আগের পর্বে আমরা শিখেছি, যে ডিপ্রেশন এবং বিষণ্ণতা এক নয়। কিন্তু তার পরও প্রশ্ন থেকে যায় যে কীভাবে আমরা বুঝবো একজন ব্যক্তি ডিপ্রেসড কি না? আমরা এই পর্বে ডিপ্রেশন শনাক্ত করতে চেষ্টা করবো। শুরুতেই আমরা পাঠ্যবই-এর মত এর লক্ষণগুলো দেখে নিই। ভয় পাওয়ার কিছু নেই, কারণ পরে এগুলো আমি যথাসম্ভব ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করবো!
- সে দীর্ঘ সময় ধরে ডিপ্রেসড মুডে থাকবে। সহজেই রেগে যাবে কিংবা বিরক্ত হবে।
- সে একসময় যা করে অনেক আনন্দ পেত, তা আর তার কাছে মজার মনে হবে না।
- ওজন (weight)-এ পরিবর্তন আসবে। রুচি বদলে যাবে।
- ঘুমের অভ্যাসে পরিবর্তন আসবে। হয় সে ঘুমাতে পারবে না কিংবা সারাদিন ঘুমিয়ে কাটাবে।
- দিনরাত নিজেকে ক্লান্ত মনে হবে।
- অপরাধবোধ এবং “কিছু পারি না” অনুভূতি লেগে থাকবে।
- সবসময় অস্থিরতায় ভুগবে।
- চিন্তা করতে সমস্যা হবে। ফোকাস ঠিক থাকবে না, কোনো কিছুতে মনোযোগ বসবে না, সিদ্ধান্ত নিতে সমস্যা হবে, সৃজনশীলতা লোপ পাবে।
- আত্মহত্যা কিংবা self-harm-এর চিন্তা বেড়ে যাবে।
এখন সমস্যা হল এদের বেশিরভাগ লক্ষণই আবার অন্যান্য বিভিন্ন শারীরিক কিংবা মানসিক সমস্যার সাথে সম্পর্কিত। তাহলে বুঝবো কেমনে এটা আসলেই ডিপ্রেশন কি না? এর জন্য কয়েকটি প্রশ্ন করে দেখা যেতে পারে। [ অবশ্যই ভিক্টিমকে না। প্রশ্ন করতে হবে নিজেকে। ভিক্টিমের সাথে পরোক্ষভাবে কথা বলে উত্তরগুলো খুঁজে নিতে হবে। ]
(১) সে কি তার প্রিয় জিনিসগুলো উপভোগ করতে পারছে?
হয়তো তার বই পড়তে অনেক ভাল লাগতো। কিংবা প্রোগ্রামিং করে সে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দিত। সে যদি বিষণ্ণতায় ভোগে, তার এগুলো চালিয়ে যেতে সমস্যা হবে না। হয়তো তার বই পড়তে একটু কষ্ট হবে, কিন্তু সে ঠিকই নিজেকে মানিয়ে নিবে।
অপরদিকে ডিপ্রেশনে আক্রান্ত হলে সব ধরণের আগ্রহ হারিয়ে যাবে। সে মাসের পর মাস প্রোগ্রামিং বন্ধ রাখবে। সে বইয়ের দিকে তাকিয়ে থাকবে, পড়তে পারবে না। এমন যদি হয়ে থাকে যে, ভাল না লাগাকে পাশ কাটিয়ে সে তার প্রিয় কাজগুলোতে মন দিতে পারছে না, তাহলে সেটি ডিপ্রেশন।
(২) তাকে দেখে কি সবসময় বলতে ইচ্ছে হয় “তোমাকে দেখতে এত ক্লান্ত দেখাচ্ছে কেন?”
ডিপ্রেশনে ভোগা মানুষগুলো এক ধরণের দুষ্টচক্রের মধ্যে পড়ে যায়। তাদের অনেক কিছু করে ফেলতে ইচ্ছে করে। কিন্তু প্রচণ্ড ক্লান্তির (মানসিক) কারণে তারা কিছুই করতে পারে না। এই কিছু করতে না পারার কারণে তাদের ডিপ্রেশন আরও বাড়ে। এই বেড়ে যাওয়া ডিপ্রেশন আবার ক্লান্তি বাড়ায়। এভাবে চলতেই থাকে।
(৩) তার আবেগ কি কোনো নির্দিষ্ট ঘটনার সাথে সম্পর্কিত?
