সূর্য – আমাদের সকল শক্তির একমাত্র উৎস হলেও বাস্তবে এটি মহাবিশ্বের ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন তারার মধ্যে নগন্য একটি তারা মাত্র। তারপরও একে কেন্দ্র করেই আমাদের সবকিছু। সূর্য কেন্দ্রিক আমাদের এ সৌর জগতের অনেক রহস্যই এখনও অমীমাংসিত। এমনকি আমাদের পৃথিবী সৃষ্টি নিয়েও রয়েছে বেশ কয়েকটি থিওরি; যার কোনটিই ফেলনা নয়। তারপর ধরুন, মেরু অঞ্চলের Aurora, এর জন্যও কিন্তু আমাদের সূর্যই দায়ী 😯 । এত রহস্যের আধার এই সৌরজগত বারে বারে আমাদের ভাবিয়ে তোলে, টেনে নিয়ে যায় রহস্যময় কিছুর সন্ধানে।
এই রহস্যময় সৌরজগত নিয়েই আমরা কয়েক পর্বে আলোচনা করব; জানব অনেক অদ্ভুত-অজানা খবর। সূর্য থেকেই যেহেতু সবকিছুর শুরু, তাহলে সূর্য দিয়েই শুরু করা যাক।
সূর্যের ইতিহাসঃ
আজ হতে ৫০০ কোটি বছর আগের কথা, মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির কোন এক কোণে মহাকর্ষের প্রভাবে জমাট বাধতে শুরু করে শীতল হাইড্রোজেন, হিলিয়াম সহ আরো কিছু পরমাণু। তারা যত কাছাকাছি আসে, তত আরো বেশি করে কাছে আসতে চায়; কারণ, দুরুত্ব কমার কারণে তাদের মধ্যকার মহাকর্ষও বাড়তে থাকে। এবং একই সাথে কাছাকাছি আসার কারণে তাদের মধ্যে সংঘর্ষও আগের চেয়ে বাড়তে থাকে। যত বেশি সংঘর্ষ হতে লাগল, তত বেশী তাপমাত্রা বাড়তে থাকল। এভাবে বাড়তে বাড়তে তাপমাত্রা যখন ১০ লক্ষ কেলভিন এ পৌঁছায় তখন অত্যধিক তাপ, চাপের প্রভাবে শুরু হয় নিউক্লীয় ফিউশন। এই নিউক্লীয় বিক্রিয়ায় প্রচন্ড শক্তি বিকিরিত হতে লাগল এবং তা বাইরের দিকে চাপ দিতে লাগল। এবং এক পর্যায়ে যখন বিকিরিত শক্তি থেকে এই বহির্চাপ এবং মহাকর্ষীয় সংকোচন সমান হল, তখন সাম্যাবস্থা সৃষ্টি হল। এই সুস্থির অতিকায় বস্তুই আমাদের সূর্য। এই অস্থিরতা থেকে সুস্থির হওয়ার এ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতেও লাগে কোটি কোটি বছর।
সুস্থির হওয়ার পর একনাগাড়ে সূর্য তার হাইড্রোজেন কে জ্বালানী হিসেবে ব্যবহার করে নিউক্লীয় ফিউশন ঘটিয়ে আসছে এবং ফলে বিকিরিত হচ্ছে বিপুল পরিমাণ শক্তি। এই বিকীর্ণ শক্তি দিয়েই চলছে সৌরজগত; চলবে যতদিন না জ্বালানী ফুরোয়।
সূর্যের গ্রহ (৮ টি):
Planet |
Distance(000 km) |
Radius(km) | Mass(kg) |
Mercury | 57,910 | 2439 | 3.30e23 |
Venus | 108,200 | 6052 | 4.87e24 |
Earth | 149,600 | 6378 | 5.98e24 |
Mars | 227,940 | 3397 | 6.42e23 |
Jupiter | 778,330 | 71492 | 1.90e27 |
Saturn | 1,426,940 | 60268 | 5.69e26 |
Uranus | 2,870,990 | 25559 | 8.69e25 |
