এ পর্বে আমরা কথা বলব নার্সিসিটিক পার্সোনালিটি ডিজর্ডার (এনপিডি) নিয়ে। উফ! নামটা খুব দাত ভাঙা তাইনা? তবে কোন চিন্তা নেই! আমরা সোজা ভাষা, প্রচুর ছবি আর ভিডিও দিয়ে ব্যাধিটির নাড়িভুঁড়ি উদ্ধার করে ফেলব। তবে তার আগে গ্রিক মিথোলজি থেকে একটা চক্কর দিয়ে আসি?

গ্রীসের নদী-দেবতা কিফিসস-এর ছেলে নার্সিসাস হরিণ শিকারে বেরিয়েছেন।
 দুপুর রোদে দুরন্ত এক হরিণকে ধাওয়া করার এক পর্যায়ে একো’র নজরে  পড়েন তিনি। নার্সিসাসের প্রেমে উতলা হয়ে একো নিজেকে নিবেদন করে তার কাছে। আত্ন-অহংকারী নার্সিসাস প্রত্যাখান করেন একোকে। আর এতে প্রতিশোধের দেবতা নেমেসিস রেগে গেলেন। আর শাস্তি দিলেন এই অহংকারীকে। কী সেই শাস্তি? শিকারের পেছনে ছুটে ক্লান্ত এবং তৃষ্ণার্ত নার্সিসাস এক ঝর্ণার কাছে এলেন। ঝর্ণার পানিতে নিজের চেহারার প্রতিচ্ছবি দেখে এমনই সম্মোহিত হলেন , ওখানেই পড়ে রইলেন। একসময় ওখানেই ডুবে মরলেন।

 

তো, নার্সিসাসের কাহিনী থেকেই নার্সিস্টিক পার্সনালিটি ডিজর্ডারের একটা ধারণা পাওয়া যায়। এনপিডি আক্রান্তরা নার্সিসাসের মতই নিজেকে সবচেয়ে ভালো, সবচেয়ে সুন্দর, বিদ্যা,বুদ্ধি,সামাজিক মর্যাদায় অন্য সবার চে’ ঢের ভালো মনে করে।
নার্সিস্টিক পারসোনালিটি ডিজঅর্ডারকে অতিরিক্ত স্বগুরুত্ব অনুধাবন,অত্যাধিক প্রশংসার প্রয়োজন, অন্যের প্রতি সহানুভূতিহীনতা দ্বারা চিহ্নিত করা হয়। এ রোগে আক্রান্ত ব্যাক্তিরা সাধারণত অহংকারী, আত্মাভিমানী, প্রতিহিংসাপরায়ণ,ও অনুভূতিহীন হয়ে থাকে এবং ব্যাক্তিগত সম্পর্কে শোষণমূলক ভূমিকা পালন করে থাকে।
এছাড়াও তারা অতিরিক্ত আত্মগর্ব,খ্যাতি, এবং ক্ষমতার ভ্রান্ত ধারণায় আচ্ছন্ন থাকে। এনপিডি আক্রান্তদের মধ্যে আবেগসংক্রান্ত সচেতনতা এবং অন্তর্দৃষ্টি কম থাকার কারণে তারা উপলব্ধি করতে পারে না যে তাদের আচরণই তাদের এবং কাছের মানুষদের সমস্যা মূল।

 

এবারে এনপিডির লক্ষণগুলো একটু দেখে নেই

 

  • সবসময় প্রশংসার প্রয়োজন অনুভব করা
  • যোগাযোগ/সম্পর্কের ক্ষেত্রে  আত্মকেন্দ্রিকতা
  • টেকসই সাবলীল সম্পর্কের ক্ষেত্রে সমস্যা
  •  মনস্তাত্বিক সচেতনতার অভাব
  •  অন্যের অনুভূতির বিষয়ে ধারণার অভাব
  •  নিজেকে অন্যের তুলনায় সর্বদা উচ্চতর অবস্থানে দেখা
  • স্বার্থপরতা করা (সুক্ষ্ণভাবে কিন্তু প্রতিনিয়ত) ,অন্যকে ছোট করা এবং নিজের অর্জন, গুণাবলিকে ফুলিয়ে ফাপিয়ে উপস্থাপন করা

Source: giphy

  • যেকোন অবমাননা বা কল্পিত অবমাননার প্রতি অতি সংবেদনশীলতা
  •  অপরাধবোধে নয়, বরং লজ্জায় বেশি কাতরতা। মনে রেখ, একজন এনপিডি আক্রান্ত ব্যাক্তি কিন্তু কখনোই তার ভুল স্বীকার  করবেনা। বরং ওটাকেই ঠিক বলে চালিয়ে নেয়ার সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে।
  •   অসৌজন্যমূলক এবং অবন্ধুসুলভ দেহভঙ্গি
  •  নিজের প্রশংসাকারীদেরকে তোষামোদ করা
  •  নিজের সমালোচকদেরকে ঘৃণা করা
  • পূর্বাপর না ভেবে অন্যদেরকে দিয়ে নিজের কাজ করিয়ে নেয়া
  •  আসলে যতোটা না, তার চেয়ে নিজেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভাবা

Image result for chess mirror narcissism

 

  • নিজেকে বহু বিষয়ের পণ্ডিত মনে করা

Image result for narcissistic personality disorder

  •  অন্যের দৃষ্টিকোণে বাস্তব পৃথিবী কেমন তা অনুধাবণে অসমর্থ্য
  •  অনুতাপ এবং কৃতজ্ঞতা প্রকাশে অস্বীকৃতি/অনীহা
  • পরশ্রীকাতরতায় আক্রান্ত এবং অন্যরাও তাদের রুপ, গুণ, অর্জন দেখে কাতর হয় এমন ধারনা পোষণ করা
  • কোন আড্ডায় বসলে তারা মনযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকতে চায়। তারা একাই কথা বলে যেতে চায়। অন্য কেউ নিজের ব্যাপারে কথা বললে তাদের খুব রাগ হয়।Image result for npd treatment

 

  • এনপিডি আক্রান্ত ব্যাক্তি ঝুঁকি নিতে ভয় পায়। কোন কারণে ব্যর্থ হলে তাদের আত্মাভিমানে ভাটা পড়বেনা?

