“পৃথিবীতে প্রাণ কীভাবে এসেছে?” – সর্বকালের অন্যতম চর্বিত ও চর্চিত প্রশ্নের তকমা এর গায়ে সেঁটে দিলেও ভুল হবে না। তা সত্ত্বেও এর যথার্থ উত্তর দেওয়া এখন অব্দি সম্ভব নয় কেননা আমরা পিছনে ফিরে প্রাণ উদ্ভবের ধারাবাহিক ঘটনাগুলো অবলোকন করতে পারি না। তবে উত্তর পাবার তৃষ্ণা মেটাতে উপস্থাপন করতে পারি নানা তত্ত্ব এবং তা দিয়ে প্রাণের উদ্ভব ব্যাখ্যা করার উপায় খুঁজতে পারি। আজকের এই লেখায় তাই আমরা প্রাণ কী তা বোঝার চেষ্টা করব ও খুব সরল এবং সহজবোধ্যভাবে পৃথিবীতে প্রাণ আসার যে প্রস্তাবিত পন্থা সেগুলোর উল্লেখযোগ্য কয়েকটি এক এক করে দেখতে সচেষ্ট হব। 😀

 

আচ্ছা, প্রাণ কাকে বলে?

তুমি নিজেই চেষ্টা করে দেখ প্রাণের একটা সংজ্ঞা লেখার, দেখবে কেমন যেন বেকায়দায় পড়ে গেছ। 😛 এটা স্বাভাবিক, সর্বযুগের লোকেরাই এটা নিয়ে ধন্দে ছিলেন এবং আছেন। তারপরও আমরা জীবিত সবকিছুর সাধারণ বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত করে বলি যে এগুলো থাকার অর্থ হলই “প্রাণ” থাকা। সুতরাং প্রাণের কোনো সংজ্ঞা আদতে দেওয়া যায় না, বরং এর দরুণ যে ধর্মগুলো জীব লাভ করে তা দিয়ে একে ব্যাখ্যা করতে হয়।

কোনো কিছু জীবিত হলে তার যে সাধারণ ধর্মগুলো আমরা দেখতে পাই সেগুলো হল –

  • জীবমাত্রই এক বা একাধিক কোষ দিয়ে তৈরি। মানবে, না মানবে না? না মানার পিছনে যুক্তি হতে পারে – “ভাই, কোষ কি জীবনে দেখেছি বলেন?” 😕
  • জীব সংবেদনশীল। অর্থাৎ তাদের অনুভূতি আছে। এটা বোঝার ব্যবস্থা তোমার কাছেই আছে। রান্নাঘরে গিয়ে ফুটন্ত পানিতে একটা হাত ডুবাও, দু’টোই ডুবালে আরো ভাল। ভালই লাগে, তাই না?
  • জীবিত সকলে শক্তি পরিপার্শ্ব থেকে গ্রহণ করে এবং তা ব্যবহার করে। সবুজ উদ্ভিদের সালোকসংশ্লেষণ এর খুব ভাল একটি উদাহরণ।
  • সময়ের সাথে জীবের বৃদ্ধি ঘটে। বহুকোষী প্রাণী ও উদ্ভিদদের ক্ষেত্রে এটা আমরা বেশ ভালভাবেই পর্যবেক্ষণ করতে পারি।
  • জীবের প্রজনন ঘটে, প্রজননের কারণে হয় সংখ্যাবৃদ্ধি। এটার এক্সপেরিমেন্ট নিজের ক্ষেত্রে করতে হলে কিছু পারিবারিক অনুষ্ঠানাদির দরকার আছে অবশ্য।
  • জীব নিজের দেহের ভেতরের একটা স্থিতিশীল অবস্থা বজায় রাখতে চায়, যে প্রক্রিয়াটাকে বলে হোমোস্ট্যাসিস (Homeostasis)। যেমন ধর, তুমি হঠাৎ খুব বেশি পানি পান করা শুরু করলে। এতে তোমার রক্তের তারল্য বেড়ে যাওয়ার আশংকা আছে অর্থাৎ রক্তে পানির পরিমাণ বেড়ে তার ঘনত্ব কমে যেতে পারে। এমতাবস্থায় তোমার শরীর নানা রেগুলেশনের মাধ্যমে পানির পরিমাণ কমাতে আরম্ভ করবে। কিডনি বেশি বেশি করে পানি ছেঁকে নেবে রক্ত থেকে আর মূত্র তৈরি হতে থাকবে বেশি পরিমাণে – এটাই হোমোস্ট্যাসিস।

