জগতের সবচেয়ে বহুল প্রচলিত, জনপ্রিয় সূত্র কিংবা কথা সম্ভবত এটাই, To every action there is an equal and opposite reaction । আমরা আর কোন সূত্র বুঝি না বুঝি এই সূত্রে সবাই এক পায়ে খাড়া। এত সহজ সূত্র হয় নাকি আবার। বেশি সহজ বলে এক ছাত্র প্রশ্ন করেছিল, ‘এটা তাহলে নিউটনের ৩য় সূত্র কেন? ১ম সূত্র হওয়ার কথা না এটা? 🙄 ’ নিউটনের মাথায় এই সহজ জিনিসটা প্রথমে আসল না কেন? অথচ যুক্তরাজ্য ভিত্তিক একটা গবেষণায় দেখা যায়, শতকরা ৮১ শতাংশ শিক্ষিত মানুষেরই এই সূত্র নিয়ে ভুল ধারণা (mis-conception) রয়েছে 😯 ।

                                                                      Newtons_Third_Law_of_Motion
আমাদের আলোচনার শুরুতেই কিছু প্রশ্ন রাখতে চাই; এ প্রশ্নগুলো কেন্দ্র করেই মূলত ভ্রান্তি তৈরি হয়। একে একে এসব প্রশ্নের উত্তর দেয়া হবেঃ
১। ধরুন আপনি একটি বস্তুর ওপর F বল প্রয়োগ করছেন। এখন নিউটনের ৩য় সূত্র অনুযায়ী বস্তুও সমান F বল প্রয়োগ করবে বিপরীত দিকে। তাহলে সামনের দিকের F আর পিছন দিকের F কাটাকাটি (একে অপরকে নিষ্ক্রিয় করে দিবে)। তাহলে বস্তু সামনে আগায় কি করে 😯 ? ( এই হাস্যকর প্রশ্ন দিয়েই কাবু করা হয়েছিল ৮১ শতাংশ মানুষ কে)
২। ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া কি সকল ক্ষেত্রেই সমান? তাহলে ধরুন একটা চলন্ত ট্রেনের সাথে একটা মাছি ধাক্কা খেল (চলন্ত ট্রেনের ধাক্কা’র কথা চিন্তা করুন 😕 ) , ৩য় সূত্র অনুযায়ী মাছিও সমান বলে ট্রেন কে ধাক্কা মারবে। তাহলে? বিপরীত দিক থেকে আরেকটা ট্রেনের ধাক্কার সমতুল্য এই ধাক্কার পরও ট্রেন চলে কীভাবে? অদ্ভুতুড়ে ব্যাপার স্যাপার।
৩। আমরা মাটিতে দাঁড়িয়ে থাকি নিউটনের ৩য় সূত্রের কল্যাণে। আমরা মাটিকে আমাদের ওজনের সমান বলে ধাক্কা দেই, মাটিও সমান বলে আমাদের উপরের দিকে ধাক্কা মারে। ধাক্কা-ধাক্কি কাটাকাটি; আমরাও মাটির ওপর খাড়া। খুব সহজ হিসেব। কিন্তু প্রশ্ন হল, তাহলে আমরা পানি’র উপর দাড়াতে পারি না কেন? পানি’তেও তো আমরা আমাদের পুরো শরীর ছেড়ে দিয়ে সমস্ত ওজন দেই; তাহলে পানি কেন আমাদের ওজনের সমান বল ব্যাক করে না। তাহলে কি আমাদের ওজনের চেয়ে কম বল ব্যাক করে? কিন্তু তা কি করে হয়? নিউটন তো এই বলেই মারা গিয়েছিল যে , “ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া সমান।  😯 ”
নিউটনের ৩য় সূত্র তো খুব বেশি সহজ, তাই এই নিয়ে আলাদা আলোচনার কিছু কি আছে? তাহলে এই প্রশ্ন গুলোর উত্তরই দেয়া যাক,
১ম প্রশ্নের উত্তরে আসি, এই প্রশ্নে বিভ্রান্ত হওয়ার মুল কারণ হল আমরা নিউটনের ৩য় সূত্রের একটা ছোট্ট পয়েন্ট মিস করে যাচ্ছি। ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া সমান এতো মুখস্থ, কিন্তু আমরা খেয়াল করতে ভুলে যাই যে, ক্রিয়া এবং প্রতিক্রিয়া সবসময়ই ২ টি ভিন্ন বস্তুর ওপর কাজ করে; কখনইই একই বস্তুর ওপর কাজ করতে পারে না। আমরা যখন বস্তুকে ধাক্কা দিচ্ছি, তখন সেটা ক্রিয়া। ফলে বস্তুও প্রতিশোধ নিতে আমাদের ধাক্কার বিপরীতে প্রতিক্রিয়া বল দেয়। এই প্রতিক্রিয়া শুধু আমাদের ওপরই কাজ করে, বস্তুর ওপর নয়। তাই আমরা যে, ক্রিয়া এবং প্রতিক্রিয়া ২টোই বস্তুর ওপর ধরে কাটাকাটি করেছিলাম, তা একেবারেই ভুল। এটা কখনই করা যাবে না; করা গেলে আমরা আসলে কখনওই কোন বস্তুকে বল প্রয়োগ করে গতিশীল করতে পারতাম না। সেক্ষেত্রে ধাক্কা-প্রতিধাক্কা কাটাকাটি হয়ে বস্তু স্থির থাকত। এবার তাহলে বল তো এই প্রতিক্রিয়া বল’টা কোথায় হারিয়ে যাচ্ছে? এর কি কোনই প্রভাব নেই আমাদের ওপর ? অথচ এরই সহোদর, ক্রিয়া’র প্রভাবে বস্তু কি সুন্দর সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
হ্যা, ক্রিয়ার মতই প্রতিক্রিয়াও সমান প্রভাব বিস্তার করে, কিন্তু সেটা চাক্ষুষ নয়। কারণ, ক্রিয়া’র ক্ষেত্রে বস্তুর দিকে বল প্রয়োগ করা হয়, ফলে ক্রিয়াকারী বস্তুর সামনের দিকে ভরবেগ সৃষ্টি হয়। তাই প্রতিক্রিয়া বল যখন ক্রিয়াকারী বস্তুর ওপর আঘাত হানে তখন সামনের দিকের ভরবেগ এবং পেছন দিকের প্রতিক্রিয়া একে ওপরকে অনেকটাই নাকোচ করে দেয়। ফলে প্রতিক্রিয়া’র প্রভাব চাক্ষুষ নয়। তবে মাঝেমধ্যে এই প্রতিক্রিয়া বলও স্বরূপ দেখিয়ে ছাড়ে। যেমন, দেয়াল ধাক্কা দিলে দেয়ালের কিছুই হয় না, কিন্তু প্রতিক্রিয়া বল ধাক্কাকারী কেই পেছনে আছড়ে ফেলে 🙄 ।

