মাদাগাস্কার । নামটা শুনেই সবার প্রথমে মাথায় আসে একটা এনিম্যাটেড মুভির  কথা।

IMDB রেটিং এ প্রায় ৭.০০ এর কাছাকাছি যাওয়া একটা এনিম্যাটেড মুভি।এযাবত কালের সর্বোচ্চ রেটিং ৯.২ থেকে মাত্র দুই কম !মনে পড়েছে? Alex,Marty,Melmen,Gloria ইত্যাদি ইত্যাদি ক্যারেক্টারগুলোর কথা? আর তাদের মজার মজার বিভিন্ন কান্ড কারখানা !নামটা মাদাগাস্কার হওয়ার পেছনের কারণটা হল, আসলেই মাদাগাস্কার নামের একটা দেশ আছে,যেখানে এরকম অনেক অনেক প্রানি আছে! আজকে আমাদের অভিজান ওই দেশের আনাচে কানাচে !

আচ্ছা,মুভিতে একটা কাঠবিড়ালি দেখা যায়, যার নাম সম্ভবত King Julien। কিম্ভুতকিমাকার আচরণের জন্যে সে বিখ্যাত,যারা মুভিটা দেখেছে তারা ভালই বলতে পারবে!

এই সেই কিং জুলিয়ান !! :D

এই সেই কিং জুলিয়ান !! 😀

কখনো কি মনে প্রশ্ন এসেছে এইরকম একটা প্রাণীকে কেন এত মজার,হাস্যকর কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র দেয়া হল? কোনো কারণ নাও থাকতে পারে,তবে আমার মনে হয় এর কারণ আছে।  🙂

এর কারণ হল, এই প্রাণী মাদাগাস্কার ছাড়া আর পৃথিবীর কোথাও পাওয়া যায়না! আরো একটা উল্ল্যেখযোগ্য বিষয় হল,জুলিয়েন কিন্তু আসলে কাঠবিড়ালি না,এর নাম লেমুর।এছাড়া আরো প্রায় ১০০ প্রজাতি এবং উপপ্রজাতির লেমুর আচ্ছে এই দেশে,যা পৃথিবীর আর কোথাও পাওয়া যায়না।লেমুরকে মাদাগাস্কারের স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মধ্যে প্রাধান্য দিয়ে “Conservation International” এর পক্ষ থেকে একে “Madagascar’s flagship mammal specieces” ঘোষণা দেয়া হয়েছে। julien এর নামের আগে king লাগানোটাও বোধয় এ কারণে। সে যাহোক, মুভির আলোচনা/সমালোচনা আপাতত বন্ধই রাখি।

রিং টেইল্ড লেমুর। এ যেন কিং জুলিয়ানের থ্রী ডি ভার্সন !

রিং টেইল্ড লেমুর। এ যেন কিং জুলিয়ানের থ্রী ডি ভার্সন !

এইসব বিলুপ্ত প্রায় প্রাণীদের এন্ডেমিক বলা হয়।মাদাগাস্কারে প্রচুর এন্ডেমিক প্রাণী ও গাছপালা আছে।এত বেশি এন্ডেমিক প্রাণী ও গাছপালার সমাহার একটি জায়গায়,এরকম স্থান পৃথিবীতে বিরল ই বলা চলে!

এখানে প্রায় ৩০০ রকম পাখ-পাখালী আছে,যার মধ্যে প্রায় ২০০ প্রজাতি(৬০%) পৃথিবীর এন্ডেমিক।সরিসৃপ শ্রেণীর প্রাণীও প্রায় এরকম ই,যার মধ্যে ৯০% হল এন্ডেমিক।বহুরূপী বা গিরগিটি শ্রেণীর প্রাণীর উদ্ভবই এই দেশ থেকে বলে অনেকে মনে করেন।মেরুদন্ডী প্রাণী নিয়ে এতটা গবেষণা না হলেও,বিজ্ঞানীদের মধ্যে প্রচুর এন্ডেমিক মেরুদন্ডী প্রাণী এই দ্বীপে পাওয়া যায় বলে মনে করেন। এছাড়া,প্রায় ৬৫০ প্রজাতির শামুক শুধুমাত্র এখানেই পাওয়া যায় !

আর গাছপালার কথা বলতে গেলে আসলে শেষ ই হবেনা।উইকিপিডিয়ার তথ্যানুযায়ী,প্রায় ১৪৮৮৩ টি প্রজাতির গাছপালা এখানে আছে,যার মধ্যে ৮০% ই পৃথিবীর আর কোথাও পাওয়া যায়না !এরকম বৈচিত্রময় প্রাচুর্যতার কারণে, “Conservation International” এই দেশকে “Diversity Hotspot” ঘোষণা করেছে! অনেক ইকোলোজিস্ট এই দেশকে অষ্টম মহাদেশ বলেও মনে করে থাকে!

