আগের পর্বে আমরা আলোচনা করেছিলাম নিউটনের ১ম সূত্র নিয়ে; দেখেছিলাম এর প্রয়োগ ও অগ্রহণযোগ্যতা। নিউটনের ১ম সূত্র ব্যাখ্যা করে, বস্তুর সেই অবস্থা, যখন বস্তুর ওপর কোন বল ক্রিয়া না করে। প্রশ্ন হল বস্তুর ওপর যখন বাহ্যিক বল ক্রিয়া করবে তখন কী ঘটবে? এর উত্তরই আমাদের দেয় নিউটনের ২য় সুত্রঃ

কোন বস্তুর ভরবেগের পরিবর্তনের হার প্রযুক্ত বলের সমানুপাতিক এবং বল যেদিকে ক্রিয়া করে ভরবেগের পরিবর্তনও সেদিকে ঘটে।

                                                               newtons-second-law-of-motion

গাণিতিক ভাবে,
F α m.(v-u)/t
⇒F α m.a
⇒F = k.ma [ যেখানে, k=1]
⇒F= ma
অর্থাৎ বল প্রয়োগের ফলে ভর-বেগের পরিবর্তন ঘটবেই। প্রশ্ন হল, ভর তো ধ্রুব রাশি তাহলে F=ma কে লিখা যায় F α a ; তাহলে সূত্রে বেগের সাথে ভর কেও গুরুত্ব দেয়া হল, কেন শুধু বেগ বলা হল না। এর কারণ হল ভর ধ্রুব রাশি হওয়া সত্ত্বেও এর প্রভাব পড়ে বস্তুর ওপর বল প্রয়োগের ক্ষেত্রে। বাস্তব উদাহরণের মাধ্যমে দেখা যাক, একটা ছোট ব্যাগ এবং একটা ভারী ব্যাগ কে একই মাত্রায় ত্বরিত করতে কিন্তু সমান বল দিলে চলে না, ভারী ব্যাগে বেশি বল দিতে হয়। একইভাবে গতিশীল একটা ট্রাক থামাতে যে বল দিতে হয়, তার চেয়ে অনেক কম বল দিতে হয় সমান বেগে চলমান একটা সাইকেলকে থামাতে। একারণেই বেগের চেয়ে ভরবেগের তাৎপর্য বেশি।

