আলো ঝাপসা হয়ে আসার সন্ধ্যায় কচুরিপানাগুলোকে উদ্বেল করা মরা বুড়িগঙ্গার স্রোত ভেঙ্গে পড়ছে সদরঘাটে সারি করে রাখা লঞ্চের বহরে, পুরানো নগরীর উর্দু স্ট্রিটে খদ্দের না পেয়ে আলস্যের হাই তুলছেন কোনো এক মাঝারী পুঁতি ব্যবসায়ী, রিকশার ক্রিং ক্রিং আর হাজারো গাড়ির হেডলাইটে আঁধার নামছে দেড় কোটি মানুষের আশ্রয় বহুতল দালানশোভিত এক মেগাসিটিতে। কিংবা ধরা যাক, ধুলো ওড়া দৌলতদিয়া ফেরিঘাটে দেদারসে চলছে গরম গরম পরোটা আর ডিম ভাজা, মধুপুরের এক গারো বাড়ির কোণে গা এলিয়ে ঘুম পাড়তে চাইছে কালো শূকরের দল, উয়ারী গ্রামের জাদুঘরটায় দিনশেষে তালা লাগানোর প্রস্তুতি নিচ্ছেন সেখানকার দ্বাররক্ষী – সুবিশাল বঙ্গভূমির যে বিভাগে কারো মিলবে এ সবকিছু অবলোকন করার সুযোগ আমি সেই বিভাগ, সেই ঢাকা বিভাগ নিয়ে লিখতে বসেছি।
ছয় বিভাগের বাংলাদেশ পড়ে পড়ে বড় হয়েছি আমরা যারা তাদের জন্য হালের আট বিভাগের বাংলাদেশ খটকাই সৃষ্টি করে বটে। তবু বলে রাখতে হয়, গত ২০১৫ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর থেকে ঢাকা বিভাগ থেকে আলাদা হয়ে আত্মপ্রকাশ করেছে নতুন বিভাগ ময়মনসিংহ। নয়ত ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, জামালপুর এবং শেরপুর জেলাগুলোকেও আমাকে এই লেখার ভিতর নিয়ে আসতে হত। প্রসঙ্গত বর্তমান ঢাকা বিভাগের অধীনস্থ জেলাগুলোর নামও বলে দিতে হয় – টাঙ্গাইল, কিশোরগঞ্জ, গাজীপুর, নরসিংদী, ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, ফরিদপুর, মাদারিপুর, শরীয়তপুর, গোপালগঞ্জ ও রাজবাড়ি।
ঢাকা বিভাগের উত্তরে তাই এখন আছে ময়মনসিংহ বিভাগ, উত্তর পূর্বে সিলেট, পূর্বে চট্টগ্রাম বিভাগস্থ ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লা ও চাঁদপুর জেলা, দক্ষিণে সমগ্র বরিশাল, দক্ষিণ-পশ্চিমে খুলনার অধিকাংশ এবং পশ্চিমে রাজশাহী বিভাগ এবং খুলনার অবশিষ্টাংশ। একমাত্র রংপুরের সাথে ঢাকা বিভাগের কোনো সংযোগ নেই।
মজার ব্যাপার হল, আট বিভাগের যে দুই বিভাগে কোনো সীমান্তবর্তী জেলা নেই তাদের একটি এই ঢাকা (অপরটি বরিশাল)। আয়তনে ঢাকা বিভাগের সবচেয়ে বড় জেলা হল টাঙ্গাইল যা সবচেয়ে ছোট নারায়ণগঞ্জের প্রায় পাঁচগুণ। বাংলাদেশে বসবাসরত মানুষের এক-তৃতীয়াংশ তাদের আবাসস্থল হিসেবে বেছে নিয়েছে এই বিভাগকে।
ঢাকা বিভাগের নাম ঢাকা রাখা হয়েছে ঢাকা জেলার নামানুসারে। প্রশ্ন হল, এই ঢাকা নামটা আসল কোথা থেকে? এ ব্যাপারে একাধিক মত থাকলেও সর্বাপেক্ষা গ্রহণযোগ্য দুইটি ঘটনা এখানে বর্ণনা করাই যায়।
