এসি কারেন্ট এর উৎপাদন, এসি থেকে ডিসি, এসি-ডিসি কারেন্টের মান- গ্রাফ ইত্যাদি সম্পর্কে জানতে আগের পর্ব (এসি কারেন্ট – ডিসি কারেন্ট [১]) পড়ে আসতে পারেন।

আজকে আমরা বিস্তারিত দেখবঃ

কোন কারেন্ট বেশি বিপদজনক- এসি নাকি ডিসি , ট্রান্সফর্মার এর কাজ, ব্যবহার , কোন কারেন্টে ট্রান্সফর্মার কাজ করে ইত্যাদি

একইসাথে আমরা আগের পর্বের অমীমাংসিত প্রশ্নগুলোর ব্যবচ্ছেদও করব। এসি কারেন্ট ডিসি কারেন্ট নিয়ে আমাদের কিছু কমন প্রশ্নঃ

  1. এসি কারেন্ট এর সমস্যাটা কি? এত অস্থির কেন 😡 ? বারবার দিক বদলায় কেন 👿 ?
  2. এসি ডিসি এই ২ টা থাকা’র দরকার কি? যেকোন একটা থাকলেই সুবিধে হত না?
  3. কোনটা বেশি বিপদজনক? কোনটায় বেশি শক (শট  😛  ) লাগে?
  4. এসি থেকে ডিসি তে কনভার্ট করে কিভাবে?
  5. আমরা বাসা’য় (মেইন লাইন) এসি ব্যবহার করি কেন?
  6. বিদ্যুৎকেন্দ্রে এসি উৎপন্ন হয় নাকি ডিসি?
  7. কারেন্টের মেইন লাইনে ট্রান্সফরমার কি কাজে আসে?
  8. ট্রান্সফরমারে শুধু এসি ব্যবহৃত হয় কেন?
  9. ক্যাপাসিটরে (ধারকে) কি এসি ডিসি দুটোই চলে?

এর মধ্যে ১,৪,৬ নং এর উত্তর আমরা আগের পর্বেই আলোচনা করেছি। আজ বাকিগুলোর উত্তর খোঁজা যাকঃ

কোন কারেন্ট বেশি বিপদজনক (এসি নাকি ডিসি):

তার আগে বলুন, কোনটা বেশি বিপদজনক? বাসের ধাক্কা খেয়ে মরা নাকি ট্রাকের ধাক্কা খেয়ে মরা? এসি কারেন্ট ডিসি কারেন্ট এর ব্যাপারটাও ঠিক এমনি; দুটোই প্রাণঘাতী বিপদজনক। তারপরও তুলনা করার জন্য বেশ কিছু ফ্যাক্টর বিবেচনা করা যাক,

প্রথমত, এ ব্যাপারে আমাদের বইয়ে দেয়া উত্তরে আসি, সেখানে দেয়া এসি কারেন্ট বেশি বিপদজনক। কারণ, ডিসি কারেন্টে ১০০ অ্যাম্পিয়ার এর শক মানে ঠিক ১০০ অ্যাম্পিয়ারই (ডিসি কারেন্ট ধ্রুব থাকে), কিন্তু এসি কারেন্টে ১০০ অ্যাম্পিয়ারের (Irms)  শক মানে শুধুই ১০০ অ্যাম্পিয়ার নয়, এখানে কারেন্ট আপ-ডাউন করে। ফলে ১০০ অ্যাম্পিয়ার কারেন্ট এর ক্ষেত্রে সর্বাধিক ১৪১ (I0) অ্যাম্পিয়ার পর্যন্ত শক খেতে হবে আপনাকে। (I0, Irms  না বুঝে থাকলে ১ম পর্ব দেখতে পারেন, ওখানে এটি নিয়ে আলোচনা হয়েছে)।

তবে এটাই একমাত্র কারণ নয়, বরং কম প্রবাহের (কারেন্ট) এর জন্য এই প্রভাব খুব নগন্য।

এসি কারেন্ট বিপদজনক হওয়ার মূল কারণটা বলিঃ এটা তো আমরা আগেই জেনেছি যে, এসি কারেন্ট খুব অস্থির, সেকেন্ডে ৫০-৬০ বার দিক বদলায় । এই অধিক কম্পাঙ্কের কারেন্ট যখন মানুষের হার্টের মধ্য দিয়ে যায়, তখন এই কম্পন হার্টের স্বাভাবিক কম্পনের উপর আরোপিত হয়। ফলে হার্ট অসংলগ্নভাবে কাঁপতে থাকে, যা স্বাভাবিক রক্ত চলাচল’কে বাধাগ্রস্ত করে – এই ঘটনা’র কেতাবী নাম – Ventricular Fibrillation ।