                                                                    motion_momentum2_240
নিউটনের ২য় সূত্র কি শুধুই, F=ma ? সূত্রের দিকে একটু গভীরভাবে মনযোগ দেয়া যাক। এখানে F হল প্রয়োগকৃত সকল বলের সমষ্টি (ঘর্ষণ, বাতাসের বাঁধা, অভিলম্ব বল, ওজন…)। এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল এই সূত্র কেবল তখনই প্রযোজ্য যখন বল প্রয়োগ ধারাবাহিক/একনাগাড়ে (continuous) হয়। যেমন, ব্যাট দ্বারা বল’কে আঘাত করা হল; এখন আমরা বলের গতিবিধি বের করতে কি F=ma ব্যবহার করব? অবশ্যই না। এই ক্ষেত্রে বল প্রয়োগ হচ্ছে যতক্ষন বল ব্যাটের সংস্পর্শে ছিল শুধুমাত্র সেই ক্ষুদ্র সময়টাতে; এর আগে-পরে বল প্রয়োগ হয় নি। তাহলে এক্ষেত্রে কি করা যায়?
এ সমস্যা সমাধানের জন্য আমাদের যেই বিষয়ে ধারণা লাগবে তাহল ঘাত এবং ঘাত-বল। আমাদের প্রয়োগকৃত বল যদি খুব অল্প সময় ধরে ক্রিয়া করে বস্তুর গতির পরিবর্তন করে কিন্তু সরণ না ঘটায় , তবে তাকে ঘাত-বল বলা হয়। সরণ হচ্ছে না, কিন্তু গতির পরিবর্তন? কীভাবে? আমাদের ব্যাটবলের উদাহরণটাই দেখা যাক। ব্যাট যখন বলে আঘাত করছে তখন হটাৎ(খুব অল্প সময়ে) বলের বেগ ঠিক ঐ জায়গায় থাকা অবস্থাতেই অনেক বেড়ে যায়। আসলে এখানেও খুব অল্প সরণ হচ্ছে, কিন্তু খুবই অল্প সময়ে খুবই অল্প সরণের মধ্যেই বেগ অসম্ভব রকম বেড়ে যাচ্ছে বলে সরণ’কে অবহেলা (বাদ দেয়া) করা হয়েছে।
আর বলের ঘাত হল এই ক্ষুদ্র সময় ও ঘাত-বলের গুণফল। তাহলে বলের ঘাত J হলে, ক্যালকুলাসের সাহায্যে সহজেই দেখানো যায়,
J= F.∆ t = mv – mu
অর্থাৎ বলের ঘাত ভরবেগের পরিবর্তনের সমান। একটু ভাল ভাবে খেয়াল করলেই দেখা যাবে, এটাও নতুন কোন ফর্মুলা নয়; নিউটনের ২য় সূত্রেরই বিশেষ রূপ। এর মাধ্যমে আমরা খুব অল্প সময়ে বেশি বল প্রয়োগের কেস গুলো সামাল দিতে পারি।
F ও a এর ব্যাপার বোঝা গেল। এবার দেখি ভর (m) এর ঘটনা কি। তার আগে সূত্রে একটু সংস্করণ করতে চাই । হ্যাঁ , নিউটনের সূত্রে হাত দিব 🙄 ; কারণে আমাদের পিছনে আছে আইনস্টাইন 😮 । নিউটনীয় স্বীকার্য অনুযায়ী বস্তুর ভর ধ্রুব থাকে। কিন্তু একেবারে সূক্ষ্মতার বিচার করলে আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা তত্ত্ব অনুযায়ী ভরও ধ্রুবক নয়। অনেক বেশি বেগে গতিশীল বস্তুর ভর বৃদ্ধি পায়। তাই আমরা নিউটনের ওপর মাতব্বরি করতে এই সূত্র কে একটু বিশেষায়িত করতে চাই। এবং সব মিলিয়ে শুদ্ধতম(!) 😯 সূত্র দাঁড়াচ্ছে,
∑F = (∆m∆v)/t

                                                                                                               fma

এরপরও কারও মনে খটকা লাগতে পারে এই ভেবে যে, এখানে সমানুপাতিক ধ্রুবক k=1 ধরা হল কেন? এর কারণ সম্পূর্ণ উদ্দেশ্যমূলক, তবে কোন ষড়যন্ত্র করা হয় নি এখানে। আসলে এই সূত্রের এর মাধ্যমেই বল’কে সংজ্ঞায়িত করা হয়। একারণেই k=1 ধরা হয়েছে, যাতে বল’র সংজ্ঞা সহজভাবে দেয়া যায়।
এবার দেখা যাক, নিউটনের ২য় সূত্র থেকে কীভাবে ১ম সূত্রে আসা যায়,
F=ma
F=0 হলে,

⇒ma=0

⇒ a=0

⇒ v-u = 0

⇒ v=u
অর্থাৎ বাহ্যিক বল প্রয়োগ না হলে (F=0) বস্তুর আদি বেগ ও শেষ বেগ একই থাকবে; মানে স্থির বস্তু স্থির থাকবে এবং গতিশীল বস্তু আগের বেগেই গতিশীল থাকবে। এটাই তো ১ম সূত্রের কথা।

আচ্ছা, সবসময় কি বলের দিকেই বস্তুর ত্বরণ ঘটবে? ব্যতিক্রম হতে পারে কি? যেমন ধরা যাক, লিফটের ক্ষেত্রে,

লিফট ওপরে ওঠার সময়ে ত্বরণ ওপরের দিকে বল প্রয়োগও উপরের দিকে। কিন্তু লিফট যখন নিচে নামে, তখন কি ঘটে? তখন লিফটের ত্বরণ নিচের দিকে হয়, কিন্তু বল প্রয়োগ করতে হয় উপরের দিকে; যাতে করে লিফট মুক্তভাবে পড়ন্ত বস্তুর মত না পড়ে আরো ধীরে পড়ে। আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে বল এর বিপরীত দিকে ত্বরণ হচ্ছে, কিন্তু ব্যাপারটা সেরকম নয়।

