pH কাকে বলে? ২.১ এ আমরা বলেছিলাম “কোনো দ্রবণে থাকা প্রোটনের ঘনমাত্রার মানের ঋণাত্মক লগারিদম নিলে আমরা যা পাই তা হল pH”। কথাটা মিথ্যা নয়, কিন্তু পুরোপুরি সত্যও নয় 😳 চমকপ্রদ এমন অনেক জিনিস আবিষ্কার করতে ও মজার কিছু শিখতেই দ্বিতীয় খন্ডের এই বোনাস পর্ব “নতুন করে pH-কে জানি” 😛

“সক্রিয় হাইড্রোজেন আয়ন” নামে কোনো কথা কি আগে শোনা আছে? 😛 নেই সম্ভবত। pH এর আসল সংজ্ঞা এই শব্দত্রয়ী ব্যবহার করেই আসে। প্রকৃতভাবে pH হল দ্রবণে থাকা সক্রিয় হাইড্রোজন আয়নের ঘনমাত্রার মানের ঋণাত্মক লগারিদম নিলে আমরা যা পাই তা। ব্যাখ্যা করা যাক হাইড্রোজেনের সক্রিয়তা (Activity of Hydrogen Ion) বলতে কী বোঝায়।

ধর, তুমি একটা রুমে বসে আছ। রুমের দরজাটা হাঁ করে খোলা আর তার কারণে দেখা যাচ্ছে রুমের সাথেই থাকা করিডর দিয়ে কে আসছে আর যাচ্ছে। তবে করিডরের পুরোটা কিন্তু তুমি দেখতে পাচ্ছ না, যার দরুণ যারা কেবল দরজার সামনে দিয়ে যাবে আসবে তাদেরই চোখে পড়বে তোমার; করিডরের এক মাথায় যদি কেউ থেকে থাকে অনড় হয়ে, তার উপস্থিতি টের পাবে না তুমি।

কল্পনা করা যাক, সত্যিই কিছু লোক ঘুরঘুর করছে দরজার সামনে দিয়ে। তুমি তাদের সংখ্যা গুণে দেখলে লোক আছে ৪ জন। তাহলে আমরা বলতে পারি, “সক্রিয়ভাবে” করিডরে হেঁটে বেড়ানো লোকের সংখ্যা ৪ জন। তবে সত্যিকারে করিডরে লোকের সংখ্যা ৪ না হয়ে ৫, ৬,৭ কিংবা ১০ও তো হতে পারে।

লঘু দ্রবণের ক্ষেত্রে সচরাচর আমরা যখন দ্রবণে হাইড্রোজেন আয়নের ঘনমাত্রা হিসাব করি, তখন এই সক্রিয় হাইড্রোজেন আয়নের সংখ্যাই আমলে নিই। তাহলে প্রশ্ন হল, নতুন করে এটাকে চেনানোর আবার কী দরকার? এটার দরকার আছে, ভয়াবহভাবেই আছে! 🙄

আমাদের মনে আসা খুব কমন একটা মজাদার প্রশ্ন হল, pH কি কখনো ঋণাত্মক হতে পারে? এর উত্তরও মোটামুটি সবার জানা – হ্যাঁ, পারবে না কেন? আমরা যদি 1M H2SO4 দ্রবণ নিই তবেই তার pH চলে আসে -0.3। সমস্যা এখানে নয়, সমস্যা হল দ্রবণে এসিডের ঘনমাত্রা যত বাড়তে থাকে, এর pH এভাবে সূত্র প্রয়োগ করে হিসাব করাটা ততই বেঠিক হতে থাকে। এর কারণ প্রধানত দুইটা :

১। এসিডসমূহ উচ্চ ঘনমাত্রায় বিয়োজিত হতে চায় না। ভর হিসেবে প্রতি গ্রাম এসিডের জন্য দ্রবণে যত বেশি পানি থাকে, বিয়োজনের হার ততই ভাল হতে দেখা যায়।

২। ঐ সেই “হাইড্রোজন আয়নের সক্রিয়তা”। তুমি 1M H2SO4 নিলেই যে 2M ঘনমাত্রার হাইড্রোজেন আয়ন দ্রবণে আসবে এটা আশা করা ভুল (১ নম্বর পয়েন্টে বলা কারণে)। আচ্ছা, ধর এসেই গেল এরা সবাই; তাও কিন্তু এই আয়নদের সবাইকে তুমি সক্রিয় বা active দেখবে না। কী সেই কারণ যার জন্য হাইড্রোজেন আয়নের দ্রবণজুড়ে বিচরণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়? এর কারণ হিসেবে বলা হয়, দ্রবণে হাইড্রোজেন আয়নের সাথে যুগপৎ বড় বড় আয়ন (যেমন SO42-, Cl) থাকলে এর পরিযাত্রা ক্ষতিগস্ত হয়। যার কারণে সক্রিয় হাইড্রোজেন আয়ন হিসেবে pH মিটার (pH মাপার যন্ত্র) কম পরিমাণ হাইড্রোজেন আয়নদের শনাক্ত করে এবং pH প্রকৃত মানের বেশি দেখায়। যেমন 0.01M HCl নিলে আমরা এক্সপেরিমেন্টাল pH পাই 2.04 (সূত্র থেকে পাওয়া উচিত ছিল 2), 0.1M HCl নিলে পাই 1.1 (আশা করেছিলাম 1)। বুঝতেই পারছ, যত ঘনমাত্রা বাড়াচ্ছি, তত বিচ্যুতি ঘটছে তাত্ত্বিক pH এর মান থেকে।

