সহজ বাংলা করলে হয় দুশ্চিন্তা। কিন্তু ব্যাপারটা ঠিক দুশ্চিন্তার মাঝে সীমাবদ্ধ না। তার চেয়ে এক কাঠি সরেস, কিংবা আরও বেশী। আমরা তাই শাব্দিক অর্থ না খুঁজে বরং জিনিষটা আসলে কী সেটা বোঝার চেষ্টা করবো। দুশ্চিন্তায় পড়িনি, এমন কেউ আমাদের মাঝে নেই। হোক সেটা এডমিশন টেস্ট, কিংবা প্রথম প্রেম পত্র দিতে গিয়ে। কিন্তু সেগুলো একটা বিশেষ ঘটনাকে ঘিরেই আবর্তিত হয়। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, এ ধরণের দুশ্চিন্তা আমাদেরকে আরও এলার্ট করে তোলে, আমরা অনেক বেশী ফোকাস করতে পারি। প্রেম পত্র দেওয়া হয়ে গেলেই সব দুশ্চিন্তা আকাশে উড়ে যায়। আমরা তখন মুক্ত পাখি, আকাশে-বাতাসে উড়ে বেড়াই।

তার সাথে এনজাইটি ডিসঅর্ডারের পার্থক্য হল, এতে সাময়িক ভয় কিংবা দুশ্চিন্তার চেয়ে বেশী কিছু থাকে। দেখা যায়, এই অনুভূতিটা দিনের পর দিন আরও জেঁকে বসছে, এবং খারাপ থেকে আরও খারাপ হচ্ছে। এটা মানুষের এক্টিভিটিতে প্রভাব বিস্তার করতে থাকে। তার কাজ, পড়াশোনা, রিলেশনশিপ সব ক্ষেত্রেই নিত্যনতুন ঝামেলা সৃষ্টি হয়। একদম ছোটখাটো ব্যাপারও তখন দুশ্চিন্তার সৃষ্টি করে।

 

আচ্ছা, আমি কি অনেক খারাপ? সবাই কি আমাকে ঘৃণা করে? আমার কি আরেকটু জোরে সালাম দেওয়া উচিত ছিল? আচ্ছা ও লোকটা কি আমার কথা শুনছে? শুনেও কিছু বলে নাই? কেন বলে নাই? সে কি আমার উপর রেগে আছে? আমার কি তাকে আবার বলা উচিত? আমার কি তাকে জিজ্ঞেস করা উচিত সে কেমন আছে? আমি রিপ্লাই দিবো? না দিলে কি সে রাগ করবে? রিপ্লাই দিলে কি দিবো? কেন দিবো? কীভাবে দিবো? কখন দিবো?

এনজাইটি কী

এনজাইটি বলতে কয়েক ধরণের সমস্যা বোঝায়ঃ

(১) ফোবিয়াঃ কোনো বিশেষ ঘটনা বা পরিস্থিতি সম্পর্কে ভীতি কাজ করা। যেমন, অনেকের এলিভেটরে ঢুকলে মনে হয় তাকে চারপাশ থেকে চেপে ধরা হচ্ছে। কিংবা অনেকের উচ্চতা ভীতি আছে। একইভাবে অনেকের পোকামাকড় সহ আরও অনেককিছুর প্রতি ভীতি কাজ করে।

(২) প্যানিক এটাকঃ এইটা এনজাইটির প্রকট পর্যায়। যেমন দেখা যায়, সব ঠিকভাবে চলেছে, সে হাসি-খুশি সবার সাথে ঘুরে বেড়াচ্ছে, একেবারে হঠাত করেই তার প্রবল ভীতি কিংবা ডিসকমফোর্ট শুরু হয়।

৩) পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডারঃ এইটা সাধারণত কোনো দুর্ঘটনার পরে হয়ে থাকে। এই স্মৃতি মন থেকে মুছে যায় না। সবসময় চোখের সামনে দৃশ্যটা ভাসতে থাকে, বেশী পরিমাণে দুঃস্বপ্ন আসতে শুরু করে।

