আগের পর্ব গুলোতে মৌমাছি’র জীবনচক্র ও এর বেশ কিছু অদ্ভুত স্বভাব নিয়ে আলোচনা হয়েছে। আজ আমরা আলোচনা করব মৌমাছি’র সবচেয়ে বিস্ময়কর সৃষ্টি ‘মধু’ নিয়ে। আমরা পর্যায়ক্রমে দেখবঃ মৌমাছির মধু তৈরির প্রক্রিয়া, দেখব মধু’র জন্য মৌমাছি কীভাবে জীবন উৎসর্গ করে দেয়, খাঁটি মধু চেনার উপায়, এবং মধু’র উপকারিতা। সেই সাথে রয়েল জেলীর ব্যাপারেও আলোচনা হবে।

মৌমাছি কীভাবে মধু তৈরি করেঃ

মৌমাছি’র সমাজে বয়স অনুযায়ী কাজ ভাগ করা থাকে। মধু’র জন্য প্রয়োজনীয় উপাদান সংগ্রহের দায়িত্বে থাকে ২২ দিন কিংবা তার চেয়ে অধিক বয়সী কর্মী মৌমাছি’রা। এরা ফুল থেকে ফুলে উড়ে উড়ে ঘুরে ঘুরে ফুলের নির্যাস (Nectar) সংগ্রহ করে। নির্যাস হল একধরণের স্যুগার-সমৃদ্ধ তরল/জেলী, যা ফুলের নেক্টারিস গ্রন্থি থেকে নির্গত হয়। এই নির্যাস ফুলের পরাগেরেনুর উপর ছড়ানো থাকে; কীটপতঙ্গ, পশু-পাখি এই নির্যাস সংগ্রহের জন্য ফুল ফুলে ঢুঁ মারে। এতে ফুলের পরাগায়ন ঘটে। ফুলের লাভ এটাই।

এই নির্যাস দিয়ে মৌমাছি কি করে? এটা দিয়েই তারা মধু বানায়। এক একটা মৌমাছি প্রতিবার ভ্রমণে প্রায় ৩০-৫০টা ফুলের নির্যাস সংগ্রহ করে তাদের বিশেষ পাকস্থলী’তে জমা রাখে। উল্লেখ্য মৌমাছি’র শুধু মধু জমা রাখার জন্য আলাদা পাকস্থলী আছে। এই মধু মৌচাকে নিয়ে এসে অন্য কর্মী মৌমাছি’র মুখে ঢেলে দেয়। এরপর কর্মী মৌমাছি এই মধু’র সাথে কিছু এনজাইম মিশিয়ে তৈরি করে মধু। এই মধু বেশ পাতলা হয়; এরপর মৌমাছি পাখা নাড়িয়ে শুকিয়ে, এনজাইম মিশিয়ে এই মধু’কে জেলীর মত করে বানিয়ে কুঠুরিতে জমা করে। এবং এরপর কুঠুরীর মুখ সিলগালা করে দেয়। এই মধু শীতকালের জন্য সঞ্চিত থাকে। প্রথম পর্বের সুত্র ধরে আবারও মনে করিয়ে দেই, যে রাণী, পুরুষ এবং কর্মীর মধ্যে শুধু কর্মী মৌমাছিই মধু তৈরির সমস্ত প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করে। কর্মী মৌমাছির এক দল সংগ্রহ করে, আরেক দল মধু বানায়, আরেক দল জমা রাখে ইত্যাদি।

মধুর জন্য জীবন উৎসর্গঃ

এক-একটা কর্মী মৌমাছি মধু সংগ্রহের জন্য বের হলে আশে-পাশেড় ৫ কি.মি. জুড়ে প্রায় ৫০-১০০ টা ফুলে ঘুড়ে বেড়ায়। এবং ফুলে মধু আসার মৌসুমে (গ্রীষ্মে) এরা এতটাই পরিশ্রম করে যে, মাত্র ৬ সপ্তাহ বাঁচে। অথচ ভাটার মৌসুমে এরা প্রায় ৯ মাস বাঁচে। আক্ষরিক অর্থে এরা মধুর জন্য জীবন উৎসর্গ করে দেয়। এবং এক একটা তাজা প্রাণের বিনিময়ে গোটা জীবনে সংগৃহীত হয় মাত্র ১/১২ চামচ মধু।

১ কেজি মধুর জন্য,

১ কেজি মধুর নির্যাস সংগ্রহের জন্য ১১০০ কর্মী মৌমাছি প্রায় ৯০ হাজার মাইল পাড়ি দেয়, যেটা কিনা চাঁদের কক্ষপথের প্রায় ৩ গুন। এ পরিক্রমায় ১১০০ মৌমাছি প্রায় ৪০ লক্ষ ফুলে ঢুঁ মারে।

সব কিছু ঠিক থাকলে এক একটা মৌ-চাকে ভাল এক মৌসুমে প্রায় ৫৫ কেজি মধু জমা হয়। যা এদের প্রয়োজনের চেয়েও দ্বিগুণ বেশি।

যাই হোক, এত কষ্ট করে যে মধু উৎপন্ন হয় তা খুব সহজলভ্য হবে এমনটা ভাবা বোকামি। তাহলে এত মানুষের মধু’র চাহিদা পূরণ হয় কীভাবে? সুন্দরবন থেকে?

