ডিজিটাল মজনু কি আর উইকিপিডিয়া না ঘেটে কোথাও যাবেন?উইকিপিডিয়ায় দেখলেন, মানচিত্রের সবচেয়ে উপরের আয়তক্ষেত্রটাই রংপুর।
উইকিপিডিয়ায় আবার রংপুরের অবস্থান সংক্রান্ত কিছু তথ্য ও ছিলঃ
ভৌগোলিক অবস্থান : রংপুর বিভাগ বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের একটি ভৌগোলিক ও ঐতিহাসিকভাবে ঐতিহ্যবাহী জনপদ। এই বিভাগের ভৌগলিক অবস্থান ২৫ ডিগ্রী ৫০ মিনিট উত্তর অক্ষাংশ ৮৯ডিগ্রী ০০ মিনিট পূর্ব দ্রাঘিমাংশ পর্যন্ত বিস্তৃত। তিস্তা নদীর উত্তর ও উত্তর-পূর্ব সীমান্তকে লালমনিরহাট ও কুড়িগ্রাম জেলা থেকে পৃথক করেছে। রংপুর বিভাগের মোট আয়তন ১৬,৩২০.২৬ বর্গকিলোমিটার। ৮টি জেলা, ৫৮টি উপজেলা, ৫২৭টি ইউনিয়ন, ২৭টি পৌরসভা ও ১২,৫৪৯টি মৌজা নিয়ে জেলাটি গঠিত।
মজনুর আবার সেই আটটি জেলার নাম জানার খুব ইচ্ছা। তো ইচ্ছাটা পূরণ করে দেই?
জেলাগুলোঃ
রংপুর
দিনাজপুর
ঠাকুরগাঁ
কুড়িগ্রাম
গাইবান্ধা
নীলফামারী
পঞ্চগড়
লালামণিরহাট
সুপ্রাচীনকাল থেকে এই অঞ্চল গৌরবময় ও বৈচিত্র্যপূর্ণ ইতিহাসের অধিকারী। এই অঞ্চল দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে যমুনা,তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র, ঘাঘট, ধরলা, করতোয়া, পুনর্ভবা প্রভৃতি নদ-নদী। হিন্দু ধর্মশাস্ত্র অনুযায়ী ভারতের পূর্বাংশ কামরূপ বা প্রাগজ্যোতিষ রাজ্যের অস্তিত্ব পাওয়া যায়, যার অন্তর্গত ছিল বর্তমান রংপুর তথা রঙ্গপুর অঞ্চল।রাজা ভগদত্তের সময় (খ্রিস্টপূর্ব ১৫শ’ অব্দ) রংপুর প্রাগজ্যোতিষের অন্তর্গতছিল। আবার রাজা সমুদ্র গুপ্তের সময় (৩৪০ খ্রি.) কামরূপের করদরাজ্যে পরিগণিত হয়। পরবর্তীতে আবার এই অঞ্চল কোচবিহারের কিছু অংশ হিসেবে পরিচালিত হতো। ৪র্থ শতাব্দীর মধ্য থেকে এ অঞ্চল সর্বপ্রথম বর্মা রাজবংশের অন্তর্ভুক্ত হয়। কালক্রমে পালবংশ, সেনবংশ আরও অনেক রাজবংশ এখানে রাজত্ব করে।
১৭৬৫ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দেওয়ানী লাভের পর রংপুর নতুন ব্যবস্থায় ইংরেজ শাসনাধীন হয়ে আসে। রংপুর অঞ্চলে সর্বপ্রথম ১৭৬৫ সালে কৃষক বিদ্রোহ দেখা দেয়। ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিপ্লবে বিদ্রোহী সিপাহীরা। এ অঞ্চলে ইংরেজ শাসকদের মাঝে ত্রাসের সঞ্চার করেছিলেন। পরবর্তীতে ১৯৩০ সালে রংপুরের বিভিন্ন অঞ্চলে সর্বপ্রথম কংগ্রেসের ডাকে আইন অমান্য আন্দোলন শুরু হয়। ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবর এখানে উত্তরবঙ্গের কৃষক নেতাদের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় এবং নবেম্বরে তেভাগা আন্দোলন শুরু হয়।
এত কিছু জানলেন আর রংপুরের নামকরণের ইতিহাস জানলেননা!
