সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বে অন্যতম পরিচিতি পাওয়া সাবজেক্ট হচ্ছে ‘পাবলিক হেলথ ”। বিষয়টি আমাদের বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের কাছে অনেকটা অপরিচিত হলেও ইতিমধ্য পাবলিক হেলথ বিষয়টি বিশ্ব দরবারে অনেক সুনাম কুড়িয়েছে। যার উপর ভিত্তি করেই দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘পাবলিক হেলথ’ বিভাগটি গুরুত্বের সাথে চালু করা হয়েছে,।

 

তবে বিষয়টি সম্পর্কে বলার আগে, বাংলাদেশে আমাদের পাবলিক হেলথ শিক্ষার সূচনা সম্পর্কে জানা যাক!

 

বাংলাদেশে এ বিষয়ে পড়ালেখার হাতেখড়ি ১৯৭৮ সালে ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব প্রিভেনটিভ অ্যান্ড সোস্যাল মেডিসিনে (নিপসম)। এই প্রতিষ্ঠান থেকে ডিপিএই ডিগ্রি দেয়া হতো। শুধু ডাক্তার, আমলা ও সরকারি কর্মকর্তারা এই ডিগ্রি নেয়ার সুযোগ পেতেন। এসব সীমাবদ্ধতার কারণে পাবলিক হেলথ ম্যানেজমেন্টে পর্যাপ্ত সংখ্যক প্রফেশনাল তৈরি করতে ব্যর্থ হয় নিপসম। এরপর ২০০৬ সালের পর থেকে দেশের বেশ কয়েকটি বেসরকারি ইউনিভার্সিটিতে পাবলিক হেলথ বিষয়ক প্রোগ্রাম শুরু হয় এবং সেখানে এমপিএইচ(MPH) ড্রিগ্রি প্রদান করা হয়। তবে জেনে রাখা ভাল, পরবর্তীতে দক্ষিন এশিয়ায় সর্বপ্রথম সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্য ২০১১ সালে, বাংলাদেশে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ”পাবলিক হেলথ এন্ড ইনফরমেটিক্স” বিভাগ চালু করে এবং আন্ডার-গ্র্যাজুয়েট(অনার্স) প্রোগ্রাম শুরু করে। বর্তমানে সাবজেক্টটি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োলজি ফ্যাকাল্টিতে (ডি ইউনিট) দাপটের সাথে নিজেদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে। উল্লেখ্য যে, ২০১৭ সাল থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাবলিক হেলথ এন্ড ইনফরমেটিক্স বিভাগ চালু হওয়ার কথা রয়েছে।

বাংলাদেশে সাময়িক ভাবে কিছুটা অপরিচিত সাবজেক্ট বলে,পাবলিক থেলথ নিয়ে বলতে গেলে বেশ কিছু সাধারন প্রশ্ন সামনে চলে আসে–

১)পাবলিক হেলথ বা জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা শিক্ষার মূল বিষয়বস্তু কিংবা উদ্দেশ্য কি?

২) পাবলিকে হেলথে কোন বিষয়গুলো মূলত পড়ানো হয়?

৩) একজন পাবলিক হেলথ স্পেশালিস্টের মূল করণীয় কাজ কি?

৪)পাবলিক হেলথ স্পেশালিস্টের চাকরীর ক্ষেত্রে সম্ভাবনা কেমন?

৫) পাবলিক হেলথে পড়ে গবেষনার সুযোগ রয়েছে কিনা?

৬) পাবলিক হেলথে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের বিদেশে কি উচ্চ শিক্ষার সুযোগ পাচ্ছে?

৭)আন্তর্জাতিক সংস্থা ও সরকারী চাকরির ক্ষেত্রে এ বিষয়ের গ্রাজুয়েটদের অগ্রাধিকার আছে কি না?

 

এখন, পর্যায়ক্রমে প্রশ্নগুলোর উত্তর দেয়ার চেষ্টা করছি…

– পাবলিক হেলথ শিক্ষার মূল বিষয়বস্তু কি?

পাবলিক হেলথ বা জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা শিক্ষার বিষয়বস্তু হচ্ছে- মানুষের রোগ নিয়ে গবেষণা ও প্রতিরোধে পদ্ধতি-ব্যবস্থাপনার আবিষ্কার। গোটা জনগোষ্ঠীর রোগ প্রতিরোধমূলক পদ্ধতি গ্রহণ ও স্বাস্থ্য সুরক্ষায় কাজ করাই পাবলিক হেলথ স্পেশালিস্টদের কাজ। বিভিন্ন দেশে এই শিক্ষা পাবলিক হেলথ ম্যানেজমেন্ট কিংবা পাবলিক হেলথ এডুকেশন নামে পরিচিত। তাছাড়া এই শিক্ষার অন্যতম মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এবং বিভিন্ন কারণে সৃষ্ট নানাবিধ স্বাস্থ্যঝুঁকি যেমন- বার্ড ফ্লু, সোয়াইন ফ্লু, জিকা, কলেরা, বসন্ত, মহামারি মোকাবেলায় পাবলিক হেলথ বিশেষজ্ঞ ও নেতৃত্ব তৈরি করা।

-কোন বিষয়গুলো মূলত পড়ানো হয়?