সাধারণত কৈশোর বা প্রাক তারুণ্যে এনপিডির জন্ম হয়। তবে কিছু কিছু কিছু লক্ষণ যেকোনো মানু্ষের মধ্যে চোখে পড়ে।diagnose না করে তাদেরকে এনপিডি রোগী বলা যাবেনা। প্রকৃত এনপিডি পরিব্যাপ্ত, লম্বা সময় ধরে দৃশ্যমান এবং সব প্রেক্ষাপটেই তা দেখা যায়। এনপিডি আক্রান্তদের লক্ষনগুলোকে ব্যাক্তিগত সম্পর্ক দুর্বল করে দেয়ার জন্য যথেষ্ট তীব্র হতে হবে। এ ছাড়াও,এনপিডির কারণে স্কুল কলেজ বা কর্মস্থলে ব্যক্তির কর্মক্ষমতা হ্রাস পায়।

এ ব্যাধির মুল কারণ এখনো জানা যায়নি। তবে বিজ্ঞানীদের ধারণা পরিবেশ, সমাজ, জিন এবং মস্তিষ্ক এর গঠন ব্যাধিকে ত্বরান্বিত করতে ভূমিকা রাখে।

জিনগত
এনপিডি জিনের মাধ্যমে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বাহিত হয়। পূর্বসূরি কারো এ ব্যাধি থাকলে উত্তরসূরির এনপিডি আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু কোন জিন এনপিডির জন্য দায়ী এবং সেটা কীভাবে ব্যাক্তির মানষিক গঠনকে প্রভাবিত করে তা নিয়ে এখনো গবেষণা চলছে।

পরিবেশ

পরিবেশ এবং সমাজ এনপিডির সূত্রপাতে প্রভাব বিস্তার করে।বাবামা’র সাথে যেসব বাচ্চাদের হৃদ্যতার অভাব থাকে তারা নিজেদেরকে অপ্রয়োজনীয় ও অন্যদের থেকে বিচ্ছিন্ন ভাবতে শুরু করে, তারা মনে করে তাদের ব্যাক্তিত্বের কোন দুর্বলতার জন্যই তারা অনাকাঙ্ক্ষিত। একদিকে বাবা মায়ের অতিরিক্ত শাসন, রাগারাগি অন্যদিকে বেশি প্রশ্রয় ও এ রোগে প্রভাব বিস্তার করে।

ট্রিটমেন্ট
এনপিডির ট্রিটমেন্ট মুলত টক থেরাপি (talk therapy) যার মাধ্যমে ব্যাক্তির প্রকৃত ব্যাক্তিত্ব, গুণাবলি, ক্ষমতা অনুধাবন করতে সাহায্য করা হয় এবং অন্যদের অনুভুতির প্রতি সহানুভূতিশীল করার চেষ্টা করা হয়। এ রোগের কোন মেডিকেশন নেই।

 

এবার আসা যাক ‘হেল্‌দি নার্সিসিজম’ প্রসঙ্গে। হেল্‌দি নার্সিসিজম হলো নিজের সত্তার সম্পর্কে প্রকৃত জ্ঞান উপলব্ধি ,নিজের প্রতি নিজের এবং অন্য বস্তুর আনুগত্য অর্জন, সত্তার স্বাভাবিকতা এবং পরম অহংবোধের সুসংহত অবস্থা, এবং প্রাপ্তির আকাঙ্ক্ষা ও উম্মত্ততার মধ্যে বিরাজমান ভারসাম্য। এটি ব্যক্তির মাঝে এক ধরণের অপরিবর্তনীয়, বাস্তবধর্মী স্বার্থ-সংশ্লিষ্টতা এবং পরিণত লক্ষ্য ও বিশ্বাস আর সেই সাথে বস্তু-কেন্দ্রিক সম্পর্ক গঠনের সক্ষমতা তৈরি করে। এটা অনেকটা অনিরাপত্তা ও অপর্যাপ্ততা প্রতিরোধী একধরণের আত্মবিশ্বাস। মানুষের স্বাভাবিক ব্যক্তিত্বের বিকাশে হেল্‌দি নার্সিসিজম অত্যাবশ্যকীয়। এতে আত্মপ্রেম অবশ্যই আছে তবে তা চারপাশের বাস্তবতাকে লীন করে এককেন্দ্রিকতা দেয়না। তাই এটি রোগের কোনো লক্ষণ নয়। এটি মানসিক সুস্বাস্থের সহায়ক।
 নার্সিস্টিক পারসোনালিটি ডিজর্ডার এর নাড়িভুঁড়ি উদ্ধারকার্যক্রম আপাতত এ পর্যন্তই।আশা করছি  আলোচনাটি সহায়ক ছিল। কষ্ট করে পড়ে ফেলার জন্য
Image result for cartoon says thank you
যাদের পড়তে ভাল লাগেনা বলে স্রেফ চোখ বুলিয়ে গেছেন তারা ভিডিওটি  দেখে আসুন 🙂

 

Nuzhat Tabassum Prova

Nuzhat Tabassum Prova