রংপুরের রঙ্গপুর নামকরণের কারণ নিয়ে এখনও চূড়ান্ত সমাধান হয়নি। কেউ কেউ মনে করেন মহাভারতের সময়ে প্রাগজ্যোতিষপুরের রাজা ভগদত্তের রঙ মহল ছিল রংপুরে এবং সেই রঙ মহল হতে নাম হয়েছে রঙ্গপুর। কারো কারো মতে ভগদত্তের কন্যা পায়রাবতীর নামানুসারে নারী জাগরণের অগ্রদ্রুত বেগম রোকেয়ার জন্মভূমি পায়রাবন্দের নামকরণ হয়েছে। কেউ কেউ মনে করেন রংপুরে বস্ত্ররঞ্জনী কারখানা ছিল। পাট নির্মিত বস্ত্রে বা চটে রং করা হতো বলে রংপুরকে রংরেজপুর বলা হতো এবং তার পরিবর্তে হয়েছে রঙ্গপুর (রংপুর)। তবে অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন রংপুরের নামকরণের ক্ষেত্রে ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মাদ বিন বখতিয়ার খলজীর অবদান গ্রহণযোগ্য। রঙ্গপুর শব্দটি ফার্সিশব্দ। আর তাই সঙ্গত কারণে বখতিয়ার শাসন আমলেই রংপুরের নাম রংপুর হয়েছে।
এত কিছু জানার পর মজনু এখন ভাবছেন, রংপুর তো যাব, লাইলিকেও পাব। কিন্তু লাইলিকে নিয়ে একটু ঘুরাঘুরি না করলে কি আর চলবে? :p
তাই তিনি প্রাচীন নিদর্শনাবলী ও দর্শনীয় স্থান সম্পর্কেও কিছু তথ্য নিয়ে রাখলেন । রংপুরে আছে কারমাইকেল বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ ভবন, পায়রাবন্দে বেগম রোকেয়ার বাড়ি, মন্থনার জমিদার বাড়ি, কেরামতিয়া মসজিদ, রংপুর যাদুঘর, মাওলানা কারামাত আলী জৈনপুরী (রহ.)-এর মাযার, হযরত শাহজালাল বোখারীর মাযার, তাজহাট জমিদার বাড়ি, কুতুব শাহের মাজার, রায়পুর জমিদারবাড়ি, পাটগ্রামে রাজা নীলাম্বরের বাড়ির ধ্বংসাবশেষ, চন্দনহাট হরি মন্দির, ডিমলা রাজ কালী মন্দির ও মিঠাপুকুর যা মোগল আমলে খনন করা হয়েছে।
এখানেই কি শেষ না কি?
অঙ্গরা মসজিদ, নীলসাগর, জেলা স্কুল, চিনি মসজিদ, সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানা, তিস্তা ব্যারেজ, হাজী তালেঙ্গা মসজিদ, সৈয়দপুর ক্যাথলিক গীর্জা।স্বপ্নপুরী, সীতাকোট বিহারের বিভিন্ন কক্ষ, ঘোড়াঘাট প্রাচীন দূর্গ মসজিদ, নয়াবাদ মসজিদ, সুরা মসজিদ, কান্তনগর মন্দির, দিনাজপুর জমিদারবাড়ির সিংহদেউড়ী, পার্বতীপুর গণ কবর, পার্বতীপুর রেল ষ্টেশন, বড়পুকুরিয়া কয়লা খনিকমপ্লেক্স, দিনাজপুর যাদুঘর, রামসাগর, রামকৃষ্ঞ মিশন।চা বাগান, ভিতরগড়, মির্জাপুর শাহী মসজিদ, হরেন সাহা শিব মন্দির, ঐতিহাসিক কাজল দীঘি, রক্স মিউজিয়াম…
ঘুরাঘুরির এত যায়গা দেখে মজনু আর লোভ সামলাতে পারলেননা। তিনি ট্রেনের টিকেট কাটতে ছুটে গেলেন কিন্তু হায় রে কপাল! মজনু পড়েছেন ট্রাফিক জ্যামে। 🙁
ট্রাফিক জ্যামে বসে মজনু তো প্রোগ্রামিং করছেন, আমরা নাহয় রংপুরের মুক্তিযুদ্ধ, ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস নিয়ে জেনে আসি?
