এসি কারেন্ট-ডিসি কারেন্ট এর উৎপাদন, এসি থেকে ডিসি, এসি-ডিসি কারেন্টের মান- গ্রাফ ইত্যাদি সম্পর্কে জানতে প্রথম পর্ব (এসি কারেন্ট – ডিসি কারেন্ট [১]) এবং এসি-ডিসি কারেন্টের নিরাপত্তা ও ট্রান্সফর্মার সম্পর্কে জানতে দ্বিতীয় পর্ব [এসি কারেন্ট-ডিসি কারেন্ট [২]: বিপদজনক কারেন্ট ও ট্রান্সফর্মার] পড়ে আসতে পারেন।

আজকে আমরা দেখবঃ

ক্যাপাসিটর কোন কারেন্টে কাজ করে- এসি কারেন্টে নাকি ডিসি কারেন্টে, নিকোলা টেসলা এবং টমাস আলভা এডিসন এর কারেন্ট যুদ্ধ, এসি কারেন্ট ডিসি কারেন্ট এ চালিত যন্ত্রাদি এবং নতুন ধরনের কারেন্ট হাই ভোল্টেজ ডিসি কারেন্ট (HVDC) এর সম্ভাবনা…

ক্যাপাসিটর এসি’তে কাজ করে, নাকি ডিসি’তেঃ

ক্যাপাসিটর হল চার্জ জমা রাখার একটা ডিভাইস। এ নিয়ে বিস্তারিত জানতে পড়ে আসতে পারেন আমাদের সাদমান সাকিবের লেখা  ক্যাপাসিটর – ধারকত্ব – ১

212

চিত্রঃ ডিসি ব্যাটারির সাথে ক্যাপাসিটর

 

উপরের চিত্রে, ধরুন ডিসি ব্যাটারির (ভোল্টেজ V) সাথে আমাদের ধারক সংযুক্ত। এখন ব্যাটারির পজিটিভ প্রান্ত থেকে পজিটিভ চার্জ এবং নেগেটিভ প্রান্ত থেকে নেগেটিভ চার্জ ধারকের ২ পাতে জমা হতে থাকবে। এভাবে চার্জ জমা হবে ধারক। এখন দেখুন যতই চার্জ জমা হচ্ছে ২ প্রান্তে, ততই তাদের মধ্যে বিভব পার্থক্য বাড়ছে। বাড়তে বাড়তে এক সময় এই বিভব আমাদের ব্যাটারির বিভব (V) এর সমান হয়ে যাবে। এবং তখনই বিদ্যুৎ প্রবাহ বন্ধ হয়ে যাবে। ফলে চার্জ জমা করে কোন লাভই হচ্ছে না।

 

ee

চিত্র-১ঃ বামে + চার্জ এবং ডানে – চার্জ জমা হয়েছে

erer

চিত্র-২ঃ বামে – এবং ডানে + চার্জ জমা হয়েছে

 

 

 

 

 

 

 

 

 

কিন্তু এসি কারেন্টের ক্ষেত্রে ভিন্ন ব্যাপার ঘটবে। (উপরের চিত্র ১,২ দ্রষ্টব্য) যেহেতু বার বার এসি কারেন্ট সোর্স এর পজিটিভ নেগেটিভ পরস্পর স্থান বদলায় তাই ধারকেও কোন একটা পাতে জমাকৃত পজিটিভ চার্জ একবার বামে তো আরেকবার ডানে জমা হবে, নেগেটিভ চার্জও বিপরীত পাতে জমা হবে।

