জয়তু সিরিজটা তাদের নিয়ে, যাদের গল্প,কবিতা,গানের প্রভাব আমার উপর অনেক বেশি। প্রথম পর্ব সত্যজিৎ রায় নিয়ে।জয়তু-১

খুব ছোটবেলায় বই পড়া শুরুই আমার সত্যজিৎ রায় দিয়ে। সম্ভবত প্রথম পড়া বই “সুজন হরবোলা”. সত্যজিৎ রায় লিখতে শুরুই করেছিলেন চল্লিশ বছর বয়সে। এই বয়সের একজনের কলম দিয়ে কি করে ফটিকিচাঁদ কিংবা সুজন হরবোলার মত লেখা বের হত ,তখন খুব অবাক লাগত। আমার ধারণা ছিল লেখাগুলো আমার বয়সী কেউ লেখে যার সত্যিই গাছের ডালে উঠে পাখি খুঁজে বের করতে ইচ্ছে করে কিংবা ওই দূর পাহাড়টার গুহায় থাকা নাম না জানা দৈত্যটাকে দেখে আসতে ইচ্ছে করে। একটু বড় হয়ে ফেলুদা শুরু করি। প্রতি বইমেলায় একটা করে খন্ড কিনে দিত বাবা। এরপর হাতে এল শঙ্কু সমগ্র। বাংলায় এত চমৎকার সায়েন্স ফিকশন খুব কম লেখককেই লিখতে দেখেছি। মনে পড়ে ছোটবেলায় “ভূতো” পড়ে খুব ভয় পেয়েছিলাম। ভূতের গল্প লেখা ছাড়াও যে ভয় দেখানো যায় সত্যজিৎ রায় তার উদাহরণ.এইটুকু লিখলে লেখক সত্যজিৎ রায়কে হয়তো কিছুটা চেনা যায়। কিন্তু সত্যজিৎ রায়ের সবচাইতে বড় পরিচয় তিনি চলচ্চিত্র নির্মাতা.মজার ব্যাপার হচ্ছে সত্যজিৎ রায়ের সিনেমার সাথে আমার পরিচয়ও তাঁরই লেখা থেকে। “অপুর সঙ্গে আড়াই বছর” নামে একটা স্মৃতিচারণমূলক লেখায় প্রথম পড়ি পথের পাঁচালী সিনেমা তৈরির গল্প। পথের পাঁচালীর অপু দুর্গার প্রথম ট্রেন দেখা -সাদা কাঁশফুলের পাশে কয়লার ট্রেনের কালো ধোঁয়া উড়িয়ে এঁকেবেঁকে চলে যাওয়ার সেই বিখ্যাত দৃশ্য নিশ্চয়ই সবার মনে আছে। কিন্তু সেই এক কয়লা ট্রেনের কয়েক সেকেন্ডের দৃশ্য ধারণ করতে অপেক্ষা করতে হয়েছিল প্রায় এক বছর। “অপুর সঙ্গে আড়াই বছর ” লেখা থেকে পাওয়া যাচ্ছে সেই গল্প –

“শুটিংয়ের একেবারেই শুরুতেই হল গোলমাল। …রেললাইনের পাশে কাশফুলে ভরা মাঠ। অপুদুর্গার প্রথম ট্রেন দেখার দৃশ্য তোলা হবে। অপু দুর্গার মন কষাকষি চলছে। দিদির পিছনে ধাওয়া করে অপু গ্রাম থেকে বেরিয়ে এসে পৌঁছেছে কাশবনে। সকাল থেকে থেকে শুরু করে বিকেল অব্দি কাজ করে প্রায় অর্ধেক দৃশ্য তোলা হল। প্রথম দিনের কাজ শেষ করে দিন সাতেক পর আবার একই জায়গায় ফিরে গিয়ে মনে হল -এ কোথায় এলাম? কোথায় গেল সব কাশ?স্থানীয় লোকের কাছ থেকে জানা গেল কাশফুল নাকি গরুর খাদ্য। এই সাতদিনে সব কাশ খেয়ে গেছে তারা। …এ দৃশ্যের পরের অংশ তোলা হয়েছিল পরের বছর শরৎকালে যখন আবার নতুন কাশে মাঠ ভরে গেছে। “

এখনকার মত উন্নত প্রযুক্তির অভাবে দেখতে তুলনামূলক সহজ দৃশ্যগুলোও ধারণ করতে সময় লাগত অনেক বেশি। তবু তিনি সত্যজিৎ রায়, সিনেমার খুঁটিনাটি প্রতিটা দৃশ্যে তিনি সফল। আচ্ছা পথের পাঁচালী ছবি দেখার সময় কেউ ধরতে পেরেছিলেন কি দুর্গাদের বাড়ি থেকে যে চিনিবাস ময়রা পেছন ফিরে বের হয়ে গেলেন আর মুখুজ্যেদের বাড়িতে যিনি ঢুকলেন তিনি একই লোক নন?! প্রথম চিনিবাস ময়রা আড়াই বছর ব্যাপী শুটিং এর মাঝেই মৃত্যুবরণ করেছিলেন। সত্যজিৎ রায়ের অসাধারণ সিনেমাটোগ্রাফি এই ত্রুটি উতরে গিয়েছিল। টেকনোলজি কিংবা বাজেটের ঘাটতি কোনটাই আটকাতে পারেনি এই অসাধারণ নির্মাতাকে। ঝুম বৃষ্টির মাঝে অপু দুর্গার গাছতলায় দাঁড়িয়ে কাপতে কাপতে বলা সেই ছড়াটার কথা মনে আছে? “নেবুর পাতায় করম চা,যা বৃষ্টি ঝড়ে যা” শরৎকালের সেই বৃষ্টির দৃশ্য তোলাটা খুব একটা সহজসাধ্য ছিল না।

ও আচ্ছা সত্যজিৎ রায়ের আরেকটা পরিচয় হচ্ছে তিনি একজন সফল অনুবাদক। রে ব্র্যাডবেরির মত লেখকের লেখার সুন্দর অনুবাদ করে গেছেন তিনি। ঠিক আক্ষরিক অনুবাদ নয়.মূল গল্পের অনুসরণে লেখা। ফেলুদা,শঙ্কু,ফটিক কিংবা চলচ্চিত্র -গোয়েন্দা উপন্যাস থেকে ছোটগল্প একজন লেখক কি করে এত ভার্সেটাইল জিনিয়াস হতে পারেন তা ভেবে অবাক হতে হয়। আরেকটা পর্বে ফেলুদার গল্প লিখব।

শ্রদ্ধা রইল এই মহান লেখক ও চলচ্চিত্রস্রষ্টার প্রতি।

জয়তু সত্যজিৎ রায়।