পাবলিক হেলথ সেক্টরে মূলত, এনাটমি,ব্যাসিক বায়ো-কেমিষ্ট্রি,এনথ্রোপলজি, রোগতত্ত্ব (ইপিডিমিওলজি) প্রজনন ও জনস্বাস্থ্য, মাতৃমঙ্গল শিশু স্বাস্থ্য, পরিবার পরিকল্পনা গবেষণা পদ্ধতি, জৈব পরিসংখ্যান , পেশাগত স্বাস্থ্য, স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা, হসপিটাল ব্যবস্থাপনা প্রভৃতি বিষয়গুলো গুরুত্বের সাথে পড়ানো হয়।

-পাবলিক হেলথ স্পেশালিষ্টের মূল কাজ কি?

একজন পাবলিক হেলথ স্পেশালিস্টের মূল কাজ হচ্ছে ; রোগ প্রতিরোধের জন্য স্বার্থক ব্যবস্থা গ্রহণ করা। কাজটি তৃণমূল পর্যায় থেকে নীতিনির্ধারণ এবং বাস্তবায়ন পর্যন্ত। এ বিষয়ে জনসচেতনতা বৃদ্ধি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, জনগণের অভ্যাসগত পরিবর্তনের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করা। যেমন- ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর, নিরাপদ পানির অভাবে অনেক সংক্রামক রোগ ছড়িয়ে পড়ে। এসব বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি, শিশু সন্তানদের টিকা দেয়া, পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি গ্রহণ, সু-স্বাস্থ্য বিষয়গুলো নিশ্চিত করা।

-চাকরী ক্ষেত্রে সম্ভাবনা কেমন?

কোনো এক সময় পাবলিক হেলথ গ্রাজুয়েটদের অভাব ছিল। মেডিকেল ডাক্তারদের দিয়ে এই স্থান পূরণ করা হতো। এখন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু তাদের স্থান ক্ষেত্রবিশেষে চিকিৎসকরা ধরে রেখেছেন। যদিও ডাক্তারদের জ্ঞান পাবলিক হেলথ বিষয়ে সীমিত। গত এক দশক থেকে পাবলিক হেলথ গ্রাজুয়েটদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে তাদের চাকরির সুযোগও বৃদ্ধি পাচ্ছে।বর্তমানে উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে পাবলিক হেলথ কেয়ার বিষয়ে নানামুখী গবেষণা ও শিক্ষার প্রসার ঘটেছে। তাছাড়া বিভিন্ন প্রতিনিয়ত বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন রকম রোগের আবির্ভাব ঘটছে। এজন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা(WHO), ইউএনএফপিএ(UNFPA), ইউএনডিপি(UNDP) ছাড়াও জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা পাবলিক হেলথ নিয়ে গবেষণাকে গুরুত্ব দিচ্ছে। সেখানে বহু লোকজনের কর্মসংস্থানও হচ্ছে। বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশের পাবলিক হেলথের ডিগ্রিধারীরা হাভার্ড, ক্যামব্রিজ, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে এ বিষয়ে উচ্চতর শিক্ষা ও গবেষণার সুযোগ পাচ্ছে। তাই পাবলিক হেলথের গ্রাজুয়েটদের স্বপ্নময় ক্যারিয়ার গড়ার সুযোগ রয়েছে।

-গবেষনার সুযোগ রয়েছে কিনা?

স্বাস্থ্য বিষয়ে গ্রাজুয়েট (এমবিবিএস) অথবা পোষ্ট গ্রাজুয়েট ডিগ্রি লাভের পরও যারা গবেষণা কাজে পারদর্শী নন, তারা পাবলিক হেলথ নিয়ে পড়তে পারেন। পাবলিক হেলথে গবেষণার কয়েকটি কোর্স যেমন- রিসার্চ ম্যাথোডলজি, বায়ো স্টাটাস্টিটিক্স, ইপিডিমিওলজি পড়ানো হয়। যা সরাসরি গবেষণা করতে সাহায্য করে। পাবলিক হেলথের ছাত্ররা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পিএইচডি, পোষ্ট ডক্টারাল পর্যায়ে গবেষণার সুযোগ পেয়েছে। এছাড়া বহু আন্তর্জাতিক সংস্থায় গবেষণা সহযোগী পদে কাজের সুযোগ পেয়েছেন এ বিষয়ের গ্রাজুয়েটরা। শিক্ষার গুণগত মান উন্নত হলে এই সুযোগ সব গ্রাজুয়েটদেরই আরও বৃদ্ধি পাবে।

-বিদেশে উচ্চ শিক্ষার সুযোগ কতটুক?