আমরা জানি এসি কারেন্ট সেকেন্ডে ৫০-৬০ বার দিক বদলায়। তার মানে উপরের এই ডান-বাম আবার বাম-ডান সেকেন্ডে ৫০-৬০ বার ঘটবে। ফলে সেটা অনেকটা নিচের চিত্রের মত দেখাবে। তাই কোন একটা নির্দিষ্ট পাতে যথেষ্ট চার্জ জমা হয়ে বিভব পার্থক্য ব্যাটারির সমান করতে পারছে না, তার আগেই আবার অন্য প্রান্তে একই চার্জ জমা হচ্ছে (চিত্র) ।

sasd

চিত্রঃ ধারকে চার্জ জমা হওয়ার ঘটনা টা সেকেন্ডে ৫০-৬০ বার জায়গা বদল করবে

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

তাই আমরা ইচ্ছে মত ধারকে এসি কারেন্ট দিয়ে আমাদের কাজ আদায় করে নিতে পারি; যেহেতু এখানে কারেন্ট বন্ধ হয়ে যাচ্ছে না ডিসি’র মত। গাণিতিকভাবেও দেখানো যায় যে, ধারক শুধুমাত্র এসি কারেন্ট এ কাজ করে, ডিসি কারেন্ট এ নয়

 

‘এসি কারেন্ট বনাম ডিসি কারেন্টঃ  নিকোলা টেসলা বনাম টমাস আলভা এডিসন’:

300px-Tesla-vs-Edison

এই বিখ্যাত দ্বন্দ্ব কারেন্টের ইতিহাসে একটা মাইলফলক। আসলে এই দ্বন্দ্ব থেকেই এসি কারেন্ট ডিসি কারেন্ট এর মধ্যে একটা সাম্যবস্থা এসেছে।

সরাসরি আমাদের ঘটনায় চলে যাই, ১৮৮৪ সাল, তখন এডিসন এর ব্যাবসা রমরমা। ডিসি কারেন্ট এর বাতি, মোটর ইত্যাদি বানিয়ে সমানে বেচতেছেন উনি। এদিকে হতাশ নিকোলা টেসলা ঘুরতে ঘুরতে এসে ভিড়লেন এডিসনের কোম্পানীতে। এডিসনও জাত চিনল টেসলা’র; তাঁকে দায়িত্ব দিল ডিসি মোটর আপডেট করে নতুনভাবে ডিজাইন করার, পারলে ৫০ হাজার ডলার পুরষ্কার 😯 ।

এবং করেও দিল টেসলা, কিন্তু এডিসন কথা রাখেন নি। পুরষ্কার হিসেবে বেতন ১৮ ডলার থেকে ২৮ ডলারে উন্নীত করে দিলেন এই যা 😯 । রাগ করে টেসলা এডিসন এর কোম্পানী ছেড়ে যোগ দিলেন ওয়েস্টিংহাউজ এর কোম্পানীতে 👿 ।

এবং এখানে এসেই টেসলা এসি কারেন্ট নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। এবং খুব দ্রুতই সাফল্যর মুখ দেখেন 🙂 । ১৮৮৮ সালে এসি কারেন্টের প্রদর্শনী করে ব্যাপক সাড়া পান টেসলা। এমনকি ৬০০০০ ডলারের স্পন্সরশিপ এর অফার পান টেসলা। আর এসব গবেষণায় তাকে পৃষ্ঠপোষকতা করেন তার মালিক ওয়েস্টিংহাউস (ইনিও একজন আবিষ্কারক)।

এসব দেখে তো এডিসন এর মাথা গরম হয়ে গেল; কারণ, এসি কারেন্ট বাজার পেয়ে গেলে তার ব্যাবসা যে লাটে উঠবে। তাই তিনি মাঠে নামলেন এসি কারেন্ট এর অপপ্রচারের উদ্দ্যেশ্যে। তিনি জায়গায় লোক জড় করে দেখাতে লাগলেন এসি কারেন্টের ভয়াবহতা। তিনি এ উদ্দ্যেশ্যে কুকুর, বিড়াল এমনকি একটি সার্কাসের হাতি’কে লোকসম্মুক্ষে ইলেক্ট্রিক শক (এসি কারেন্ট) দিয়ে মেরে ফেললেন 😯 । সেখান থেকেই মূলত ইলেকট্রিক চেয়ার ব্যবহার শুরু হয়। এরপর থেকেই টর্চার করার জন্য ইলেকট্রিক চেয়ার জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।

