আলো এক মাধ্যমে চলতে চলতে অপর কোনো মাধ্যমের সামনে এসে পড়লে কী হয়? ঐ আলোর কিছু অংশ মাধ্যমের বিভেদতল থেকে প্রতিফলিত হয়ে আগের মাধ্যমে ফেরত আসে, কিছু পরিমাণ আলো দ্বিতীয় মাধ্যম দিয়ে প্রতিসরিত হয় আর বাকীটা ঐ মাধ্যম শোষণ করে নেয়। এখন এই তিন ঘটনার মধ্যে প্রতিফলনের পরিমাণ নগণ্য ধরলে ঘটে কেবল প্রতিসরণ আর শোষণ। কন্টেইনারে রাখা কোনো দ্রবণের ভেতর দিয়ে নির্দিষ্ট তীব্রতার আলো চালনা করে দ্রবণ থেকে বের হওয়া (প্রতিসরিত) আলোর হ্রাসকৃত তীব্রতা মেপে আমরা বলে দিতে পারি কতটুকু আলো দ্রবণটা শুষে নিয়েছে। আজকে আমাদের আলোচনা এই ঘটনা সংক্রান্ত বিয়ার-ল্যাম্বার্ট এর সূত্র (Beer-Lambert law) নিয়েই।
প্রথমে একটু ইতিহাস নিয়ে কথা বলি? এই সূত্রটার নাম প্রকৃতপক্ষে হওয়া উচিত ছিল বোগি-ল্যাম্বার্ট-বিয়ার এর সূত্র (Bouguer-Lambert-Beer law)। ১৭২৯ সালে সর্বপ্রথম বিজ্ঞানী পিয়েরে বোগি-ই উল্লেখ করেন যে কোনো সুষম ঘনত্বের মাধ্যমের ভেতর দিয়ে যাবার ফলে শোষিত আলোর পরিমাণ ঐ আলোর অতিক্রান্ত পথের সমানুপাতিক। এর অর্থ তুমি আলোর চলার পথে শরবতের একটা মোটা গ্লাস রাখলে যে পরিমাণ আলো নির্গত হবে, একটা চিকন গ্লাস রাখলে আলো নির্গত হবে তার চেয়ে বেশি। এই একই কথা ১৭৬০ সালে বিজ্ঞানী ল্যাম্বার্ট তার বই Photometria তে তুলে ধরেন এবং তা ব্যাপক আকারে লোকসম্মুখে আসে। এরও অনেক পরে, ১৮৫২ সালে বিয়ার নামের এক গবেষক বলেন শোষণের হার দ্রবণের ঘনমাত্রার সমানুপাতিকও বটে। এই দুই সারকথাকে এক করেই আমরা আজকের বিয়ার-ল্যাম্বার্ট এর সূত্র প্রতিপাদন করি।
এই সূত্রের একটা ক্লোজ লুক পেতে হলে প্রথমে জেনে নেওয়া ভাল সঞ্চালন হার (Transmittance) এবং শোষণ (Absorbance) সম্পর্কে। ধরা যাক কোনো আলোক উৎস থেকে আমরা I0 তীব্রতার আলো পাচ্ছি এবং এই আলো কোনো দ্রবণের ভেতর ঢুকে নির্গত হচ্ছে I তীব্রতায়। এক্ষেত্রে সঞ্চালন হার হিসেবে আমরা উল্লেখ করব I/I0 অনুপাতটিকে। এই হারকে T ধরে T= I/I0 তাহলে লেখাই যায়। মাঝে মধ্যে সঞ্চালনকে শতকরা আকারে প্রকাশ করা হয়। তার জন্য আর কিছুই না, I/I0 অনুপাতটিকে 100 দিয়ে গুণ করে দিলেই হবে (শতকরা সঞ্চালন হারের প্রতীক হিসেবে %T ব্যবহার করা হয়)।
তাহলে প্রশ্ন হল, শোষণ আবার কোন বস্তু? আগেই উল্লেখ করা I0 ও I এর জন্য শোষণ হল log10 (I0 / I) রাশিটি। শোষণকে A দ্বারা উল্লেখ করলে আমরা A = log10 (I0 / I) লিখতে পারি। যদি দ্রবণ কোনো আলো শোষণ না করে তবে I = I0 হয়। ফলে I0 / I = 1 পাওয়া যায় এবং শোষণের মান হয় শুন্য। অন্যদিকে, সকল আলো দ্রবণ শুষে নিলে I এর মান হয় শুন্য এবং I0 / I = ∞ পাওয়া যায় এবং শোষনের মানও অসীম হয়।
এতক্ষণে বোধহয় আঁচ করে ফেলতে পেরেছ, A আর T এর মধ্যে বিদ্যমান সম্পর্কটা। সেটা হবে, A = log10 (1/T) , তাই নয় কি?
