আমার ছোটবোন যখন কেবল কোনটা হাত, কোনটা পা, কোনটা পা এইসব শিখে ফেলেছে, তখন আমার মা তাকে ‘ক্লাস-ওয়ান’ থেকে ‘ক্লাস-টু’ এর পড়া ধরালেন। এবারের পাঠ্য- কোনটার কি কাজ। তখনো আমার বোন পুরোপুরি কথা শেখেনি, তাই পড়াশোনা সে করতে লাগল ইশারায়। আম্মু তাকে বলেন-“মনি তুমি খাও কি দিয়ে?” আমার বোন আঙুল দিয়ে মুখ দেখায়, আম্মু যদি বলেন-“কি দিয়ে দেখ?” সে দেখায় চোখ। আমাদের সবার শৈশবেই এমন ঘটনা ঘটেছে আর আমরা সবাই সেই শৈশব অনেক আগেই পিছে ফেলে এসেছি, কাজেই এখন সময় এসেছে ক্লাস থ্রিতে ওঠার। এবারের পাঠ্য- কিভাবে দেখি।

এটা জানতে গেলে আমাদের প্রথমে জানতে হবে চোখের গঠন- অর্থাৎ তার বিভিন্ন অংশ এবং সেগুলোর কাজ আর তারপর সব অংশের কাজ মিলিয়ে কিভাবে পুরো দেখার ব্যাপারটা ঘটে। এই অংশে আমি অনেক ছোটখাট ব্যাপার এড়িয়ে যাব, আমাদের দরকার মূল ব্যাপারে স্পষ্ট ধারণা।

আমাদের চোখ দেখতে আসলে একটা বলের মত যার সামনের দিকে থাকে পিউপিল বা চোখের মণি। চোখের মণি একটি ছিদ্রের মত কাজ করে যে ছিদ্র দিয়ে আলো চোখের ভেতরে ঢোকে। পিউপিলের সমিনে থাকা আইরিশ আলোর তীব্রতা অনুযায়ী ছিদ্রের আকার ঠিক করে। এতে করে দেখার জন্য যততুকু দরকার, ততটুকু আলো চোখে ঢুকতে পারে। মণির ঠিক পেছনে থাকে লেন্স, এর কাজ হচ্ছে আগত আলোকে প্রতিসরিত করে চোখের ভেতরে পেছনের দিকে রেটিনার ওপর ফেলা। রেটিনা একটি আলোক সংবেদী পর্দার মত কাজ করে, এটি বুঝতে পারে এর ওপর কোথায় কতটুকু আলো পড়ছে, কেমন (অন্য অর্থে কোন রং এর) আলো পড়ছে। এটি এই আলোক সংকেতকে তড়িৎ সংকেতে রুপান্তরিত করে অপটিক স্নায়ুর মাধ্যমে মাথায় পাঠিয়ে দেয়।

 

Untitled

 

ছবিতে কিছু খুটিনাটি ব্যাপার দেখানো হয়েছে যেগুলো আমি বলিনি। পরে প্রয়োজনমত সেগোলো সম্পর্কে জানব। এখানে আমাদের মূল ব্যাপার যেটি জানা দরকার, সেটি হল: কোন বস্তু থেকে আলো এসে লেন্সে পড়ে, লেন্স সেই আলোকে পাঠায় রেটিনায়, রেটিনা আলোকে ইলেকট্রিক্যাল সিগন্যালে পরিণত করে মস্তিষ্কে পাঠায়, মস্তিষ্ক সেই সিগন্যাল থেকে বস্তুর ছবি বুঝতে পারে ব্যাপারটা নিচের ছবিতে দেখানো হল:

Untitled

ছবিতে খেয়াল করে দেখ: কোনকিছু আসলে যেভাবে থাকে, রেটিনাতে পড়ে তার উল্টো হয়ে। আমাদের মস্তিষ্ক সেটিকে সোজা করে নেয়।