এ তো গেল পয়েন্ট আকারে কেতাবী কথাবার্তা উপস্থাপন 😛 এগুলো মনে রাখতে তোমার গলা টিপে ধরছে না কেউ, নির্ভার হয়ে গল্পের মত লাইনের পর লাইন পড়লেই হবে। নির্ভার হয়ে পড়লেই তো আসল শেখা শেখা হয় 😀

আরেকটা কথা যোগ করতে চাই উপরের পয়েন্টগুলোর সাথে। আমরা জানি জীব মানেই কোষনির্মিত এবং এই কোষের ভেতরে থাকে ঘন, জেলির মত অর্ধতরল সাইটোপ্লাজম। আমরা যারা পরীক্ষার খাতায় কোষের চিহ্নিত স্থিরচিত্র অংকন করি তাদের এমন ধারণা থাকা খুবই সঙ্গত যে কোষ যেমন স্থির আঁকা হয় তেমনভাবেই বুঝি সারাটিক্ষণ থাকে। কিন্তু প্রকৃতভাবে, কোষের ভেতর সাইটোপ্লাজম সর্বদা ঘূর্ণায়মান অবস্থায় থাকে (Cytoplasmic streaming), আর তার সাথে আবর্তন করতে থাকে কোষ অঙ্গাণুগুলো। এ নিয়ে একটা ভিডিও দেখে আসলে মন্দ হয় না। 😉

যাহোক, যে কথাটা বলতে চাচ্ছিলাম সেটা আসলে আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষকের বলা। তিনি এই সাইটোপ্লাজমের কোষাভ্যন্তরে ঘুরতে থাকা বা streaming কে প্রাণের আরো একটা গুরুত্বপূর্ণ ফিচার বলে উল্লেখ করতে চেয়েছেন। বক্তব্যটা নেহাৎ ফেলনা নয়। কোষ জীবিত থাকলে এই স্ট্রিমিং যে চলবেই!

আমাদের আলোচনায় আমি কিন্তু খুব কৌশলে ভাইরাসের কথা বাদ দিয়েছি কেননা তাকে টেনে এনে আমি বিপদ (একইসাথে বিতর্কে) বাড়াতে চাই না। উপরে যা বলা হয়েছে তাতেই বুঝতে পারা যায় ভাইরাস পূর্ণাঙ্গভাবে জীব নয়, সে কেবল জীবের কতগুলো বৈশিষ্ট্য ধারণ করে। অনেকের মতে তাই ভাইরাস জীব এবং জড়ের মধ্যে যোগসূত্র স্থাপনকারী সত্তা।

এবার আমরা প্রবেশ করতে যাচ্ছি প্রাণের উদ্ভব সংক্রান্ত প্রস্তাবনাগুলোর ভিতরে। একে একে শুরু করা যাক তবে।

ঐশতত্ত্ব (Special Creation)

এই পৃথিবী এবং তাতে থাকা জীব জড় সকল কিছু তো বটেই, সমগ্র মহাবিশ্বের একজন সৃষ্টিকর্তা আছেন – পৃথিবীর সকল ধর্মের মূলে নিহিত আছে এই বক্তব্যটি। অবাক লাগতে পারে এটা ভেবে যে, বিজ্ঞানের আলোচনার সাথে ধর্মীয় বিশ্বাস কেন টেনে আনা হচ্ছে? এর কারণ হল বিজ্ঞানীরা আর অন্য দশটা প্রস্তাবনার মত এটাকেও প্রাণ সৃষ্টির একটা তত্ত্ব হিসেবে বিবেচনা করতে চান (যদিও এটা পরীক্ষা নিরীক্ষা করে ভুল বা শুদ্ধ প্রমাণের ব্যবস্থা নেই)।

বাইবেলে বলা আছে, ঈশ্বর ছয়দিনে এই পৃথিবী সৃষ্টি করেন এবং সপ্তম দিনে বিশ্রাম নেন। তিনি প্রথম মানুষ হিসেবে সৃষ্টি করেন আদমকে, অতঃপর আদমের পাঁজর থেকে তার স্ত্রী হবাকে। সনাতন ধর্মমতে প্রথম মানুষ ছিলেন মনু ও অর্ধঙ্গী শ্রদ্ধা। সকল সভ্যতার উপাখ্যানেই প্রথম মানব মানবীদের এরকম বিভিন্ন নামকরণ করা হয়েছে। অর্থাৎ, ধর্মমতে প্রাণ সর্বশক্তিমানের সৃষ্ট। পরীক্ষণের ভিত্তিতে যাচাই করার সুযোগ নেই বিধায় অনেকেই এ তত্ত্ব গ্রহণ করতে চান না।