বায়ান্নের একুশে ফেব্রুয়ারী ঢাকায় ছাত্রদের মিছিলে পাকিস্তান পুলিশ গুলি চালালে সালাম,বরকত, রফিক, জব্বার শহীদ হন।এ খবর রংপুরে আসে সন্ধ্যাবেলা। সৃষ্টি হয় উত্তেজনা। কারমাইকেল কলেজ থেকে তাৎক্ষণিকভাবে বিরাট মিছিল বের হয়। মিছিলে হামলা করে পুলিশ। পুলিশের গুলিতে আহত হয় ৩(তিন) জন। পুলিশের দমন পীড়ন এড়িয়ে পাড়ায় পাড়ায় খন্ড মিছিল অব্যাহত থাকে। মাতৃভাষা বাংলার দাবিতে স্লোগান উচ্চারিত হতে থাকে। ছাত্র আন্দোলন ক্রমশ: বেগবান হয়। আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন মতিউর রহমান (পরবর্তীতে মন্ত্রী, আওয়ামী লীগ), নুরুল ইসলাম (পরবর্তীতে অধ্যাপক), আব্দুস সোবহান (গাইবান্ধা), কাজী আব্দুল হালীম, খন্দকার আজিজার রহমান (গাইবান্ধা), সুফী মোতাহার হোসেন, মকসুদ হোসেন (মুন্সিপাড়া রংপুর) প্রমুখ।
১৯৫৪ সালের ২৯ মে পাকিস্তানে ৯২ (ক) ধারা জারির পর শেরে বাংলা এ.কে. ফজলুল হক গৃহবন্দি হন, শেখ মুজিবসহ পাঁচ- ছয় হাজার রাজনৈতিক নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়। ৩০ মে ১৯৫৪ তারিখে পুলিশ গ্রেফতার করে রংপুরের যুক্তফ্রন্ট কর্মী কাজী মোহাম্মদ এহিয়া, শিবনে মুখার্জী, নূরুল ইসলাম (পরবর্তীতে অধ্যাপক), সাংবাদিক আমিনুল ইসলাম, আজিজুল হক এডভোকেট, ভিকু চৌধুরী , ধীরেন ভট্টাচর্য, দারাজ উদ্দীন মন্ডলকে। একই সময়ে গ্রেফতার হন গাইবান্ধার মতিয়ার রহমান, মিঠাপুকুরের আব্দুল জলিল প্রধান, নীলফামারির জমশেদ আলী, শফিয়ার রহমান প্রমুখ।
পঞ্চাশের দশকে রংপুরে ‘ছেড়া তার’ নামে একটি নাটক রাজনৈতিক মর্যাদা অর্জন করে। রংপুরের আঞ্চলিক ভাষায় রচিত তুলশী লাহিড়ীর এই নাটকটিতে প্রভাবশালী কর্তৃক গরীব মানুষকে শোষণের আলেখ্য রূপায়িত হয়। কাজী মুহাম্মদ এহিয়া এতে মূল চরিত্রে অভিনয় করতেন। উদ্দেশ্য ছিল, শোষণ বঞ্চনা সম্পর্কে সাধারণ মানুষকে ব্যাপকভাবে সচেতন করে তোলে। পাকিস্তান পুলিশ এ নাটকের মঞ্চায়নে বাধার সৃষ্টি করেছিল। ষাটের দশকের রাজনীতিতে আরো্ ফলপ্রসূ ভূমিকা পালন করেছিল জহির রায়হানের সিনেমা ‘জীবন থেকে নেয়া’।
’৭০ এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্টতা প্রাপ্তিতে সারাদেশের মতো রংপুরের মানুষ উদ্বেলিত হলো। ইয়াহিয়া থান একাত্তরের ৩ মার্চ জাতীয় সংসদের অধিবেশনে আহবান করলেন। কিন্ত ভুট্টোর ষড়যন্ত্রে তা আবার স্থগিত হয়ে গেলো। দেশবাসী অধির আগ্রহে আশা করছিলো বাঙালির ম্যান্ডেট নিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর ক্ষমতায় যাচ্ছেন। ইয়াহিয়া খানের কুট কৌশল বুঝে ১ মার্চ সংসদীয় দলের বৈঠক