প্রথম ঘটনাটি এরকম – সেন রাজবংশের দ্বিতীয় রাজা বল্লাল সেন বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে প্রমোদ বিহারের সময় অদূরবর্তী জঙ্গলে দেবী দূর্গার একটি মূর্তি খুঁজে পান। শিবের একনিষ্ঠ উপাসক বল্লাল শিবপত্নী দূর্গার প্রতি শ্রদ্ধাস্বরূপ উক্ত স্থানে এক মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। মূর্তিটি ঢাকা বা গুপ্ত অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল বলে মন্দিরের নামকরণ করা হয় ঢাকেশ্বরী মন্দির এবং কালক্রমে মন্দিরটির আশেপাশের স্থান ঢাকা নামে পরিচিত হয়ে ওঠে।
দ্বিতীয় গল্পটি এমন – মুঘল শাসনামলে ১৬১০ খ্রিস্টাব্দে সুবা বাংলার (বাংলা প্রদেশ) রাজধানী হিসেবে ঢাকাকে ঘোষণা করেন মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীর। যে কোনো অঞ্চলের রাজধানীর মর্যাদা পাওয়া ঢাকার জন্য সেটাই প্রথম। এই খবরে ইসলাম খান (সুবা বাংলার প্রথম সুবাদার) আনন্দের বহিঃপ্রকাশস্বরূপ ঢাক বাজানোর নির্দেশ দেন। জনশ্রুতি বলে, এ ঘটনার ভিত্তিতেই নগরের নাম ঢাকা রূপ নেয়। অবশ্য সম্রাট জাহাঙ্গীরের প্রতি শ্রদ্ধাস্বরূপ রাজধানীকে জাহাঙ্গীরনগরও বলা হত যা জাহাঙ্গীরের পুরো জীবদ্দশায় বজায় ছিল।
ঢাকা নামকরণের গল্প করতে করতে আমি ঢাকা শহরের কথায় ডুবে গেছি তা এতক্ষণে খেয়াল করে ফেলার কথা। ঢাকা জেলার আয়তনের এক-পঞ্চমাংশ দখল করে আছে বিশালতায় বিশ্বের সতেরতম এই মেগাসিটি। বললে অত্যুক্তি হয় না – ঢাকা নগরী ঢাকা জেলা তো বটে, ঢাকা বিভাগেরই প্রাণ। সাথে সমগ্র দেশেরই নয় কি?
উত্তরে তুরাগ আর দক্ষিণে বুড়িগঙ্গার মধ্যবর্তী লম্বাটে এই ক্রমবর্ধমান আয়তক্ষেত্র ধারণ করে আছে কত মানুষ, তাদের বর্ণীল স্বপ্ন, কত না ইতিহাস! মুঘল স্থাপত্য লালবাগ কেল্লা, স্বাধীনতার ডাকে ফুঁসে ওঠা সোহরাওয়ার্দী উদ্যান (তৎকালীন রেসকোর্স ময়দান), জাতীয় জাদুঘর, সিপাহী বিদ্রোহের স্মৃতিমাখা বাহাদুর শাহ পার্ক, দেশের প্রথম উচ্চশিক্ষাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় সংসদ ভবন, সুপ্রিম কোর্ট, বাংলাদেশ ব্যাংক ভবন, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, হোম অব ক্রিকেট শেরে বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়াম, বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম, ঢাকা চিড়িয়াখানা, বোটানিক্যাল গার্ডেন, রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিধন্য বলধা গার্ডেন – সবই গর্ভস্থ এই শহরের। মহানগরের বাইরে সাভার উপজেলাস্থ জাতীয় স্মৃতিসৌধ এবং চিরসবুজ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কথাও না বললেই নয়। ঢাকা বিভাগের চারটি সিটি কর্পোরেশনের দুইটি এখানে – ঢাকা উত্তর ও ঢাকা দক্ষিণ। ঢাকা দক্ষিণই মূলত প্রধান ও প্রাচীনতার সাক্ষ্যবাহী নগরী।