Neptune | 4,497,070 | 24764 | 1.02e26 |
৮ টা গ্রহ! তাহলে প্লুটো এখানে নেই কেন 🙄 ? প্লুটো কি তবে গ্রহ নয় 😯 ?? জানতে হলে পড়তে হবে মুনতাসিরের লেখা যে কারণে গ্রহ নয় প্লুটো
যাই হোক, আমরা এসব গ্রহ নিয়ে বিস্তারিত দেখব আগামী কয়েক পর্বে। আজকে আমরা শুধু সূর্য নিয়েই আমাদের আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখব। প্রথমে সূর্যের বায়োডাটা দেখে নেই, এরপর কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্য নিয়ে আলোচনা করব।
এক নজরে সূর্যঃ (সুবিধা’র জন্য তথ্যগুলো পয়েন্ট আকারে দেয়া হল)
- বয়সঃ ৪৬০ কোটি বছর।
- অবস্থানঃ মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি (ছায়াপথ) এর কেন্দ্র থেকে ২৫ হাজার আলোক বর্ষ দূরে। পৃথিবী থেকে এর গড় দূরত্ব ১৫ কোটি কিলোমিটার।
- উপাদানঃ ৭৪ ভাগ হাইড্রোজেন, ২৫ ভাগ হিলিয়াম, ১ ভাগ অন্যান্য
- আবর্তনকাল (ছায়াপথের চারদিকে): ২৫ কোটি বছরের একবার ছায়াপথকে একবার ঘুরে আসে। এই ঘূর্ণনের বেগ ২১৭ কিমি/সেকেন্ড
- আবর্তনকাল (নিজ অক্ষের চারদিকে): ২৫ দিন, ৯ ঘন্টা,৭ মিনিট ১২ সেকেন্ড। নিজ অক্ষের উপর এর ঘুর্ণন গতি প্রায় ৭১৭৪ কিমি/ঘন্টা।
- তারার ধরনঃ হলুদ বামন
- ব্যাসঃ ১৩ লক্ষ কিমি ; আমাদের পৃথিবীর চেয়ে ১০৯ গুণ বেশি।
- ভরঃ ১.৯৮*১০৩০ কেজি ; পৃথিবীর ভরের চেয়ে ৩৩২,৯৫০ গুণ বেশী। আমাদের সৌরজগতের মোট ভরের ৯৯.৮ ভাগই হল সূর্য।
- আপেক্ষিক ঘনত্বঃ গড়ে ১.৪৮ প্রায়; তবে কেন্দ্রের ঘনত্ব প্রায় ১৫০,০০০ কেজি/মিটার৩ ।
- অভিকর্ষজ ত্বরণ (g এর মান, পৃষ্ঠে): ২৭৪ মি/সে২
- মুক্তিবেগ (সূর্যপৃষ্ঠ থেকে): ২০ লক্ষ কিমি/ঘন্টা
- তাপমাত্রাঃ ৫৫ হাজার ডিগ্রী সেলসিয়াস (বাহিরের পৃষ্ঠে), কেন্দ্রে ১৫০ কোটি ডিগ্রি সেলসিয়াস
- শক্তিঃ ৩৮৬ বিলিয়ন বিলিয়ন মেগা ওয়াট। প্রতি সেকেন্ডে ৭০ কোটি টন হাইড্রোজেন ৬৯.৫ কোটি টন হিলিয়ামে রূপান্তরিত হয়। এবং এই ৫০ লক্ষ টন ভর শক্তিতে রূপান্তরিত হয়। এই শক্তি কিন্তু গামা রশ্মি হিসেবে কেন্দ্র থেকে নির্গত হয়। কিন্তু কেন্দ্র থেকে বহির্ভাগে আসতে আসতে শক্তি অনেকটাই শোষিত হয়, ফলে দৃশ্যমান আলো হিসেবে দেখা যায়।
সূর্যের কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্যঃ
ডিফারেন্সিয়াল রোটেশনঃ সূর্য’র কেন্দ্র খুব ঘন কঠিন পদার্থের হলেও যত বাহিরের দিকে যাওয়া যায়, ততই ঘনত্ব কমতে থাকে। একদম বাহিরের দিকে গ্যাসীয় স্তর থাকে। এর ফলে সূর্যের ঘূর্ণন (নিজ অক্ষে) সব জায়গায় সমান নয়। সূর্যের কেন্দ্র এর ঘূর্ণন সূর্যের বাহিরের পৃষ্ঠের ঘূর্ণনের চেয়ে বেশী। এর ফলে কেন্দ্রের আবর্তনকাল ২৪-২৫ দিন হলেও বাহিরের পৃষ্ঠের আবর্তনকাল ৩০ দিনও ছাড়িয়ে যায়। এমনটা জুপিটারেও (বৃহস্পতি) দেখা যায়।