পাবলিক হেলথ গ্রাজুয়েটদের উচ্চ শিক্ষার সুযোগ অন্য যে কোনো বিষয়ের চেয়ে বেশি। পাবলিক হেলথে বিষয়ে ডিগ্রিপ্রাপ্ত অনেক গ্রাজুয়েট বর্তমানে আমেরিকা, কানাডা, ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া এবং থাইল্যান্ডে উচ্চ শিক্ষা নিচ্ছে। কেউ কেউ অন্যান্য দেশে চাকরির সুযোগও পেয়ে গেছে। বিষয়টির গুরুত্ব বেশি থাকায় এবং মানব কল্যাণে ভূমিকা রাখার কারণে জনস্বাস্থ্য বিশ্বের উন্নত দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে পড়াচ্ছে।

এবং সর্বশেষ প্রশ্নটি ছিল বিশ্বমানের প্রতিষ্ঠানে পাবলিক হেলথ স্পেশালিষ্টদের চাকরী গুরুত্ব কতটুক। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা(WHO) পৃথিবীর সবচেয়ে বড় জন-স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান। এটা মূলত পাবলিক হেলথ বিশেষজ্ঞদের দ্বারাই পরিচালিত। বিশ্বব্যাপী এর কার্যক্রম বিস্তুত। এছাড়া ইউএনডিপি, ইউএনএফপিএ, আইসিডিডিআরবিসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থায় পাবলিক হেলথ গ্রাজুয়েটদের চাহিদা রয়েছে। আন্তর্জাতিক এনজিওগুলোতে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। এ বিষয়ে বহু গ্রাজুয়েট দেশে-বিদেশে আন্তর্জাতিক সেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আছে।
কর্মক্ষেত্র পাবলিক হেলথের বহু গ্রাজুয়েট বর্তমানে জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থায় দেশে-বিদেশে উচ্চ বেতনে চাকরি করছে। দেশের বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পর্যায়েও প্রতিনিধিত্ব করছে পাবলিক হেলথের ছাত্ররা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ইউএনএইডস, ইউএনএফপিএ, জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা, ইউএসএইডের বিভিন্ন প্রকল্পে নিয়োগে বর্তমানে পাবলিক হেলথের ডিগ্রিধারীদের অগ্রাধিকার দেয়া হচ্ছে। আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংস্থা (আইএনজিও) যেমন- আইসিডিডিআরবি, সেভ দ্য চিলড্রেন, এফএইচআই-৩৬০, আইডিআরসিতে কর্মসংস্থান হয়েছে এই বিষয়ের শিক্ষার্থীদের। জন হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন গবেষণা প্রজেক্ট, ওয়াটার এইড ও কেয়ারের বিভিন্ন প্রকল্পে কাজের সুযোগ হচ্ছে বাংলাদেশী ডিগ্রিধারীদের। পাবলিক হেলথ ম্যানেজমেন্টের ছাত্ররা জাতিসংঘসহ বিভিন্ন সংস্থা থেকে সবচেয়ে বেশি ফেলোশিপ পাচ্ছে। গত বছর ইউএসএইড বাংলাদেশের পাবলিক হেলথের ১০০ শিক্ষার্থীকে ফেলোশিপ দিয়েছে।

তাছাড়া, এটা অনীস্বীকার্য স্বাস্থ্য অধিদফতরে পাবলিক হেলথ বিশেষজ্ঞদের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরে পাবলিক হেলথ গ্রাজুয়েটদের ব্যাপক চাহিদা যা অতীতে ডাক্তার এবং অনভিজ্ঞ দিয়ে পূরণ করতে হয়েছে। তবে পাবলিক হেলথ গ্রাজুয়েটদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেলে তারা এই দায়িত্ব আরও ভালভাবে পালন করতে পারবেন। এছাড়া সরকারের অধীনে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগ, পরিবেশ, পুষ্টি পরিকল্পনা ও অন্যান্য মন্ত্রণালয়ে পাবলিক হেলথ গ্রাজুয়েটদের চাকরির সুযোগ রয়েছে।

সর্বশেষে ,বিশ্ব দরবারে যদি নিজের দেশকে উপস্থাপন করতে চাই তাহলে বলবো অবশ্যই পাবলিক হেলথ শিক্ষা এবং সেটা নিয়ে গবেষনা গুরুত্বপূর্ণ একটি প্ল্যাটফর্ম হতে পারে। এবং তোমাদের যদি সত্যিই ভবিষ্যতে পাবলিক হেলথ নিয়ে পড়ার ইচ্ছে থাকে তাহলে অবশ্যই সেটার শুরু বিশ্ববিদ্যালয় জীবন থেকে করা শ্রেয়। যেহেতু,পাবলিক হেলথ বিষয়ক আন্ডার-গ্র্যাজুয়েট সরকারী প্রোগ্রাম দক্ষিন এশিয়ায় সর্বপ্রথম জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োলজি অনুষদে চালু করেছে সেহেতু তোমার প্রথম টার্গেট জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পুরান কলায় অবস্থিত ‘পাবলিক হেলথ এন্ড ইনফরমেটিক্স’ বিভাগ হতে পারে । সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে কম খরচে পাবলিক হেলথ বিষয়ে পড়তে চাইলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় একটি ভাল অপশন হতেই পারে!

– মামুন উর রশিদ (প্রান্ত)
ডিপার্টমেন্ট অফ পাবলিক হেলথ এন্ড ইনফরমেটিক্স,৫ম ব্যাচ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।