আসলে বাজারের বেশির ভাগ মধুই হল কৃত্তিম মধু। কৃত্তিম মধু হল গ্লুকোজ, ডেক্সট্রোস, মোলাসেস, স্যুগার সিরাপ, ইনভার্ট স্যুগার, ময়দা, ভুট্টা, স্টার্চ এবং এই ধরনের বিভিন্ন উপাদান দিয়ে তৈরি নকল মধু। এই মধু খেয়ে মজা পেলেও কাজের কাজ কিছুই হবে না। তাই আসল-নকল এর সমাহার থেকে খাঁটি মধু চিনে নেওয়া জরুরি। তো কীভাবে চিনবেন খাঁটি মধু? চলুন দেখা যাক,

 

কীভাবে চিনবেন খাঁটি মধুঃ

  • খাঁটি মধু’তে কখনও পিঁপড়ায় ধরে না 😯 । হ্যা, ঠিকই শুনছেন; কোন পোকা-মাকড়ই ধরে না। কারণ, মৌমাছি মধুতে এমন উপাদান ব্যবহার করে যাতে পিঁপড়া সহ কোন পোকা-মাকড়ই ধরতে না পারে।
  • খাঁটি মধু পানিতে দ্রবীভূত হয় না। এক চামচ মধু পানিতে দিলে যদি তলানীতে এসে জমা হয় তবে বুঝবেন খাঁটি মধু; আর পানিতে মিশে গেলে বুঝবেন কৃত্তিম মধু।
  • ডিমের কুসুম নিয়ে তার সাথে খাঁটি মধু মিশিয়ে ভাল মত নাড়লে ডিমের কুসুম প্রায় সিদ্ধ হওয়ার মত অবস্থায় পৌঁছাবে; কিন্তু কৃত্তিম মধু’র সাথে এই ঘটনা ঘটালে ডিমের কুসুম ডিমের কুসুমই থাকবে, কোন পরিবর্তন হবে না।
  • খাঁটি মধু ম্যাচে লাগানোর পর ম্যাচ জ্বালানোর চেষ্টা করুন; দেখবেন ঠিকই জ্বলবে। কিন্তু কৃত্তিম মধু লাগালে ম্যাচ নষ্ট হয়ে যাবে (ভরসা ম্যাচ ছাড়া, কারণ ভরসা ম্যাচ ভিজলেও জ্বলে 😛 ) । কারণ, কৃত্তিম মধু’তে প্রচুর পানি থাকে, যা খাঁটি মধু’তে থাকে না।
  • ব্রেডে কিংবা রুটিতে খাঁটি মধু মাখলে সেটা তৎক্ষণাৎ শক্ত হয়ে যায়; অন্যদিকে কৃত্তিম মধু ব্রেড কিংবা রুটি’কে সিক্ত করে। কারণ কৃত্তিম মধু’তে প্রচুর পানি থাকে।
  • খাঁটি মধু বেশ ঘন কিন্তু কম আঠালো থাকে; অন্যদিকে কৃত্তিম মধু বেশি আঠালো এবং পাতলা হয়।
  • খাঁটি মধু খেলে তৎক্ষণাৎ শরীর গরম হয়ে যায় এবং এর প্রভাব বেশকিছুক্ষণ থাকে। কৃত্তিম মধু’র ক্ষেত্রে মুখ অসম্ভব মিষ্টি হয়ে যাওয়া ছাড়া আর তেমন কোন প্রভাব দেখা যায় না।
  • খুব ভাল ঘ্রাণশক্তি থাকলে খাঁটি মধু’র থেকে ফুলের গন্ধও পাওয়া যায় (যে ফুল থেকে মধু তৈরি হয়েছে)।
  • অনেকদিন রাখলে খাঁটি মধু কেলাস গঠন করে, কৃত্তিম মধু তা করে না।
  • খাঁটি কাগজে এক ফোঁটা দিলে কাগজ ভিজে না, ভিজলেও শুকিয়ে যায় দ্রুতই; কারণ খাঁটি মধুতে পানি থাকে না বললেই চলে। কৃত্তিম মধু কাগজে দিলে, কাগজ ভিজে থাকে অনেকক্ষণ।

 

খাঁটি মধু দেখতে বেশ অপরিষ্কার এবং এতে পরাগরেণু ভাসতে দেখা যায়। এজন্য মধু প্রক্রিয়াজাতকরণ প্রতিষ্ঠান গুলো পরাগরেণু দূর করার জন্য মধু’কে পাস্তুরিত করে। এতে বেশ পরিষ্কার এবং উজ্জ্বল বর্ণের খাঁটি মধু পাওয়া যায়। তবে এই প্রক্রিয়ার সবচেয়ে বড় সমস্যা হল, পাস্তুরিত করার পর মধুর অনেক গুণাগুণই আর থাকে না। নিচের চিত্রঃ

shocking_differences_between_comparison61_n_6

 

