জয়তুর আজকের লেখাটা মহাবিশ্বের উদ্ভব ও পরিণতি বিষয়ে মৌলিক গবেষণার জন্য বিশেষভাবে খ্যাত ড. জামাল নজরুল ইসলামকে নিয়ে। ড. ইসলাম মৃত্যুর আগ পর্যন্ত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রিসার্চ সেন্টার ফর ম্যাথমেটিকাল এন্ড ফিজিকাল সায়েন্সের এর গবেষক এবং চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এর একজন সিন্ডিকেট সদস্য ছিলেন।

তিনি ১৯৩৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের যশোর জেলার ঝিনাইদহ শহরে জন্মগ্রহণ করেন।পাকিস্তানের মারীরলরেন্স কলেজ থেকে তিনি সিনিয়র কেমব্রিজ (ও লেভেল) এবং হায়ার সিনিয়র কেমব্রিজ (এ লেভেল) পাস করেন। এরপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে বিএসসি অনার্স করে কেমব্রিজের ট্রিনিটি কলেজে আবারও গ্রাজুয়েট করেন। ১৯৬৪ সালে এখান থেকেই প্রায়োগিক গণিত ও তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর ১৯৮২ সালে ড. ইসলাম অর্জন করেন অত্যন্ত দুর্লভ ও সম্মানজনক ডক্টর অব সায়েন্স বা ডিএসসি ডিগ্রি। ছাত্রজীবনে তাঁর সহপাঠী ছিলেন ভারতের বিখ্যাত জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞানী জয়ন্ত নারলিকা যিনি ফ্রেডরিক হয়েলের সাথে “হয়েল নারলিকা তত্ত্বের” উন্নতি করেছিলেন।।আরেকজন সহপাঠী ছিলেন ব্রায়ান জোসেফসন, যে তার পিএইচ ডি থিসিসের জন্য মাত্র ৩৩ বছর বয়সে, ১৯৭৩ সালে, পদার্থবিদ্যায় নোবেল পুরস্কার পায়। পরবর্তীতে কর্মক্ষেত্রে তার বন্ধু তালিকায় যুক্ত হয়েছিলেন নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং, আব্দুস সালাম এবং রিচার্ড ফাইনমেন এর মত বিজ্ঞানীরা।

১৯৬৩ থেকে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত ইসলাম যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অফ মেরিল্যান্ডে পোস্ট ডক্টরাল ফেলো হিসেবে কর্মরত ছিলেন। কর্মজীবনে এছাড়াও তিনি কেমব্রিজের ইনস্টিটিউট অফ থিওরেটিক্যাল অ্যাস্ট্রোনমি-তে (বর্তমানে ইনস্টিটিউট অফ অ্যাস্ট্রোনমি),ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি,ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয় লন্ডনের কিংস কলেজ ইউনিভার্সিটি কলেজ, কার্ডিফ (বর্তমানে কার্ডিফ বিশ্ববিদ্যালয়) ,সিটি ইউনিভার্সিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করেন। কিন্তু ১৯৮৪ সালে তিনি যুক্ত্ররাস্ট্র ও যুক্তঅরাজ্যের খ্যাতনামা প্রতিষ্ঠানের লক্ষ টাকা বেতনের লোভনীয় চাকরি, গবেষণার অফুরন্ত সুযোগ, আর নিশ্চিত নিপাট জীবন সব ছেড়ে ছুড়ে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বিশ্ববিধ্যালয়ে তিন হাজার টাকার প্রফেসর পদে এসে যোগ দিলেন।তিনি নিজেই একটি সাক্ষাৎকারে বলেছেন,

“স্থায়ীভাবে বিদেশে থাকার চিন্তা আমার কখনোই ছিল না। দেশে ফিরে আসার চিন্তাটা প্রথম থেকেই আমার মধ্যে ছিল, এটার ভিন্নতা ঘটে নি কখনোই। আরেকটা দিক হল, বিদেশে আপনি যতই ভালো থাকুন না কেন, নিজের দেশে নিজের মানুষের মধ্যে আপনার যে গ্রহণযোগ্যতা এবং অবস্থান সেটা বিদেশে কখনোই সম্ভব না।”

