ব্লাড গ্রুপিং সম্পর্কে জানতে হলে প্রথমেই কিছু বেসিক টার্ম সম্পর্কে ক্লিয়ার কনসেপ্ট রাখা জরুরি, সেগুলো হল – অ্যান্টিজেন, অ্যাগ্লুটিনোজেন, অ্যান্টিবডি, অ্যাগ্লুটিনিন, ইম্যুনোগ্লোবিউলিন এবং অ্যাগ্লুটিনেশন। নামগুলো খেয়াল করলে বুঝা যায় প্রথম ৫ টা যেখানে জৈব রাসায়নিক বস্তু, সেখানে ৬ষ্ঠটি হচ্ছে একটি প্রক্রিয়া।

প্রথম প্রশ্ন, অ্যান্টিজেন কী? রাসায়নিকভাবে অ্যান্টিজেন হল মিউকোপলিস্যাকারাইড ধরণের শর্করা জাতীয় পদার্থ। এর প্রকারভেদ জিজ্ঞাসা করলে সহসাই মুখ ফুটে বেরিয়ে আসে যা তা হল- এটি দু’রকম : অ্যান্টিজেন A এবং অ্যান্টিজেন B। আসলেই কি অ্যান্টিজেন কেবল এই দু’রকম?


না, প্রকৃতপক্ষে মানুষের রক্তকণিকার পরিধি জুড়ে অন্তত ৩০ রকম অ্যান্টিজেনের উপস্থিতি হরদমই দেখা যায়। এছাড়াও প্রায় ১০০ রকম বিরল অ্যান্টিজেনের অস্তিত্ব সম্পর্কে জানা গিয়েছে। এদের মধ্যে অধিকাংশই বেশ দুর্বল প্রকৃতির; যা জিনতাত্ত্বিক গবেষণায় কিঞ্চিৎ ভূমিকা রাখতে পারলেও ব্লাড গ্রুপিং কিংবা রক্ত সঞ্চারণ জনিত কোন ঘটনায় সম্পূর্ণ ভূমিকাহীন।