ডেকে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিতের সিদ্ধান্তের ঘৃণা ভরে প্রত্যাথান করলেন বঙ্গবন্ধু এবং ২ মার্চ ঢাকায় এবং ৩ মার্চ সারা দেশে হরতালের কর্মসূচী ঘোষণা করলেন: পরবর্তী ঘোষণা ৭ মার্চ রেসকোর্সের মাঠে দেবেন বলে জানিয়ে দিলেন। রংপুরে ২ মার্চ ১১ দফা আন্দোলনের নেতা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি আব্দুর রউফ অনেক রাত অবধি সভা করলেন পাঙ্গা হাউসের ছাদে। সেখানে উপস্থিত ছিলেন রংপুর জেলা ছাত্রলীগের সে সময়ের সভাপতি রফিকুল ইসলাম গোলাপ, সাধারণ সম্পাদক মমতাজ জাকির আহমেদ সাবু, ছাত্রনেতা হারেস উদ্দিন সরকার, অলক সরকার, ইলিয়াস আহমেদ, আবুল মনসুর আহমেদ, মাহবুবুল বারী, মুখতার ইলাহী, জিয়াউল হক সেবু, জায়েদুল, নুরুল হাসানসহ অন্যান্য নেতা- কর্মীবৃন্দ।
রংপুর জেলা আওয়ামীলীগের অন্যতম নেতা সিদ্দিক হোসেন এমসিএ, শেখ আমজাদ হোসেন, এ্যাডভোকেট আব্দুল গণি, শাহ্ আব্দুর রাজ্জাক এমসিএ, হামিদুজ্জাম্ন এমসিএ, গাজী রহমান এমসিএ, তৈয়বুর রহমান, আবুল হোসেন, মীর আনিছুল হক পেয়ারা প্রমূখ নেতৃবৃন্দ এ অঞ্চলের মানুষকে প্রতিরোধ আন্দোলনে সম্পৃক্ত করার জন্য কর্মী বাহিনী নিয়ে বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়লেন।
১১ দফা কর্মসূচী আন্দোলনের ছাত্রনেতা আব্দুর রউফ রংপুর প্রেস ক্লাবে জানিয়ে ছিলেন, সংগ্রাম ছাড়া সামনে আর কোন পথ নেই।পরদিন ৩ মার্চ সারা দেশের মতো রংপুরেও হরতাল পালিত হয়। হরতালের জন্য কোন পিকেটিং এর প্রয়োজন হয়নি। স্বত:স্ফুর্ত মানুষ হরতাল করে। রংপুরের রাজনীতির ইতিহাসে একটি স্মরণীয় দিন। কাচারি বাজার হতে ছাত্রনেতাদের নেতৃত্বে ছোট একটি মিছিল শুরু হয় মূল শহর অভিমূথে। পথে সর্বস্তরের মানুষ মিছিলে অংশগ্রহণ করতে থাকে। ক্রমানয়ে মিছিলের বিশালতা বাড়তে থাকে। মিছিলটি ছিল জঙ্গি কিন্ত সুশৃঙ্খল । মিছিলে গণনবিদারী শ্লোগান চলছে।‘তোমার আমার ঠিকানা – পদ্মা, মেঘনা,যমুনা’। ‘ তোমার নেতা আমার নেতা, শেখ মুজিব শেখ মুজিব’।‘ ইয়াহিয়ার মুখে লাথি মারো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’। মিছিল প্রেসক্লাব চত্বরে এলে অসংথ্য মানুষ হাততালি দিয়ে স্বাগত জানায়।সে সময়ের এমসিএ সিদ্দিক হোসেন সাথী – কর্মী নিয়ে মিছিলে যোগ দেন। সবারই এক লক্ষ্য স্বাধীনতা। মিছিলের অগ্রভাগে সিদ্দিক হোসেন এমসিএ , ডা: সোলায়মান মন্ডল এমএনএ, ছাত্রনেতা রফিকুল ইসলাম গোলাপ, অলক সরকার, মাহবুবুল বারী, খন্দকার গোলাম মোস্তফা বাটুল, অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম(প্রয়াত), হারেস উদ্দিন সরকার, মমতাজ জাকির আহমেদ সাবু, খন্দকার মুকতার ইলাহী, জিয়াউল হক সেবু, নূরুল রসুল চৌধুরী, ইলিয়াস আহমদ, হালিম খান, তবিবুর রহমান, গোলাম কিবরিয়া, আব্দুল মান্নান (খলিফা), নূরুল হাসান, আবুল মনছুর আহমেদ, জায়েদুল, টুলু লুলু প্রমুখ নেতৃবৃন্দ।