যাইহোক, কেন এত বৈচিত্র? এত এত বিলুপ্ত প্রায় গাছপালা,প্রাণী,সব এই দেশে? আচ্ছা এটা বুঝতে হলে এর গঠন গড়ন সম্পর্কে একটু ছোট্ট ধারণা প্রয়োজন!

প্রায় ১৩৫ মিলিয়ন বছর আগে,প্রাগৌতিহাসিক যুগে,পুরো পৃথিবীর স্থলভাগ একসাথে ছিল। পরে ভাংগনের কারণে বৃহত এ ভুখন্ড ভেঙ্গে দুভাগ হয়ে দুদিকে সরে যায়। এদের বলা হয় সুপার-কন্টিনেন্ট। নাম গন্ডোয়ানা আর লরেশিয়া। মাদাগাস্কারকে,ইন্ডিয়া,এন্টার্ক্টিকা কে সংগে নিয়ে গন্ডোয়ানা লরেশিয়া থেকে আলাদা হয়ে দূরে সরে যায়। পরে এখন থেকে প্রায় ৮৮মিলিয়ন বছর আগে মাদাগাস্কার ইন্ডিয়া আর এন্টার্কটিকা থেকে আলাদা হয়ে যায়।এটি দ্বীপে রূপান্তর হয়। এইযে,প্রায় ৮৮ মিলিয়ন বছর ধরে এটি সম্পুর্ণ আলাদাভাবে জীবনরসের যোগান দিয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত,এটাই এর বৈচিত্রতার মূল কারণ।সবগুলো দেশ,মহাদেশ থেকে আলাদা হয়ে,শুধু এর ভেতরকার রসদ নিয়ে ,বিবর্তনের মাধ্যমে যেসব প্রাণী,গাছপালা গড়ে উঠেছে,তার সবই প্রায় সতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের !

মাদাগাস্কার সম্পর্কে এবার একটা মজার তথ্য বলি। আসলে এর নাম মাদাগাস্কার না! মালাগাসি(মাদাগাস্কার এর ভাষা) ভাষায় মাদাগাস্কার নামের কোনো অর্থবহুল শব্দ নেই ! আসলে মধ্যযুগে,প্রায় ১৩য় শতাব্দীর দিকে,মার্কো পোলো (ইতালীয় বণিক),তাঁর book of the marvels of the world বইএ ভুল করে ,সোমালি পোর্টের মোগাধিসু র সাথে গুলিয়ে ফেলে এর নাম মাদাগাসিকারা অন্তর্ভুক্ত করেন।তাঁর এই ভুলের কারণে ,মালাগাসি(মাদাগাস্কারের মানুষ)-দের,যুগ যুগ ধরে,অর্থহীন একটা নাম নিয়ে বেঁচে থাকতে হচ্ছে! পরে ১৫০০ শতাব্দীর দিকে,পর্তুগীজ অনুসন্ধানকারী Diogo Dias এর নাম সাউ লরেন্সো রাখলেও, রেনেসার ম্যাপে ,মাদাগাস্কার নামটাই খুঁজে পাওয়া যায়। তাই শেষ পর্যন্ত এই নামটাই টিকে গেছে।

অনেক সুন্দর,তাইনা?

অনেক সুন্দর,তাইনা?

seychelles-island@2x

আফ্রিকার দক্ষিন-পূর্ব উপকূলের দিকে ,ভারত মহাসাগরে ভেসে থাকা এই দ্বীপটি পৃথিবীর চতুর্থ বৃহত্তম দ্বীপ।আর দেশ হিসেবে ৪৭তম । মাদাগাস্কারের মানুষের মধ্যেও জাতিগত ভাবে অনেক বৈচিত্র লক্ষ্য করা যায়।বিভিন্ন প্রজাতির বাস এই দেশে,যার মধ্যে ‘মেরিনা’ উপজাতির সংখ্যাই বেশি।এছাড়া বেটসিমিসারাকা,বেটসিলিও,সিমিহেতি ইত্যাদি আরো অনেক জাতি আছে যাদের সংখ্যা তূলনামূলকভাবে বেশি।

যদি কখনো কেউ মাদাগাস্কারে যায়,ইংরেজি বলে খুব একটা সূবিধা করতে পারবে বলে মনে হয়না! 😛  কারণ,সেখানকার দ্বিতীয় ভাষা ইংরেজি নয়,ফেঞ্চ! আর প্রথম ভাষা তো তাদেরই মাতৃভাষা , মালাগাসি ।অফিশিয়াল ল্যাংগুয়েজ বলে কোনো ভাষার কথা লিখিত নেই! তবে অলিখিত ভাবে,মালাগাসি মতান্তরে ফ্রেঞ্চ কে অফিস আদালতে অফিশিয়াল ল্যাঙ্গুয়েজ হিসেবে ব্যবহার করা হয়।

