১৯৫৪ সালের কোন এক পড়ন্ত বিকেল, কলোম্বিয়া অডিটোরিয়ামের সামনে রাজ্যের ভিড়; ভেতরে চলছে ‘লুইসভিলে হোম শো’। সেদিন আর সবার সাথে শো দেখতে এসেছিল স্কুল পালিয়ে আসা দুই বন্ধুও; একজন কৃষ্ণাঙ্গ আরেক জন শ্বেতাঙ্গ। কালো চেহারার, সুঠাম দেহের ছেলেটি তার প্রিয় Schwinn ব্র‍্যান্ডের সাইকেল’টি অডিটোরিয়াম এর বাইরে বেধে রেখেই শো দেখতে ঢুকল। দুই বন্ধুতে মিলে ঘুরে ফিরে শো দেখল; ফ্রি হটডগ আর পপকর্ণ খেল। শো শেষে অডিটোরিয়াম থেকে বেরিয়ে আসতেই দেখা গেল বেধে রাখা সাইকেলটি জায়গামত নেই; চুরি গেছে।

নতুন সাইকেল হারিয়ে রাগে রীতিমত জ্বলছিল ছেলেটি। তখন অডিটোরিয়ামের সামনেই ডিউটিতে ছিল পুলিশ অফিসার জো মারটিন (উল্লেখ্য মারটিন কলোম্বিয়া জিম এর বক্সিং কোচও ছিল)। ছেলেটি সোজা গিয়ে তার কাছে জানাল যে, যে কোন মূল্যে চোরটা’কে তার চাই, সে নিজ হাতে পিটাবে চোর’কে।
জো মারটিন ১২ বছরের ছেলের দৃঢ়তা ও লড়াইয়ের মানসিকতা দেখে অবাক হল, “মারতে চাইলে, মারার নিয়ম কানুন শিখে নিতে হবে না?” মারটিন তখনই দৃঢ়চেতা ছেলেটি’কে তার জিমে বক্সিং শেখার প্রস্তাব দিল; এবং ছেলেটিও সানন্দে রাজি হয়ে গেল এ প্রস্তাবে।

পরদিন থেকে শুরু হল আরামপ্রিয় ছেলেটির প্র‍্যাক্টিস। সপ্তাহে ৬ দিন নিয়মিত জিম, প্রতিদিন ভোরে উঠে দৌড়ানো, বক্সিং প্র‍্যাক্টিস ইত্যাদির মাধ্যমে ধীরে ধীরে ফিটনেস আসতে শুরু করল তার। ছেলেটি চিরতরে ছেড়ে দিল প্রিয় জাংক ফুড, বিয়ার আর সিগারেট; কঠোর অধ্যবসায়ের সাথে চলতে লাগল তার অনুশীলন।
এবং এখান থেকেই শুরু হল একজন ক্লেসিয়াস ক্লে হয়ে ওঠার গল্প, একজন মোহাম্মদ আলী হয়ে ওঠার গল্প…

১২ বছরের সেই আরামপ্রিয় ছেলেটির অমানুষিক পরিশ্রম, আত্মত্যাগ ও সংযম ছিল সত্যিই অবিশ্বাস্য। বড় ধরনের ফল আসল ছয় বছর পর; ১৯৬০ এর অলিম্পিকে মাত্র ১৮ বছর বয়সে লাইট হেভিওয়েট গোল্ড মেডেল জিতলেন আলী। এরপর ১৯৬৪ সালে, মাত্র ২২ বছর বয়সে ওয়ার্ল্ড হেভিওয়েট টাইটেল জিতে রেকর্ড গড়লেন।

বক্সিং এর এই সর্বোচ্চ টাইটেল জেতার পরপরই মোহাম্মদ আলী মুসলমান হন। এ সময় তিনি ঘোষনা দেন তিনি Nation of Muslim [একটি কৃষ্ণাঙ্গ ইসলামি গোত্র] গোত্রের সদস্য। তারপর তার বহুল খ্যাত ক্লেসিয়াস ক্লে নাম বদলিয়ে মোহাম্মদ আলী রাখেন।