ডিসি এই ঘটনা ঘটায় না? না, ডিসি কারেন্টের কম্পাঙ্ক শুন্য, তাই ডিসি কারেন্ট এটা না করে হার্ট’কে ফ্রিজড (স্ট্যাচু) 😐  করে দেয়। কারেন্ট থেকে আমাদের আক্রান্ত ব্যাক্তি মুক্ত হওয়ার পর, একটা স্ট্যাচু হার্ট একটা Fibrillated হার্টের চেয়ে দ্রুত ও সহজে আগের অবস্থায় ফিরে আসতে পারে।

তাই এসি কারেন্টে আক্রান্ত রোগীকে হাসপাতালে Defibrillating যন্ত্র দিয়ে হার্টকে স্বাভাবিক কম্পাঙ্কে আনার চেষ্টা করা হয়। অন্য কোন কারণে হার্টে Ventricular Fibrillation হলেও একই কাজ করা হয়। এই যন্ত্র আমরা সবাইই দেখেছি, ২টা বাটি’র মত জিনিস বুকের ২ পাশে চেপে ধরে শক দিতে হয়।  Bean মুভিতে সবাই যখন হাল ছেড়ে দিয়েছিল তখন Mr.Bean এই কাজ করে রোগীর জ্ঞান ফিরিয়েছিল 😀 ।

তৃতীয়ত বলে রাখি কারেন্ট যদি কোন কারণে হার্ট দিয়ে না যায়, যেমন এক হাত দিয়ে ঢুকে ঐ পাশেরই পা দিয়ে বের হয়ে গেল (বর্তনী তৈরি করে 😯  ) তাহলে এই ঘটনা ঘটবে না। সে কেস এও কিন্তু এসি কারেন্টই বিপদজনক। কীভাবে? মানুষের শরীরের রোধ (Impedance) ডিসি কারেন্টের জন্য সমান থাকলেও এবং এসি কারেন্ট এর জন্য কমে যায়। এর কারণ, এসি কারেন্ট এর ফ্রিকুয়েন্সি, যেটা এই বিশেষ রোধ – impedance কে কমিয়ে দেয়। ফলে এসি কারেন্ট এর কুপ্রভাবও ডিসির চেয়ে বেশি 🙁 ।

চতুর্থত এসি কারেন্ট বিপদজনক আরো একটা কারণে। এসি কারেন্ট এর ফ্রিকুয়েন্সি শরীরের পেশিগুলোকে সংকোচন করে ফেলে; যা শরীরকে কারেন্ট লাইনের সাথে আটকে রাখতে সাহায্য করে। অন্যদিকে ডিসি কারেন্ট যেহেতু প্রথম থেকেই ধ্রুব গতিতে চলে, তাই এক্ষেত্রে কারেন্ট শুরুতেই হটাৎ করে দেহকে টেনে ধরে, সঙ্গে সঙ্গে প্রতিক্রিয়া বলের কারণ স্বরূপ মানুষটি ছিটকে পড়ে। এ অভিজ্ঞতা হয়ত অনেকেরই হয়েছে। অর্থাৎ ঝাঁকি দিয়ে ছিটকে ফেলে ডিসি কারেন্ট আর আটকে রাখে এসি কারেন্ট ( এ বিষয়ে ঠিক উল্টো ব্যাখ্যা দেয়া আছে বেশ কিছু ফিজিক্স ফোরাম, ব্লগে; বিভ্রান্ত হওয়ার কিছু নেই 🙂 )।

পঞ্চমত, আমাদের দৈনন্দিন ব্যবহারে আমরা ডিসি যেসব ক্ষেত্রে ব্যবহার করি, তার সবগুলোই খুব কম ভোল্টেজের। সাধারনত আমরা ২৪ ভোল্ট পর্যন্ত ব্যবহার করে থাকি। তাই ডিসি কারেন্ট এর দুর্ঘটনা সম্ভাবনাও কম, এবং ঘটেও তাই।

সব মিলিয়ে এসি কারেন্টই সবচেয়ে বিপদজনক। তবে তার মানে এই না যে, ডিসি কারেন্ট ভাল 🙁 ।

 

ট্রান্সফর্মারঃ

আমরা প্রথম পর্বে দেখেছিলাম গতানুগতিক বেশিরভাগ বিদ্যুতকেন্দ্রেই এসি কারেন্ট উৎপন্ন হয়। এই এসি কারেন্টে ভোল্টেজ অনেক কম থাকে এবং কারেন্টের প্রবাহ বেশি থাকে। এই কারেন্ট আমাদের বাসায় পৌঁছানোর আগে ২ বার ট্রান্সফর্মার পার করে আসে। কেন করে? ট্রান্সফর্মার এর কাজটাই বা কি?

