টাইম ট্রাভেল কেন সম্ভব নয়? টাকা আয় করার চেয়ে ব্যয় করা সহজ কেন? একটা ভাঙ্গা খেলনা কেন নিজে নিজে জোড়া লেগে ঠিক হয় না? – এই সকল প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আমরা যার দ্বারস্থ হতে পারি, সে হল এনট্রপি (Entropy) যা কলেজের পদার্থবিজ্ঞান সিলেবাসের হটকেক একটা টপিক। কিন্তু এনট্রপিকে যত সহজে “বিশৃংখলার পরিমাপ” বলে আমরা চালিয়ে দিতে চাই, ততটা পরিষ্কার ধারণা এর ব্যাপারে আমরা হয়ত কেউই রাখি না। এমনকি বিদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতেও ছাত্রদের প্রতি শিক্ষকদের বার্তা থাকে, “এনট্রপি সংক্রান্ত সমস্যা সমাধান করতে থাকো, নিজেই বুঝতে শিখবে এটা কী”। এই যখন অবস্থা, তখন একটু সময় ব্যয় করা যাক রহস্যময় এনট্রপিকে খানিকটা করায়ত্ত করার চেষ্টায়!

প্রথমেই আসা যাক শক্তি নিয়ে আলোচনায়। শক্তির নাম শুনতেই আমরা শরীর দুলিয়ে যে কথাটা ফোঁস করে বলে ফেলি তা হচ্ছে “কাজ করার সামর্থ্য”। এই সামর্থ্য কার? সামর্থ্য আসলই বা কোত্থেকে? কে এই কাজ করছে? এই প্রশ্নগুলোও তাহলে সম্পূরক হওয়া উচিত।

বিং ব্যাং তত্ত্ব (Big Bang theory) অনুযায়ী, অত্যধিক ভর কিন্তু নগণ্য আয়তনের কণার বিস্ফোরণ থেকে যখন মহাবিশ্বের পথচলা শুরু হয় তখন প্রচুর শক্তিও মুক্ত হয় এবং তা মহাশূণ্যে ছড়িয়ে পড়ে। এই শক্তি হল আদি মহাবিশ্বের কাঁচামাল যা থেকে পরবর্তীতে সৃষ্টি হতে পেরেছিল ভর (আইনস্টাইনের E=mc2 সমীকরণ এক্ষেত্রে স্মর্তব্য, যার অর্থ : ভর ও শক্তি, একটি হতে অন্যটিতে রূপান্তরযোগ্য)। তবে সব শক্তি কিন্তু তখন ভর হয়ে যায় নি, শক্তির অস্তিত্ব আছে এবং তার বৈশিষ্ট্য হল শক্তির ঘনত্ব যেখানে বেশি সেখান থেকে ঘনত্ব যেদিকে কম সেদিকে পরিযাত্রা করা। হাতে এক টুকরো বরফ তুলে নিলে তাপশক্তি আমাদের হাত থেকে বরফে যায় ও তাকে গলিয়ে দেয় এজন্যেই। শক্তির কারণেই পদার্থের অবস্থার রূপভেদ দেখা যায়, শক্তিকে দিয়ে যখন আমরা নিজেদের কাজ করিয়ে নিই (যেমন হাতঘড়ি চলে ব্যাটারির বিদ্যুৎশক্তিতে) তখন আমাদের চোখে ধরা দেয় এর কাজ করার সামর্থ্য।

ধরা যাক একটা লেকের মাঝখানে বাঁধ দিয়ে দেওয়া হয়েছে, তার দুইপাশে পানির উচ্চতা দু’রকম। এখন যদি বাঁধটা খুলে দেওয়া হয় তবে কী হবে? দুই উচ্চতার পানি মিলেমিশে সমান উচ্চতার হয়ে যাবে। একপাশের উঁচু লেভেলে পানির যে কণাগুলো ছিল, তারা তুলনামূলক বেশি বিভবশক্তি ধারণ করে ছিল। কিন্তু এখন তারা ঐ শক্তি ব্যয় করে নিচে নেমে এসেছে এবং পুরো লেকজুড়ে পানির উচ্চতা সমান হয়ে গেছে। যদি বলা হয়, এই সমান অবস্থা থেকে আবার কি আপনাআপনি পূর্বের অবস্থা তৈরি হতে পারবে? উত্তর হল, না। এই যে উচ্চে থাকা পানিকণারা শক্তি ব্যয় করে নিচে নেমে গেছে এবং তারা আবার নিজেরা কাজ করে উঁচু পানির স্তর তৈরি করতে অপারগ – এটাই শক্তির অপ্রাপ্যতা (যে শক্তি ব্যয় করে আমি বাঁধ বানালাম, এই পানিটুকু উঁচুতে তুললাম, তারা সমান লেভেলের হয়ে যাবার পর আর কখনোই নিজেরা ঐ কাজটুকু করে আগের মত হবে না)।

