“আমার জীবন, অন্যের ডিসিশান-১ (পেশা)”
আমাদের সমাজে অন্যতম পাপ হিসেবে দেখা হয় নিজের জীবনের সিদ্ধান্ত নিজে নেয়া। বিশ্বাস হচ্ছে না? পড়ে দেখুন সত্য কিনা?
আমি কি হবো?
– আমার ছেলে/মেয়ে বড় হয়ে ডাক্তার/ইঞ্জিনিয়ার/জজ উকিল হবে। ছেলে/মেয়ে সায়েন্স বুঝুক আর নাই বুঝুক, তার আগ্রহ চিত্রকলাতে থাকলেও তাকে মুখ ঠেঁসে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ারের বড়ি খাওয়ানো হয়। কারণ, হচ্ছে তার বাবার স্বপ্ন/মার স্বপ্ন/দাদা-দাদী/নানা-নানীর স্বপ্ন। নতুন যোগ হচ্ছে হবু শ্বশুর-শ্বাশুড়ীর স্বপ্ন যার ছেলে বা মেয়েকে এখনো দেখা যায় নি। একটি ছেলে বা মেয়ের যে নিজের স্বপ্ন থাকতে পারে এটা আমাদের সমাজে অবাস্তব। “তুই কি বুঝবি?”- এক ধমকে নামিয়ে দেয়া হয়। চিকিৎসা-প্রকৌশল নি:সন্দেহে ভালো পেশা এবং খুবই সম্মানজনক পেশা। কিন্তু সবাই যদি ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হয় তবে পুলিশ কে হবে, শিক্ষক কে হবে, মেকানিক কে হবে, ব্যবসায়ী কে হবে? ধরুন, আপনার প্রচন্ড পিপাসা পেয়েছে আর আপনাকে দেয়া হচ্ছে মিষ্টি-মন্ডা, তাতে কি আপনার তৃষ্ণা মিটবে? আমাদের সমাজ তিলে তিলে নষ্ট করে স্বপ্ন, নষ্ট করে আশা।
যার ইচ্ছা ছিলো না সে ডাক্তার হলে সমস্যা কি? ভাল স্টুডেন্ট হলে সে ঐটাতেও ভালো করবে।
–মোটেও না। পড়াশুনা আর পেশা দুটি দুই জগত। আপনি ভাল স্টুডেন্ট হলেই ভালো প্রফেশনাল হবেন তার গ্যারান্টি নেই। পেশাগত দক্ষতা নির্ভর করে অভিজ্ঞতা, আগ্রহ এবং আউট-অব-বক্স চিন্তার উপর। যার প্রোগ্রামিং এ আগ্রহ তাকে জোর করে বায়োলজি পড়ালে সে হয়তো ভাল রেজাল্ট করবে কিন্তু তার সকল সৃজনশীলতা নষ্ট হবে। কারণ, তাতে আগ্রহই নাই। এবং সবচেয়ে বড় কথা হলো, তাকে যদি প্রোগ্রামিং এ সুযোগ দেয়া হতো তবে তার অস্বাভাবিক ভালো কিছু করা সুযোগ থাকতো। যাদেরকে আপনি সাফল্যবান দেখেন তাদের লাইফ দেখলেই আইডিয়া পাবেন। বিল গেটস যদি ডাক্তারি করতো কিংবা জুকারবার্গ যদি বায়োলজি পড়তে যেত তবে তারা কোনটাই হতে পারতো না। আপনি যদি আপনার কাজে আনন্দ না পান, তবে আপনি সে কাজে বাকি জীবন কিভাবে কাটাবেন?
প্রফেশনাল সেক্টরে সমস্যা কেন?
-আমাদের প্রফেশনাল সেক্টরে অনেকেই আছেন, যারা চলে আসেন অন্যদের ডিসিশানের কারণে বা নিরুপায় হয়ে। ধরুন, আপনি ব্যাঙ্ক জব করছেন, অথচ আপনার এটা করার কোন ইচ্ছাই ছিলো না। তাতে কি হবে? আপনার যদি ব্যাঙ্ক জবের প্রতি আসলেই আগ্রহ থাকতো তবে আপনি ব্যাঙ্কিংয়ের পরিবর্তনের জন্য অনেক আইডিয়া চিন্তা করতে পারতেন। আপনি ভাবতে পারতেন, কিভাবে গ্রাহকদের তথ্য সহজে আদান-প্রদান করা যায় বা অনলাইনে কিভাবে একজন গ্রাহক সব তথ্য পাবে ইত্যাদি। আগ্রহ না থাকায় যা হবে, আপনি নিমরাজি হয়ে কাজ করে যাবেন। ব্যাঙ্ক সেবায় গ্রাহক খুশি না অখুশি তাতে আপনার মাথা ব্যাথা নাই কারণ মাস শেষে টাকা আসলেই হবে। এত যা হচ্ছে একটা সেক্টরে যতটা উন্নতি হবার কথা তার চেয়ে অনেক কম হচ্ছে। এখন প্রতিটি সেক্টরই কোনটা কোন ভাবে অন্য সেক্টরের সাথে সম্পর্কিত। এটা সেক্টর মার খেলে অন্যটাও এমনিতেই মার খাবে। আর তাতে যা হবে উদ্যোক্তা বা বিনিয়োগকারীরা মরিয়া হবে লাভের জন্য- ফলাফল দূর্নীতি। তার মানে এই না, ভুল পেশা গ্রহণই একমাত্র কারণ। অনেকগুলো কারণের মধ্যে এটা একটা।
পেট চললে পরে স্বপ্নের কথা?
–মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়। আপনি যদি আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন দেখেন তবে হয়তো ঘরের সিলিং ছুঁতে পাবেন কিন্তু আপনার স্বপ্নই যদি থাকে আলমিরার উপরটা ধরার তবে চেয়ার পর্যন্ত যাবেন কিনা সন্দেহ। আর যে পেট চালানোর ধান্ধায় থাকবে, তার শুধু পেটই চলারই অবস্হা হবে, মাথা চলার অবস্হা হবে না।
জব সেক্টর নাই? আমিতো অমুক সাবজেক্টে পড়ি, বিশাল সিজিপিএ। জব দেখান?
–জব সেক্টর আছে। আমি অনেককেই একটা কথা বলি, “জব সেক্টর কারও জন্য তৈরি হয় না, বরং নিজেকে জব সেক্টর তৈরি করতে হয়।” যে আপনাকে টাকা দিবে কোন কাজ করার জন্য সেই কাজের জন্য আপনি নিজে কতটা যোগ্য বিবেচনা করুন। সাথে সাথে আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে আপনি কোথায় সেটাও বিবেচনা করুন। বলবেন, আন্তর্জাতিক দিয়া বাংলাদেশ চলে না। ভুল কথা। আপনার দৈনন্দিন জীবনের যাবতীয় বিষয়ই আপনি আন্তর্জাতিকভাবে তুলনা করেন। ভেবে দেখুন।
– অবশ্যই পারবো না। কারণ, আমি আপনার সাবজেক্ট সম্পর্কে কোন আইডিয়া নাই। আন্দাজে কথা বলা মোটেও ভাল বিষয় না। কোন জব আপনার জন্য ভাল সেটা আপনি ছাড়া কেউ ভাল জানবে না। এই সিদ্ধান্ত আপনাকেই নিতে হবে। কারণ, শুধু জিপিএ আপনাকে জব দিবে না, ঐ জব করার জন্য আপনার এক্সট্রা কোন অভিজ্ঞতা বা এক্সটা কোন কোর্স করেছেন কিনা সেটা আগে দেখুন। ধরুন, দুইজন আবেদন করলো, একজনের সিজিপিএ ৪ এ ৪ আরেকজনের ৩.৬। যার জিপিএ কম, তার এই কাজে অভিজ্ঞতা আছে বা সম্পর্কিত কোন কোর্স করা আছে। চাকরি হবে কম জিপিএ ওলার। কারণ হলো, যে জব দিবে সে ভাববে কার পিছনে আমি কত ইনপুট এবং টাইম দিবো আর সে কতটুকু আইট-পুট কম সময়ে দিবে।
পরিবার/সমাজ/বন্ধু-বান্ধব কি বলবে?
–জীবনটা আপনার। আর সেটা একবারই। এক জীবন যদি অন্যদের স্বপ্ন আর সিদ্ধান্ত পূরণেই ব্যস্ত থাকেন, তবে সেটাকে নিজের জীবন বলার কোন মানে হয় না। আপনি অন্যের জীবন শুধু শরীরে বয়ে চলেছেন।
বেয়াদব তকমা লাগবে?
–কথা মিথ্যা না। আরো শুনবেন, “হ্যায় তো বেশি বুঝে, এই ডিসিশান নিলো আমাগো জিগাইলোই না।’। এ কথা গুলো আমাকে অনেক শুনতে হয়। কারণ অতি-সাধারণ, পারিবারিকভাবে আমাদেরকে নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নেয়ার জন্য উৎসাহিত করা হয়। তার স্বাধীনভাবে কাউকে না বলে সিদ্ধান্ত নেয়া অনেকে অপছন্দ এমনকি বেয়াদবি মনে করে। একবার একা গিয়ে নিজের জন্য শার্ট কিনে আনায় এক অল্প পরিচিত বন্ধু ব্যাপক ক্ষোভ দেখালো, তার মতে একা এক শার্টের সিদ্ধান্ত নেয়া মোটেও উচিত হয় নাই। আমার উত্তর ছিল, জীবনের প্রতি ক্ষেত্রে যদি অন্যের সিদ্ধান্তে চলতে হয়, তবে অতি-শীঘ্রই আমাকে টয়লেটে যাওয়ার আগে তোকে জিজ্ঞাসা করে যেতে হবে।
একটি ছেলে/মেয়ে এক একটি স্বপ্ন। সে স্বপ্নগুলো সুন্দর ফুলে রূপান্তরিত হবে যদি তাদেরকে তাদের পছন্দের পেশা গ্রহণ করতে দেয়া হয়। তাতে দেশ এবং জাতি সবারই মঙ্গল হবে।
পুনশ্চ: বড় পোষ্টের জন্য দু:খিত।