“অম্ল-ক্ষারক সাম্যাবস্থা” শীর্ষক সিরিজের প্রথম পর্বে সবাইকে স্বাগতম 😀 রসায়নবিজ্ঞানের অবিচ্ছেদ্য এক অংশ হল অম্ল-ক্ষারক সংক্রান্ত আলোচনা – তা আমরা কে না জানি? সেই হাই স্কুল থেকে আমাদের ধারণা দেওয়া শুরু হয় অম্ল (Acid) আর ক্ষারক (Base) সম্পর্কে। এমনকি উচ্চ শিক্ষায় রসায়ন পড়তে গেলেও এই টপিক যে তোমার পিছু ছাড়বে না তা বেশ হলফ করেই বলা যায়। এই সিরিজে তাই চেষ্টা করা হবে অম্ল আর ক্ষারকের যাবতীয় আলোচনা এবং তাদের সাম্যবস্থা নিয়ে সোজাসাপ্টা কিন্তু কার্যকরী কিছু কথা বলার 😀

খেলতে গেলে হুড়হুড় করে মাঠে নেমে পড়লেই তো হয় না, তার পূর্বে প্রস্তুতিমূলক কিছু ব্যাপারও থাকে। তেমনি অম্ল-ক্ষারক নিয়ে বকবক করার পূর্বে চোখ বুলিয়ে নেওয়া ভাল অম্ল আর ক্ষারক কারা, তারা কীভাবে কাজ করে – এসকল ব্যাপারগুলোর উপর। আমরা এই সিরিজের প্রথমে মূলত নজর দেব অম্ল আর ক্ষারককে বর্ণনা করে এমন কিছু মতবাদসমূহের উপর। আরো আবিষ্কার করার চেষ্টা করব এই তত্ত্বগুলোর মধ্যকার আন্তঃসম্পর্ক।

তিনটি মতবাদের মধ্যে সবার আগে আসবে আরহেনিয়াস এর তত্ত্ব (Arrhenius Theory of Acids and Bases). যা আমাদের জানায় –

  • অম্ল হল সেসব যৌগ যারা জলীয় দ্রবণে হাইড্রোজেন আয়ন (H+) দান করে
  • ক্ষারক সেসব যৌগ যারা জলীয় দ্রবণে হাইড্রক্সাইড আয়ন (OH) দান করে
  • অম্ল ক্ষারকের মধ্যে প্রশমন বিক্রিয়া ঘটে কারণ এই দুই যৌগ থেকে আগত H+ ও OH বিক্রিয়া করে পানি (H2O) অণু তৈরি করে

যুগের পর যুগ সাদা চোখে আমরা অম্ল ক্ষারক বলে যাদের চিনে এসেছি এবং এদের বৈশিষ্ট্য বা বিক্রিয়ায় যা যা পড়েছি তার পুরো নকশাটাই এই আরহেনিয়াস তত্ত্বের আদলে করা। হবেই না বা কেন? অম্ল-ক্ষারক মতবাদগুলোর মধ্যে সবচেয়ে পুরাতন মতবাদ হল এটি, এবং এটিই সবচেয়ে সরল ও সহজবোধ্য।

একটা জিনিস খেয়াল করে দেখ, অম্ল ক্ষারকের সংজ্ঞায় আমি “জলীয় দ্রবণ” শব্দযুগল হাইলাইট করে দিয়েছি। এর কারণ হল  আরহেনিয়াস মতবাদ কেবল পানিতে দ্রবীভূত অবস্থাতেই অম্ল আর ক্ষারকের আচরণ ব্যাখ্যা করতে পারে। জলীয় দ্রবণে অম্ল ক্ষারকের বিক্রিয়া ব্যাখ্যায় এই মতবাদ এককথায় অব্যর্থ। অন্যসব ক্ষেত্রে আরহেনিয়াস সাহেব দুই বাহু তুলে সারেন্ডারের ভঙ্গী করেন এবং বলেন “ইহা ব্যাখ্যা করা আমার কম্ম নয়”।

তো এই মতবাদ অনুযায়ী HCl, H2SO4, H3PO4, HNO3, CH3COOH – এরা সবাই হল এসিড কেননা জলীয় দ্রবণে এরা সবাই H+ দান করে (তুমি বলবে – আরে ধুর! এটা তো আমি সেই বাচ্চাকাল থেকে জানি 😛 )।

HCl (g) + H2O (l) → H+ (aq) + Cl (aq)

H2SO4 (l) + H2O (l) → H+ (aq) + HSO4– (aq)