সুতরাং, চাইল তোমার কাছে 12M HCl এর ঘনমাত্রা আর তুমি তা নাচতে নাচতে বের করে ফেলার আগে ভাবো কাজটা কতটুকু যুক্তিসঙ্গত হচ্ছে।

এখন তুমি বলতে পারো, pH মিটারে pH এর মান কমুক সমস্যা নেই। হাইড্রোজেন আয়ন দ্রবণে থাকা নিয়ে কথা, সেটা থাকলেই হবে; ডিটেক্ট করার দরকার কী তাদের? হ্যাঁ এটা ঠিক তোমার অম্ল-ক্ষারক প্রশমন বিক্রিয়াতে এই সক্রিয়তা কোনো প্রভাব ফেলে না। সক্রিয় নিষ্ক্রিয় সকল প্রোটনই বিক্রিয়া করে ফেলে পূর্ণ প্রশমনের সময়। কিন্তু ভুলে যেও না এই এক প্রশমন ছাড়াও অম্লের আরও কাজ আছে। সেসব মেজারমেন্টে হাইড্রোজেন আয়নের আপাত ঘনমাত্রা নয়, সক্রিয়তা পরিমাপনই আবশ্যক হয়ে দাঁড়ায়।

অনেক ভাল তো! তো ভাই ঘন এসিডের দ্রবণ ছেড়ে যদি একটু 10-8 M ঘনমাত্রার অতিলঘু HCl দ্রবণের pH কত হয় তা বলতেন? 😕

এটা কি আমার বলার জিনিস? 👿 ক্যালকুলেটর থেকেই তো পাওয়া যায় pH যে 8 তা!

ওমা! নিরপেক্ষ পানির pH ই তো 7, তাতে HCl দিয়েছি, যদিও বা খুবই খুবই অল্প, কিন্তু কিছু হাইড্রোজেন আয়ন তো বাইরে থেকে দিয়েছি পানিতে! এর pH তাহলে 7 থেকে না কমে কীভাবে উল্টো 8 হতে পারে?

তাহলে এক কাজ করি, হ্যাঁ? পানিতে আগে থেকেই থাকা হাইড্রজেন আয়নের ঘনমাত্রা এসিডের সাথে আসা হাইড্রোজেন আয়নের ঘনমাত্রার সাথে যোগ করে দিই? তাহলে দ্রবণের জন্য আমরা [H+] পাই 1.1×10-7 M, pH আসে 6.96। শাব্বাশ! এবার খাসা মিলেছে বটে!

কিন্তু ঐ যে বলেছিলাম, পৃথিবীটা কেবল সরল সমস্যা দিয়ে পূর্ণ হলে তো ভালই হত। এই সমস্যাটা দুর্ভাগ্যবশত এমন এক পিস যা তোমার পিছু ছাড়তে চাইবে না সহজেই 😯