প্রাণের মহাজাগতিক উদ্ভব (Extraterrestrial Origin or Panspermia)

প্রাণের উদ্ভব মোটেই এই পৃথিবীতে হয় নি। মহাকাশে থাকা অজস্র গ্রহাণুপুঞ্জ কিংবা মহাজাগতিক ধূলিতে জটিল জৈব অণূসমূহ ছিল এবং সেগুলোই পৃথিবীতে পতিত হয়ে পরবর্তীতে প্রাণের সূচনা করে (জীব মাত্রই অসংখ্য জৈব অণুর সমষ্টি)। অনেকে আরেক কাঠি এগিয়ে বলতে চান মহাকাশের এসব বস্তুতেই হয়ত প্রাণের অস্তিস্ত্ব ছিল। প্রাণের ভৌত ভিত্তি হিসেবে আমরা যে প্রোটোপ্লাজমকে (protoplasm) আখ্যায়িত করি সেটাই নাকি অণুবীজ বা স্পোর (spore) আকারে ঘুরে বেড়াত মহাকাশজুড়ে। পৃথিবীর জন্মলগ্ন থেকে যে অগণিত উল্কাপাত হয়েছে তার সাথে এই স্পোর এসে প্রাণের আরম্ভ ঘটায় পৃথিবীতে। অতঃপর এককোষী জীব থেকে শুরু করে আস্তে আস্তে জটিল থেকে জটিলতর গঠন নিতে থাকে জীবসমূহ এবং উদ্ভব ঘটে নানা প্রজাতির। বিখ্যাত রসায়নবিদ আরহেনিয়াসও (অম্ল-ক্ষারকের মতবাদের জন্য যিনি বিখ্যাত) এই তত্ত্বে বিশ্বাসী ছিলেন এবং মনে করতেন জীবনের এই চিহ্নগুলো মহাশূন্যে ছড়িয়ে আছে এবং তাই পৃথিবীর বাইরেও প্রাণের অস্তিস্ত্ব রয়েছে অবশ্যই।

কিন্তু প্রশ্ন হল, মহাকাশের ঐ স্বল্প তাপমাত্রায়, শুষ্কতায় কিংবা রেডিয়েশনে জীবিত কিছু বা তার স্পোর বেঁচে থাকার সম্ভাবনা তো শূন্যেরও নিচে। তার উপর উল্কাপাতে যে প্রখর তাপমাত্রা তৈরি হয় তাতেই বা কীভাবে এগুলো জীবিত থাকবে? এটাও ভুলে যাওয়া চলবে না যে আমরা এখনো পৃথিবীর বাইরে প্রাণ খুঁজে পাবার কোনো শক্ত প্রমাণ পাই নি।

তবে এই তত্ত্বজড়িত অনেক ইন্টারেস্টিং ঘটনাও আছে। ২০০১ সালে ভারতের কেরালায় দুই মাসব্যাপী লাল বৃষ্টি বা রক্ত বৃষ্টি (Red Rain or Blood Rain) হয়। বৃষ্টির পানির নমুনা সংগ্রহ করে দেখা যায় এতে এমন অণুজীব আছে যাতে কোষপ্রাচীর বহুস্তরী এবং এ কারণে এদের সাধারণভাবে অণুজীব বলে শনাক্ত করাও কষ্টকর। চাঞ্চল্যকর তথ্য হল, এই অণুজীবগুলো উচ্চ তাপমাত্রায় অস্বাভাবিক উচ্চহারে বিভাজনক্ষম। কয়েকজন বিজ্ঞানী তাই ঘোষনা দিয়ে বসেন এই অণুজীবগুলো নির্ঘাত মহাশূন্য থেকে আসা প্রাণ। এরপর রক্তবৃষ্টি আরো কয়েকবার হানা দিয়েছে ঐ অঞ্চলে। সর্বশেষ শ্রীলংকাতেও ২০১২ সালে ঘটেছে এই ঘটনা। তবুও রক্ত বৃষ্টি এখনো অমীমাংসিত এক রহস্যই থেকে গেছে।