কথা ছিল, তেতুলতলা থেকে মিছিল ফিরে আসবে আবার শহরে। কিন্তু তেতুলতলায় কারমাইকেল কলেজের ছাত্র নেতৃবৃন্দের এবং আলমনগর এলাকার আওয়ামীলীগ, ছাত্রলীগ, শ্রমিক লীগের নেতা কর্মীদের চাপের মুখে মিঠিল এগিয়ে চললো আলমনগর স্টেশন অভিমূখে। মিছিলের অগ্রভাগ যখন খাদ্য গুদামের কাছে পৌছেছে ঠিক সে সময়ে গুলি বর্ষিত হলো অবাঙালি সরফরাজ খানের বাড়ি থেকে। গুলিতে আহত হয়েছে এক কিশোর। নাম তার শংকু সমজদার, বাড়ি গুপ্তপাড়ায়। বয়ষ আনুমানিক ১২ বছর। আহত শংকুকে নিয়ে হাসপাতালে ছুটলো মিছিলে অংশগ্রহণকারী মোসলেম উদ্দিন (পরবর্তীতে পৌর কমিশনার) । কিন্ত হাসপাতালে পৌছার আগেই শংকু মারা গেছে। শংকু মারা যাবার খবরে উত্তেজিত হলো জনতা। এক পর্যায়ে সারা শহরে অবাঙালিদের দোকানে ভাংচুর অগ্নিসংযোগ করতে থাকে। যে বাড়ি থেকে গুলি ছোড়া হয়েছে তা আক্রমণের চেষ্টাকালে ইপিআর বাহিনীর সদস্যরা বাধা দেয়। বিক্ষুদ্ধ জনতাকে শান্ত করার জন্য
এমএনএ ড়া: সোলায়মান মন্ডল জ্বালাময়ী ভাষণ দেন। যে কো্ন মূল্যে প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহবান জানান। সারা শহর তথন বিক্ষুদ্ধ। খন্ড খন্ড মিছিল চলছে। ইতোমধ্যে অবাঙালিদের গুলিতে আরো দুজন প্রাণ হারালো। এরা হলেন রংপুর কলেজ ছাত্র আবুল কালাম আজাদ, বাড়ি মিঠাপুকুর। অপরজন সরকারী চাকুরে ওমর আলী। ওমর আলী ছুরিকাঘাতে মারা যান দেওয়ানবাড়ি রোডের জেনারেল বুট হাউজের সামনে। আবুল কালাম আজাদ প্রাণ হারান বাটার গলির মুখে একচেঞ্জের সামনে। মিছিলে সেদিন দুজন ছাত্র আহত হয়েছিল। একজন শরিফুল আলম ওরফে মকবুল গুলিবিদ্ধ অবস্থায় বিনা চিকিতসায় একমাস পর হাসপাতালে প্রাণ হারান। অপরজন মোহাম্মদ আলী, রংপুর কলেজের ছাত্র সংসদের ছাত্র মিলনায়তন সম্পাদক, পায়ে গুলি বিদ্ধ হয়েছিল। সে সময়ে রংপুরের ডেপুটি কমিশনার সৈয়দ শামীম আহসান ব্যক্তিগত উদ্যোগ নিয়ে পরিস্থিতি শান্ত করার চেষ্টা করেন। কিন্ত ব্যর্থ হয়ে বেলা ২.৩০মিনিটে সন্ধ্যা আইন জারি করেন। তিন জনের লাশ দেথে এসে পরবর্তী কর্মসূচী নিয়ে আলোচনায় বসার জন্য আওয়ামী লীগ, ছাত্র লীগ নের্তৃবৃন্দ ডিসির বাসভবনে পৌঁছেন বিকেল ৪ টায় । মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমান রংপুরের মানুষের এ ত্যাগের কথা জলদগম্ভীর কন্ঠে উচ্চারণ করেছেন।