বিষণ্ণতা বা মন খারাপের ব্যাপারগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রে কোনো সুনির্দিষ্ট ঘটনা দ্বারা প্রভাবিত হয় – মায়ের বকা খাওয়া, রেজাল্ট খারাপ করা কিংবা কারো সাথে ঝগড়া। সেই মন খারাপ হয় খুবই স্বল্পস্থায়ী। অন্যদিকে ডিপ্রেশনের ক্ষেত্রে অধিকাংশ ক্ষেত্রে কোনো কারণ লাগে না। হয়তো দেখা যায় সে অনেক হাসিখুশি, হঠাত করে আকাশ থেকেই যেন ডিপ্রেশন নেমে আসে।
কিংবা যদি কোনো নির্দিষ্ট কারণে যদি ডিপ্রেশন প্রভাবিত হয়েও থাকে, শীঘ্রই সেটা প্রাথমিক কারণগুলো পাশ কাটিয়ে “জীবন দর্শন”-সম্পর্কিত হয়ে যায়। এক্ষেত্রে ডিপ্রেশনটা একটা কারণ থেকে শুরু হয়, যেটাকে আমরা সোর্স রিজন বলবো। এমন কিছু যেটা খুব ছোটও হতে পারে আবার বিশাল বড় কিছুও হতে পারে। এমন কিছু যেটা মানুষটার সকল বিলিফ সিস্টেম এর ভিত্তিপ্রস্তর নাড়িয়ে দেয়। সে ছোটবেলা থেকে যা জানতো, যে সকল জিনিস তার মানসিকতাটাকে কন্ডিশন করে, সে সবগুলোর প্রতি কিছুটা অবিশ্বাস, অনেকটা সন্দেহ আর প্রচুর প্রশ্ন তৈরি করে দেয়। আর আমাদের ভেতরের রিফ্লেক্স সিস্টেম চেষ্টা করে সেই অবিশ্বাস গুলো কে দূর করতে। তৈরি হয় দ্বন্দ, তৈরি হয় নিজের ভেতরেই একটাটা ক্রাইসিস, গৃহযুদ্ধ। আল্টিমেটলি এভাবে মানুষটা ডিপ্রেশন এর পরতে পরতে হারিয়ে যায়।
ডিপ্রেশন এর কারণে মানুষ অনেক কর্মক্ষমতা হারায় ফেলে। সেজন্যে আরো অনেক ভুল হয়,ব্যর্থতা আসে। সেগুলোই একসময় হয়ে যায় ট্রিগারিং রিজন, বা সেকেন্ড লেভেল রিজন। সে দিনের পর দিন কাটিয়ে দিতে থাকে, কিন্তু তার ডিপ্রেশন সেই আগের মতই থেকে যাবে। “মন খারাপ কেন?”-এটার উত্তর সে দিতে পারবে না। কারণ উত্তর তার নিজেরই জানা নেই।
(৪) খাওয়া-দাওয়া এবং ঘুমের সমস্যা
ডিপ্রেশনের সাথে খাওয়া-দাওয়া এবং ঘুমের সমস্যা জড়িত। ঘুমের সমস্যাটা দুই ধরণের – কেউ হয়তো একেবারে ঘুমাতেই পারে না, রাতের পর রাত জাগতে থাকে (Insomnia)। আরেক পক্ষ আবার সারা দিন ঘুমিয়ে কাটিয়ে দেয়, বিছানা থেকে উঠতেই চায় না। কিংবা দেখা যায় সে কয়েকদিন একেবারেই ঘুমালো না, আবার কয়েক দিন দিনরাত ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিল। হতে পারে সে স্বাভাবিক সময়েই ঘুমোচ্ছে, কিন্তু ঘুমগুলো হয়ে যায় ভীষণ পাতলা কিংবা গাঢ়। ঘুমের মাঝে ভয়ংকর সব দুঃস্বপ্ন দেখা এর আরেকটি লক্ষণ।