“Cassius Clay is a name that white people gave to my slave master. Now that I am free, that I don’t belong anymore to anyone, that I’m not a slave anymore, I gave back their white name, and I chose a beautiful African one.” – Muhammad Ali

এজন্য ব্যাপক সমালোচিত হন দেশ ও দেশের বাইরের ভক্তদের কাছে। মোহাম্মদ আলী পরবর্তী সময়ে প্রায়শই সাক্ষাৎকারে ধর্ম টেনে আনতেন, ধর্মের প্রতি অনুরাগ ফুটে ওঠে সেসব সাক্ষাৎকারে।

১৯৬৭ সাল পর্যন্ত টানা ২৯ ম্যাচে জয়ের ধারা অব্যাহত রাখেন আলী। তারপরই অনাকাঙ্খিতভাবে ছেদ পড়ে তার ক্যারিয়ারে।
তখন চলছিল ঐতিহাসিক ভিয়েতনাম যুদ্ধ; ইউএস আর্মিরর পক্ষ থেকে তাকে যুদ্ধে যোগ দেয়ার আহ্বান জানান হয়। কিন্তু মানবতা, বিবেকবোধ থেকে মোহাম্মদ আলী এ প্রস্তাবে অসম্মত হন,

I ain’t got no quarrel with those Vietcong.

যার ফল দাড়ায় ভয়াবহ; এজন্য তার বক্সিং লাইসেন্স কেড়ে নেয়া হয়, হেভিওয়েট টাইটেল এর স্বীকৃতি ফিরিয়ে নেয় ইউএস অথোরিটি। তাকে ৫ বছরের জন্য কারাদণ্ড দেয়া হয়। আপীল করার মাধ্যমে ৩ বছরের মাথায় এ কারাদণ্ড মউকুফ হয়। ফলে জেলে যেতে হয় নি তাকে; কিন্তু বক্সিং ক্যারিয়ারে ৩ বছরের ছেদ পড়ে যায়।

আগের মত ক্ষুরধার ক্ষিপ্র আলী হয়ত তখন হয়ত আর ছিল না। তারপরও ৪৩ মাস পর বক্সিং রিং এ ফিরে এসেই জেরী’কে ৩ রাউন্ডে হারিয়ে চমকে দেন আলী। এরপরই ১৯৭১ এ ওয়ার্ল্ড হেভিওয়েট টাইটেল এর জন্য ফ্রেজিয়ার এর সাথে লড়েন।

যেই লড়াইটাকে হলা হয়, “ফাইট অফ দ্য সেঞ্চুরি “। এবং এই লড়াইতেই প্রথমবারের মত কোন প্রফেশনাল খেলায় মোহাম্মদ আলী পরাজিত হন। অবশ্য পরবর্তীতে এই ম্যাচের নক-আউট ডিসিশনটা বিতর্কিত সিদ্ধান্ত বলে বিবেচিত হয়।

ঐ হারের মধ্য দিয়েই হয়ত প্রবল সম্ভাবনাময় মোহাম্মদ আলী’র ইতি ঘটতে পারত। কিন্তু ইনি যে মোহাম্মদ আলী, এত সহজে হার মানতে পারেন না তিনি।
৩০ বছরের ভারী শরীর নিয়ে আবার অনুশীলন শুরু করলেন আলী; শুরু করলেন আবার ফিরে আসার অনুশীলন, কিংবদন্তী হওয়ার জন্য অনুশীলন।

‘I hated every minute of training, but I said, ‘Don’t quit. Suffer now and live the rest of your life as a champion.’ – Muhammad Ali