CH3COOH (l) + H2O (l) → H+ (aq) CH3COO (aq)

আর NaOH, KOH, Ca(OH)2 রা হল ক্ষারক কারণ এরা পানিতে OH দান করে (এটাও জানি :/ )।

NaOH (l) + H2O (l) → Na+ (aq) +  OH (aq)

Ca(OH)2 (l) + H2O (l) →  Ca2+ (aq) +  2OH (aq)

তৃতীয় পয়েন্টটা মনে আছে? প্রশমন বিক্রিয়া ঘটে কারণ অম্লের  H+ ও ক্ষারকের OH বিক্রিয়া করে H2O তৈরি করে, যা একটি প্রশম যৌগ (H2O এর ভেতর অম্ল বা ক্ষারকের ধর্ম মোটামুটি নেই)। তাহলে একবার মিশিয়েই দেখি যেকোনো একটা অম্লের দ্রবণের সাথে যেকোনো একটা ক্ষারকীয় দ্রবণকে 😀

Na+ (aq) + OH (aq) +  NO3 (aq) + H+ (aq)  → Na+ (aq) + NO3 (aq) + H2O (l)

বিক্রিয়াটাকে পরিমার্জন করে এভাবেও লেখা যায় –

NaOH (aq) + HNO3 (aq) → Na+ (aq) + NO3 (aq) + H2O (l)

একটা জিনিস চোখে পড়েছে? ক্ষারকের Na+ আর অম্লের NO3  দ্রবণে বিক্রিয়ার আগে যেভাবে ছিল, বিক্রিয়া ঘটবার পরেও একইভাবে থেকে যাচ্ছে। অর্থাৎ বিক্রিয়াটা প্রকৃতপক্ষে কেবল পানির অণু তৈরিতেই সীমাবদ্ধ, এই আয়নগুলোর যেন কোনো কাজই নেই। বেকার এই আয়নগুলোর একটা কাজের নাম অবশ্য দিই আমরা, ডাকি দর্শক আয়ন (Spectator ion) বলে।

শুধু কি OH আয়নধারী ক্ষারক? ধাতব অক্সাইডগুলোও তো অম্লের সাথে এই বিক্রিয়া দিতে পারে –

CaO + 2HCl  → CaCl2 + H2O

আরহেনিয়াস সাহেব, এই প্রশ্নের উত্তর দেন?

আরহেনিয়াস তখন মাথা চুলকে বললেন, কঠিন ধাতব অক্সাইডরা আসলে পানির সাথে বিক্রিয়া করে প্রথমে ধাতব হাইড্রোক্সাইড হয়ে নেয়। তাই পরবর্তীতে তারা সাফল্যের সাথে প্রশমন বিক্রিয়া ঘটাতে পারে।

CaO (s) + H2O (l) → Ca(OH)2 (aq)

এরপর এই Ca(OH)2 আয়নিত হয়, বাকীটা তো ইতিহাস!

আমাদের প্রাণপ্রিয় NH3 গ্যাসকেও পানিতে চালনা করে দ্রবণ বানানোর পর অম্লের সাথে এভাবে বিক্রিয়া দিতে দেখা যায় এই কারণেই।

 NH3 (g) + H2O (l) → NH4OH (aq)

যদি এই দ্রবণে HCl (aq) নিই তাহলে যা হবার তাই হবে, বিক্রিয়া হবে এমন –

NH4OH (aq) + HCl (aq) → NH4Cl (aq) + H2O (l)

সব মানলাম, সব বুঝলাম। কিন্তু খটকা বাঁধে তখন যখন আমরা দেখি অ্যামোনিয়া গ্যাস অবস্থায় হাইড্রোজেন ক্লোরাইড গ্যাসের সাথে যুগলবন্দী হয়ে NH4Cl তৈরি করে ফেলে!!

NH3 (g) + HCl (g) → NH4Cl (g)

বিস্ময়ে চিৎকার করে যখন আমরা বলে উঠি “দ্রবণ টবণ কিচ্ছু নাই! ক্যামনে কী?” তখন দেখা যায় পিছন থেকে জনাব আরহেনিয়াস আস্তে করে সটকে পড়লেন। ঐ যে তিনি বুঝে গিয়েছেন, ইহা তার কম্ম নয় 🙁

আরহেনিয়াস মতবাদের সবচেয়ে বড় সীমাবদ্ধতাটা এখানেই। এ মতবাদে জলীয় দ্রবণ ছাড়া আমরা একরকম অন্ধ যদি কোনো যৌগকে অম্ল বা ক্ষারক এর স্বীকৃতি দিতে বলা হয়।