ঢাকার উত্তরে ঢাকার চেয়েও বড় জেলা, যা ইতোমধ্যে অগণিত অ্যামেজমেন্ট পার্ক এবং পিকনিক রিসোর্টের জন্য নাম কুড়িয়েছে – তা হল গাজীপুর। মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে সর্বপ্রথম সশস্ত্র যে প্রতিরোধের কথা জানা যায় (১৯ মার্চ, ১৯৭১) তা সংঘটিত হয় এখানেই। মুসলিম বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম সমাবেশ বিশ্ব ইজতেমা গাজীপুরের টঙ্গী উপজেলার তুরাগ নদীর তীরে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে।
ভাওয়াল জাতীয় উদ্যান, বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্ক, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশের একমাত্র আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয় ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অফ টেকনোলজি আছে এ জেলায়। গাজীপুরে আরো রয়েছে জাতীয় পর্যায়ের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সদর দপ্তরসহ বহু সংখ্যক সরকারী, স্বায়ত্বশাসিত, বেসরকারী প্রতিষ্ঠান এবং ক্ষুদ্র/মাঝারী ও ভারী শিল্প কারখানাসহ দেশের তৈরী পোশাক শিল্পের বিরাট অংশ। গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন বাংলাদেশের বৃহত্তম সিটি কর্পোরেশন।
টাঙ্গাইল, ঢাকার বিভাগের সর্ববৃহৎ জেলা হলেও এই নাম দেড়শ বছর আগেও ব্যবহৃত হত কি না তা নিয়ে সন্দেহ আছে। ১৮৭০ সালের পূর্বে এই স্থান আতিয়া নামে পরিচিত ছিল এবং ময়মনসিংহ জেলার একটা মহকুমা হিসেবে পরিগণিত হত। টাঙ্গাইলে নিবাস ছিল রাজনীতির ময়দানে অন্যতম শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর যিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লিগের প্রতিষ্ঠাতা।
টাঙ্গাইলের দর্শনীয় স্থানের মধ্যে মধুপুর গড়, আতিয়া মসজিদ, ধনবাড়ি মসজিদ রয়েছে। টাঙ্গাইলে, বিশেষত মধুপুরে রয়েছে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর বাস, যাদের মধ্যে গারোরাই সংখ্যাপ্রধান। টাঙ্গাইলের চমচম এবং তাঁতের শাড়ীর কথাই বা কার অজানা?
বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি তৈরি করার ম্যাশিন বলা যায় যে জেলাকে তা হল কিশোরগঞ্জ। মোট তিনজন এবং পর পর দুইজন রাষ্ট্রপতি এসেছেন এই জেলা থেকে। প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান এবং বর্তমান রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ, দু’জনের জন্মই এখানে। আরো জন্মেছেন ১৯৭১ মুজিবনগর সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামও। ষষ্ঠ শতকে