খাওয়া-দাওয়ার রুচি একেবারেই চলে যায়। “জীবনেরই যেখানে কোনো অর্থ নেই, সেখানে খাওয়া-দাওয়া করে কী হবে? ” আবার অনেকের ক্ষেত্রে “Over eating”-এর সমস্যাও দেখা দেয়।
(৫) নিজের প্রতি ঘৃণা
ডিপ্রেসড মানুষদের সবচেয়ে বড় সমালোচক হয়ে ওঠে এরা নিজেরা। আমার মতে ডিপ্রেশনের সবচেয়ে ক্ষতিকর দিক হল নিজের প্রতি ঘৃণা। তারা সব কিছুতে নিজের ভুল খুঁজতে শুরু করে। তাদের কাছে মনে হয় “আমার মত খারাপ মানুষ দুনিয়ায় আর নাই। আমি অন্ধকার তলিয়ে গেছি। আমার আসল রূপ দেখলে সবাই আমাকে ঘৃণা করবে।” নিজের প্রতি সব আত্মবিশ্বাস হারিয়ে যায়, সবকিছুতে নেগেটেভিটি দেখতে শুরু করে। “আমি কিছু পারি না”, “পুরো জীবনটা এভাবেই নষ্ট করে গেলাম” – এ ধরণের অপরাধবোধগুলো তাকে ডিপ্রেশনের সাগরে আরও তলিয়ে দেয়। যদি এমন হয়ে থাকে যে, কোনো একজন প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসী, আশাবাদী মানুষ হঠাত করে সব আত্মবিশ্বাস হারিয়ে বসে আছে, তাহলে বুঝে নিবেন যে সে ডিপ্রেশনে ভুগছে।
Self-loathing লক্ষণটি দেখা দিলে মানসিক সাহায্য নেওয়া আবশ্যিক!
(৬) নিজের ক্ষতি করা
বিষণ্ণতার ক্ষেত্রে এই জিনিসটা একেবারেই দেখা যায় না। কিন্তু ডিপ্রেশনের ক্ষেত্রে এটি খুবই সাধারণ। যখন ব্যক্তি ডিপ্রেসড থাকে, তখন তার মাথায় ক্রমাগত আত্মহত্যা কিংবা মৃত্যুর চিন্তা চলতে থাকে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ডিপ্রেসড দশা কাটিয়ে উঠলে সে এগুলো নিজের চিন্তা বলে মেনেই নিতে পারে না। “বেঁচে থেকে কী হবে?”, “এখন হঠাত যদি আমি নিচে পড়ে যাই, তাহলে কেমন হবে?”, “এইসব পড়ালেখা কেন করতিছি? কোনো অর্থ তো নেই” – একজন ডিপ্রেসড ব্যক্তি এই কথাগুলো বলবে, সেটা মোটামুটি ধরেই নেওয়া যায়।
(৭) অল্পতে রেগে যাওয়া কিংবা বিরক্ত হওয়া
অধিকাংশ ক্ষেত্রে ডিপ্রেসড মানুষগুলো মনের মধ্যে কী চলছে, সেটা নিজের মধ্যেই লুকিয়ে রাখে। তাই তাদের ক্ষেত্রে অনেক সময় সাধারণ ঘটনাতেই রাগ উঠে যায়।
তবে সবচেয়ে ভাল হয় যদি এসব ক্ষেত্রে একজন (যোগ্য) মনোবিজ্ঞানীর সাহায্য নেওয়া হয়। আর এমন ভাবার কোনো কারণ নেই যে, ডিপ্রেসড মানুষগুলা মানসিকভাবে অনেক বেশী দুর্বল। বরং আমার মনে হয় এরাই মানসিকভাবে সবচেয়ে বেশী শক্তিশালী! <3
that means i’m depressed 🙁
May be! Have you considered consulting a specialist? 🙂
No 🙁 ;(
ভাল লেখা ছিল, এরকম আরও কিছু দিও।
y