আমাকে যদি কেউ কখনো এক বাক্যে বলতে বলে কোডিং শিখে আমার কি লাভ হয়েছে, আমার উত্তর হবে, কোডিং আমাকে শিখিয়েছে চিন্তা করতে।
প্রথম শুনে একটু অবাক লাগা স্বাভাবিক। কোথায় কোডিং আর কোথায় চিন্তা-ভাবনা! কিন্তু এটাই সত্য। এটা বুঝতে হলে তোমার জানতে হবে, কোডাররা কী করে?
কোডাররা কোড লেখে। কিন্তু ব্যাপার হল প্রোগ্রামিং-এর ডজন খানেক সিনট্যাক্স জানলেই কিন্তু কোডার হওয়া যায় না। এরকম হলে তো কন্ডিশনাল লজিক, লুপ, অ্যারে শিখেই সবাই কোডার হয়ে যেত। ল্যাঙ্গুয়েজ একজন কোডারের জীবনের ক্ষুদ্র একটা মাধ্যম মাত্র। জ্যোতির্বিজ্ঞানে একটা টেলিস্কোপের গুরুত্ব যতটুকু, কোডিং-এর জন্য এই ল্যাঙ্গুয়েজের গুরুত্বও ততটুকুই। ল্যাঙ্গুয়েজ ছাড়া কিচ্ছু হবে না ঠিক, কিন্তু শুধু ল্যাঙ্গুয়েজ শেখাটাই সব না!
কোডাররা ম্যাথমেটিক্স নিয়ে ঘাটাঘাটি করে। কিন্তু তারা গণিতবিদ নয়। তারা ডিজাইন করে, কিন্তু তারা ডিজাইনার না। তারা স্ট্র্যাটেজি ঠিক করে, কিন্তু তারা স্ট্র্যাটেজিস্টও না! তাহলে তারা কী? সহজ কথায়, তারা হল jack of all trades, master of none!
তাদেরকে অ্যালগোরদিম রেডি করতে হয়, সেটা ইমপ্লিমেন্ট করতে হয়, ওয়েবসাইট বানানো শিখতে হয়, সফটওয়্যার বানাতে হয়, হার্ডওয়্যার নিয়ে পড়াশোনা করতে হয়। তারা সবই করে, কিন্তু কোনোটাতেই একেবারে মাস্টার হয়ে যায় না!
তারা সবাই হল প্রবলেম সলভার। তারা সমস্যা নিয়ে কাজ করে। তারা যেকোনো সমস্যা অ্যানালাইজ করতে শিখে। এবং তারা এটাও বিশ্বাস করতে শেখে যে, সব সমস্যার একটা সমাধান আছে। এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা হল, এই প্রবলেম যে শুধু প্রোগ্রামিং রিলেটেড হবে তাই না। রিয়েল লাইফ প্রবলেম সলভিং স্কীলও বাড়তে থাকে ক্রমাগত।
আমি এত সুনাম করছি, তার মানে কিন্তু এই না যে দলে দলে এখন সবাই এই সাবজেক্ট পড়তে চলে আসবা! এই ভুলটা করার আগে তোমার অনেকগুলা বাস্তবতা সম্পর্কে জানতে হবে।
এখন একটা মিসকনসেপশন হয়ে গেছে যে, কম্পিউটার সাইন্স পড়লে নিশ্চিত চাকরি! আগেই জেনে রাখ কথাটা অনেক বড় একটা মিথ্যা। তুমি যদি দেশ থেকে গুগল, মাইক্রোসফটে যাওয়া কয়েকজনকে দেখেই ধরে নাও যে কম্পিউটার সাইন্স পড়লেই এটা করা যাবে, তবে সেটা হবে অনেক বড় বোকামি।