কৃষ্ণদাস প্রামাণিকের ছেলে নন্দকিশোর ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে একটি গঞ্জ প্রতিষ্ঠা করেন; এ গঞ্জ থেকই কালক্রমে নন্দকিশোরের গঞ্জ বা ‘কিশোরগঞ্জ’-এর উৎপত্তি হয়। এর অধিকার নিয়ে ১২শ থেকে ১৬শ শতক পর্যন্ত বিরোধ ছিল গারো, রাজবংশী, হাজং, কোচ জনগষ্ঠীর সাথে মুসলিমদের। ১৬০০ সালের আগেই কিশোরগঞ্জের অনেকাংশের দখল নিতে সক্ষম হন বারো ভূঁইয়ার প্রধান ঈসা খান এবং মুঘল সাম্রাজ্য থেকে একে বাইরে রাখেন। তার মৃত্যুর পর তার পুত্র মুসা খান এর দখল রাখলেও অবশেষে কিশোরগঞ্জ মুঘল সাম্রাজ্যভুক্তই হয়।
কিশোরগঞ্জে আদি পৈতৃক নিবাস রয়েছে সত্যজিত রায়ের, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীনও এখানকার মানুষ ছিলেন। কিশোরগঞ্জের সবচেয়ে বিখ্যাত জিনিসের একটি হল এখানকার শোলাকিয়া ঈদগাহ ময়দান যাতে বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয়।
ঢাকার পার্শ্ববর্তী (পূর্বে) অবস্থিত জেলা নরসিংদী। এর পূর্বে ব্রাহ্মণবাড়িয়া এবং দক্ষিণে নারায়ণগঞ্জ জেলা। তাঁত শিল্পকে অন্যমাত্রা দেওয়া এই জেলা স্বাদে অনন্য কলার জন্যও বিখ্যাত বটে। তবে নরসিংদীর সবচেয়ে বড় আকর্ষণ হল এর বেলাব উপজেলার উয়ারী-বটেশ্বর গ্রামে অবস্থিত প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান। ঢাকা থেকে ৭০ কিলোমিটার উত্তর পূর্বে মাটির নিচে অবস্থিত এই দূর্গ নগরী আড়াই হাজারের বছরেরও পুরনো যেখানে খননকাজ এখনো চলছে। এখানে খুঁজে পাওয়া গিয়েছে বৌদ্ধ পদ্মমন্দির যা ১৪০০ বছরের পুরনো। হারানো এই নগরীকে ধারণা করা হচ্ছে ইউরোপীয় ভূগোলবিদ টলেমি উল্লেখিত সৌনাগড়া হিসেবে, যা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও রোমান সাম্রাজ্যের মালামাল সংগ্রহ ও বিতরণের এন্ট্রি পোর্ট হিসেবে কাজ করত।
সোনালি আঁশ পাটের জন্য বিখ্যাত “প্রাচ্যের ড্যান্ডি” নারায়ণগঞ্জ। এটির প্রসার হয়েছিল মূলত শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে নদীবন্দর হিসেবে। সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত নারায়ণগঞ্জ নামের কোনো নগরীর অস্তিত্ব প্রাচীন বাংলার মানচিত্রে পাওয়া যায় না। নারায়ণগঞ্জ নামকরনের পূর্বে সোনারগাঁ ছিল প্রাচীন বাংলার রাজধানী। মুসলিম আমলের সোনারগাঁ নামের উদ্ভব প্রাচীন সুবর্ণগ্রামকে কেন্দ্র করেই। বহু অঞ্চলে মুসলিম অধিকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে ঢাকা নগরের অভ্যুদয়ের পূর্ব পর্যন্ত সময়কালে দক্ষিণ-পূর্ববঙ্গের প্রশাসনিককেন্দ্র ছিল সোনারগাঁ। সোনারগাঁয়ের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক গুরুত্বের দ্রুত পতন শুরু হয় ঢাকায় মুঘল রাজধানী স্থাপনের (১৬১০) পর থেকেই।
