একটা বাড়ি বানাতে যেমন অনেকগুলো সমান বা নিয়ন্ত্রিত মাপের ইট লাগে, আমাদের দেহ বানাতেও তেমনি ছোট ছোট কিছু ইট লাগে। বিজ্ঞানের ভাষায় ইটগুলোকে বলে কোষ। মনে করুন, আমার বাড়ির  ইটগুলো সব একই মাপের ছিল। হঠাৎ করে অন্য মাপের, অন্য ধরণের একটা ইট মাঝখানে ঢুকে গেল। তাহলে কি বাড়িটা ঠিক ভাবে গড়ে উঠবে? নাকি সমস্যা দেখা দিবে?একই ভাবে, আমাদের শরীরের কোষগুলো একটা নিয়ম মেনে একটা নির্দিষ্ট আকৃতি ও আকারে বেড়ে উঠে। যদি অনিয়ন্ত্রিত কোষ বিভাজনের কারণে এ নিয়মের ব্যাতিক্রম হয় , কোষগুলোর স্বাভাবিক আকার আকৃতি বদলে যায়, তবে সে অবস্থাকে বলে ক্যান্সার।

ক্যানসার

ক্যান্সার

স্তনের কোষগুলোর অনিয়ন্ত্রিত বিভাজনের ফলে কোষের আকার আকৃতি অস্বাভাবিক হয়ে গেলে সে অবস্থাকে বলা হয় স্তন ক্যানসার। বিশ্বে নারীমৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ স্তন ক্যানসার। প্রতি ২ মিনিটে একজন স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত মহিলাকে চিহ্নিত করা হয় এবং প্রতি ১৩ মিনিটে একজন আক্রান্ত মহিলা মৃত্যুবরণ করেন।

 

ধরণঃ

স্তন ক্যান্সার প্রধানত দু ধরণের।

ইনভ্যাসিভঃ

এ ধরনের ক্যান্সারে  ক্বাষুদ্র উদ্গতাংশে (lobule) বা নালিতে (duct) ক্যান্সার কোষের জন্ম হয়ে তা লসিকার (lymph) মাধ্যমে অন্যান্য অঙ্গে ছড়িয়ে যায়।

নন ইনভ্যাসিভঃ

এ ধরণের ক্যানসারে ক্যানসার কোষ তার উৎপত্তিস্থলেই থাকে এবং ছড়িয়ে যায়নি। এ পর্যায়কে ক্যান্সার পূর্ববর্তী পযায় বলা হয়ে থাকে। চিকিৎসা না নিলে এটি ইনভ্যাসিভ ক্যান্সারে পরিণত হতে পারে।

স্তন ক্যানসার কেন হয়?

স্তন ক্যান্সার ঠিক কেন হয় সে তথ্য এখনো অজানা। তবে অন্যদের চেয়ে যাদের স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হওার সম্ভাবনা বেশি তাঁরা হলেনঃ

  • বয়স্কা মহিলা। মহিলাদের বয়স যত বাড়ে, তাঁদের স্তন ক্যানসারের  সম্ভাবনা তত বাড়ে।  প্রায় ৮০% স্তন  ক্যানসারে আক্রান্ত মহিলার বয়স ৫০ এর উপরে।
  • যাদের রক্ত সম্পর্কের কোনো আত্মীয় স্তন ক্যান্সার/ অভারিয়ান (Ovarian) ক্যানসার এ আক্রান্ত, তাদের স্তন ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
  • যাদের পুর্বে নন ইনভ্যাসিভ স্তন ক্যান্সার ছিল, তাদের আবারো ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা আছে।
  • ভারী স্তন টিস্যু অধিকারী নারী।
  • যেসকল মহিলার ঋতুস্রাব (period) ১২ বছরের পূর্বে শুরু হয়েছে।
  • যাদের রজঃচক্র (menstrual cycle) দেরীতে বন্ধ হয়েছে।
  • মেদবহূল শরীরের অধিকারী নারী।
  • তুলনামূলক লম্বা মহিলাদের স্তন ক্যানসারের ঝুঁকি বেশি।
  • অ্যালকোহল গ্রহণকারী মহিলা
  • যেসকল মহিলা কাজের কারণে কারসিনোজেনিক (carcinogenic) পদার্থ; যেমন- অতিবেগুনী রশ্নি,  তামাক, র‍্যাডন গ্যাসের সংস্পর্শে আসেন।

লক্ষণ

স্তন ক্যান্সারের প্রথম লক্ষণ হল স্তনের একটি অংশের টিস্যু ভারী বা থোকা থোকা (lump) হয়ে যাওয়া। আক্রান্তদের বেশীরভাগেরই মাথা ব্যাথা করে, স্তন ফুলে যায় বা স্তনে র‍্যাশ দেখা যায়।

যেকোন মহিলা নিচের লক্ষনগুলো প্রত্যক্ষ করলে তার ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করা উচিত