ট্রান্সফর্মার এর কাজ হল কারেন্ট এর ভোল্টেজ বাড়ানো কিংবা কমানো। যেহেতু, ক্ষমতা, P=VI এবং এক্ষেত্রে ক্ষমতা পরিবর্তন হয় না। তাই সূত্র থেকে সহজেই বোঝা যায় যে, ভোল্টেজ বাড়ালে কারেন্ট কমবে, আর ভোল্টেজ কমালে কারেন্ট বাড়বে।

ট্রান্সফর্মার কাজ করে শুধুমাত্র এসি কারেন্টে। কারণ হিসেবে বলা যায়ঃ ট্রান্সফর্মার চলে তড়িৎ চৌম্বক আবেশ এর সূত্র অনুয়ায়ী এবং এক্ষেত্রে পারস্পরিক আবেশ ঘটে(চিত্র ১ ও ২ ):  প্রথম প্রান্তের কুন্ডলীতে প্রবাহিত কারেন্ট বার বার দিক বদলায় (এসি কারেন্ট); ফলে এর সাথে সংশ্লিষ্ট চৌম্বক ক্ষেত্রেরও পরিবর্তন হয়। এই পরিবর্তনশীল চৌম্বক ক্ষেত্র দ্বিতীয় প্রান্তের কুন্ডলীতে দিক পরিবর্তী এসি কারেন্ট আবিষ্ট করে। ২ প্রান্তের কুন্ডলীর সংখ্যার কম-বেশি দিয়ে নির্ণীত হয় ভোল্টেজ বাড়বে নাকি কমবে। ডিসি কারেন্ট দিক বদলায় না বিধায়, সেক্ষেত্রে চৌম্বক ক্ষেত্রেরও পরিবর্তন হয় না, তাই আবিষ্ট বিদ্যুৎও উৎপন্ন হয় না। তাই ভোল্টেজ আপ-ডাউন করার জন্য ট্রান্সফর্মারে অবশ্যই এসি কারেন্ট সরবরাহ করতে হয়। যাই হোক এর কৌশল এখানে না বুঝলেও সমস্যা নেই, পরবর্তীতে তড়িৎ-চৌম্বক নিয়ে আর্টিকেলে বিস্তারিত থাকবে।

ট্রান্সফর্মার ২ ধরণেরঃ স্টেপ আপ( চিত্র-১) ও স্টেপ ডাউন (চিত্র-২)। স্টেপ আপে ভোল্টেজ বাড়ানো হয় (একইসাথে কারেন্টও কমে) এবং স্টেপ ডাউনে ভোল্টেজ কমানো হয় (একইসাথে কারেন্টও বাড়ে)।

1221

 

প্রশ্ন জাগে যে, কারেন্ট একবার কমিয়ে, আরেকবার বাড়িয়ে কি লাভ? যেই লাউ সেই কদু হল না? আচ্ছা, ধরুন বিদ্যুতকেন্দ্রে উৎপন্ন বিপুল পরিমাণ কারেন্ট আপনি বিন্দুমাত্র না কমিয়েই পাঠিয়ে দিলেন দূর-দূরান্তে। এই বিপুল কারেন্ট যখন কারেন্টের তার দিয়ে হাজার হাজার মাইল পাড়ি দিবে তখন তারে উৎপন্ন তাপের কারণে বিপুল পরিমাণে বিদ্যুতশক্তি নষ্ট হবে, যা কোনভাবেই কাম্য নয়।

তাই এর সমাধানের জন্য যেটা করা হয় তাহল, স্টেপ আপ ট্রান্সফর্মার দিয়ে প্রথমে কারেন্ট কমানো হয় (ভোল্টেজ বাড়িয়ে), এরপর এই কম কারেন্ট’কে দূর-দূরান্তে পাঠানো হয়। এভাবে অল্প অল্প করে কারেন্ট পাঠানোতে উত্তাপজনিত শক্তিক্ষয় কম হয়। আবার যখন দূরের কোন শহরে/এলাকায় বিদ্যুৎ পৌঁছায় তখন ঠিক উল্টো কাজ করা হয়। স্টেপ ডাউন ট্রান্সফর্মার দিয়ে এবার কারেন্ট বাড়ানো হয় ( ভোল্টেজ কমিয়ে)। এবং শহর/এলাকার বাসা বাড়িতে সরবরাহ হয় সেই কম ভোল্টেজের বেশি কারেন্ট।  (নিচের চিত্র)