সৌর চক্রঃ সূর্যে বেশ কিছু চাক্রিক ঘটনা ঘটতে দেখা যায়। এবং অদ্ভুত ভাবে এ চক্রের সময় ১১ বছর। অর্থাৎ প্রতি ১১ বছর অন্তর এ ঘটনাগুলোর পুনরাবৃত্তি দেখা যায়। কেন ১১ বছর চক্রের স্থায়িত্ব তা নিয়ে কোন সুনিশ্চিত তথ্য এখন অবধি পাওয়া যায় নি। তবে ধারণা করা বিচ্ছিন্ন ও অসম চৌম্বক ক্ষেত্র এর জন্য দায়ী। সৌরকলঙ্ক, সূর্যের চৌম্বক ক্ষেত্র এবং সৌর ঝড়ে এই সৌর চক্র দেখা যায়।
সৌরকলঙ্কঃ এত সুন্দর চাঁদের গায়েই যখন কলঙ্ক আছে, তখন ভয়ঙ্কর সুন্দর সূর্যেও কলঙ্ক থাকবে ধরেই নেয়া যায়। সূর্যের দিকে গভীর দৃষ্টি দিলে যে কালো দাগ দেখতে পাওয়া যায় তাই সৌরকলঙ্ক। ১৬১১ খ্রিষ্টাব্দে গ্যালিলিও প্রথম টেলিস্কোপ দিয়ে সৌরকলঙ্ক প্রত্যক্ষ করেন। তবে তারও আগে চীনা জ্যোতির্বিদদের সৌরকলঙ্ক দেখার কথা জানা যায়। সূর্যের উপরিভাগের তাপমাত্রা প্রায় ৫৫০০ ডিগ্রী সেলসিয়াস। এ তাপমাত্রা সর্বত্র সমান নয়; কোথাও অনেক কম, কোথাও বেশি। বেশি তাপমাত্রার এলাকা থেকে তাপ কম তাপমাত্রার এলাকায় আসলে অনেক তাপ শোষিত হয়। ফলে কম তাপমাত্রার এলাকা গুলো কালো দেখায়; যা সৌরকলঙ্ক নামে পরিচিত। সৌরকলঙ্ক বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে হতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে ৫০ হাজার কিমি পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। সৌর কলঙ্কের গভীর কালো অংশকে বলা হয় প্রচ্ছায়া (Umbra) আর একে ঘিরে যে হাল্কা ছায়া দেখা যায় তাকে বলে উপচ্ছায়া (Penumbra) ।
সৌর কলঙ্কের ক্ষেত্রে সৌর চক্র অনুযায়ী প্রতি ১১ বৎসর পর পর এই সৌর কলঙ্কের দাগের সংখ্যা ০ থেকে বেড়ে ২৫০ পর্যন্ত হয়, আবার কমে ০ এ ফিরে আসে। এভাবে প্রতি ১১ বছর পর পর এ ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে। সৌরকলঙ্ক অপেক্ষাকৃত কম তাপমাত্রার হলেও এর চৌম্বককক্ষেত্র অনেক বেশী হয়।
সূর্যের চৌম্বক ক্ষেত্রঃ সূর্যের চৌম্বক ক্ষেত্র পৃথিবীর চেয়ে প্রায় দ্বিগুন এর মত। কিন্তু খুব ঘন সন্নিবিষ্ট এলাকায় এ চৌম্বক ক্ষেত্র পৃথিবীর চেয়ে ৩০০০ গুণ বেশী পর্যন্ত হতে পারে। সূর্যের চৌম্বক ক্ষেত্র এর এরকম অসম বিস্তৃতির মূল কারণ ডিফারেন্সিয়াল রোটেশন। সৌর কলঙ্ক এর এলাকায় চৌম্বক ক্ষেত্রের মান অস্বাভাবিক বেশী হয়ে থাকে। সৌর চক্র অনুযায়ী প্রতি ১১ বছর পর পর সূর্যের চৌম্বক ক্ষেত্রের পোলারিটি রিভার্স হয় (সম্পূর্ণ বিপরীত হয়)।