কিন্তু সকল চেষ্টা বৃথা গেল। মানুষ ধীরে ধীরে বুঝতে শুরু করল এসি কারেন্টের মাহাত্ম। বুঝতে শুরু করল কীভাবে এসি কারেন্ট দিয়ে বিদ্যুৎ সরবরাহ করলে কীভাবে অনেক খরচ কমে যায়, অনেক শক্তি বেঁচে যায়।

এডিসন এর প্ল্যান ছিল এরকমঃ যেহেতু ডিসি কারেন্ট অনেক দূরদূরান্তে পাঠানোর ক্ষেত্রে অনেক শক্তি নষ্ট হয় এবং ভোল্টেজ ড্রপ করে; তাই প্রতি ১ বর্গকিলোমিটারে একটি করে ডিসি কারেন্ট সোর্স (বিদ্যুৎউৎপাদন কেন্দ্র) থাকবে, যা নিশ্চিত করবে মানুষের চাহিদা। কিন্তু এ অলীক চিন্তা যে কতটা অসম্ভব এবং উচ্চাভিলাষী তা সকলেই বুঝতে পেরেছিল।

তাই মানুষ দূরদূরান্তে কারেন্ট সরবরাহের সুবিধার কথা চিন্তা করে, এসি কারেন্টকেই বেছে নিল। এতে শক্তিও কম খরচ হবে, ভোল্টেজও ড্রপ করবে না। এভাবেই শুরু হল এসি কারেন্ট এর যুগ।

তবে এডিসনও কিন্তু জয়ী এ খেলায় । এখনকার বেশিরভাগ প্রায় ৮০-৮৫ ভাগ ইলেকট্রনিক সামগ্রীই চলে ডিসি কারেন্টে 💡  । মানে কি? এই বললাম এসি কারেন্ট এর যুগ, এখন আবার বলছি সব চলে ডিসি কারেন্টে? বিভ্রান্ত হওয়ার কিছু নেই? আচ্ছা পুরো কারেন্ট এর চক্র শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বলি, তাহলেই পরিষ্কার হবেঃ

প্রথমেই বিদ্যুতকেন্দ্র থেকে টার্বাইন ঘূর্ণনের মাধ্যমে এসি কারেন্ট উৎপাদন। উৎপন্ন ‘লো ভোল্টেজ হাই কারেন্ট’ থেকে স্টেপ আপ ট্রান্সফর্মার এর মাধ্যমে ‘হাই ভোল্টেজ লো কারেন্ট’ এ রূপান্তর; এবং এই আকারেই বহুপথ পাড়ি দিয়ে আমাদের শহরে আসে কারেন্ট (এতে শক্তি বাঁচে অনেক)। এরপর আবার স্টেপ ডাউন ট্রান্সফর্মার দিয়ে ‘লো ভোল্টেজ হাই কারেন্ট’ এ পরিবর্তন হয়; এবং সেই আকারেই আমাদের ঘরে এসে ঢুকে। এরপর ধরুন আপনি ফ্যান এর সুইচ অন করলেন, এসি কারেন্ট তার দিয়ে ফ্যান এ পৌঁছবে। এবং এসি  কারেন্ট ডায়োডের মাধ্যমে ডিসি কারেন্টে কনভার্ট হবে এবং সেই ডিসি কারেন্ট দিয়েই ফ্যান চলবে। একইকথা লাইটের জন্যও প্রযোজ্য। এবার আপনি ল্যাপটপ অন করলেন, আবার সেই একই এসি কারেন্ট এসে ঢুকবে আবার ল্যাপ্টপের অ্যাডাপ্টরে, সেখানে এসি থেকে ডিসি হবে ঐ একই ডায়োড এর মাধ্যমে; এবং ডিসি’তে ই চলে আপনার ল্যাপটপ ।

