বৃষ্টি দেখলেই হয়তো প্রেমিকার বৃষ্টিস্নাত শরীরের দৃশ্য মনের আঙিনায় অস্তিত্বে নড়েচড়ে উঠে! আবার হয়তোবা যাতায়াতের দুর্বিসহ অবস্থা মনকে খারাপ করে দেয়। আমাদের এই বাংলায় এই বৃষ্টির সাথে রয়েছে অনেক কিছুর মেলবন্ধন। একেকজনের কাছে তাই এর একেকটি রূপ। আমি বৃষ্টি পছন্দ করি। বৃষ্টির উন্মুক্ত নাচন কেমন যেন এক বিষণ্ন পরিবেশ তৈরি করে ফেলে। মাঝেমধ্যে আমি বৃষ্টির মধ্যে রেইনকোট পড়ে বের হয়ে পড়ি। আজও বের হয়েছিলাম। উদ্দেশ্য ছিল উত্তরায় যাওয়া। হেঁটে হেঁটে তো আর যাওয়া যাবে না তাই বাসে উঠে বসলাম। সিট পেয়েছিলাম জানালার পাশে। ঢাকার রাস্তা, জ্যাম তো সামান্য হলেও থাকবে।

একটা ব্যাপার খেয়াল করলাম। বাস যখন মাঝে মধ্যে থেমে যাচ্ছিল, তখন বৃষ্টি সোজাসুজি নিচে পড়ছিল। আর বাসের গতি যখন বাড়ছিল তখন বৃষ্টির গতিপথ পালটে যাচ্ছিল; মানে বৃষ্টি সোজাসুজি নিচে না পড়ে বাঁকা হয়ে পড়ছিল। আমি আগে কখনো ব্যাপারটা বিশেষভাবে খেয়াল করিনি। সাধারণত, বাসায় বসে থেকে জানালা দিয়ে একই ঘটনা ঘটতে দেখলে ‘বাতাসের কারণে হয়েছে’ বলেই ব্যাপারটাকে উড়িয়ে দেয়া যায়। কিন্তু, বাসে বসে থাকায় একটু অন্য ব্যাখ্যার প্রয়োজন হল। কারণ, আমি মোটামুটি নিশ্চিত বাতাসের গতিবেগ নগণ্য ছিল। তাহলে, বৃষ্টির গতিপথ এরকম হুট করে পরিবর্তিত হওয়ার মানে কি?

কলেজে পড়ার সময় আপেক্ষিক গতি নিয়ে কিছু অঙ্ক কষেছিলাম। বৃষ্টির বাঁকা নাচন দেখে মনে হল যে খালি অঙ্কই কষে গেছি এতদিন, আত্মস্থ করা হয়নি। যাই হোক, এরপর ব্যাখ্যার কাজে নেমে গেলাম। আজকের আর্টিকেল এই ব্যাখ্যাকে ঘিরেই।

শুরু থেকে শুরু করা যাক। ধরা যাক, আমি একটি ট্রাকে বসে আছি আর তুমি একটি গাড়িতে। গাড়িটি 79 km/h বেগে উত্তর দিকে আর ট্রাকটি 126 km/h বেগে দক্ষিণ দিকে যাচ্ছে। (ভূপৃষ্ঠের সাপেক্ষে বেগ দুটি হিসেব করা হয়েছে) আরও ধরে নিচ্ছি রাস্তাটি উত্তর-দক্ষিণ দিক বরাবর প্রসারিত যাতে আমরা একমাত্রিকভাবে হিসেবগুলো করতে পারি। এখন প্রশ্ন হচ্ছে তুমি আমার গতিবেগ কত হিসেব করবে? তুমি কিন্তু দেখবে না যে আমি 126 km/h বেগে দক্ষিণ দিকে যাচ্ছি! তাহলে কি দেখবে তুমি? এই বিষয়টি সমাধানের জন্য আমাদেরকে কল্পনাশক্তির সাহায্য নিতে হবে। প্রথমে মনে কর, তোমার গাড়িটি চলছে না, রাস্তার উপর ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। তখন তুমি ট্রাকের গতিবেগ যা হিসেব করবে তা হল 126 km/h, কারণ এখন তোমার গাড়ি আর ভূপৃষ্ঠের মধ্যে কোনো আপেক্ষিক গতি নেই। আর তাই, ট্রাকের বেগ ভূপৃষ্ঠে দাঁড়িয়ে হিসেব কর অথবা গাড়িতে বসে হিসেব কর, একই মান পাবে।