১৭ মার্চ ৭১ রংপুর ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক রফিকুল ইসলাম গোলাপ কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ প্রেরিত স্বাধীন বাংলার জাতীয় পতাকার নমুনাসহ স্বাধীনতার ইশতেহার গ্রহণ করেন। ২৩ মার্চ জেলা প্রশাসকের বাসভবনে এবং ইলিয়াস আহমেদ জেলা প্রশাসক অফিসের ছাদে স্বাধীন বাংলা পতাকা উত্তোলন করেন। একই দিনে নবাবগঞ্জ বাজারে স্বাধীন বাংলা পতাকা উত্তোলন করেন ন্যাপ (ভাসানী) নেতা মাহফুজ আলী(জররেজ)। নবাবগঞ্জ বাজারের পতাকা উত্তোলন অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন মরহুম মো: আজমল, মোজাফ্ফর প্রধান, সেলিম চৌধুরী, শাহ্ তবিবর রহমান, শেখ শাহী, মোজাহারুল ইসলাম লুলু, আবু জাফর মুকুল, কাজী আহমেদ এহিয়া এবং আরো অনেক। পতাকা উত্তোলন অনুষ্ঠানে নেতা মাহফুজ আলী (জররেজ) বীরত্বব্যঞ্জক স্বরে বলেন, ‘আজ আমরা স্বাধীন, দেশ স্বাধীন করব নয়তো মরবো’। সভায় সভাপতিত্ব করেন কাজী মোহাম্মদ এহিয়া। তিনি বলেন, ‘পূর্ব পাকিস্তান অবলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। আমি দিবচক্ষ্যে দেখতে পাচ্ছি, বাংলার মানুষ এ দেশকে অল্পদিনের মধ্যে স্বাধীন করবে”। উল্লেখ্য, ২৩ মার্চ বঙ্গবন্ধু নিজ হাতে তার ধানমন্ডির ৩২ নম্বর এর বাড়িতে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করেন।
২৪ মার্চ ৭১ রংপুরে একসাথে ঘটে দুটি ঘটনা। ঐদিন কার্ফ্যু ভঙ্গ করার দায়ে পাকবাহিনী ইয়াকুব মাহফুজ আলী জররেজকে বেত্রাঘাত করে এবং ন্যাপ কর্মী রফিককে মেরে পায়ের হাড় ভেঙ্গে দেয়। জনগণ এই অত্যাচারের প্রতিবাদে জেলা প্রশাসকের বাংলো ঘেড়াও করে। ওদিকে মুরগি ও ডিমের খোজে পাকবাহিনীর একটি জীপ দামোদড়পুর হাটে গেলে শাহেদ আলী, রফিকুল আলম বাদশা, আব্দুস ছালাম, রফিকসহ আরো তিন-চার জন বাঙ্গালী যুবক তাদের ঘিরে ফেলে। উদ্দেশ্য, পাকবাহিনীকে খাদ্য সরবরাহ বন্ধ করে দেয়া । ৭ই মার্চ এর ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছেন, “ওদের ভাতে মারবো পানিতে মারবো”। শাহেদ আলী লাফ দিয়ে গাড়ীর বনেটে উঠে একটানে এল.এম.জি. ছিনিয়ে নেয় দাড়িয়ে পাকিস্তানি সেনার কাছ থেকে। ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে পড়ে লে. আব্বাসী। এ সুযোগে শাহেদ আলী খাপ্পর দিয়ে (বল্রমের মতো), আঘাত করে আব্বাসীকে। ক্যাপ্টন আব্বসী লুটিয়ে পড়েন মাটিতে। রফিক, ছালাম, রফিকুল আলম বাদশা তাতক্ষনিকভাবে তাদের হাতে থাকা চাপাতি, কুড়াল, কোদাল দিয়ে আঘাত করতে থাকে অপর তিনজন সেনাকে।