  • স্তনে থোকা থোকা দেখা দেওয়া।
  • বগলের নিচে বা স্তনে ব্যাথা হওয়া যেটা ঋতুস্রাবের সাথে সম্পর্কিত নয়।
  • স্তনবৃন্ত বা এর চারপাশে র‍্যাশ দেখা দেওয়া।
  • যেকোনো একটি বগলের নিচ ফুলে যাওয়া।
  • স্তনবৃন্তের আকৃতি বদলে যাওয়া অথবা স্তনবৃন্ত ভেতরের দিকে ঢুকে যাওয়া।
  • স্তনের আকৃতি ও আয়তন বদলে যাওয়া।
  • স্তন বা স্তনবৃন্তের ত্বক উঠে যাওয়া।
  • স্তনের যেকোন অংশের টিস্যু ভারী হয়ে যাওয়া।
  • স্তনবৃন্ত থেকে রক্ত বা স্বচ্ছ তরল পদার্থ নির্গত হওয়া।

কোন মহিলা নিজে যদি উপরে বর্ণিত কোন লক্ষ্ণণ দেখে থাকেন, তার উচিৎ ডাক্তারের সাথে কথা বলা।

নির্ণয়

সাধারণত বেশ কিছু পরিক্ষার পরে ডাক্তাররা কোনো মহিলার স্তন ক্যান্সার নির্নয় করতে পারেন।

ব্রেস্ট এক্সামিনেশন

ডাক্তাররা রোগীর স্তনে যেকোন অস্বাভাবিকতা যেমন, স্তনের আকৃতি বদলে যাওয়া, স্তন বৃন্ত উলটে যাওয়া, স্তন বৃন্ত থেকে কিছু নির্গত হওয়া ইত্যাদি নির্ণয়ের জন্য স্তন পরীক্ষা করেন।

এক্স রে (ম্যামোগ্রাম) 

ম্যামোগ্রামকে ব্রেস্ট ক্যান্সার স্ক্রিনিং ও বলা হয়। ডাক্তার যদি স্তন পরীক্ষার সময় কোন অস্বাভাবিকতা লক্ষ্য করেন, তবে ম্যামোগ্রাম করাতে বলেন।

ব্রেস্ট আল্ট্রাসাউন্ড

এ ধরণের স্ক্যানের মাধ্যমে স্তনের থোকা (lump) কোন কঠিন বস্তু নাকি তরল পদার্থে পুর্ন সিস্ট তা বোঝা যায়।

বায়োপসি 

স্তনের অস্বাভাবিক অংশের টিস্যু নিয়ে তা ল্যাবে পরীক্ষা করে ক্যান্সার উপস্থিতি, ধরণ ও তীব্রতা নির্ণয় করা যায়।

 

সতর্কতা

দৈনন্দিন জীবনের কিছু পরিবর্তন আনলে তা স্তন ক্যান্সার প্রতিরোধে সাহায্য করতে পারে। যেমনঃ

  • পরিমিত অ্যালকোহল গ্রহণ। গবেষণায় দেখা যায় আয়লকোহল পানকারী মহিলাদের চেয়ে কখনো অ্যালকোহল পান করেননি এমন মহিলাদের স্তন ক্যানসারের ঝুঁকি কম।
  • নিয়মিত শরীর চর্চা করলে স্তন ক্যানসারের ঝুঁকি কমে।
  • পরিমিত খাদ্য গ্রহণ
  • রজঃচক্র  বন্ধের পরে হরমোনাল থেরাপি না করা
  • ওজন নিয়ন্ত্রন করা
  • স্তন্যপান করালে স্তন ক্যানসারের ঝুঁকি কমে

স্তন ক্যান্সারের ধাপসমূহ

  • ধাপ ০ঃ নন ইনভ্যাসিভ ক্যান্সার। এ ধাপে ক্যান্সার কোষগুলো উৎপত্তিস্থলেই থাকে। এবং অন্য কোনো অঙ্গে ছড়িয়ে যায়নি।
  • ধাপ ১ঃ টিউমারের আয়তন প্রায় ২ সেন্টিমিটার হয়। টিউমার কোন লিম্ফ নোডে সাথে সম্পৃক্ত হয়না।
  • ধাপ ২ঃ টিউমারের আয়তন ২ থেকে ৫ সেন্টিমিটার হয়।আক্রান্ত স্তনের দিকের বাহুর লিম্ফ নোডে ক্যান্সার ছড়িয়ে যায়।
  • ধাপ ৩ঃ টিউমারের ব্যাস ২ ইঞ্চির বেশি হয়। এ পর্যায়ে ক্যান্সার বগলের নিচে এবং স্তনের আশেপাশের টিস্যুতে ছড়িয়ে যায়।
  • ধাপ ৪ঃ এ পর্যায়ে ক্যান্সার স্তন, বগল ও লিম্ফ নোড ছাড়াও অন্যান্য অঙ্গে ছড়িয়ে যায়।

 

এ পর্বে আমরা নারীর স্তন ক্যানসার নিয়ে আলোচনা করেছি। আগামী পর্বে পুরুষের স্তন ক্যান্সার নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করব।

সাথে থাকুন 🙂

কৃতজ্ঞতা 
Medical news today
Cancer center

 

Nuzhat Tabassum Prova

Nuzhat Tabassum Prova