Solar Wind, Solar Flares, CME/Solar Storms :
আলো ও তাপ ছাড়াও সূর্য থেকে অসম ও বিচ্ছিন্ন চৌম্বক ক্ষেত্রের প্রভাবে প্রায়ই আয়নিত কণা (প্রধানত ইলেকট্রন ও প্রোটন) ছিটকে আসে। এই সকল আয়নিত কণা প্রায় ৪৫০ কিমি/সেকেন্ড বেগে সৌরজগতের মধ্য দিয়ে ছুটে চলে। এগুলো আপেক্ষাকৃত কম শক্তির। এদের Solar Wind বলা হয়।
আগেও বলেছি যে, প্রতি সৌর চক্রের (১১ বছর) একটা নির্দিষ্ট সময়ে সর্বাধিক সৌর কলঙ্ক দেখা যায় (২৫০ টি প্রায়)। এসময়ে সূর্য বেশ অস্থিরতা প্রদর্শন করে। এই সময়ে সূর্য থেকে খুব উত্তপ্ত আয়নিত প্লাজমা ছিটকে আসে – এদের বলে Solar Flares। এদের গতি প্রায় আলোর গতির কাছাকাছি, এরা সবদিকে ছড়িয়ে পড়ে। এরা এসে পৃথিবীর আয়নমণ্ডলে আঘাত হানে; তবে পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্রের প্রভাবে আর ভেতরে আসতে পারে না। তবে তবুও কিছু কিছু প্রভাব দেখা যায়। যেমন, এ সময় পৃথিবীর রেডিও বার্তা বিঘ্নিত হতে থাকে। এছাড়া ছোট ছোট গ্রহাণুপুঞ্জ এবং স্পেসশিপ এর উপর এর মারাত্মক প্রভাব পড়ে।
যখন খুব বেশী মাত্রায় আয়নিত প্লাজমা নির্গত হয় এবং কণাগুলো চুম্বকিতও হয়ে পড়ে, তখন সূর্য থেকে বিপুল পরিমাণ এ চুম্বকিত ও আয়নিত প্লাজমা ছিটকে আসে। এর গতি কিছুটা কম। একে বলা হয় CME (Coronal Mass Ejections) কিংবা Solar Storms। এই CME এর প্রভাব অন্য ২ টির চেয়ে বেশী পড়ে পৃথিবীতে।
CME’ র চুম্বকিত ও আয়নিত প্লাজমা কণা পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্র দ্বারা আকৃষ্ট হয়; এবং পৃথিবীর ২ মেরুর দিকে ধাবিত হয়। সেখানে বায়ুর অক্সিজেন ও নাইট্রজেন এর সাথে CME প্লাজমা’র সংঘর্ষ/বিক্রিয়া ঘটে। এবং এর ফলেই দেখা যায় নয়নাভিরাম দৃশ্যঃ Aurora ।
হ্যা, ঠিক তাই। পৃথিবীর ২ মেরুর এই বিরল দৃশ্য Aurora Borealis (উত্তর মেরু’তে) Aurora Australis ( দক্ষিণ মেরু’তে) ঘটার মূল কারণ CME। নিচে Aurora’র চিত্রঃ
আরও জানতে পড়তে পারেন Aurora ।
CME এর সর্বাধিক নিঃসরণ প্রতি সৌর চক্রে (১১ বছরে) এক বার হয়। তার মানে এই Aurora ও ১১ বছরে একবার পরিপূর্ণভাবে দেখা যায়। এবং দুঃখের বিষয় সর্বশেষ Aurora পরিপূর্ণভাবে দেখা গেছে ২০১৩ সালে 🙁 । তারমানে আবার ২০২৪ সালে দেখা যাবে 🙂 ।
সূর্য নিয়ে এতটুকুই। আগামী পর্বে আমরা গ্রহ নিয়ে আলোচনা করব। সেই পর্যন্ত ভাল থাকুন, স্বশিক্ষার সাথেই থাকুন 🙂 ।
রেফারেন্সঃ
- SolarFacts
- NASA
- Space.com
- CERN
- Iyakov Perelman
- Ishaque
You did a great job!