আমাদের দেশে সরকারী-বেসরকারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান মিলিয়ে প্রতি বছর গ্র্যাডুয়েশন শেষ করা কম্পিউটার সাইন্টিস্টের সংখ্যা ২৫০০-এর কম হবে না। এদের মধ্যে কিন্তু মাত্র ১০-১২ জনই যায় গুগল কিংবা মাইক্রোসফটে। এর বাইরে হয়তো ১৫০ জন ভাল কোথাও উচ্চ শিক্ষা অর্জনের সুযোগ পায়। মিডিয়াম একটা কোম্পানির চাকরি পাওয়া ছাত্র সহ হিসেব করলে হয়তো বলা যায়, হয়তো ১০০০ জন প্রতিষ্ঠা লাভে সফল হয়।
কিন্তু এরপরও কিন্তু ১৫০০ জন থেকে যায়, যাদের কথা ফেসবুকে ঢালাও করে প্রচার হয় না। তাদের অনেকে হয়তো শেষ পর্যন্ত অন্য কোনো পেশা নিয়ে নেই। এদের মেধার কিন্তু কোনো ঘাটতি ছিল না। ভুলটা হয়েছিল সাবজেক্ট পছন্দ করার সময়। যা বুঝাতে চাচ্ছি, তা হল কম্পিউটার সাইন্স সবার জন্য না। এটা তোমার জন্য একটা ভাল অপশন হবে নাকি সেটা বিচার করার দায়িত্ব পুরোপুরি তোমার উপর। তবে আমি এ ব্যাপারে কয়েকটা হিন্ট তোমাকে দিতে পারি।
প্রথমত, তোমার শুরুতেই উচিত হবে প্রোগ্রামিং সম্পর্কে কিছু বেসিক ধারণা অর্জন করা এবং সম্ভব হলে বিভিন্ন অনলাইন জাজে কিছু প্রবলেম সলভ করে ফেলা। যেহেতু তোমাদের আইসিটি আছে, সুতরাং এটা খুব কঠিন কিছু হওয়ার কথা না। যদি দেখ, তোমার প্রবলেম গুলো সলভ করতে মজা লাগছে। এবং একটা সল্ভ করার পর আরেকটা সল্ভ করতে ইচ্ছে হচ্ছে, তাহলে go for it! কম্পিউটার সাইন্স মানেই প্রচুর প্রবলেম সলভিং। কম্পিউটার সাইন্টিস্টরা প্রবলেম পেলেই তা কী কী উপায়ে সমাধান করা যায়, তা নিয়ে উঠে পড়ে লাগে!
দ্বিতীয়ত, তোমাকে এই সাবজেক্টে পড়তে গেলে সব ধরণের ইগো বিসর্জন দিতে হবে। তোমার প্রতি পদে পদে ভুল হবে। সবসময়ই দেখবা তোমার আশেপাশে এমন কেউ আছে যে তোমার চেয়ে অনেক ভাল পারে (এবং সেই সাথে এমন কেউ যার চেয়ে তুমি ভাল পার)। ১০০ লাইনের কোড লিখে হয়তো তোমার ১০০০ টা বাগ ডিবাগ করতে হবে। আর কন্টেস্ট করার ইচ্ছে থাকলে তো কথায় নাই। হতাশা সৃষ্টির জন্য প্রোগ্রামিং কন্টেস্টের মত ভাল কিছু মনে হয় আর নেই! এগুলো দেখে হতাশ হয়ে গেলে হবে না। হতাশ হলেই সব শেষ। তাই আগেই নিজেকে মানসিকভাবে প্রস্তুত রাখতে হবে, বুঝতে হবে তুমি এসব হতাশা ডিল করতে প্রস্তুত কি না। নাহলে পরের চার-পাঁচ বছর নাকের পানি-চোখের পানি এক হয়ে যাবে।
তৃতীয়ত, কম্পিউটার সাইন্স হল সবচেয়ে কম্পিটিটিভ সাবজেক্টগুলোর মধ্যে একটা। এখানে প্রতিনিয়তই তোমাকে কাজ করতে হবে উন্নতির জন্য। সারা জীবনে তুমি আর আত্ম-তৃপ্তির দেখা পাবে না। প্রতিটা সকাল শুরু হবে “কিছু পারি না কেন?” ধরণের চিন্তা ভাবনা নিয়ে। যদিও তুমি অনেক কিছুই শিখবে, এই ফিল্ডে তারপরও এমন জিনিস লাগবেই, যেটা তুমি জান না! এই ফিল্ডের একমাত্র ধ্রুব জিনিস হল পরিবর্তন!