১৯৭৪ এ দুবছর বাদে ফিরে এসেই ফ্রেজিয়ার কে হারিয়ে প্রতিশোধ তোলেন। ঐ বছরই হেভিওয়েট টাইটেল হোল্ডার ফোরমেন’কে চ্যালেঞ্জ করেন এবং তার সাথে হেভিওয়েট টাইটেল এর জন্য লড়াইয়ে নামেন। সে ম্যাচে খুব কম মানুষই এই বুড়ো আলী’র ওপর বাজি ধরেছিল, কিন্তু আলী সবাইকে অবাক করে দিয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করেন, ওয়ার্ল্ড হেভিওয়েট টাইটেল পুনরুদ্ধার করেন।

১৯৭৮ এ এসে আলী আবারও তার টাইটেল হারান নতুন মুখ লিও স্পিংস এর কাছে। টাইটেল পুনরুদ্ধারের জন্য ৭ মাস পর আলী আবারও চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেন স্পিংস এর প্রতি।

“He who is not courageous enough to take risks will accomplish nothing in life.” – Muhammad Ali

চ্যালেঞ্জ ম্যাচে আবারও টাইটেল ফিরিয়ে আনেন আলী। এবং প্রথম বক্সার হিসেবে ৩ বার ওয়ার্ল্ড হেভিওয়েট টাইটেল জয়ের গৌরভ লাভ করেন।

১৯৮১ তে ৩৯ বছর বয়সে অবসরে যান আলী। ততদিনে এ কিংবদন্তী’র রেকর্ড এর ঝুলি ফুলে ফেঁপে একাকার। ক্যারিয়ার শেষে তিনি ৫৬ ম্যাচ খেলে মাত্র ৫ টি ম্যাচে হারেন, এবং ৩৭ টি ম্যাচেই প্রতিপক্ষকে নক-আউট করেন।

১৯৮৪ তে তার পারকিনসন ডিজেস ধরা পড়ে। তারপরও থেমে থাকেননি তিনি। শান্তিদূত হিসেবে আফগানিস্তান, ইরাকে যান তিনি; সাদ্দাম হোসেনের সাথে সরাসরি বন্দী বিনিময় এর প্রস্তাব পেশ করেন। আলী যেরকম ইসলাম এর বিষবাস্প জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন; তেমনি একই ভাবে ইসলামের নামে যেকোন হুমকি/অপবাদের কঠোর জবাব দিতেন আলী। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের রিপাবলিকান পার্টির মনোনয়ন প্রত্যাশী ডোনাল্ড ট্রাম্পের মুসলিম বিদ্বেষী বক্তব্যের কঠোর সমালোচনা করেন আলী।

তিনি বাংলাদেশেও এসেছিলেন; ১৯৭৮ সালে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের নিমন্ত্রণে তিনি এদেশ ঘুরে যান। মূলত স্পিঙ্কস এর সাথে হারের পরপরই বাংলাদেশ সফরে আসেন আলী। বাংলাদেশ সফরে তিনি সুন্দরবন, সিলেট, রাঙ্গামাটি, কক্সবাজার ঘুরে বাংলাদেশের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হন। স্বতঃস্ফূর্তভাবে উচ্চারিত হয় তার কন্ঠে,

স্বর্গে যেতে চাইলে বাংলাদেশে আসুন”

1465159983

 

ঢাকায় ১২ বছর বয়সী বালক- গিয়াসউদ্দিনের সঙ্গে তিনি প্রীতি বক্সিং ম্যাচে অংশ নিয়েছিলেন। ওয়ার্ল্ড হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়ন সেই বালকের কাছে নক-আউট হন। হাসতে হাসতেই আলী বরণ করে নেন সেই বালককে।

যাওয়ার সময়ে আলী’কে সম্মাননা হিসেবে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদান করেছিলেন জিয়াউর রহমান। কৃতজ্ঞকন্ঠে আলী,

“যদি যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমাকে বের করেও দেওয়া হয়, আমার আরেক ঘর আছে।”

সম্প্রতি পুনঃপ্রকাশিত ১৯৭৮ সালে রেগিন্যাল্ড ম্যাসে’র বানানো এক দুর্লভ ডকুমেন্টারি থেকে বাংলাদেশ সফরের তথ্য পাওয়া যায়: ‘Muhammad Ali Goes East: Bangladesh’ I Love You’

