চেয়ে উন্নত বলে যাদের আমরা গণ্য করবো তারা হলো Echinonodermata

এখানে সামান্য উলটাপালটা ঘটনা ঘটে বলে মনে হয়। কারণ Echinoderm রা কিন্তু সেগমেন্টেড না! এখন হয়তো তুমি লাফ দিয়ে উঠবে যে যারা সেগমেন্টেড না তারা কিভাবে Annelidদের আগে আসে। কিন্তু এখানে তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটা ব্যাপার ঘটে। তুমি খেয়াল করলেই দেখবে, Echinodermদের Endoskeleton বলে একটা ব্যাপার থাকে(নামের অর্থটা একটু বুঝে নিও। Endo শব্দের মানে হলো “ভিতর” আর Skeleton মানে হলো “কঙ্কাল”)। এই এন্ডোস্কেলেটন খুব গুরুত্বপূর্ণ বিবর্তনিক বৈশিষ্ট্য। ক্যানো? সেটা ব্যাখ্যা করি।

বিবর্তনের যে প্রাকৃতিক নির্বাচন মতবাদ সেটা আমাদের কি বলে? এ মতবাদ বলে, যে যতো বেশি পরিবেশের সাথে মিলেমিশে থাকতে পারবে, পরিবেশের উপর নিজের একটা ভূমিকা দেখাতে পারবে তারাই টিকে যাবে। এখন এন্ডস্কেলেটন তৈরি হবার মানে হলো এতে করে প্রাণির দেহের অভ্যন্তরে একটা কাঠামো তৈরি হওয়া,। এতে করে হলো কি, নটোকর্ড বলে একটা জিনিস তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে গেলো। এখন প্রশ্ন আসতে পারে নটোকর্ড জিনিসটা কি? নটোকর্ড জিনিসটা আর কিছুই না, এটা আমাদের মেরুদণ্ডের ছোটোভাই। আমরা বলতে পারি নটোকর্ড মেরুদণ্ডের Analogous(Analogous শব্দের মানে ডিকশনারিতে একটু খুঁজে নিও। আমি Analogous শব্দের সোজা কোনো বাংলা খুঁজে পাই নি! 😛 )। এখন তাহলে আবার প্রশ্ন আসতেই পারে মেরুদণ্ডের সাথে বিবর্তনিক বৈশিষ্ট্যের কি সম্পর্ক। দ্যাখো, মেরুদণ্ডের সাথে স্নায়ু ব্যাপারটার অনেক ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ আছে। (জুওলজিতে স্নায়ুবিক নিয়ন্ত্রণ পড়তে গেলেই তোমরা ব্যাপারটা বুঝতে পারবে। আপাতত আমার কথা মেনে নাও)। আর স্নায়ু জিনিসটা যেকোন প্রাণির জন্য খুব, খুব বিশাল একটা ব্যাপার। কেননা যখন একটা প্রাণির স্নায়ু তৈরি হয় তখন সে পরিবেশ থেকে তথ্য সংগ্রহ করতে পারে, বিভিন্ন উদ্দীপনায় সাড়া দিতে পারে, অর্থাৎ পরিবেশের সাথে তার একটা যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হয়। ফলে সে বিবর্তনিক প্রক্রিয়ায় অনেকদূর এগিয়ে যায় বা যেতে পারে।
এবারা আসো Echinodermদের বেলায় কি ঘটে। দ্যাখো, তাদের কিন্তু একটা সুগঠিত অন্তঃকঙ্কাল আছে। কাজেই নটোকর্ড তৈরির একটা সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না? আর নটোকর্ড তৈরি হলে স্নায়ুর একটা ব্যাপারের ইঙ্গিত মিলছে না? কাজেই তুমিই এবার বলো একাইনোডার্মদের আর উপরে স্থান না দিয়ে উপায় আছে? অবশ্য আরো ব্যাপার আছে! Echinodermদের ছোটোভাই Arthropodদের কিন্তু সিলোম আছে। কিন্তু সেটা সংক্ষিপ্ত আর অন্যদিকে Echinodermদের সিলোম একেবারে সুগঠিত। কাজেই এদিক দিয়েও কিন্তু তারা উন্নত! আবার এদের একটা সুগঠিত Water-Vascular System আছে। Water-Vascular System মানে হলো পানি-সংবহন তন্ত্র। এখানে পানি সংবহনতন্ত্র মানে হলো তাদের দেহে গমনকারী পানিগুলোকে Process করার জন্য তাদের একটা তন্ত্র আছে। তন্ত্র কথাটার কিন্তু একটা ওজন আছে। কারণ এই তন্ত্র তৈরি হতে কিন্তু আগে অঙ্গ হতে হয়েছে, অঙ্গ হতে টিস্যু হতে হয়েছে আর এই টিস্যু হতে কিন্তু কতগুলো কোষকে একত্রিত হতে হয়েছে। কাজেই বুঝতে পারছো, অতি অবশ্যই অবশ্যই Echinoderm রা Arthropodদের চেয়ে উন্নত!

যাই হোক, আমরা পুরো চ্যাপ্টারের মোটামুটি “অপরিচিত” প্রাণিগুলো নিয়ে আলোচনা শেষ করে নিয়েছি! সামনে আমরা হয়তো আর একটা পর্বেই আলোচনা গুটিয়ে নিবো। সে পর্যন্ত এতোটুকুই থাক।

খেয়াল কর

(একটা কথা তোমাকে অবশ্যই মনে করিয়ে দেয়া উচিত বলে আমি মনে করি। আর সেটা হলো পরীক্ষার খাতায় তুমি এই সিরিজ পড়ে গেলেই যে আন্সার করতে পারবে ব্যাপারটা কিন্তু মোটেও এমন না। বরং তুমি যাতে বইটা একটু মজা নিয়ে পড়তে পারো, সেজন্যই আমি এতো কাহিনী ফেঁদে বসেছি। বইয়ের প্রত্যেক পর্বের শনাক্তকারী বৈশিষ্ট্যগুলো দেখে নিবে। আর যদি Visualize করতে চাও তাহলে গুগল তো আছেই। যে পর্বের প্রাণিদের চেহারা 😛 দেখতে চাচ্ছো তাদের নাম লিখে সার্চ দিলেই অজস্র রং-বেরঙ্গের প্রাণি তোমাদের জন্য হাজির হয়ে যাবে।)