কথা হচ্ছে এই দুই রাশি নিয়ে এত চিল্লাচিল্লি কেন? খেয়াল করলেই দেখবে, A আর T এর মাঝে T কে বুঝতে আমাদের বেশি সুবিধা হয়। I0 তীব্রতার আলো যেয়ে I হয়ে বেরিয়ে আসলে I/I0 অনুপাতটা বোঝায় মোট তীব্রতার (I0) কতভাগ সংরক্ষিত হচ্ছে। কিন্তু শক্ত কথাটা কি জানো? সঞ্চালন হার কিন্তু দ্রবণের ঘনমাত্রা আর আলোকপথের দৈর্ঘ্যের সাথে বাড়ে না, বরং কমে। বিজ্ঞানীরা দেখলেন, T এর বিপরীত অনুপাতটির (I0 / I) লগারিদম নিলে বরং তা সুন্দরমত ঘনমাত্রা আর আলোকপথের সাথে ওঠানামা করে। বুঝে গেছ, এই রাশিটি শোষণ (A) ব্যতীত অন্য আর কী ই বা হতে পারে? 😀
এসো তবে দেখে নেওয়া যাক শতকরা সঞ্চালন হারের বিভিন্ন মানের জন্য শোষণের মানগুলো কীরূপ হয়।
তো বোগি সাহেব আবিষ্কার করেছিলেন; তার কথাই প্রতিধ্বনিত করেছিলেন ল্যাম্বার্ট – শোষণ বাড়বে যদি দ্রবণের ঘনমাত্রা একই হওয়া সত্ত্বেও এর ভেতর দিয়ে আলো যাবার রাস্তা অর্থাৎ আলোকপথের দৈর্ঘ্য আমরা বাড়িয়ে দিই, ঠিক অনেকটা এই চিত্রের মত –
তাহলে প্রথম স্বীকার্য অনুযায়ী আমরা লিখতে পারব A∝l, যেখানে l হল আলোকপথ, c অপরিবর্তীত থাকছে।
অনেক অনেক পরে, জনাব বিয়ারের ভাষ্য অনুযায়ী, আলোকপথ এক থাকলেও ঘন দ্রবণ আলো বেশি শোষণ করবে। সুতরাং, ঘটবে এই ঘটনা –
তো, এটা জানার পর A∝c লিখতে আর দোষ কোথায়? টের পাওয়া যাচ্ছে, c এখানে ঘনমাত্রা নির্দেশক, l পরিবর্তন করি নি।
এই দুই জিনিস কম্বাইন করে তাহলে আমরা লিখে ফেলি,
A∝cl, যখন c ও l উভয়েই পরিবর্তীত হতে পারে
কেবল সমানুপাতিক সম্পর্ক জানা থাকলে তো চলবে না, সমীকরণ আকারে প্রকাশ করতে পারলে তবেই না আমরা এ সংক্রান্ত গাণিতিক সমস্যা সমাধানে পারঙ্গম হব। সেই উদ্দেশ্যেই এই সম্পর্কের ডানপাশে অবতারণা করা হয় একটি সমানুপাতিক ধ্রুবকের, ε
A=εcl
নতুন আমদানি করা এই ধ্রুবক সম্পর্কে আরো জানতে ইচ্ছা করছে? এর নাম আমরা বলি মোলার শোষণ গুণাংক কিংবা মোলার শোষণ সহগ। উপরের সমীকরণ থেকে আমরা লিখতে পারি –
ε=A/cl
তারমানে, ε হল একক ঘনমাত্রার ও একক আলোকপথসম্পন্ন কোনো নির্দিষ্ট দ্রবণের শোষণ। ঘনমাত্রার একক mol/L এবং সাধারণভাবে আলোকপথকে cm এ পরিমাপ করা হয় বিধায় মোলার শোষণ সহগের একক দাঁড়ায় L mol-1cm-1 । খেয়াল রাখতে হবে, A এর কিন্তু কোনো একক নেই কারণ তা দুইটি তীব্রতার অনুপাতের লগারিদম যা একটি এককবিহীন বিশুদ্ধ সংখ্যা।
ε এর পূর্ববর্তী সংজ্ঞায় “নির্দিষ্ট দ্রবণ” কথাটা খেয়াল করেছ? এটা লেখার অর্থ সকল দ্রবণের জন্য ε এর মান সমান হয় না, আলাদা আলাদা দ্রবণের জন্য এই ধ্রুবকও আলাদা হয়। যেমন চিনির দ্রবণ এবং কপার সালফেটের দ্রবণের জন্য ε এর মান ভিন্ন ভিন্ন হবে।
তাহলে সর্বোপরি আমরা বিয়ার ল্যাম্বার্ট সূত্রকে এভাবে লিখতে পারি –
log10 (I0 / I) = A = εcl