(৪) অবসেসিভ কমপালসিভ ডিজঅর্ডারঃ একই কাজ কিংবা একই চিন্তা বারবার করতে থাকা। বারবার বললে ঠিক বোঝানো হয় না। বলা যায় দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, সারাদিন-সারারাত।

(৫) জেনারালাইজড এনজাইটি ডিজঅর্ডারঃ জীবনের সার্বিক ব্যাপারগুলো (কাজ, পড়াশোনা, রিলেশনশিপ ইত্যাদি) নিয়ে অত্যধিক [অনেক ক্ষেত্রে অকারণ] দুশ্চিন্তা।

(Greenberger & Padesky, pp. 174-175)

 common-types-of-anxiety-disorder

এই লেখায় আমরা মূলত জেনারালাইজড এনজাইটি ডিজঅর্ডার নিয়ে কথা বলবো।

 

লক্ষণসমূহ

এখানে একটা কথা বলে রাখা ভাল। যে লক্ষণগুলো বলা হবে, সেগুলো থাকার অর্থ এই নয় যে কেউ জেনারালাইজড এনজাইটি ডিজঅর্ডারে ভুগছে। বরং এর মানে হল “হয়তো সে জেনারালাইজড এনজাইটি ডিজঅর্ডারে ভুগতে পারে। তাকে চিকিৎসক দেখাতে পারলে ভাল হয়।” নিচের বেশ কিছু লক্ষণ দৈনন্দিন জীবনে এমনিতেই দেখা যায়। এগুলো থাকলে GAD হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, যদি এদের কনসিস্টেন্সি অনেক বেশী হয়, কিংবা দিনের পর দিন (কমপক্ষে ছয় মাস) ধরে এগুলো দেখা যায়।

ছয় মাস বা তার বেশী সময় ধরেঃ

  • এক বা একাধিক ঘটনা নিয়ে দুশ্চিন্তায় ভোগা
  • দুশ্চিনা থামাতে না পারা (অনেকের ধারণা কেউ চাইলেই দুশ্চিন্তা থামাতে পারে। এজন্যে একটি কথা প্রায়ই শোনা যায়, “আরে চিন্তা করিও না! তুমি চিন্তা করে করেই সব এমন করে ফেলো!” যারা ডিজঅর্ডারে ভোগে, তাদের জন্য এটা থামানো সম্ভব না। )
  • দৈনন্দিন কার্যক্রমে কি প্রভাব বিস্তার করছে? [ পড়াশোনা, অফিসের কাজ, হ্যাংআউট ]

উপরের প্রশ্নগুলির উত্তর যদি হ্যাঁ হয়, তাহলে সাথে কি নিচের এক বা একাধিক ব্যাপার ঘটছে সাথে?

  • অস্থিরতা
  • খুব সহজেই টায়ার্ড হয়ে যাওয়া
  • মনোযোগ দিতে না পারা
  • অল্পতেই বিরক্ত হয়ে যাওয়া
  • পেশীতে সমস্যা [যেমন, পিঠ কিংবা ঘাড়ে ব্যাথা ]
  • ঘুমাতে সমস্যা [ ঘুমাতে না পারা, কিংবা বার বার ঘুম ভেঙ্গে যাওয়া ]
  • Lightheadedness
  • হাতের তালু ঘেমে যাওয়া
  • অকারণে ভীতি
  • সাহায্য নেওয়ার অনিচ্ছা
  • ধংসাত্বক চিন্তাভাবনা
  • পার্ফেকশন নিয়ে খুব বেশী মাথা ঘামানো
  • এনজাইটি শুরু হলে নিজেকে গুটিয়ে নেওয়া
  • এনজাইটি সৃষ্টি করে এমন বিষয় বা ঘটনা থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখা। এটা বিশেষভাবে ক্ষতিকর। কারণ অনেকক্ষেত্রেই দেখা যায়, সে নিজেকে তার কাছের মানুষজন, কিংবা কাজকর্ম থেকে দূরে সরিয়ে ফেলছে। কারণ, কিছু একটা ঠিকভাবে না হলে সে এনজাইটিতে ভুগবে!