1119412744

লাল বা রক্ত বৃষ্টিতে সৃষ্ট বন্যা, কেরালায়

 

প্রাণের স্বতঃস্ফূর্ত সৃষ্টি (Spontaneous Generation or Abiogenesis)

জীবদের সৃষ্টি হয়েছে সম্পূর্ণ জড় বস্তু থেকে। পৃথিবীতে থাকা বিবিধ অণু নানা পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে তাদের স্থিতিশীলতা বাড়ায় এবং ঐ পরিবেশে (উচ্চতাপ, বজ্রপাত, উল্কাপাত) একে অপরের সাথে সংঘবদ্ধ হয়ে জটিল গঠন লাভ করতে থাকে। এসব রূপান্তরের মাধ্যমেই হয়ত সৃষ্টি হয় প্রথম কোষ, যা থেকে কালের পরিক্রমায় জন্ম নেয় পৃথিবীর সকল জীব। অনেক বিজ্ঞানীই এই তত্ত্বটিকে প্রাণের উদ্ভব ব্যাখ্যা করার জন্য বেশ সহায়ক বলে মনে করেন।

উপরে যে কথাগুলো বলা হল, এগুলো বিজ্ঞানসম্মত বলেই লোকে এতে সায় দেয়। মিলার-উইরে (Miller-Urey) নামের দুই গবেষক নিম্নভাবে একটা পরীক্ষণ সাজিয়ে দেখান যে সত্যিই পানি, মিথেন, অ্যামোনিয়ার মত সরল অণু থেকে জটিল জৈব অণু প্রস্তুত সম্ভব ছিল আদিম, উত্তপ্ত ও রুক্ষ পৃথিবীতে।

2000px-Miller-Urey_experiment-en.svg

Miller-Urey Experiment. Image Courtesy : Wikipedia

তবে প্রাচীনকালে লোকেদের Abiogenesis সম্পর্কে যে ধারণা ছিল তা একেবারেই গাঁজাখুরি মনে হতে পারে। এই যেমন : মিশরীয়দের ধারণা ছিল নীল নদের কাদার উপর সূর্যশক্তি এসে পড়াতেই তা থেকে সৃষ্টি হত সাপ, ব্যাঙ, কুমির। ভ্যান হেলমন্ট (১৫৭৭-১৬৪৪) নামের এক লোক মতপ্রকাশ করেছিলেন যে মানুষের ঘাম আর শস্যদানা থেকে ইঁদুর জন্মাতে পারে। পরবর্তীতে অষ্টাদশ, ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীতে অনেক মেধাবী বিজ্ঞানীরা পরীক্ষণের মাধ্যমের এই ধারণা ভুল প্রমাণ করেন। মহান বিজ্ঞানী লুই পাস্তুরের ডিজাইন করা এই বিখ্যাত পরীক্ষণটা সামান্য বুদ্ধি থাকলেই দেখে আসতে পারো মজা করে 😛

প্রাণ চিরন্তন (Eternity of Life)

প্রাণের উদ্ভব নিয়ে আমাদের শেষ তত্ত্ব হতে যাচ্ছে এটা। ১৮৮০ সালে প্রেয়ের নামক ভদ্রলোক দ্বারা উপস্থাপিত এই তত্ত্বটা অনেকটা শক্তির সংরক্ষণশীলতা নীতির মত। এই প্রস্তাবনা অনুযায়ী পৃথিবীতে আদিতেও প্রাণ ছিল, আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে; অর্থাৎ প্রাণের কোনো শুরু বা শেষ নেই। জীবগুলো কেবল এক রূপ থেকে অন্য রূপে পরিবর্তীত হয়, অর্থাৎ তাদের প্রাণ অবিনশ্বর। ব্যাপারটাকে পুনর্জন্মের সাথে সম্পর্কিত করা যায়।

তবে আমরা এখন জানি, আমাদের এই পৃথিবী নিজেই অনন্তকাল ধরে বিরাজ করছে এমনটা নয়। তাহলে যখন পৃথিবী ছিল না, তখন জীবগুলো ছিল কোথায়?

আজকের মত শেষ করছি এখানেই। তোমাদের সকল ধরণের মতামত ও পরামর্শ জানতে অপেক্ষামান হয়ে রইলুম 😀 ধন্যবাদ।