এটা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল না, ছিল তখনকার ঐতিহাসেরই ধারাবাহিকতায় একটা অনিবার্য ঘটনা। বলা উচিত, মুক্তিযোদ্ধেরই সুচনা ঐ ঘটনায় বাঙালি জনতা পাকসেনাদের সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র কেড়ে নেয় এবং জীপটি পুড়িয়ে ফেলে। জনতার আক্রমণে আহত পাকসেনাদের রংপুর সদর হাসপাতালে আনা হয়, বিদ্রোহী জনতা হাসপাতালে ওদের চিকিতসার বিরোধীতা করলে পাকসেনারা জনতার আক্রমণের ভয়ে আতঙ্কিত হয়ে গুলি ছুড়ে। এখানে এই ঘটনার পাকসেনাদের গুলিতে পৌরবাজারের সামনে রাজ্জাক নিহত হয়। হত্যাকান্ডে ঘটনায় জনতার মাঝে নতুন করে উত্তেজনা বৃদ্ধি পায়। শহীদ রাজ্জাকের সমাধি আছে হনুমন তলা কাজী নজরুল ইসলাম রোডে।
ওদিকে ২৫ মার্চের কাল রাতে ঢাকার রাজারবাগ ও পিলখানা পুলিশ স্টেশনে নারকীয় হত্যাযজ্ঞের ঘটনায় এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবরের গ্রেফতারের খবরে গোটা রংপুরের মানুষ জঙ্গি প্রতিরোধ গড়ে তোলে এবং যুদ্ধংদেহী হয়ে উঠে। ততকালীন রংপুর জেলার রংপুর সদর, কুড়িগ্রাম, নীলফামারী, গাইবান্ধা মহকুমার প্রত্যেক থানায় বিক্ষুদ্ধ জনতা সবখানে রেললাইন তুলে ফেলে। পুল, কালভার্ট ভেঙ্গে দেয়। যোগাযোগের সময় রাস্তা কেটে দিয়ে রাস্তার উপর বড় বড় গাছ ফেলে ব্যারিকেড রচনা করেন।
তিস্তা ব্রীজের (কাউনিয়া পয়েন্ট) যুদ্ধঃ ২৭ মার্চ ১৯৭১
২৩তম ব্রিগেড রংপুর সেনানিবাসের মেজর এজাজ মোস্তফা ছিলেন অবাঙালী। ২৭ মার্চ ৭১, পাকিস্তানিরা তাকে দায়িত্ব দিয়ে পাঠায় তিস্তা ব্রীজ দখল করার জন্য। মেজর এজাজ মোস্তফা রংপুর শহর থেকে অবাঙালি যুবকদের একটি দল নিয়ে কাউনিয়ায় যান। কাউনিয়ার ওসিকে সাথে নিয়ে তা’রা তিস্তা নদীর দক্ষিণপাড়ে রেকি করতে থাকেন। তাদের অনুমান ছিল যে, গুরুত্বপূর্ণ তিস্তা রেলসেতুর অপর পাড়ে বাঙালি মুক্তিসেনা ও মুক্তিপাগল জনতা অপেক্ষায় আছে। পাকিস্তানদের অনুমান ভুল ছিল না, ভুল ছিল বাঙালিদের সমর্থক সম্পর্কে ধারণা। পাকিস্তান সেনানিবাস থেকে ২৬ মার্চ পালিয়ে কুড়িগ্রামে চলে যাওয়া ক্যাপ্টেন নওয়াজেশ ইতোমধ্যেই সেখানে আওয়ামীলীগ, ছাত্রলীগসহ অগ্রসর ছাত্র সমাজ এবং কলেজ অধ্যাপক, রাজনৈতিক নের্তৃবৃন্দকে সংগঠিত করে মুক্তিযুদ্ধ হেডকোয়াটার গড়ে তুলছেন এবং গুরুত্বপূর্ণ বেসামরিক নেতৃবৃন্দ, ছাত্র নের্তৃবৃন্দকে নিয়ে হাইকমান্ড গঠন করেছেন। নওয়াজেশ এসব সাংগঠনিক কাজ সম্পন্ন করেছেন ইথারের গতিতে। অত:পর এই চৌকষ বাঙালি সেনাকর্মকর্তা দ্রুততম সময়ের মধ্যে তার বাহিনী পাঠিয়ে দিয়েছেন তিস্তা রেলসেতুতে। ইপিআর জোয়ানরা সেতুর উপর ওত পেতে ছিলো। পাকিস্তানি সেনারা তিস্তার পশ্চিমপাড়ে এক শ’গজ নিশানার মধ্যে আসা মাত্র হাবিলদার ওহাব গুলি ছোড়েন। অব্যর্থ গুলি পাকিস্তানি মেজর এজাজ মোস্তফার বুক ফুটো করে বেরিয়ে যায়। এ যুদ্ধে পাকিস্তান পক্ষের ১৫ জন সেপাহী ও্র কাউনিয়া খানার ওসি মৃর্ত্যু বরণ করেন। অবশিষ্টরা পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে এটা ছিল একেবারেই দিককার সম্মুখযুদ্ধ, এবং এ যুদ্ধে বাঙালিরা গুরুত্বপূর্ণ বিজয় অর্জন করেন।