যদি উত্তর হ্যাঁ হয়, তাহলে হয়তো জেনারালাইজড এনজাইটি ডিজঅর্ডার হতে পারে

এছাড়া এনজাইটি ডিজঅর্ডারের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে আছে আরও কিছু ডিজঅর্ডার যেমন, ডিপ্রেশন, সোশ্যাল ফোবিয়া (সোশ্যাল সিচুয়েশনগুলা এড়িয়ে যাওয়া)। এছাড়া মাথা ব্যাথা, Bowel complaint-এগুলোও প্রায়ই দেখা যায়।

______________________________________________________________________

আমাদের দেশে মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতনতা নেই বললেই চলে। তাই এই বিষয়গুলো নিয়ে কোনো তথ্যও নেই। তবে beyondblue-এর মতে অস্ট্রেলিয়াতে প্রতি বছর প্রতি সাত জনে একজন এনজাইটি ডিজঅর্ডারে ভোগে। এবং তাদের মধ্যে তিন পার্সেন্ট GAD-তে ভোগে। সে সাথে মোট জনসংখ্যার ৬ পার্সেন্ট জীবনের কোনো না কোনো সময়ে GAD-তে আক্রান্ত হয়। সাধারণত ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের মাঝে GAD বেশী দেখা যায়। এটা যেকোনো সময়েই দেখা দিতে পারে। তবে গড়ে ৩০ বছরের পরই এটা সাধারণত দেখা দেয়।

আমাদের দেশেও পরিসংখ্যান খুব বেশী ভিন্ন হওয়ার কারণ নেই। বরং সংখ্যাটা আরও বেশী হলেও অবাক হওয়ার কারণ নেই। আমাদের সমাজকাঠামো থেকে শুরু করে অনেক কিছুই শিশুদের প্রতিকূল থাকে। এবং শিশুমনে পুষে রাখা রাগ, ক্ষোভ কিংবা অভিমান প্রকাশ এক সময় পেতে শুরু করে। আমাদের আশেপাশে এমন অনেকেই হয়তো আছেন, যারা প্রতিনিয়ত ভুগছেন, অথচ কাউকে বলতেও পারছেন না। আমরা কীভাবে তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসতে পারি?

প্রথমত, আমাদের সবার মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে জানতে হবে। এটা বুঝতে হবে যে মানসিক সমস্যা মানেই কারো পাগল হয়ে যাওয়া না। এবং এটাও মানতে হবে যে এ সমস্যাগুলো খুবই বাস্তব

দ্বিতীয়ত, পারস্পরিক যোগাযোগ বাড়াতে হবে। সকল ব্যস্ততার মাঝে সময় খুঁজে নিতে হবে প্রিয় মানুষগুলোর জন্য। বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, অর্থবহ কিছু কনভার্সেশনই সমস্যা অনেকাংশে সমাধান করে দেয়।

তৃতীয়ত, যদি মনে হয়ে থাকে যে, অবস্থা দিন দিন খারাপের দিকে যাচ্ছে, তাহলে তাকে বুঝতে হবে কাউন্সেলিং কিংবা সাইকিয়াট্রিস্টের সাহায্য দরকার। এখানে ভয় বা লজ্জার কিছুই নেই!

_____________________________________________________________

আজ এ পর্যন্তই। সবাই ভাল থাকবেন, ভাল রাখবেন প্রিয় মানুষগুলোকে।

রেফারেন্স

(১) Greenberger & Padesky

(২) 7 Cups of Tea

(৩) Beyond Blue

(৪) National Institute of Mental Health

(৫) Teen Mental Health

 

Muntasir Wahed

Muntasir Wahed

System Administrator at স্বশিক্ষা.com
Jack of all trades, master of none.
Muntasir Wahed
Muntasir Wahed