এবার ২য় প্রশ্নের ক্ষেত্রে কী ঘটছে দেখা যাক? এখানে ট্রেন মশাকে কি আসলেই অনেক জোরে ধাক্কা (বলপ্রয়োগ) দিবে? নিউটনের ২য় সুত্র কি বলে? ক্রিয়াশীল বল ভরবেগের পরিবর্তনের হারের সমানুপাতিক (সংখ্যাগতভাবে সমান)। তাহলে এ ক্ষেত্রে মশার উপর ক্রিয়াশীল বল হবে অতিক্ষুদ্র, কেননা মশার ভর অতিনগন্য। ফলে বেগের পরিবর্তন যাই হোক না কেন, ভরের অতি নগন্যতার কারণে ক্রিয়াশীল বলও অতি নগন্য পর্যায়ে নেমে আসে। ক্রিয়া বল নগন্য, ফলে ট্রেনের ওপর প্রতিক্রিয়া বলও উপেক্ষনীয়। এখানেও নিউটনের ৩য় সূত্রের কোনই ব্যত্যয় ঘটে নি। একই সাথে নিউটনের ২য় সূত্রের প্রয়োগ ঘটেছে। এখানে প্রসঙ্গক্রমে বলা যায় যে, বস্তুর ভর যত বেশি তার উপর ক্রিয়াশীল বল তত বেশি হওয়ার সম্ভাব্যতাও বেড়ে যায়। সম্ভাব্যতা বলছি একারণে যে, বল ভর ছাড়াও বস্তুর বেগের পরিবর্তনের উপরও নির্ভর করে।