দেশে ফিরে এসে জামাল নজরুল ইসলাম গড়ে তুলেছেন রিচার্স সেন্টার ফর ম্যাথমেটিক্যাল অ্যান্ড ফিজিক্যাল সায়েন্স (আরসিএমপিএস)যার মূল লক্ষ্য হল মৌলিক বিজ্ঞান চর্চার জন্য বাংলাদেশের আগামী প্রজন্মকে উদ্বুদ্ধ করা।এই সংস্থাটির আয়োজনে বেশ কিছু আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন সেমিনার-সিম্পোজিয়ামঅনুষ্টিত হয়েছে , যেখানে বেশ কয়েকজন নোবেলবিজয়ী বিজ্ঞানীসহ বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানীরা এসেছেন।
ড. ইসলাম পঞ্চাশটিরও বেশি গবেষণাপত্র এবং বই লিখে গেছেন যার অধিকাংশই প্রকাশিত হয়েছে বিশ্ববিখ্যাত জার্নালসমূহে। এরমধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে কেমব্রিজ প্রেস থেকে প্রকাশিত “দ্য আল্টিমেট ফেইট অব দ্য ইউনিভার্স”। ১৯৮৩ সালে বইটি প্রকাশ হওয়ার পর থেকে বিশ্বের বিজ্ঞানী মহলে হৈ চৈ পড়ে যায়। মহাবিশ্বের শেশ পরিণতি কি হতে পাঁড়ে তার ওপর লেখা এই বইটি ফরাসি, ইতালীয়, জার্মান, পর্তুগিজ, সার্বোক্রোয়েট সহ পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত।দ্বিতীয় বই “রোটেটিং ফিল্ডস ইন জেনারেল রিলেটিভিটি প্রকাশিত হয় কেমব্রিজ প্রেস থেকে ১৯৮৫ সালে। এছাড়াও তার উল্লেখযোগ্য প্রকাশনাগুলোর মধ্যে রয়েছে “অ্যান ইন্ট্রোডাকশন টুম্যাথমেটিক্যাল কসমোলজি (১৯৯২)” এবং “ক্লাসিকাল জেনারেল রিলেটিভিটি”। তার লেখা বইগুলো কেমব্রিজ, অক্সফোর্ড, প্রিন্সটন, হার্ভার্ডের মতো বিশ্বের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্য।

বিশ্বখ্যাত এই পদার্থবিজ্ঞানী ২০০১ সালে তিনি একুশে পদক লাভ করেন।১৯৯৮ সালে ইতালির আবদুস সালাম সেন্টার ফর থিওরিটিকাল ফিজিক্সে থার্ড ওয়ার্ল্ড একাডেমী অফ সায়েন্স অনুষ্ঠানে তাঁকে মেডাল লেকচার পদক দেয়া হয়.এছাড়াও তিনি ন্যাশনাল সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি মেডেল(১৯৯৪),বাংলাদেশ বিজ্ঞান একাডেমী স্বর্ণপদক(১৯৮৫),কাজী মাহবুবুল্লাহ এন্ড জেবুন্নেছা পদক (২০০০)ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এর রাজ্জাক-শামসুন আজীবন সম্মাননা পদক (২০১১) লাভ করেন।

অধ্যাপক ইসলামের গবেষণার ক্ষেত্র ছিল বিশাল। যার মধ্যে রয়েছে তাত্ত্বিক কণা, কোয়ান্টাম ক্ষেত্র তত্ত্ব, মহাকর্ষ তত্ত্ব, আপেক্ষিকতার তত্ত্ব, আইনষ্টাইন ম্যাক্সওয়েল সূত্র, নক্ষত্রের গঠন, মহাবিশ্ব তত্ত্ব অন্যতম। বিজ্ঞানচর্চার বাইরে দেশের ও আন্তর্জাতিক সমাজ-রাজনীতি-অর্থনীতি নিয়েও তাঁর নিজস্ব চিন্তাভাবনা ও মূল্যায়ন ছিল।মাতৃভাষায় বিজ্ঞানচর্চায় তিনি তরুণদের উদ্বুদ্ধ করে গেছেন সবসময়।নির্মোহ ও গুণী এই বিজ্ঞানী ১৬ মার্চ ২০১৩ সালে চট্টগ্রামে ৭৪ বছর বয়সে মারা যান।আমরা মৌলিক বিজ্ঞানচর্চায় নিবেদিতপ্রাণ এই বিজ্ঞানীকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি।

জয়তু অধ্যাপক জামাল নজরুল ইসলাম।