রংপুর ক্যান্টনমেন্ট আক্রমণঃ
এদিকে ২৮ মার্চ ৭১ রংপুর ক্যান্টনমেন্ট আক্রমণের কর্মসূচী হাতে নেয় রংপুরের জাগ্রত সাহসী জনতা।রংপুর ক্যান্টনমেন্ট আক্রমণের পরিকল্পনা তৈরী করেন তৎকালীন আইন পরিষদের সদস্য আওয়ামীলীগ নেতা জনাব সিদ্দিক হোসেন, নিসবেতগঞ্জের আওয়ামীলীগ নেতা শেখ আমজাদ হোসেন, এ্যাডভোকেট গণিসহ অনেকেই। অভিযান সফল করার জন্য রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট প্রচারণা শুরু করেন। দুর্ভাগ্য রংপুর বাসীর রংপুর ক্যান্টমেন্ট আক্রমণের খবর যেভাবেই হোক পৌঁছে যায় পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তাদের কাছে। ২৮ মার্চের ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাওয়ের সংগঠক জনাব শেখ আমজাদ হোসেন আমাকে জানিয়েছেন, ২৭ মার্চ রাতে রংপুর নিউ ইঞ্জিনিয়ার পাড়ায় জনৈক উকিলের বাড়ীতে আওয়ামীলীগ ছাত্রলীগের একটি গোপন বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সেই বৈঠকে ঘাপটি মেরে বসে থাকা জনৈক পাকিস্তানি চর সমস্ত খবর ফাঁস করে দেয় পাকিস্তানিদের কাছে।
এ পর্যায়ে ঢাকা সেনানিবাস হেডকোয়াটার থেকে নির্দেশ আসে বাঙালি সৈন্য ও বাঙালি ই.পি.আর জোয়ানদের গ্রেফতার নিরস্ত্র করার। আরো নির্দেশ আসে রংপুরের গুরুত্বপূর্ণ নেতৃবৃন্দকে গ্রেফতারের। ২৭ মার্চ পাকিস্তানি সৈন্যরা রংপুর ই.পি.আর ক্যাম্পে হানা দিয়ে বাঙালি জোয়ানদের গ্রেফতার করে এবং তাদের সমস্ত অস্ত্র ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যায়। ওরা ক্যান্টনমেন্টের ভিতর ট্যাংক বাহিনীর বাঙালি সেনাদের গ্রেফতার করে। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে গ্র্রেফতারের জন্য বিশাল গাড়ির বহর নিয়ে অস্ত্র উচিয়ে শহরের বিভিন্ন বাড়িতে তল্লাশী চলে।
স্বাধীনতার যুদ্ধে ঘটে গেছে এমন খন্ড খন্ড আরো অনেক ঘটনা।
প্রিয় পাঠক, রংপুর বিভাগ নিয়ে আমরা কত্ত কিছু জেনে ফেলেছি! কিন্তু যার জন্য রংপুরে আসা, সে মজনু কোথায় ?!?
তিনি এখনো জ্যামে 🙁
মজনুর বেদনায় খুব ব্যাথিত আমি।তাই আপাতত রংপুর থেকে বিদায় নিচ্ছি। আমার মন ভাল হলেই ঢু মারব অন্য একটি বিভাগে, সাথে থাকবেন তো?
তথ্যসুত্রঃ উইকিপিডিয়া, বাংলাদেশ জাতীয় তথ্য বাতায়ন।