এই যে শক্তির অপ্রাপ্যতার কথা আসল, এখান থেকেই এনট্রপির শুরু।

কেতাবী ভাষায় এনট্রপি হল কোনো সিস্টেমের একটা স্টেট ফাংশন ( স্টেট ফাংশন হল চাপ, তাপমাত্রা কিংবা আয়তনের মত রাশি যা দিয়ে বোঝা যায় ঐ সিস্টেম কী অবস্থায় আছে)। একটি গ্যাসীয় সিস্টেমের এনট্রপি নির্ভর করে তার তাপমাত্রা ও আয়তনের উপর। আলাদা কন্টেইনারের দু’রকম গাসের মিক্সিং ঘটলেও বদলাতে পারে তাদের প্রত্যেকের এনট্রপি। তরল কিংবা কঠিন পদার্থের এনট্রপি নির্ভরশীল তাদের তাপমাত্রা ও অভ্যন্তরীন গঠনের উপর। এই নির্ভরশীলতাগুলো আমরা মাথায় রাখার চেষ্টা করি কারণ পরবর্তীতে আমরা এগুলোর বেসিসে নানা উদাহরণ দেখব। বাহ্যিকভাবে তাপমাত্রা কিংবা আয়তনের পরিবর্তনের সাপেক্ষে যখন আমরা ক’টা সূত্র ব্যবহার করে এনট্রপির পরিবর্তন কষে ফেলি তখন এনট্রপি কী তা বোঝার জন্য যথেষ্ট কাজ আমরা করি না (অথচ আমাদের লক্ষ্য থাকে সেরকমই, আগেই বলেছি)। একেবারে ক্ষুদ্র আণবিক পর্যায়ের আলোচনা ও তার সাথে পরিসংখ্যানের মত বিষয়কে একাত্ম করেই এনট্রপি হয়ে ওঠে প্রকৃত এনট্রপি, শৃংখলা ও বিশৃংখলার নির্ধারক।

ফিরে যাই শক্তির অপ্রাপ্যতার সাথে এনট্রপির সম্পর্কে। বরফ যখন স্বাভাবিক তাপমাত্রায় পানি হয়, তখন তা পরিবেশ থেকে তাপশক্তি গ্রহণ করে থাকে। পরিবেশ তাপ হারাল, বরফকে তার সমান তাপমাত্রার পানি বানিয়ে দেবার মত কাজ করল – কিন্তু এর উল্টোটা ঘটানোর প্রত্যাশা সে এই গলে যাওয়া পানির কাছ থেকে করতে পারবে না (যেমন সমান হয়ে যাওয়া লেকের পানির ক্ষেত্রে আমরা করি নি)। কোনো শক্তি কিন্তু এখানে ধংস হয় নি, যে শক্তি পরিবেশ হারিয়েছে তা বরফ শোষণ করে পানি হয়েছে; কিন্তু শক্তির যে বৈষম্য বরফ ও পরিবেশের মাঝে ছিল তা নষ্ট হয়েছে, যা প্রকৃতির নিয়মানুসারে অফেরতযোগ্য। বরফ পানি হবার প্রক্রিয়াটা তাই স্বতস্ফূর্ত। এখানে একটু ছোট্ট করে প্রত্যাগামী ও স্বতঃস্ফূর্ত প্রক্রিয়ার পার্থক্য বলে দিতে চাই। এই যে আমরা বরফ থেকে পানি পেলাম তা কিন্তু চাইলেই আবার বরফ বানিয়ে ফেলা যায় (বরফ থেকে তাপ শুষে নিয়ে, যা রেফ্রিজারেটর করে) অর্থাৎ উল্টো ঘটনাটা চাইলেই আমরা শক্তি ব্যয় করে ঘটাতে পারি (রেফ্রিজারেটর চালাতে শক্তি লাগে কি লাগে না?)। সুতরাং বরফ থেকে পানি হওয়াটা প্রত্যাগামী (Reversible), উল্টো ঘটনাও ঘটানো যেতে পারে। তবে এই উল্টো ঘটনাটা স্বতঃস্ফূর্ত হচ্ছে না, হলে আমাদের এত কাহিনী করার দরকারও পড়ত না। স্বতঃস্ফূর্ত কেবল বরফ থেকে পানি হবার প্রক্রিয়াই। সকল স্বতঃস্ফূর্ত প্রক্রিয়াতেই শক্তির বৈষম্য নষ্ট হয়, শক্তি উচ্চ ঘনত্ব থেকে কম ঘনত্বের এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। ফলে আগে কম শক্তিবিশিষ্ট এলাকার কণাগুলো যেরকম অবস্থায় ছিল, নতুন আসা শক্তি পেয়ে তারা চঞ্চল ও বিশৃংখল হয়ে ওঠে (বরফের পানি হওয়াটা কল্পনা করতে থাকি)। তার মানে কী দাঁড়াল? কোনো স্বতঃস্ফূর্ত প্রক্রিয়ার লক্ষ্যই থাকি শক্তির ঘনত্বের পার্থক্য নষ্ট করা, শক্তি ছড়িয়ে দেওয়া ও ফলশ্রুতিতে বিশৃংখলা বাড়িয়ে দেওয়া। আবার স্বতঃস্ফূর্ত প্রক্রিয়ার মানেই ঐ ছড়িয়ে পড়া শক্তি আপনাআপনি আবার বেশি ঘনত্বের জায়গায় ফিরে এসে জড় হবে না, এই বিপরীত কাজ করতে তারা কখনোই চাবে না। সুতরাং, শক্তির ঘনত্ব যেখানে বেশি ছিল, তা শক্তি হারাল এবং ঐ জায়গায় হারানো শক্তি অপ্রাপ্য হয়ে গেল। এই স্বয়ংক্রিয় অপ্রাপ্যতা সৃষ্টির নিয়তি হিসেবেই বাড়ল বিশৃংখলা, এনট্রপি। (চলবে)

এনট্রপি ও শক্তিহীন শক্তির গল্প ২