আসলে দেখার সময় আমাদের চোখ এবং মাথা অনেক রকম কাজ করে। সেগুলো নিয়েই আমি ধীরে ধীরে আলাপ করব। কিন্তু শুরুতেই আমাদের দুটো ব্যাপার জেনে নেয়া দরকার:রং কিভাবে বুঝতে পারি আর দূরত্ব কিভাবে বুঝতে পারি।

এগুলো আসলে খুবই বেসিক ধরণের কথা, তোমাদের অনেকেই এগুলো ভালোভাবেই জানো। তারা চাইলে এই অংশটা এড়িয়ে যাও।

আমরা রঙ কিভাবে দেখি- এটা বুঝতে গেলে আগে জানা দরকার রঙ কি এবং কিভাবে সৃষ্টি হয়।

রং আসলে কোন বস্তুর নিজস্ব ধর্ম না- কোনকিছুর আসলে রঙ নেই। কোনকিছু থেকে প্রতিফলিত হয়ে চোখে আসা আলো রং বলে আমাদের কাছে মনে হয়। আলোতে সাধারণত বিভিন্ন কম্পাঙ্কের মিশ্রণ থাকে।(যেমন সাদা আলোতে দৃশ্যমান সব কম্পাঙ্ক থাকে।) কোন ব্তুর উপর আলো পড়লে বস্তুটি আলোর কিছু কম্পাঙ্ক শোষণ করে, কিছু প্রতিফলণ করে। (বিস্তারিত জানতে সাদমান সাকিবের এই লেখাটি দেখ।) কখনো কখনো প্রায় পুরোটাই শোষন করে বা প্রতিফলন করে। রঙ নির্ভর করে এই প্রতিফলিত আলোর কম্পাঙ্কের উপর। যেমন সাদা রঙের বস্তু সব কম্পাঙ্ক প্রতিফলন করে, কালো বস্তু সব কম্পাঙ্ক শোষণ করে, লাল বস্তু শুধু লাল আলো প্রতিফলন করে বাদবাকিটুকু শোষণ করে ফেলে।

Untitled

মাত্র একটি কম্পাঙ্ক দিয়ে তৈরী আলোকে একবর্ণী আলো বলে। ‘একবর্ণী’ অর্থ এক বর্ণ বিশিষ্ঠ হলেও এটি আসলে একটি ‘রঙ’এর আলো বোঝায় না, বোঝায় একটি কম্পাঙ্ক। একেবারে অল্প কম্পাঙ্কের আলো দেখা যায় না। ৪০০টেরাহার্জের কাছাকাছি কম্পঙ্ক থেকে মানুষ অনুজ্জল লাল দেখতে পায়। কম্পাঙ্ক বাড়ার সাথে সাথে এই আলোর রঙ কমলা, হলুদ, সবুজ, আসমানী, নীল, বেগুনি হয়। আমাদের চোখ বেগুনি রঙ ঠিকমত দেখতে পায় না। একই উজ্জ্বলতার বেগুনি আলোকে অন্যান্য আলোর চাইতে কম উজ্জ্বল মনে হয়। ৭০০ থেকে ৮০০ টেরাহার্জ কম্পাঙ্কের মধ্যে আমরা আবার দেখার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলি।

Untitled

রেটিনাতে দুই রকমের আলোক সংবেদী কোষ থাকে- রড কোষ এবং কোণ কোষ। রড কোষগুলো সব এক রকম। এগুলো অল্প তীব্রতায় কর্যকর হয়, এগুলো শুধু আলোর তীব্রতা বুঝতে পারে, কিন্তু কম্পাঙ্ক বুঝতে পারে না। কোণ কোষ সংবেদনশীল হতে হলে আলোর তীব্রতা একটু বেশী হতে হয় কিন্তু এরা রঙের প্রতি সংবেদনশীল। তাই রড কোষ কার্যকর হয় রাতের কম আলোতে আর এইসময় রঙ বোঝা যায় না। কোণ কোষ তিন রকমের যারা তিন রকমের কম্পাঙ্কের প্রতি সাড়া দেয়।