৩২ বছর পারকিনসন ডিজেসের সাথে লড়াইয়ের পর গত ৩ জুন হার মানেন কিংবদন্তী মোহাম্মদ আলী। ১৯৪২ সালের ১৭ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের কেন্টাকির লুইসভিলে’তে জন্মানো আলী’র শেষ ঠিকানাও হয় সেই লুইসভিলে’তেই। গত ১১ জুন তার জন্মস্থানে তাকে সমাহিত করা হয়।

স্পোর্টস ইলাস্ট্রেটেড তাঁকে “শতাব্দীর সেরা খেলোয়াড়” ও বিবিসি তাঁকে “শতাব্দীর সেরা ক্রীড়াব্যক্তিত্ব” হিসেবে সম্মানিত করেছে।

Mystry of being – ‘THE GREATEST’:

মোহাম্মদ আলী’র – দ্য গ্রেটেস্ট হয়ে ওঠা কিন্তু বেশ রহস্যময়। বক্সিং এর ব্যাকরণের কিছুই অনুসরণ করতেন না তিনি। তিনি ঘুসি এড়ানোর জন্য কখনই মুখের সামনে হাত তুলতেন না, কিংবা প্রতিপক্ষের হাত সরিয়ে দিতেন না। বরং অসাধারন ক্ষিপ্রতার সাথে মুখ সরিয়ে নিতেন। তার বডি শেপ, স্টাইল কিছুই বক্সিং এর সাথে মানানসই নয়। ড. ডেক এর মুখেই শোনা যাক,

“Muhammad Ali was not a natural. He had great speed but he didn’t have the physique of a great fighter, he didn’t have the strength, and he didn’t have the classical moves. In fact, he boxed all wrong. He didn’t block punches with his arms and elbows. He punched in rallies like an amateur. He kept his jaw exposed. He pulled back his torso to evade the impact of oncoming punches, which Jose Torres [former colleague of Ali] said was ‘like someone in the middle of a train tack trying to avoid being hit by an oncoming train, not by moving to one or the other side of the track, but by running backwards.’” – Dr. Dweck

বক্সিং জগতে একটা টার্ম আছে – “Tales of the tape“; এর দ্বারা একজন বক্সারের বেশ কিছু শারীরিক পরীক্ষা, শারীরিক গঠন ও ভঙ্গিমা বিবেচনা করে তার সম্পর্কে, তার ক্যারিয়ার সম্পর্কে আন্দাজ করা হয়। এর দ্বারাই নির্ণয় করা যায়, বক্সিং রিং এ কে ডমিনেট করবে। মূলত জুয়াড়ি’রা এর উপর ভিত্তি করেই বাজি ধরত।

মজার ব্যাপার হল, এই “Tales of the tape” প্রক্রিয়ার প্রায় সবগুলোতেই ফেল করেন মোহাম্মদ আলী। অর্থাৎ তার ক্যারিয়ার, বক্সিং দক্ষতা নিয়ে কোনই আশার বাণী শোনাতে পারেন নি বোর্ড। বক্সিং জগতে অযোগ্য হিসেবে বিবেচিত হয় মোহাম্মদ আলী।

তাহলে আলী’র -‘দ্য গ্রেটেস্ট’ হওয়ার পেছনে রহস্য’টা কি?

অনেকে বলেন আলী’র ক্ষিপ্রতা, অনেকে বলেন আলী’র ক্ষুরধার বুদ্ধিমত্তা…অনেকে বলেন আরাধ্য Chi Energy’র কথা… কে জানে?

হয়ত কিংবদন্তী – খেলোয়াড়ঃ মোহাম্মদ আলী’র এ উক্তিতেই লুকিয়ে আছে ‘দ্য গ্রেটেস্ট’ হওয়ার রহস্য……

Float like a butterfly,
Sting like a bee,
Your hands can’t hit what your eyes can’t see.