এখন আমরা প্রকৃত ঘটনায় ফিরে আসি। গাড়িটি 79 km/h বেগে চলা শুরু করল। তুমি যখন চলমান গাড়িতে বসে ট্রাকের বেগ হিসেব করতে যাবে তখন তুমি দেখবে যে ট্রাকটি তোমার দিকে আগের চেয়ে তাড়াতাড়ি এগিয়ে আসছে। কারণ এখন তুমি দেখছ যে গাড়ি আর ট্রাকের দূরত্ব কম সময়ে বেশি পরিবর্তিত হচ্ছে। দূরত্বের এই বেশি পরিবর্তনে কিন্তু তোমার গাড়ির বেগেরও অবদান আছে। কিন্তু, তুমি যখন বেগ হিসেব কর তখন আসলে নিজেকে স্থির হিসেবে চিন্তা করেই তা কর। তাই আপাতদৃষ্টিতে যা মনে হবে তা হল যে ট্রাকটির বেগ বেড়ে গেছে। তোমার মনে প্রশ্ন জাগতে পারে ট্রাকের বেগের এই আপাত পরিবর্তন কত? এর উত্তর হচ্ছে ভূপৃষ্ঠের সাপেক্ষে তোমার গাড়ির বেগের যে পরিবর্তন হয়েছে তার সমান।

P001

এতক্ষণ যা বললাম তা গাণিতিকভাবে প্রকাশ করব। ধরে নাও, P003 হচ্ছে ভূপৃষ্ঠের সাপেক্ষে ট্রাকের বেগ। এমনিভাবে P003 ও P003 হচ্ছে যথাক্রমে ভূপৃষ্ঠের সাপেক্ষে গাড়ির ও গাড়ির সাপেক্ষে ট্রাকের বেগ। তাহলে আমরা লিখতে পারি,

P003

এই সমীকরণটিতে কিন্তু বেগগুলোর ভেক্টররূপ লেখা হয়েছে। (বোল্ডP003 ভালোভাবে নাও বুঝা যেতে পারে) আরেকটা উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হল,

P003

আমরা প্রথমেই ধরে নিয়েছিলাম যে সমস্যাটি একমাত্রিক। তাই শুধু একটি দিককে ধনাত্মক হিসেবে চিহ্নিত করলেই হবে। এই ক্ষেত্রে ধরে নিচ্ছি উত্তর দিক ধনাত্মক। ফলে,

P003

P003

সুতরাং, গাড়িতে বসে থেকে তোমার কাছে মনে হবে যে আমি দক্ষিণ দিকে 205 km/h বেগে যাচ্ছি। (ঋণাত্মক চিহ্ন দক্ষিণ দিক নির্দেশ করছে।)

এবার আমরা বৃষ্টির সমস্যায় ফিরে যাই। বৃষ্টির সমস্যাটি কিন্তু দ্বিমাত্রিক। তবে ভয় পাওয়ার কিছু নেই! আমরা কিছুক্ষণ আগে যেই ভেক্টর সমীকরণ ব্যবহার করেছি তা এখানেও প্রযোজ্য। 😀

ধরে নাও আমি ভূপৃষ্ঠের সাপেক্ষে বাসে করে P003 বেগে এগোচ্ছি। আর বৃষ্টি ভূপৃষ্ঠের সাপেক্ষে P003 বেগে নিচে পড়ছে। আমি জানতে চাই আমার সাপেক্ষে বৃষ্টির বেগ কি (মান এবং দিক দুটিই)। মনে কর, যেই বেগটি নির্ণয় করতে চাচ্ছি তা হল P003 । ভেক্টর সমীকরণটি তাহলে হবে,

P003

অথবা,

P003

ভেক্টর ডায়াগ্রাম এঁকে ফেলি চল।

P002

এভাবে ডায়গ্রাম এঁকে সহজেই মান ও দিক বের করে ফেলতে পারি আমরা। পিথাগোরাস ভাইয়ার নীতি অনুসারে,

P003

[এখানে, v কে বোল্ড করে লেখা হয়নি। কারণ এখানে v দিয়ে মান বুঝাচ্ছে, ভেক্টর না।]

আর ত্রিকোণমিতির সূত্রানুসারে,

P003

মনে করলাম, ভূপৃষ্ঠের সাপেক্ষে বাসের গতিবেগ ছিল 60 km/h আর বৃষ্টির গতিবেগ 600 কোণে বেঁকে যাচ্ছিল। তাহলে, উপরের সমীকরণ বলে দিচ্ছে বৃষ্টির বেগ ছিল প্রায় 35 km/h ।

যদি ভূপৃষ্ঠের সাপেক্ষে বৃষ্টির বেগ অপরিবর্তিত থাকে তাহলে বাসের বেগ বাড়ার সাথে সাথে বৃষ্টির গতিপথের অভিলম্ব থেকে বিচ্যুতির পরিমাণও বাড়তে থাকে। এ ঘটনাই আমরা বর্ষাকালে অহরহ দেখি। কিন্তু, আমাদের মস্তিষ্ক সবকিছুকেই স্বাভাবিক হিসেবে ধরে নেয় বলেই এসব ঘটনা আর বিশ্লেষণ করা হয়ে উঠে না।

[এই আর্টিকেল যখন লেখা হয় তখন বর্ষাকালই ছিল। কিন্তু, পরবর্তীতে এটাকে পাবলিশ করতে ভুলেই যাই। :p ]

ATM Jahid Hasan

ATM Jahid Hasan

Little is known and little will be known.
ATM Jahid Hasan
ATM Jahid Hasan
ATM Jahid Hasan

Latest posts by ATM Jahid Hasan (see all)