989

চিত্রঃ বিদ্যুৎ কেন্দ্র হতে বাসা পর্যন্ত কারেন্ট এর প্রবাহ

 

বেশি ভোল্টেজে কম কারেন্ট পাঠালে কীভাবে শক্তি সাশ্রয় হয় – এই বিষয়ে এখনও কারও সন্দেহ থাকলে নিচের চিত্রকল্প চিন্তা করুনঃ

ট্রান্সফর্মার এর পুরো ব্যাপারটা একটু  অন্যভাবে চিন্তা করা যাক, ধরুন আমাদের পাইপ দিয়ে অনেক দূরে পানি পাঠাতে হবে। এখন আমরা কীভাবে পানি পাঠাব? খুব অল্প অল্প পানি নিয়ে অনেক বেশি চাপে পাঠাবো ? নাকি অনেক কম চাপে একসাথে বেশি পানি পাঠাবো? অবশ্যই প্রথমটা করব; কারণ অধিক চাপে অল্প অল্প করে পানি পাঠালে ঘর্ষণজনিত বাঁধা কম হবে। ফলে কম শক্তিখরচে পানি সরবরাহ নিশ্চিত হবে।

ট্রান্সফর্মারেও ঠিক একই নীতি অবলম্বন করেছি আমরা, এখানে পানির চাপ হল ভোল্টেজ (বিভব শক্তি) আর পানির প্রবাহ/পরিমাণ হল কারেন্ট 🙂 ।

(কম ভোল্টেজ-বেশি কারেন্ট) ➡ স্টেপ আপ ট্রান্সফর্মার ➡ (বেশি ভোল্টেজ-কম কারেন্ট) ➡ স্টেপ ডাউন ট্রান্সফর্মার ➡  (কম ভোল্টেজ-বেশি কারেন্ট)।

এখন নিশ্চয়ই বোঝা গেল এসি কারেন্ট এর উপযোগিতা কি এক্ষেত্রে। এসি কারেন্ট (দিক পরিবর্তী) ছাড়া এখানে এক কুন্ডলী থেকে আরেক কুন্ডলীতে বিদ্যুৎ আবিষ্টই করা যাবে না। এই সুবিধা ছাড়াও আরেকটা সুবিধা হলঃ এসি কারেন্ট দিয়ে আমরা যদি দূর দূরান্তে কারেন্ট পাঠাই, তাহলে ভোল্টেজ ড্রপ হয় না বললেই চলে; হলেও সেটা কাভার দেয় ট্রান্সফর্মার। কিন্তু ডিসি দিয়ে পাঠাতে গেলে ভোল্টেজ ড্রপ হত অনেক বেশি (যেটা করেছিলেন টমাস আলভা এডিসন)।

ট্রান্সফর্মার নিয়ে আজ এতটুকুই। তড়িৎ-চৌম্বক নিয়ে স্বশিক্ষার সামনের কোন সিরিজে ট্রান্সফর্মার নিয়ে বিস্তারিত থাকবে।

আর আগামী পর্বে আমরা দেখব ক্যাপাসিটর বা ধারক এর ক্ষেত্রে এসি কারেন্ট ডিসি কারেন্ট এর ভূমিকা, নিকোলা টেসলা ও টমাস আলভা এডিসন এর কারেন্ট যুদ্ধ 🙂 এবং দেখব কে সেরা?  😯

সেই পর্যন্ত স্বশিক্ষার সাথেই থাকুন  🙂  …ভালো থাকুন  🙂

[কোন ভুল থাকলে কিংবা প্রশ্ন থাকলে কমেন্টে জানিয়ে বাধিত থাকবেন ]

||প্রথম পর্বঃ

এসি কারেন্ট – ডিসি কারেন্ট [১]

References:

  • Arc-Flash and Electrical Shock Hazards – How to Keep Your Facility Compliant by Dennis K. Neitzel, CPE
  • Electric Shock: http://hyperphysics.phy-astr.gsu.edu/hbase/electric/shock.html
  • Electric Shock: http://en.wikipedia.org/wiki/Electric_shock
  • allaboutcircuits.com
  • youtube
  • google
  • Khaled Mosharraf Mukut