একারণে একেবারে চাকভাঙ্গা খাঁটি অপাস্তুরিত মধুই সবচেয়ে উপকারী।

খাঁটি মধু’র স্বাস্থ্যগত উপকারিতাঃ

খাঁটি মধু’র স্বাস্থ্যগত উপকারিতা’র কথা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। সেই প্রাচীনকাল থেকেই মানুষ নানা কাজে মধু ব্যবহার করে আসছে। ৪০০০ বছর আগে থেকে ভারতে আয়ুর্বেদিক চিকিৎসায় মধু ব্যবহৃত হয়ে আসছে। কামাসূত্র’র সাথে মধুর গভীর যোগসাজেশ রয়েছে। নিম্নের রোগগুলোর জন্য মধু চিকিৎসা অব্যর্থঃ  ➡

  • ওজন কমানো
  • হাই-প্রেশার
  • ক্যান্সার
  • হার্ট-ডিজিস
  • অ্যান্টি-ছত্রাক
  • অ্যান্টি-ব্যাক্টেরিয়া
  • অ্যান্টি-এলারজিক
  • রূপচর্চা
  • আলসার
  • গ্যাস্ট্রিক
  • ঠান্ডা-কাশি
  • মাথার খুশকি ও চুল পরা
  • ইনসমনিয়া
  • স্মৃতি শক্তি বৃদ্ধি
  • কাটা-পোড়া দ্রুত আরোগ্য
  • শারীরিক শক্তি বৃদ্ধি
  • ডায়াবেটিস

ইত্যাদি’র জন্য মধু’র জুড়ি মেলা ভার।

একটা কমন প্রশ্ন যে, মধু তো মিষ্টি, তাহলে মধু খেলে ডায়াবেটিস বেড়ে যাবে কিনা? এর উত্তর হচ্ছে না। কারণ, ডায়াবেটিস বেড়ে যাওয়ার মূল কারণ স্যুগার এর পরিমাণ বেড়ে যাওয়া। কিন্তু খাঁটি মধু’তে যে প্রাকৃতিক স্যুগার থেকে তাতে ডায়াবেটিস বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। বরং রক্তে গ্লুকোজ রেগুলেট করতে সাহায্য করে। (ভিডিও দেখুন, বিশ্বাস না হলে  😛 )

 

রয়েল জেলীঃ

মধু’র স্বাস্থ্যগত উপকারিতা প্রসঙ্গ যখন এলই, তখন এই সুযোগে মানুষের জন্য উপকারী ও সম্ভাবনাময় রয়েল জেলীর কথাও শোনা যাক। রয়েল জেলী কি? রয়েল জেলী হল দুধের ন্যায় সাদা বস্তু, যা উৎপন্ন হয় কর্মী মৌমাছির মাথা’র মগজ থেকে। রয়েল জেলী নিষিক্ত ডিম হতে উৎপন্ন কর্মী মৌমাছি’দের খাওয়ানো হয় ৩ দিন পর্যন্ত। এরপর তাদের স্বাভাবিক খাবার (মধু,রেনু ইত্যাদি) খাওয়ানো হয়। আর মৌচাকের রাণী মৌমাছি’কে সারা জীবন এই রয়েল জেলি খাওয়ানো হয়। যার ফলে পুরো মৌচাকে রাণীই একমাত্র প্রজনন ক্ষমতা লাভ করে। এই রয়েল জেলী শুধু যে মৌমাছির জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে তা নয়, মানব জীবনে অন্যান্য প্রাণীর জীবনেও মৌমাছির রয়েল জেলী’র বিশেষ ভূমিকা রয়েছে; আছে বেশ কিছু যুগান্তকারী সম্ভাবনা। যেমন, বন্ধাত্ব্য মোচনে রয়েল জেলী’কে কাজে লাগানোর জন্য গবেষণা চলছে এছাড়া মানুষের অন্যান্য রোগ প্রতিরোধেও  রয়েল জেলী ব্যবহার করা যায় কিনা, সে ব্যাপারে  গবেষণা চলছে। এছাড়া রয়েল জেলী ক্যান্সার চিকিৎসায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে বিজ্ঞানীরা আশাবাদী।

পরিশেষে মধু তাজা খাবেন। রান্না করে মধু খাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য হানিকর। ভাল থাকবেন।  🙂

আগের দুই পর্বঃ

  1. মৌমাছি [১] – দ্য ড্যান্সিং ম্যাথমেটিশিয়ান আর্কিটেক্ট

  2. মৌমাছি [২] – মৌমাছির মিলন ও বংশ-পরম্পরা

 

রেফারেন্সঃ

  • allabouthoneys.com
  • realfoodforlife.com
  • Liquid Gold – Yan Markovich
  • google