তৈরি পোশাক এবং পাটশিল্পের জন্য নারায়ণগঞ্জের খ্যাতি বিশ্বব্যাপী। বিশ্বের সবচেয়ে বড় পাটকল আদমজী পাটকল অবস্থিত ছিল এখানেই। রপ্তানী শিল্পে পাট যখন বাংলাদেশের প্রধানতম পণ্য, তখন নারায়ণগঞ্জ “প্রাচ্যের ডান্ডি” নামে খ্যাত থাকলেও বর্তমানে নিট গার্মেন্টস ও হোসিয়ারী শিল্পের জন্য সুপরিচিত। সোনারগাঁও অঞ্চলের জামদানি ও মসলিন কাপড় তৈরির ইতিহাস প্রায় সাড়ে চারশ বছরের পুরোনো। বর্তমানে জামদানি শিল্প টিকে থাকলেও মসলিন শিল্প বিলুপ্ত। ঢাকা বিভাগের অন্যতম সিটি কর্পোরেশন ‘নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন’ প্রতিষ্ঠিত হয় ২০১১ সালে।
পদ্মাপাড়ের জেলা ফরিদপুর। ফরিদপুরের নামকরণ করা হয়েছে এখানকার প্রখ্যাত সুফি সাধক শাহ শেখ ফরিদুদ্দিনের নামানুসারে। এই জেলার পূর্বনাম ছিল ‘‘ফতেহাবাদ’’। ফরিদপুর জেলার প্রতিষ্ঠা সন ১৭৮৬ (ব্রিটিশ আমল) হলেও তখন এটির নাম ছিল জালালপুর এবং প্রধান কার্যালয় ছিল ঢাকা। ১৮০৭ খ্রিঃ ঢাকা জালালপুর হতে বিভক্ত হয়ে এটি ফরিদপুর জেলা নামে অভিহিত হয় এবং হেড কোয়ার্টার স্থাপন করা হয় ফরিদপুর শহরে। গোয়ালন্দ, ফরিদপুর সদর, মাদারিপুর ও গোপালগঞ্জ এই চারটি মহকুমা সমন্বয়ে ফরিদপুর জেলা পূর্ণাঙ্গতা পায়। বর্তমানে বৃহত্তর ফরিদপুর জেলা ফরিদপুর, রাজবাড়ি, গোপালগঞ্জ, মাদারিপুর ও শরিয়তপুর এই পাঁচটি জেলায় রূপান্তরিত হয়েছে। বৃহত্তর ফরিদপুরের মাদারিপুর থেকে হাজি শরীয়তুল্লাহ ফরায়েজী আন্দোলন শুরু করেন। শরীয়তুল্লাহের পুত্র দুদু মিয়ার নেতৃত্বে এখানে নীলবিদ্রোহ হয়। এ জেলার গড়াই, মধুমতি ও বরশিয়া নদীর তীরবর্তী স্থানে নীল চাষ হত।
এই এলাকার অর্থনীতি মূলত পাট কেন্দ্রিক । ফরিদপুর পাটের জন্য বিখ্যাত । এটি একইসাথে বাংলাদেশের অন্যতম বড় নদী বন্দর। এখান থেকে পাট নদী পথে সারা দেশে চলে যেত। বাংলাদেশের একমাত্র নদী গবেষণা ইনস্টিটিউট এখানেই অবস্থিত। এ জেলা জন্ম দিয়েছে বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আবদুর রউফ, সাহিত্যিক মীর মশাররফ হোসেন, পল্লীকবি জসীম উদ্দীন, শিক্ষাবিদ কাজী মোতাহার হোসেনের মত কৃতী মানুষদের।
খুলনা বিভাগ ঘেঁষে থাকা ঢাকা বিভাগের সর্বদক্ষিণের জেলা গোপালগঞ্জ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মস্থান হিসেবে জেলাটি ব্যাপক সমাদৃত। টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর সমাধি কমপ্লেক্স এখানকার চিত্তাকর্ষক স্থানসমূহের শীর্ষেই।
