কবি তাঁর বিখ্যাত কাব্য বিদ্যাসুন্দর শেষ করেই পা বাড়ালেন রাজার বাড়ির দিকে। ব্যস্ত রাজা কৃষ্ণচন্দ্র কাব্যটির এক পাতাও না উল্টিয়ে পাশে রেখে দিলে কবি চেঁচিয়ে উঠলেন,
“মহারাজা করছেন কী! করছেন কী! সব রস যে গড়িয়ে পড়লো!”
রাজা তখন তাঁর সব কাজ ফেলে চোখের সামনে মেলে ধরলেন বিদ্যাসুন্দর কাব্য, যে কাব্য পরবর্তী দু’শ বছর পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যে আলোড়ন জাগিয়েছে।
বিদ্যাসুন্দর কাব্যের স্রস্টার নাম ভারতচন্দ্র রায়। মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যকে অলংকৃত করা এ জাদুকরের জন্ম ১৮ শতকের প্রথম দিকে। সমাজ আর সাহিত্য তখন পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল বলে দু’ ক্ষেত্রেই অন্ধকার বিরাজমান । বাংলা সাহিত্যের মধ্য যুগ তখন যাই যাই করছে। সাহিত্যের একটি যুগ যখন শেষ হয়ে আসে তখন শেষের বছরগুলোতে নানা রকম পতন দেখা দেয়। অন্যদিকে ভারতচন্দ্রের মৃত্যুর ৩ বছর আগে আমাদের দেশ দখল করে ইংরেজরা। সব মিলিয়ে, ভারতচন্দ্র পতন যুগের কবি।
ভারতচন্দ্রের জন্ম হয় বর্ধমানের পান্ডুয়া গ্রামে। তাঁর পিতা নরেন্দ্রনারায়ণ রায় ছিলেন সে গ্রামের জমিদার। কিন্তু কবির জন্মের পর পর বর্ধমানের রাণী নরেন্দ্রনারায়ণের পান্ডুয়ার রাজপ্রাসাদ বলপূর্বক দখল করেন এবং তাঁকে আর্থিক সংকটে ফেলে দেন। ১০ বছর বয়সে কবি পালিয়ে তাঁর মামাবাড়ি চলে যান। সেখানে এক পণ্ডিতের কাছে সংস্কৃত ব্যাকরণ রপ্ত করেন। মাত্র ১৪ বছর বয়সে সারদা গ্রামের কেশরকুনি আচার্য বংশের এক কন্যাকে বিয়ে করে বাড়ি ফিরে আসেন তিনি।
সেকালের রাজভাষা ছিল ফারসি। কিন্তু কবি তা না শিখে শিখেছেন সংস্কৃত। সেটা দিয়ে আর যাই হোক চাকরী হবে না। তাই ফারসি ভাষা শিখতে যান হুগলী জেলার রামচন্দ্র মুনশির বাড়িতে। খুব মনোযোগ দিয়ে অর্থকরী ভাষা ফারসি শিখে শিক্ষককে মুগ্ধ করে দেন তিনি। সেখানেই রচনা করেন তাঁর প্রথম কবিতা। ভারতচন্দ্রের প্রথম কবিতা ছিল বিমিশ্র দেবতা সত্যনারায়ণের সম্মানে রচিত একটি পাঁচালি। সত্যনারায়ণকে মনে করা হতো ফকির রূপী বিষ্ণুর অবতার। মুন্সি পরিবার কর্তৃক আয়োজিত সত্যনারায়ণের উৎসব উপলক্ষে এ পাঁচালি রচিত। জনৈক হীরারাম রায়ের অনুরোধে তিনি এ দেবতার ওপর আরও একটি সংক্ষিপ্ত পাঁচালি রচনা করেন। তরুণ বয়সে রচিত এ দুটি রচনার মধ্যে তাঁর কবি প্রতিভার পরিচয় পাওয়া যায়। ভারচন্দ্রের তরুণ বয়সের এ রচনার একটি আকর্ষণীয় বৈশিষ্ট্য ছিল অত্যন্ত নির্খুত ও স্বাধীনভাবে বাংলা ভাষায় ফারসি ও উর্দু শব্দের ব্যবহার। তাঁর পরবর্তী রচনাবলিতে এটি একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্যরূপে দেখা দেয়। তিনি সবার কাছে একজন ফারসি পন্ডিত হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।