ঝামেলা আরো একটা আছে। উপরের প্রত্যেকটা প্রশমন বিক্রিয়ায় দেখ উৎপন্ন হয়েছে লবণ আর পানি। তারমানে আমরা ধরেই নিয়েছি সমতুল পরিমাণ ক্ষারক আর অম্ল (মানে 1 mol NaOH এর সাথে, 1 mol HCl কিংবা 1 mol Ca(OH)2 এর সাথে 2 mol HCl; সমতাকৃত সমীকরণে অম্ল ক্ষারক যে মোল অনুপাতে বিক্রিয়া করছে সেই অনুপাতে নেওয়া অম্ল ক্ষারকই পরস্পর সমতুল) বিক্রিয়ার পর প্রাপ্ত দ্রবণটা নিরপেক্ষ হতে যাচ্ছে। কিন্তু দেখা যায় Cu(OH)2 আর H2SO4 এর বিক্রিয়ায় যে CuSO4 এর দ্রবণ পাওয়া যায় তা বেশ অম্লীয়। আবার KOH আর H2CO3 থেকে পাওয়া K2COএর দ্রবণও প্রশম নয়, বরং ক্ষারীয়। এই সমস্যাটা হয় কারণ আরহেনিয়াস মতবাদ খুবই সরল হবার কারণে তা ব্যাখ্যা করতে পারে না ক্ষারক কিংবা অম্লের শক্তিমাত্রা। সাধারণত শক্তিশালী অম্ল আর দুর্বল ক্ষারকের মিশ্রণে পাওয়া দ্রবণ অম্লীয় আর শক্তিশালী ক্ষারক এবং দুর্বল অম্লের বিক্রিয়ায় পাওয়া দ্রবণ ক্ষারীয় হয়; অম্ল আর ক্ষারক উভয়েই সবল হলে দ্রবণ নিরপেক্ষ হয় – যার সন্তোষজনক ব্যাখ্যা আমরা পরবর্তীতে অম্ল-ক্ষারকের ব্রনস্টেড-লাউরি মতবাদ হতে পাই। এই মতবাদটিই আমাদের আগামী পর্বের আলোচ্য।

সবকিছুর পরেও আরহেনিয়াস মতবাদের একটা উল্লেখযোগ্য সাফল্য আছে। যেহেতু আমরা দেখতে পাই, প্রশমন বিক্রিয়া মূলত পানির অণু তৈরির বিক্রিয়া ছাড়া আর কিছুই নয়, তাহলে সকল প্রশমন বিক্রিয়ায় এনথালপির পরিবর্তন একই মানের হওয়া উচিত অর্থাৎ সকল ক্ষেত্রে পানি তৈরির দরুণ যে তাপশক্তি উৎপন্ন হয়, কেবল সেটাই দৃশ্যমান হবার কথা। সত্যিই দেখা যায় যে, সবল অম্ল ও সবল ক্ষারকের বিক্রিয়ায় প্রতি অণু পানি তৈরির জন্য একই পরিমাণ তাপ নির্গত হচ্ছে ও তার মান 57.3 KJ। আমরা এটাকে প্রকাশ করি এভাবে : শক্তিশালী অম্ল ও ক্ষারকের প্রশমন বিক্রিয়ায় এনথালপির পরিবর্তন ΔH = -57.3 KJ। আবার শক্তিশালী অম্ল ক্ষারকের কথা চলে আসল, তাই না? কী আর করার? সবল অম্ল ও ক্ষারগুলো পরিপূর্ণভাবে আয়নিত হয়ে যায় জলীয় দ্রবণে, যার ফলে তাদের কাছ থেকে মনমত পরিমাণে H+ ও OH পাব কি পাব না তা নিয়ে চিন্তা করতে হয় না, সমীকরণ মোতাবেক ঠিকঠাক পরিমাণেই পানি উৎপন্ন হয়। কিন্তু দুর্বল এসিড বা ক্ষারক শতভাগ আয়নিত না হবার কারণে উৎপন্ন পানির পরিমাণে ঘাপলা থেকে যায়। তাছাড়া উৎপন্ন তাপের কিছু পরিমাণ তারা নিজেরাই শোষণ করে নেয় নিজেদের বিয়োজন বাড়ানোর স্বার্থে। এজন্যই দুর্বল অম্ল-ক্ষারকের বিক্রিয়া তাপ মাপাটা হাড় জ্বালাতন করে করে ছাড়ে আমাদের 🙁 (চলবে)