গোপালগঞ্জে আরো আছে কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের পৈতৃক নিবাস। ধারণা করা হয়, জেলার পূর্ব সীমানার খাটরা গ্রামের অধিবাসী হিন্দু ধর্মালম্বীরাই প্রায় ৮০০ বছর পূর্বে এ অঞ্চলে প্রথম বসতি স্থাপন করে (বল্লাল সেনের শাসনামলে)। গোপালগঞ্জ বহু প্রাচীন হিন্দু নিদর্শনে সমৃদ্ধ এবং এখানকার জনসংখ্যা মাত্র ১২ লাখের মত।
পঞ্চদশ শতাব্দীর সুফি সাধক বদর উদ্দিন শাহ মাদার (রঃ)এর নাম অনুসারে মাদারিপুর জেলার নামকরণ করা হয়। হাজী শরিয়তউল্লাহ এবং বিখ্যাত লেখক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের জন্ম এখানেই। পদ্মার তীরবর্তী এই জেলায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে আরো দশটির মত নদী। পাটালিগুড়ের জন্য এই জেলা বিখ্যাত।
শরীয়তপুর জেলা পূর্বে বৃহত্তর বিক্রমপুর (বর্তমানে মুন্সিগঞ্জ) এর অংশ ছিল। শরীয়তপুর বাংলাদেশের একটি ঐতিহ্যবাহী জেলা। প্রাচীন আমলে বৌদ্ধ শাসকগণ, গুপ্ত, বর্মন, সেন বংশের রাজারা এখানে শাসন করতেন বলে জানা যায়। এই জেলায় বসবাসকারী মানুষের বেশীর ভাগ কৃষিকাজের সাথে যুক্ত। উৎপাদনশীল শস্যের মধ্যে রয়েছে ধান, পাট, গম, পিঁয়াজ, মিষ্টি আলু, টমেটো প্রভৃতি। শিল্প কারখানা এখানে তেমন একটা গড়ে ওঠে নি।
রাজবাড়ি যে কোন রাজার বাড়ির নামানুসারে নামকরণ করা হয়েছে এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। তবে কখন থেকে ও কোন রাজার নামানুসারে রাজবাড়ি নামটি এসেছে তার সুনির্দিষ্ট ঐতিহাসিক কোন তথ্য পাওয়া যায়নি। বর্তমান রাজবাড়ি জেলা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জেলার অন্তর্ভূক্ত ছিল। ১৭৬৫ সালে এটি রাজশাহীর অন্তর্ভুক্ত ছিল। পরবর্তীতে এ জেলা এক সময় যশোর জেলার অংশ ছিল। ১৮১১ সালে ফরিদপুর জেলা সৃষ্টি হলে রাজবাড়িকে এর অন্তর্ভূক্ত করা হয়। রাজবাড়ি জেলার অর্থনীতি কৃষিনির্ভর। জেলাটি শিল্পে সমৃদ্ধ না হলেও অর্থনীতিতে অবদান রয়েছে। রাজবাড়ি জেলার উত্তরে পদ্মা নদী, পদ্মা ও যমুনার সঙ্গমস্থল দৌলতদিয়া অবস্থিত এখানেই।
ঢাকার পূর্বে অবস্থিত জেলা মানিকগঞ্জ। মূলতঃ সংস্কৃত ’মানিক্য’ শব্দ থেকে মানিক শব্দটি এসেছে। গঞ্জ শব্দটি ফরাসী। তবে মানিকগঞ্জ নামের উৎপত্তি সর্ম্পকীয় ইতিহাস আজও রহস্যাবৃত । মানিকগঞ্জ নামে কোন গ্রাম বা মৌজার অস্তিত্ব নেই। ১৮৪৫ সাল মহুকুমা সৃষ্টির আগে কোন ঐতিহাসিক বিবরণে বা সরকারী নথিপত্রে মানিকগঞ্জ এর নাম পাওয়া যায়নি। কিংবদন্তী রয়েছে যে, অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধে মানিক শাহ নামক এক সুফি দরবেশ এখানকার মানিকনগর গ্রামে আগমন করেন এবং খানকা প্রতিষ্ঠা করে ইসলাম ধর্ম প্রচার করেন। তার পুণ্য স্মৃতি রক্ষার্থেই হয়ত এই জেলার নাম পরবর্তীতে মানিকগঞ্জ হয়ে ওঠে।