আমরা আগেও উল্লেখ করেছিলাম যে, বস্তুর ত্বরণ বের করতে হলে এর উপর ক্রিয়াশীল সকল বল হিসেবে আনতে হবে। এখানে লিফটের ক্ষেত্রেও আনুষাঙ্গিক সকল বল বিবেচনায় আনতে হবে। তাহলে দেখা যাবে, সকল বলের চেয়ে অভিকর্ষ বল এর প্রাধান্য বেশি, তাই বস্তু অভিকর্ষের দিকেই ত্বরিত হয়। নিউটনের ২য় সূত্রের কোনই ব্যত্যয় ঘটেনি।
সংক্ষেপে নিউটনের ২য় সূত্রের মূল বিষয় হল, বল প্রয়োগ করলেই বস্তুর ত্বরণ ঘটবে। তাহলে এবার বলুন তো বল প্রয়োগ ছাড়া কি বস্তু গতিশীল থাকতে পারে না? উত্তর যদি না হয়, তবে আবার নিউটনের ১ম সূত্রে ফিরে যান। উত্তর হ্যাঁ হলে ঠিক আছে; গতিশীল থাকা আর ত্বরিত হওয়া এক কথা না। বস্তু ধ্রুব বেগে গতিশীল থাকলে সেক্ষেত্রে ত্বরণ থাকে না, কিন্তু ত্বরণ না থাকলেও বস্তু কিন্তু গতিশীলই থাকে।

আমরা এই যে বল বল করছি সেই বল’র উৎপত্তি আসলে কোথায়? সকল বলই আসলে ৪ টি মৌলিক বল’র ভিন্ন ভিন্ন প্রকাশঃ

  1. মহাকর্ষীয় বল
  2. তাড়িৎ-চৌম্বক বল
  3. দুর্বল চৌম্বক বল
  4. শক্তিশালী চৌম্বক বল

এদের শক্তির তুলনা করলে এমন দাঁড়ায়, মহাকর্ষ বলকে 1 ধরলে

নিউক্লীয় শক্তিশালী বল = 1042

তাড়িত-চৌম্বক বল= 1039

দুর্বল নিউক্লীয় বল = 1030

এ বল গুলো কিভাবে কাজ করে, পার্থক্য কি এসব নিয়ে অন্য কোন আর্টিকেলে জানব। আপাতত এটুকু জেনে রাখি যে, বিজ্ঞানীদের ধারণা, এ ৪ টি বল আসলে একই বলেরই ভিন্ন ভিন্ন রূপ। এ ধারণার পেছনে যথেষ্ট কারণও আছে। সে ধারণা থেকে বিজ্ঞানীরা এমন কোন তত্ত্বের খোঁজে গবেষণা করে যাচ্ছেন, যেই তত্ত্ব একত্রিত করবে এই ৪ বলকে। এবং যথেষ্ট অগ্রগতিও হয়েছে সে গবেষণায়। পাকিস্তানি বিজ্ঞানী আব্দুস সালাম এবং হার্ভার্ড এর বিজ্ঞানী স্টিভেন ওয়াইনবারগ শেষ ৩ টি বলকে একত্রিত করতে পেরেছেন। তারা ভেক্টর বোসনস নামে ৩ টি কণা (ω+ –  ,Z0) র সাহায্যে ব্যখ্যা করেছেন তাদের তত্ত্ব।

এখন প্রচেষ্টা চলছে মহাকর্ষের সাথে এক করার। এবং আশা করা যায় তা করতে পারলে ২-৩ টা নোবেল প্রাইজ তো বাগানো যাবেই 😕 , সেই সাথে তা হবে ইতিহাসের অন্যতম যুগান্তকারী আবিষ্কার 😀 ।

নিউটনের ২য় সূত্র নিয়ে এই পর্যন্তই। আগামী পর্বে থাকবে নিউটনের ৩য় সূত্র নিয়ে কিছু ভ্রান্তি (misconceptions) এবং এই সূত্রের অপব্যবহার। আগামী পর্ব এখানে…

নিউটনের গতিসূত্র [পর্ব-৩]- ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া