৩য় প্রশ্নের উত্তরে আসি, মানুষ কেন পানির উপর দাড়াতে কিংবা হাটতে পারে না? তার আগে দেখা যাক, মানুষ মাটি’র উপর দাড়ায় কিভাবে। মাটির উপর মানুষ তার *ওজনের সমান বল প্রয়োগ করে, মাটি’ও সমান বলে প্রতিক্রিয়া দেয়। ফলে সাম্যাবস্থা বজায় থাকে এবং আমরা ঠিকঠাক দাঁড়াতে পারি।

[ওজন হল আমরা যেই তলের সাথে যুক্ত, সেই তলে যে পরিমান বল দেই তাই। যেমন, মুক্ত ভাবে পড়ার সময়ে আমরা কোন বস্তুর ওপর কোন বল প্রয়োগ করতে পারি না, ফলে ওজন ০। আবার লিফটে ওঠার সময়ে m(g+a) এবং নামার সময়ে m(g-a) বল প্রয়োগ করি মেঝের উপর। ফলে প্রতিক্রিয়া হিসেবে লিফটও ওঠার এবং নামার সময়ে যথাক্রমে আমাদের ওজনের চেয়ে বেশি {m(g+a)} এবং কম {m(g-a)} বল দেয়। এবং আমরা যথাক্রমে ভারী এবং হালকা অনুভব করি]

কিন্তু পানির উপর আমরা আমাদের ওজনের সমান বল দিতে পারি না।  পানি তরল বলে ওজনের সমান বল দেয়ার অনেক আগেই পানি ছড়িয়ে পড়ে। অন্যান্য তরলের মত পানিও খুব সহজেই আকার পরিবর্তন করে, স্থিতিস্থাপকতা অনেক কম। তাই আমরা আসলে পানি’র উপর আমাদের ওজনের সমান বল দেই না (দিতে পারলে তো দিব!), তার চেয়ে অনেক কম বল দেই। ফলে পানি’ও প্রতিক্রিয়া হিসেবে আমাদের ওজনের চেয়ে অনেক কম বল দেয়। এই কম বল আমাদের কে পানি’র ওপর খাড়া রাখতে পারে না। ফলে ধীরে ধীরে পানির নিচে তলিয়ে যাই 😛 । এ ঘটনা টা আর্কিমিডিসের সূত্র দিয়েও ব্যাখ্যা করা যায়।

আমাদের দৈনন্দিন জীবনের প্রায় সব ক্ষেত্রেই এই ৩য় সূত্রের প্রয়োগ দেখা যায়। তবে কোন কোন ক্ষেত্রে অপব্যবহারও লক্ষ করা যায়। যেমন,ঘূর্ণায়মান বস্তুর ঘূর্ণনের ব্যাখ্যা দেয়া হয়, আকাশ থেকে পেড়ে আনা প্রতিক্রিয়া বল ‘কেন্দ্রবিমুখী বল’ এর মাধ্যমে। এমনকি অনেক বিখ্যাত বই-পুস্তকে, National Geographic এর ডকুমেন্টারিতেও এ নিয়ে অপব্যাখ্যা করা হয় 😎 ।  এটা বহুল প্রচলিত একটা ভ্রান্ত ধারণা (mis-conception) ছাড়া আর কিছুই নয়। এই ভ্রান্ত ধারণা (mis-conception) নিয়ে শীঘ্রই স্বশিক্ষা’য়  আর্টিকেল বের হবে। 😉

আমরা উঠতে-বসতে সবখানেই ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার খেলা দেখি; হয়ত তেমন ভাবে চোখে পড়ে না। অথচ যেকোন ঘটনায়,স্পর্শে ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া থাকেই।  এছাড়া আমরা পড়ে এসেছি পৃষ্ঠটান, কৌশিকতা নিয়ে; এই কৌশিকতা কিন্তু ক্রিয়া বল নয় প্রতিক্রিয়া বল এর ফসল। যেমনটা আমাদের হাঁটা চলা ইত্যাদি প্রতিক্রিয়া’র কারণেই হয়ে থাকে।