প্রশাসনিক জটিলতা নিরসনকল্পে ১৮৫৬ সালে মানিকগঞ্জ মহকুমাকে ফরিদপুর জেলা থেকে ঢাকা জেলায় অর্ন্তভূক্ত করা হয়। মানিকগঞ্জ জেলার উত্তর সীমান্তে টাঙ্গাইল জেলা। পশ্চিম এবং দক্ষিণ সীমান্তে যমুনা ও পদ্মা নদী পাবনা ও ফরিদপুর জেলাকে বিচ্ছিন্ন করেছে। আরিচা ঘাট এই জেলার অন্যতম দর্শনীয় স্থান। যমুনা সেতুর আগে এই ঘাট দিয়েই যানবাহন পারাপার করা হত।
সবার শেষে আসছে মুন্সিগঞ্জ জেলার কথা। এর পূর্বনাম ছিল বিক্রমপুর, যা লোকমুখে আজও ব্যবহৃত হয়। প্রাচীনকালে নিঃসন্দেহে মুন্সিগঞ্জ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক কেন্দ্র ছিল। অঞ্চলটি খ্রিস্টীয় দশ শতকের শুরু থেকে তেরো শতকের প্রথম পর্যন্ত চন্দ্র, বর্মন ও সেন রাজাদের রাজধানী ছিল। মুন্সিগঞ্জের খ্যাতি ১২৮০ খ্রিস্টাব্দের প্রথম দিক পর্যন্ত বিদ্যমান ছিল। এরপর মুসলিম শাসকগণ সুবর্ণ গ্রামের (সোনারগাঁও) সন্নিকটে তাঁর রাজধানী স্থানান্তর করেন। তখন থেকে সমগ্র সুলতানি আমলে এ অঞ্চলটি বিস্মৃতির পাতায় থেকে যায়। এরপর মুঘল যুগে রাজস্ব তালিকায় শুধু পরগনা হিসেবে এর নামের উল্লেখ পুনরায় দেখা যায়। মুগল আগ্রাসনের বিরুদ্ধে মুন্সিগঞ্জের জমিদার চাঁদ রায় ও কেদার রায়ের (বাংলার বারো ভূঁইয়াদের উল্লেখযোগ্য দু’জন) বীরোচিত প্রতিরোধ মুন্সিগঞ্জকে কিছুটা স্বল্পস্থায়ী গৌরব প্রদান করে।
এই জেলার বরেণ্য ব্যক্তিবর্গের মধ্যে আছেন অতীশ দীপংকর (বৌদ্ধ ধর্ম প্রচারক), লেখক হুমায়ুন আজাদ, চিত্রকার চাষী নজরুল ইসলাম। লেখক মানিক বন্দোপাধ্যায় এবং বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসুর আদি পৈতৃক নিবাস ছিল এখানেই।
যুগ যায়, যুগ আসে। গঙ্গা থেকে পদ্মা নাম হওয়া নদীটা পলিমাটি দিয়ে আরো ধুয়ে দিয়ে যায় গাঙ্গেয় এই সমভূমিকে। কালের পরিক্রমায় কত স্থানের নাম পাল্টায়, কত স্থান হয়ে যায় বিলীন, ধংসপ্রাপ্ত। আজ থেকে হাজার বছর পর একদিন আমরাও হয়ত পুরাতত্ত্বের বিষয় হব; ঢাকার নাম কে জানে ঢাকা থাকবে কি না। কিন্তু এই জীবদ্দশায় ভোরবেলায় এখনো উঠে খুঁজতে চাইব দালানের আড়ালে ঢাকা পড়া সূর্যটাকে, পড়তে চাইব নাভিঃশ্বাস ওঠানো যানজটটার প্রেমে। প্ল্যান করব বন্ধুদের সাথে ইলিশে চেপে মাওয়া ঘুরে আসার কিংবা আরিচা ঘাট দিয়ে ফেরি পারাপারের সময় বড় চর দেখে ভাবব এটা রাজবাড়ি না মানিকগঞ্জের ভেতরে? ঢাকা বিভাগের প্রতিটি ধূলিকণা এভাবেই বেঁচে থাকুক ঢাকা হয়ে, যুগের পর যুগ। বঙ্গদেশের গ্ল্যামারাস রিজিয়ন হয়ে থাকার অধিকার যে তাকে ছাড়া আর কাউকে কখনো মানায় নি!
অসাধারণ! ঢাকা শহরের ইতিহাস নিয়েও লেখা চাই। ^_^