এ সম্পর্কিত গাণিতিক সমস্যা সমাধানের জন্য আমাদের নিকট যথেষ্ট পরিমাণ ডাটা দেওয়া হলে সহজেই আমরা সূত্র ব্যবহার করে অজ্ঞাত রাশিটার মান বের করে নিয়ে আসতে পারি। তবে জেনে রাখা ভাল, উচ্চ ঘনমাত্রার দ্রবণের জন্য বিয়ার-ল্যাম্বার্ট সূত্র হতে বিচ্যুতি দেখা দেয়। যার অর্থ, উচ্চ ঘনমাত্রার ক্ষেত্রে ঘনমাত্রা বাড়ালে শোষণ একই হারে বাড়তে দেখা যায় না। নিচের ছবিটি খেয়াল করলেই বিষয়টি বুঝতে পারবে।
এত কথা যখন হল, তখন শোষণ মাপে কে তা নিয়েও একটু কথা হোক। আমরা যে যন্ত্রের মাধ্যমে এই শোষণ বা Absorbance পরিমাপ করি তার নাম হল স্পেকট্রোফটোমিটার (Spectrophotometer)। একটা কিউভেটে পরীক্ষণীয় দ্রবণ নিয়ে তা স্পেকট্রোফটোমিটারের নির্দিষ্ট চেম্বারে রাখা হয় এবং এর ভেতর দিয়ে আলো যেতে দেয়া হয়। যন্ত্রটি নিজেই আলোর তীব্রতার অনুপাত থেকে শোষণ গণনা করে এবং ডিজিটাল ডায়ালে তা দেখায়।
স্পেকট্রোফটোমিটারের কার্যপ্রণালী মোটামুটি এরকম। একটি আলোক উৎস থেকে তা প্রথমে একবর্ণী আলো তৈরি করে এবং তা দ্রবণের ভেতর দিয়ে চালনা করে শোষণ নির্ধারণ করে।
প্রশ্ন হতে পারে, বহুবর্ণী আলো থেকে একবর্ণী আলো তৈরি করার দরকারটা কী? এটা আমরা জানি যে, একবর্ণী আলোতে কেবল একরকম তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো থাকে। সকল দ্রবণই একটা নির্দিষ্ট তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলোতে সবচেয়ে বেশি আলো শোষণ করার প্রবণতা দেখায়। বেনজিনে দ্রবীভূত অ্যানথ্রাসিনের জন্য যেমন এই তরঙ্গদৈর্ঘ্য হল 430 nm, ন্যাফথালিনের জন্য 425 nm। মূলত দ্রবণে দ্রব হিসেবে যে যৌগ থাকে তার আণবিক গঠন ও বন্ধন প্রকৃতির জন্যই দ্রবণ এরূপ আচরণ প্রদর্শন করে, একটা নির্দিষ্ট তরঙ্গদৈর্ঘ্যে বাড়িয়ে দেয় শোষণের পরিমাণ। কোনো দ্রবণের শোষণ মাপার জন্য এই নির্দিষ্ট তরঙ্গদৈর্ঘ্য ব্যবহার করলে দেখা যায় ভাল ফলাফল পাওয়া যায়। তাই বিভিন্ন তরঙ্গদৈর্ঘ্যবিশিষ্ট বহুবর্ণী আলো প্রবেশ না করিয়ে ঐ তরঙ্গদৈর্ঘ্যের একবর্ণী আলো বেছে নেওয়া হয়। স্পেকট্রোফটোমিটারে এজন্য শোষণ মাপার পূর্বে আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য সেট করে দেবার ব্যবস্থাও থাকে।
শেষ করতে যাচ্ছি একটা কুইজ দিয়ে 😀 মোলার শোষণ সহগ বেশি হবার অর্থ তার আলো শোষণের ক্ষমতা বেশি, তাই না? কপার সালফেট বা তুঁতের দ্রবণ তো দেখতে ঘন নীল হয়, তাহলে এর শোষণ সহগ কত হতে পারে? তোমাকে দুইটা মেজারমেন্ট বলা হল – 100,000 L mol-1 cm-1 আর 20 L mol-1 cm-1 । কোনটা এর ε এর প্রকৃত মান? উত্তর দেবার জন্য কমেন্ট কর পোস্টের নিচে, সাথে মতামত জানাতেও ভুলো না 🙂
শুভকামনা তোমাদের জন্য!
onk sundor hoise broo..onkdin dhore ai ta akta airokom likha kujtachilmm.
jodi shomvhob hoy bro parla bornalimittik roshayon somporkhe likhen ektuuu
চেষ্টা থাকবে 🙂 মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ 🙂
Super nice
100,000 L mol^-1 cm^-1 হবে না ভাইয়া? 😛
I think this writing is helpful. Anyway the answer is 20 mol/ (L.cm)
Great initiative to help the students!
Really awesome…..