Untitled

অল্প কম্পাঙ্কের কোণ সাড়া দেয় লাল আলোয়, মধ্যম কম্পাঙ্কের কোণ সাড়া দেয় সবুজ আলোয়, উচ্চ কম্পাঙ্কের কোণ সাড়া দেয় নীল আলোয়। তাই আমরা রঙ দেখি এই তিন রঙের মিশ্রণ হিসাবে। এই তিনটি রংকে বলে প্রাথমিক রঙ। আমরা যেকোন রঙ আসলে এই তিন রঙ থেকে যোগমূলক মিশ্রণ পদ্ধতিতে তৈরী করে ফেলি। যখন তিনটি রঙের সবকয়টি সমানভাবে মিশে যায়, তখন সেটি হয় সাদা। আর কোন রঙ না থাকলে সেটি হয় কালো।

এই পদ্ধতিতে রঙ মেশানো দেখে ফেলা যাক। যেহেতু, কালো রঙে কোন আলোই থাকে না, তাই কালো রঙ এই পদ্ধতিতে শূন্যের মত কাজ করে। তাই কালোর সাথে অন্য যেকোন রঙ মেশালে সেই রঙ অপরিবর্তিত থাকে। যেমন:

কালো+লাল=লাল

কালো+সবুজ=সবুজ

কালো+নীল=নীল

 

আবার যদি শুধু সবুজ আর নীল মেশাও, নীল বাদ রাখ, সেটি হয়ে যায় হলুদ। একইভাবে,

 

Untitled

 

 

এতক্ষণ আমরা যেভাবে রঙ মিশিয়েছি, তাতে সব রঙ সমান পরিমাণে মিশিয়েছি। অর্থাৎ হলুদ তৈরী হয়েছে সমান পরিমাণ লাল আর সবুজের মিশ্রণে। কিন্তু আমরা যদি সমান পরিমাণে না মিশিয়ে বিভিন্ন পরিমাণে মেশাই, যদি একটা রঙ বেশী অন্যটা কম দিই তাহলে কি হবে? এবার সেটাই দেখা যাক।

১ টুকু সবুজ + ২ টুকু লাল = কমলা

১ টুকু লাল + ২ টুকু সবুজ = লাইম

১ টুকু সবুজ + ১ টুকু নীল + ৪ টুকু লাল = বাদামী

নিচের ছবিতে এই ব্যাপারটা দেখানো হয়েছে।

                                                                            Color_mix

 

এভাবে তিনটি রঙ নানা অনুপাতে মিশিয়ে নতুন রঙ তৈরী করার ব্যাপারটা তোমরা ফটোশপে পরীক্ষা করে দেখতে পারো।

 

 Snap 2015-04-18 at 12.07.55                 Snap 2015-04-18 at 12.08.25

লাল, সবুজ, নীল সবগুলো রঙ পূর্ণমাত্রায়                             লাল, সবুজ বা নীল কোনটিই না

মিশে তৈরী হয়েছে সাদা                                                      থাকায় তৈরী হয়েছে কালো

 Snap 2015-04-18 at 12.09.10                  Snap 2015-04-18 at 12.09.57

লাল আর সবুজ মিলে তৈরী হয়েছে হলুদ                                      বিভিন্ন পরিমাণে রঙ তিনটি                                                                                                                                                        মিশে তৈরী হয়েছে বেগুনী

তিনটি মৌলিক রঙের মিশ্রণে তৈরী বিভিন্ন রঙ

 

এখন তোমরা কেউ কেউ আপত্তি তুলতে পারো- লালের সাথে কালো মেশালে তো লাল কালচে দেখা যায়- এটা কোনভাবেই শূন্যের মত না- বরং রঙ থেকে কিছুটা বিয়োগ করে ফেলার মত। আসলে তোমরা যেই পদ্ধতির কথা বলছ, সেটা রঙের ‘বিয়োগমূলক মিশ্রণ’। সেটা আপাতত আমাদের আলোচনার বাইরের ব্যাপার।

সিরাজুস সালেহীন

সিরাজুস সালেহীন

আমার সম্পর্কে জানার দরকার নেই। 🙂