সরাসরি ডিসি’কারেন্ট এ চলেঃ মোবাইল ফোন, টর্চ লাইট, LED লাইট, CFL লাইট, ব্যাটারী চালিত যেকোন কিছু । সৌর বিদ্যুতেও কিন্তু সরাসরি ডিসি কারেন্ট উৎপন্ন হয়। তাই এক্ষেত্রেও কোন কনভার্টার লাগে না। সরাসরি এ বিদ্যুৎ দিয়ে যন্ত্রাদি চলে। তবে মোটর চালিত যন্ত্রাদি কিন্তু ডিসি’তে চলে না (আধুনিক যন্ত্রাদিতে এ সমস্যা নেই)।

সরাসরি এসি’কারেন্ট এ চলেঃ ট্রান্সফর্মার, মোটর ও কম্প্রেশর সম্পর্কিত যন্ত্রাদি; যেমন, মাইক্রো-ওয়েভস, ওয়াশার, ফ্রিজ, মোটর [মাইক্রো-ওয়েভস এ ট্রান্সফর্মার থাকে, আর ওয়াশারে মোটর এবং ফ্রিজে কম্প্রেশর থাকে]।

তবে বলে রাখি আধুনিক অনেক ফ্যান, লাইট সরাসরি এসি কারেন্টেও চলতে পারে । আরও আধুনিক ব্যাপার হচ্ছে নতুন নতুন অনেক সামগ্রীই এখন এসি ডিসি উভয়তেই চলতে পারে [হীটার, ইস্ত্রী, টোস্টার]।

অর্থাৎ আমরা এসি কারেন্ট সরবরাহের জন্য বেশি ব্যবহার করি, এবং ডিসি কারেন্ট বেশির ভাগ যন্ত্রপাতি চালাতে ব্যবহার করি। দুইটাই চলে সমান তালে। তবে যারা এই সিরিজ পড়তে পড়তে ভাবছেন সব ক্ষেত্রেই এসি কারেন্ট সেরা তাদের জন্য বলি,

বর্তমানে এসি কারেন্ট’কে রিপ্লেস করার জন্য অন্য একটা কারেন্ট এর কথা ভাবা হচ্ছে – সেটা হল ‘হাই ভোল্টেজ ডিসি কারেন্ট(HVDC)’ 💡 । এসি কারেন্ট বার বার কনভার্ট করতে গিয়ে বিপুল শক্তি অপচয় হয়, এটা রোধ করার জন্যই এই কারেন্ট এর কথা ভাবা হচ্ছে। HVDC দূর-দূরান্তে সরবরাহ করতেও সমস্যা হবে না; যেহেতু হাই ভোল্টেজ (কারেন্ট কম) তাই শক্তি খরচও কম হবে। জার্মানিতে HVDC ব্যবহার শুরু হয়ে গিয়েছে ইতোমধ্যে। এখন দেখার পালা সারা বিশ্বে আসতে কতদিন লাগে।

সেই পর্যন্ত স্বশিক্ষার সাথেই থাকুন  🙂  …ভালো থাকুন  🙂

[কোন ভুল থাকলে কিংবা প্রশ্ন থাকলে কমেন্টে জানিয়ে বাধিত থাকবেন ]

||প্রথম পর্বঃ এসি কারেন্ট – ডিসি কারেন্ট [১]

||দ্বিতীয় পর্বঃ এসি কারেন্ট-ডিসি কারেন্ট [২]: বিপদজনক কারেন্ট ও ট্রান্সফর্মার

References:

  • Arc-Flash and Electrical Shock Hazards – How to Keep Your Facility Compliant by Dennis K. Neitzel, CPE
  • Electric Shock: http://hyperphysics.phy-astr.gsu.edu/hbase/electric/shock.html
  • Electric Shock: http://en.wikipedia.org/wiki/Electric_shock
  • allaboutcircuits.com
  • youtube
  • google
  • Abdullah Ibn Mahmud
  • Khalded Mosharraf Mukut