চতুর্থত, হতে হবে অনেক বেশি ক্রিয়েটিভ আর হতে হবে ধৈর্যশীল! প্রথার বাইরে গিয়ে নতুন নতুন চিন্তা করতে জানতে হবে। একটা প্রবলেম মেইনস্ট্রীম পন্থা ছাড়া আর কী উপায়ে সমাধান করা যায়, সেটা নিয়ে প্রচুর চিন্তা ভাবনা করার ধৈর্য থাকতে হবে।
পঞ্চমত, তোমাকে বুঝতে হবে একজন কোডার হতে হলে যে তোমাকে এই সাবজেক্ট পড়তেই হবে এমন কোনো কথা নেই। তোমার যদি ম্যাথ কিংবা ফিজিক্স অনেক বেশি ভাল লাগে, কিন্তু সেই সাথে তুমি কোডিং করতে চাও, ম্যাথ কিংবা ফিজিক্সে ভর্তি হয়ে এই কাজ চালিয়ে যাওয়া কোনো ব্যাপারই না!
তবে তুমি যদি মনে কর, তোমার কোডিং ছাড়া কিছুই ভাল লাগে না এবং তুমি একটা কোডিং-বেইসড ক্যারিয়ার গড়ে তুলতে চাও, তবে আমার উপদেশ থাকবে, সুযোগ থাকলে অবশ্যই কম্পিউটার সাইন্স নাও, সেটা যেই ভার্সিটিই হোক না কেন। ইন্সটিটিউটের পেছনে দৌড়াতে গিয়ে কখনো নিজের প্যাশনকে বিসর্জন দিও না।
নিজেকে প্রশ্ন কর আগামী ১০ বছর পর নিজেকে কোথায় দেখতে চাও। একটা প্রতিষ্ঠিত ভার্সিটিতে কোনো আগ্রহ নেই এমন একটা সাবজেক্টের গ্র্যাজুয়েট হিসেবে, নাকি নিজের প্যাশনের সাবজেক্টের গ্র্যাজুয়েট হিসেবে। যদি কোনো সন্দেহ থাকে এই ব্যাপারে, আমার প্রোফাইল থেকেই ঘুরে এস! আমার কম্পিউটার সাইন্স পড়ার ইচ্ছা ছিল বলেই আমি এই কাজ করেছি। আমার যদি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ নাও হত, আমি অন্য কোথাও এই বিষয়েই পড়তাম। সমাজ কী বলবে – এই প্রশ্ন আমাকে কোনোদিন দ্বিধান্বিত করতে পারতো না। এবং এই কথা বুকে হাত রেখেই বলতে পারি, আমি যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, তার জন্য আমি এখন পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষগুলোর মধ্যে একজন!
তোমার হয়তো বিভিন্ন ইঞ্জিনিয়ারিং ভার্সিটিতে ফর্ম নেওয়া হবে না। কিংবা ভর্তির সুযোগ হবে না। কিন্তু যাই হোক, একটা জিনিস মাথায় রেখ, আগে সাবজেক্ট, পড়ে ভার্সিটি। মৃত্যুর আগে তোমার সুযোগ কখনোই শেষ হয়ে যাবে না। আশা করি কিছুটা হলেও বুঝাতে পেরেছি। এই সাবজেক্ট সম্পর্কে যে কোনো প্রশ্ন চাইলে করতে পার।
হ্যাপি অ্যাডমিশন ফাইট!
inspiring.