আচ্ছা বলুন তো, ক্রিয়া কোনটা আর প্রতিক্রিয়া কোনটা। সচরাচর আগের টা’কে ক্রিয়া ধরা হয় এবং পরের টা’কে প্রতিক্রিয়া ধরা হয়। কিন্তু ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া’র তো আগে পরে নেই, একসাথেই হয়! আসলে এ নিয়ে বিভ্রান্ত হওয়ার কোনই কারণ নেই। এ ব্যাপার গুলো আসলে আপেক্ষিক। এটা নিয়ে চুল্কানি’র কিছু নেই।

ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া এবং ভরবেগের পরিবর্তন এ ২টি ধারণা একত্রিত করে ভরবেগের সংরক্ষণ সূত্র, আর এই সূত্র  কাজে লাগিয়ে অসংখ্য যুগান্তকারী আবিষ্কার রয়েছে মানুষের। রকেট, জেট প্লেন, এক্সিলেটর ইত্যাদি আসলে ভরবেগের সংরক্ষণ সূত্রের প্রয়োগ ছাড়া আর কিছুই নয়। এ প্রসঙ্গে বলে রাখি, যে ভরবেগের পরিবর্তন শুধু বই পুস্তক অনুযায়ী একমাত্রিক/ সরলরৈখিক হবে এমন কোন কথা নেই। দ্বিমাত্রিক, ত্রিমাত্রিক যে কোন ক্ষেত্রেই ভরবেগের সংরক্ষণ সূত্র কাজ করে, ঠিক আগের মতই।

                    elas_col

যেমন, উপরের ক্ষেত্রে ভরবেগের সংরক্ষণ সূত্র বলা যায় ,

m1u1 cos0+ m2 u2 cos0 = m1v1 cosθ+ m2 v2 cos φ

বোমা ফাটার ক্ষেত্রেও দেখা যায় সবদিকে ছড়িয়ে পড়া বিচ্ছিন্ন কণা গুলোর সামগ্রিক ভরবেগ সমষ্টি শুন্য! 😯 কারণ, আদি ভরবেগও যে ছিল শুন্য।

u4l2e1

এরকম আরো বহু ক্ষেত্রে প্রয়োগ ঘটে ভরবেগের সংরক্ষণ সূত্র, নিউটনের ৩য় সূত্রের…

uesc_03_img0155c044dfb5c775bc22441f8dc252914d74d99aa369 flying-bird-newton-third-law-of-motion newtons-laws-airplane Physice_For_Kids_Balloon_TheZeroLife.Com_action-reaction-forces

উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের শেষ দিকে এসে সবাই যখন আইনস্টাইনের ‘আপেক্ষিকতা তত্ত্ব’র সাথে পরিচিত হয়, তখন তীব্র অবিশ্বাস জাগে বিষয়গুলো নিয়ে। কারণ এই আপেক্ষিকতা তত্ত্ব আমাদের প্রিয় নিউটনের সূত্র গুলোকে হুমকির মুখে ঠেলে দেয়। আমরা জানতে পারি দৈর্ঘ্য, সময় ভর এসব কিছুই ধ্রুব নয়। নিউটনের মৌলিক স্বীকার্য গুলো ভেঙ্গে পড়ে সেখানে।

নিউটনের ১ম সূত্র, ২য় সূত্র৩য় সূত্র নিয়ে প্রচুর ভ্রান্তির পরও এগুলোই কিন্তু আমাদের মত আম-শিক্ষার্থী দের সবচেয়ে পরিচিত, সহজ এবং প্রিয় বিষয়। আমাদের ফিজিক্সের শুরুই হয় এখান থেকে, অথচ বেশি সহজ বলে কিংবা অজ্ঞাত কারণে এই বিষয়গুলো নিয়ে ছোট ছোট কিন্তু একেবারেই মৌলিক অনেক কিছুই আমাদের অজানা থেকে যায়। এই সিরিজে সেগুলোই উল্লেখ করার চেষ্টা করা হয়েছে, হয়ত আরও সুন্দর ভাবে করা যেত, হয়ত অনেক কিছুই বাদ পড়ে গেছে, হয়ত দরকার ছিল না এসবের। তবুও আইনস্টাইনের যুগে এসে আবার নিউটনের সূত্রগুলো নিয়ে চুলকাতে পেরে আনন্দিত।

কৃতজ্ঞতা :

  • খালেদ মোশাররফ মুকুট
  • চমক হাসান
  • গিয়াস উদ্দিন
  • বন্ধুবর্গ