এসিড অণুর হাইড্রোজেন আয়নগুলো প্রকৃতপক্ষে পানি বিয়োজনের যে উভমুখী বিক্রিয়া আছে, সেই সাম্যাবস্থাকে প্রভাবিত করবে। পানির বিয়োজনের ফলে হাইড্রোজেন আয়ন আর হাইড্রক্সাইড আয়ন উৎপাদ হিসেবে তৈরি হয়। আমরা কিছু হাইড্রোজেন আয়ন এখানে যোগ করায় প্রকারান্তে উৎপাদই যোগ করছি, যার কারণে বিক্রিয়া পশ্চাৎমুখী হয়ে পানি তৈরি করে ফেলবে। খেয়াল কর, পানির নিজস্ব হাইড্রোজেন আয়নের ঘনমাত্রা 10-7 M, যা কিনা HCl হতে আসা 10-8 M হাইড্রোজেন আয়ন ঘনমাত্রার দশগুন। আমার ব্যাপারটা একটু সহজ করে চিন্তা করি। ধর, পানির বিয়োজনের ফলে সাম্যাবস্থায় 100 টি H+ আর 100টি OH তৈরি হয়েছে। এক্ষেত্রে সাম্যপ্রতিষ্ঠার পর পানির আয়নিক গুনফল তাহলে 100×100=10,000। এখন সেখানে আরো 10টি H+ এল এসিডের কল্যাণে। সুতরাং H+ এর পরিমাণ বেড়ে দাঁড়াল 110, OH থাকল সেই 100 টিই। সুতরাং নতুন আয়নিক গুণফল দাঁড়াবে 110×100=11,000। কিন্তু আমরা যেহেতু তাপমাত্রা বাড়াই নি, তাই সাম্য ধ্রুবকের মত কাজ করা আয়নিক গুণফলও পরিবর্তীত হবার প্রশ্ন আসে না। এজন্য, H+ এর পরিমাণ কমতে হবে, আর সাথে কমবে OH এর সংখ্যাও কারণ এরা দু’জন মিলিত হয়েই পানির অণু তৈরি করবে। তো, প্রোটন 109 টা হলে হাইড্রক্সাইড কমে হবে 99টা, আরো কমে 108 টা হলে হাইড্রক্সাইড 98… এভাবে কমে কমে আবার যতক্ষণ না গুণফল 10,000 এর অনুরূপ হবে চলতেই থাকবে। আমরা দেখি 105 টা প্রোটন আর 95 টা হাইড্রক্সাইড হলে গুণফল আসে 105×95=9,975, যেটা 10,000 এর বেশ কাছে। তাই এই অবস্থাতেই সাম্যাবস্থা পুনরায় স্থাপিত হবে বলে ধরে নেওয়া যায়।

একটা মজার ব্যাপার খেয়াল করলে দেখবে, এখানে হাইড্রোজেন আয়ন আর হাইড্রক্সাইডের পরিমাণের পার্থক্য কিন্তু সর্বদা 10ই থেকে যাচ্ছে, যা যোগকৃত হাইড্রোজেন আয়নের পরিমাণের সমান। সুতরাং আমাদের কেসেও আমরা ফিরে যেয়ে বলতে পারি নতুন সাম্যাবস্থায়,

[H+] – [OH] = 10-8 M

অর্থাৎ, [OH] = ( [H+] – 10-8 ) M

পানি বিয়োজনের সাম্যাবস্থার ক্ষেত্রে 25° C এ সর্বদা, [H+] × [OH] = 10-14 mol2L-2

অতএব, নতুন সাম্যাবস্থায়, [H+] × ( [H+] – 10-8 ) = 10-14 mol2L-2

এখন আর কিচ্ছু না, এই সমীকরণ সমাধান করলেই দ্রবণে বিরাজমান প্রোটনের ঘনমাত্রা আমাদের হাতে চলে আসবে। আমি সমাধান করে পেলাম, [H+] = 1.05×10-7 M। সুতরাং pH = -log(1.05×10-7) = 6.978।

অবশেষে! এটাই উত্তর 😀

অতি গাঢ় আর অতি লঘু এসিডের ক্ষেত্রে pH নির্ণয়ের ঝুটঝামেলা আমরা দেখে ফেললাম তবে। আমার আলোচনা করার ইচ্ছা ছিল দুর্বল অম্ল আর সবল ক্ষারকের লবণের দ্রবণ কেন ক্ষারকীয় এবং সবল অম্ল-দুর্বল ক্ষারকের লবণের দ্রবণ কেন অম্লীয় হয় এর pH ভিত্তিক উপস্থাপন। যা হোক, সে ব্যাপারে আমি আর কথা বাড়ালাম না, তোমরা এই লিংক থেকে ঘুরে আসলেই তা বুঝতে পারবে।

একটা প্রশ্ন দিয়ে তোমাদের ধন্ধে ফেলে শেষ করছি। ঐ যে সক্রিয় হাইড্রোজেন আয়নের কথা বলছিলাম, তোমাদের কি একবারও মাথায় এসেছে প্রোটন তো পানির সাথে হাইড্রোনিয়াম আয়ন আকারে থাকে, তাহলে আমরা মুক্ত হাইড্রোজেন আয়ন নিয়ে এত চিন্তিত কেন? এর উত্তর খোঁজার ভার তোমাদের দিচ্ছি। সাধারণ চিন্তাধারা থেকে একটু আলাদাই এই সক্রিয় হাইড্রোজেন আয়ন ধারণার ভিত্তি, তাই একটু ভজকট পেকেই যায়। আমাদের ব্যর্থতা আমরা দ্রবণে ঢুকে দেখতে পারি না প্রকৃতপক্ষে কী হচ্ছে, কী চলছে। একটু ভেবো, খুঁজো উত্তরটা। আমাদেরকে তো বলাই আছে, “চাও, তোমাদের দেওয়া হবে; খোঁজ কর, পাবে; দরজায় আঘাত দাও, তোমাদের জন্য খোলা হবে।”

দ্বিতীয় খন্ড তবে শেষ হচ্ছে এখানে। খুব শীঘ্রই শেষ ও তৃতীয় খন্ডের পর্বগুলো নিয়ে আসব তোমাদের জন্য 😀