ফরাশডাঙ্গায় তখন ফরাসি সরকারের চাকুরী করেন ইন্দ্রনারায়ন চৌধুরী। ভারতচন্দ্র ভাল কবি, ছন্দ গাঁথেন অনায়েসে তাই দেখে ইন্দ্রনারায়ন তাঁকে নবদ্বীপের রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের কাছে পাঠালেন। ভারতচন্দ্রের গুনে মুগ্ধ হয়ে রাজা তাঁকে সভাকবি হিশেবে বরণ করে নেন। কৃষ্ণচন্দ্রই তাঁকে রায়গুণাকর উপাধি দেন। এ ছাড়াও রাজার কাছ থেকে তিনি মাসিক ৪০ টাকা এবং প্রচুর জমিজমা লাভ করেন।
রাজসভার এ কবির কাব্যে ছিল চাতুর্য, বুদ্ধির খেলা আর পান্ডিত্য। সহজ সরল কোন অনুভূতি তাঁকে মুগ্ধ করেনি বুং তিনি সব সময় চেয়েছেন এমন বস্তু যা তাঁর পাঠককে চমকে দিবে। তাঁর কথা ছিল ধারালো, চকচকে তরবারির মত। কবির সবকিছুতেই ঠাট্টা খুঁজে পেতেন। বিদ্রুপ করতে পারতেন সবাইকে নিয়ে। মধ্যযুগের সকল কবিই যখন নিজের নায়িকাকে চাঁদের মত রূপসী বলছেন তখন ভারতচন্দ্র বললেন
কে বলে শারদ শশী সে মুখের তুলা
পদনখে পড়ে আছে তাঁর কতগুলা।
মধ্যযুগের এ বর্ণকারিগর এমন অসংখ্য চমৎকার কথা বলেছেন অবিরাম। তাঁর মুখের অনেক কথা প্রবাদ হয়ে আজো প্রাণময় মানুষের মুখে মুখে।
নগর পুড়িলে দেবালয় কি এড়ায়?
মন্ত্রের সাধন কিংবা শরীর পাতন।
এ সবই কবির মুখনিঃসৃত বাক্য।
কবির কাব্য মাত্র একটি। নাম অন্নদামঙ্গলকাব্য।
কাব্যটির আছে ৩টি ভাগ। এক ভাগের নাম অন্যদামঙ্গল, এক ভাগের নাম বিদ্যাসুন্দর আর অপরটির নাম ভবানন্দ-মানসিংহ কাহিনী। এ কাব্যে কবি তাঁর রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের পূর্বপুরুষ ভবানন্দ গুণকীর্তন করতে চেয়েছিলেন। মধ্যযুগের এ কবি দেবদেবীর কাহিনীর মাঝে সাধারণ মানুষের চাওয়া পাওয়া গল্প জুড়ে দিয়েছেন। বলেছেন ঈশ্বরী পাটনির কথা। অন্নদা দেবী ঈশ্বরী পাটনির নৌকায় নদী পার হয়ে বললেন, কী বর চাও তুমি বল। গরীব মাঝি দেবীর সাক্ষাত পেয়ে জগতের সব ধন সম্পদ, মণিমুক্তা, সম্পত্তি চাইতে পারত। কিন্তু সে দেবিকে বলল, তাঁর সন্তান, তাঁর সবচেয়ে মুল্যবান সম্পদ যেন দুধে ভাতে থাকে।
আমি দেবী অন্নপূর্ণা প্রকাশ কাশীতে।
চৈত্রমাসে মোর পূজা শুক্ল অষ্টমীতে॥
কত দিন ছিনু হরিহোড়ের নিবাসে।
ছাড়িলাম তার বাড়ি কন্দলের ত্রাসে॥
ভবানন্দ মজুন্দার নিবাসে রহিব।
বর মাগ মনোনীত যাহা চাহ দিব॥
পরণমিয়া পাটুনী কহিছে জোড় হাতে।
আমার সন্তান যেন থাকে দুধেভাতে॥
তথাস্তু বলিয়া দেবী দিলা বরদান।
দুধেভাতে থাকিবেক তোমার সন্তান॥
তথ্যসূত্র
লাল নীল দীপাবলি – হুমায়ূন আজাদ।
বাংলাপিডিয়া।