ইংরেজির রাজত্বে ফ্রেঞ্চ সেকেন্ড ল্যাঙ্গুয়েজ হওয়ার কারণ একসময় ফ্রান্সের অধিনে ঔপনিবেশিক শাসনে ছিল এই দেশ।২৯ জুন,১৯৬০ সালে স্বাধীনতার দেখা পায়,এলেন,জুলিয়েনের মাদাগাস্কার !এর আগের শাসনামলগুলোও খুব একটা সুখকর ছিলনা। সে নিয়ে আজ আর না-ই বলি।

ধার্মিকভাবে এ দেশে নিজেদের ঐতিহ্যবাহী ধর্মাবলী ই বেশি,তবে ১৮৩৫ এর দিকে লন্ডন মিশনারি সোসাইটি এ দেশে খৃষ্টান ধর্মের গোড়া পত্তন করেন। ইসলামধর্মাবলম্বীও আছে ,আরববণিকদের চেষ্টার ফসল যা।লন্ডন মিশনারি সোসাইটি শুধু ধর্মপ্রবর্তন করেই ক্ষান্ত দেয়নি, প্রথম ইউরোপিয়ান ধাঁচের স্কুলটাও স্থাপন করেছিল তারা।বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় দেশটা মোটামুটি এগিয়েই আছে বলা যায়,রাভালোমানানা শাসনামলে(২০০২-২০০৯) ৬ থেকে ১৩ বছর বয়সের সকল শিশুর জন্য লেখাপড়া আবশ্যিক এবং বিনামূল্য করা হয়েছে।এদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় ৫ বছর পর্যন্ত প্রাইমারী লেভেলের পড়াশুনা হয়,আর মাধ্যমিক কে লোয়ার ও আপার দু ভাগে ভাগ করে যথাক্রমে চার ও তিন বছর পর্যন্ত পড়ানো হয়। প্রতিটি অঞ্চলে অন্তত একটি প্রাইমারি স্কুল আছে,আর প্রতিটা প্রজাসভায় একটা করে লোয়ার লেভেল মাধ্যমিক স্কুল আছে।

যদিও ড্রপ আউটের সংখ্যা নিতান্ত কম নয়,এবং পড়ালেখার মান ও এতটা ভালো নয়,তবুও সরকার চেষ্টা করে যাচ্ছে একটা স্বাক্ষর জাতি উপহার দিতে।

মাদাগাস্কারে অনেক জাতির মানুষ থাকলেও তাদের মধ্যে এক গভীর মিতালি বিদ্যমান,যা তাদের ঐক্যকে আরো সুদৃঢ করে তুলেছে।

আরো অনেক অনেক তথ্য হয়তো দেয়া যেত,কিন্তু তথ্যের ভারে ভারাক্রান্ত করা আমার লেখার উদ্দ্যেশ্য ছিলনা,তাই আর কথা বাড়াচ্ছিনা। যা তথ্য দিয়েছি তার বেশিরভাগই উইকিপিডিয়া এবং অন্যান্য সাইট থেকে নেয়া। কেউ আরো বিস্তারিত জানতে চাইলে গুগলের সাহায্য নেয়া যায়।[শেষে কিছু সাইটের লিংক দিয়ে দিচ্ছি,যা মাদাগাস্কার সম্পর্কে জানতে সাহায্য করবে 🙂 ]

আসলে জানার মত আরো অনেক কিছু আছে। মাদাগাস্কার -এর মানুষ সম্পর্কে জানার আছে,মানুষগুলোর কালচার,জীবিকা,জীপনযাপনের ধরণ ,এদেশের ইতিহাস সব কিছুই আসলে মনোমুগ্ধকর কিছু রহস্যকে উদ্ঘাটন করে ।এছাড়া প্রকৃতির নৈসর্গিক সৌন্দর্য্যের কথা আর কি ই বা বলব, It is a part of beautiful Africa !! 🙂

সামগ্রিকভাবে বলব,কখনো আফ্রিকা ঘুরে দেখার সূযোগ হলে,সবার আগে যেই দেশটাতে যেতাম আমি,সেই দেশটা হল Republic of Madagascar !  😀

মাদাগাস্কার সম্পর্কে একপলকে কিছু তথ্য
সাংবিধানিক নামঃ        Republic of Madagascar

  • Repoblikan’i Madagasikara  (Malagasy)
  • République de Madagascar  (French)
আয়তন(ক্ষেত্রফল):       ৫৮৭০৪১ বর্গ কিলোমিটার
জনসংখ্যাঃ       ২২০০৫২২২(২০১২সালের তথ্যানুযায়ী)
রাজধানীঃ       আন্টানানারিভো
জনসংখ্যার ঘনত্বঃ       প্রতি বর্গ কিলোমিটারে ৩৫জন
ভাষাঃ       মালাগাসি,ফ্রেঞন
জাতীয় সংগীতঃ        Ry Tanindrazanay malala ô!
        (Oh, Beloved Land of our Ancestors!)

লিংক ১ঃ https://en.wikipedia.org/wiki/Madagascar

লিংক ২ঃ http://travel.nationalgeographic.com/travel/countries/madagascar-facts/

লিংক ৩ঃ http://www.worldatlas.com/webimage/countrys/africa/mg.htm