মোদ্দা কথা তাহলে এই দাঁড়াল, ব্লাড গ্রুপিং এর জন্য নির্ধারিত অ্যান্টিজেনের সংখ্যা মাত্র ২ টি – অ্যান্টিজেন A এবং অ্যান্টিজেন B; যেগুলোর কথা ইতোমধ্যেই একবার উল্লেখ করা হয়েছে। এই দু’টিই কেবল রক্ত সঞ্চারণ জনিত ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।
এবার আসি, অ্যাগ্লুটিনোজেনের ব্যাখ্যায়… প্রকৃতপক্ষে, অ্যান্টিজেন ২ টির ( এখন আর আমরা ১৩০ রকম অ্যান্টিজেনের ব্যাপারটা মাথায় রাখব না, কারণ আমাদের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে ব্লাড গ্রুপিং নিয়ে আলোচনা) প্রতিটি-ই ক্ষেত্র বিশেষে কখনও পৃথকভাবে আবার কখনও বা উভয়ই অ্যাগ্লুটিনোজেন হিসেবে চিহ্নিত হয়। ব্যাপারটা একটু ধোঁয়াশে মনে হচ্ছে কি? হওয়ারই কথা!! কারণ, এটি বুঝার আগে আমাদের বুঝতে হবে অ্যান্টিবডি কী জিনিস? আর অ্যাগ্লুটিনেশনই বা কোন ধরণের প্রক্রিয়া? চল, আগে তাহলে ঘুরে আসি অ্যান্টিবডির রাজ্যে।
রাসায়নিক ভাবে অ্যান্টিবডি হল গ্লাইকো-প্রোটিন ধর্মী যৌগ। বিটা-লিম্ফোসাইট ও প্লাজমা কোষ থেকে এসব যৌগ উৎপন্ন হয়। কী ভাবছ? অ্যান্টিজেনের উৎপত্তিস্থল সম্পর্কে তো কিছু জানা হয়নি, তাই না? কারণটাও খুব সোজা! খেয়াল কর, অ্যান্টিজেন হচ্ছে রক্তের নিজস্ব বস্তু, ইংরেজিতে আমরা যাকে বলি “ইনহেরেন্ট”। অর্থাৎ এই অ্যান্টিজেন প্রতিটি মানব শিশু জন্মসূত্রেই লাভ করে থাকে। অপরদিকে, অ্যান্টিবডি নবজাত শিশুর রক্তে সম্পূর্ণভাবে অনুপস্থিত থাকে। কখন-কেন এই অ্যান্টিবডি মানব রক্তে উৎপত্তি নেয় সে সম্পর্কে আমরা একটু পরেই জানব। অ্যান্টিজেন-অ্যান্টিবডির আলোচনায় পুনরায় যাওয়ার আগে এবার ইম্যুনোগ্লোবিউলিন সম্পর্কে ধারণা দিয়ে রাখি।
চল, এর জন্য একটু আমরা ফিরে তাকাই রক্তের রাসায়নিক গঠনের দিকে। শতকরা হিসেবে রক্তের প্রায় ৫৫ শতাংশ হচ্ছে রক্তরস। রক্তরসের মধ্যে রয়েছে পানি (৯০-৯২%) আর কঠিন পদার্থ (৮-১০%)। সেই কঠিন পদার্থের জৈব বিভাগের একটি অংশ হচ্ছে প্রোটিন। অর্থাৎ সহজ কথায় রক্তের রক্তরসের মাঝে বেশ কিছু প্রোটিন-ধর্মী উপাদান বিদ্যমান। এমন-ই একটি প্রোটিন ধর্মী উপাদান হচ্ছে আমাদের ইম্যুনোগ্লোবিউলিন। এই ইম্যুনোগ্লোবিউলিন (Ig) রয়েছে মোট ৫ রকম– IgG, IgM, IgA, IgE ও IgD। মজার ব্যাপার কী জানো? ইম্যুনোগ্লোবিউলিন সম্পর্কে জানতে জানতে প্রকারান্তরে আমরা আসলে অ্যান্টিবডি সম্পর্কেই জেনে গেলাম!! দাঁড়াও, বুঝিয়ে বলছি…. অ্যান্টিবডি প্রকৃতপক্ষে ইম্যুনোগ্লোবিউলিনেরই ভিন্ন ভিন্ন অংশের সমষ্টি। ধরে নাও, সংখ্যার হিসাবে কোন এক ব্যক্তির রক্তরসে ১০০ টি অ্যান্টিবডি রয়েছে। তাহলে দেখা যাবে, ১০০ টার মধ্যে ৭৫-৮০ টি হচ্ছে প্রকৃতিগতভাবে IgG, ১০-১৫ টি IgA এবং বাকি ৫-১০ টি IgM (উল্লেখ্য, অধিকাংশ ব্লাড গ্রুপ অ্যান্টিবডি-ই এই IgG, IgM এবং IgA প্রকৃতির। শতকরা হিসেবে IgD ও IgE উপেক্ষণীয়)। অর্থাৎ অ্যান্টিবডি আসলে সামগ্রিকভাবে ইম্যুনোগ্লোবিউলিন বৈ আর কিছুই নয়।
এখন, প্রশ্ন হচ্ছে অ্যান্টিবডির প্রকারভেদ তাহলে কোনগুলো? IgG, IgM, IgE নাকি অ্যান্টিবডি A এবং অ্যান্টিবডি B? একটু মনোযোগ দাও – প্রতিটা Ig ই এক একটা অ্যান্টিবডি। কিন্তু অ্যান্টিবডি হয় শুধু A বা B- এই টাইপ। এখন অ্যান্টিবডি A এর সংখ্যা ১০০ টা হলে এর মধ্যে ৭৫ টাই হচ্ছে IgG ধরণের অ্যান্টিবডি। বাকি ২৫ টা IgE ও IgM। এই শতকরা সংখ্যার ব্যাপারটা আপেক্ষিক। এদিক-সেদিক হতে পারে। কিন্তু সামগ্রিকভাবে মানুষের প্লাজমায় বিদ্যমান এবং রক্ত সঞ্চারণজনিত ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখে এমন অ্যান্টিবডি কেবল দুই ধরণের-ই! ★ অ্যান্টিবডি A / anti- A / a / alfa এবং, ★অ্যান্টিবডি B / anti-B / b / beta খেয়াল করো, অ্যান্টিবডি A হবে নাকি B হবে সেটা Ig এর সাংখ্যিক অনুপাতের উপর নির্ভর করে না। নির্ভর করে রক্তে থাকা অ্যান্টিজেনের গঠনের ভিন্নতার উপর। অর্থাৎ, অ্যান্টিবডি A ও B গঠনগত দিক থেকে ভিন্ন কিন্তু উপাদানগত দিক থেকে একই। এখন কথা হচ্ছে, অ্যান্টিবডি যেহেতু অ্যান্টিজেনের মত ইনহেরেন্ট প্রকৃতির নয়, সুতরাং অ্যান্টিবডি উৎপন্নের নির্ধারিত সময়কাল এবং যুক্তিযুক্ত কারণ থাকা অতীব জরুরি। আর এটি বুঝতে হলে আগে লাগবে ” অ্যাগ্লুটিনেশন” সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা। মানে হচ্ছে রক্ত জমাট বেঁধে যাওয়া। জানা দরকার, জমাট কখন আর কেনই বা বাঁধবে?
এখন পর্যন্ত আমরা দু’ধরণের অ্যান্টিজেন ও দু’ধরণের অ্যান্টিবডির কথা জেনেছি। তার মধ্যে অ্যান্টিজেন A ও অ্যান্টিবডি B এর সমগোত্রীয় অ্যান্টিবডিদ্বয় হচ্ছে যথাক্রমে অ্যান্টিবডি A ও অ্যান্টিবডি B। রক্ত জমাট বাঁধার রাসায়নিক নাম হচ্ছে অ্যান্টিজেন- অ্যান্টিবডির ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া; যা নির্ভর করে রক্তে উপস্থিত অ্যান্টিজেন ও অ্যান্টিবডি দুইটি কি সমগোত্রীয় নাকি ভিন্ন গোত্রীয় – তার উপর। যদি সমগোত্রীয় হয় ( অর্থাৎ, ধরে নাওও কারও রক্তে একই সাথে অ্যান্টিজেন A ও অ্যান্টিবডি A বিদ্যমান) তবে, সেখানে পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার এক বিরূপ বিক্রিয়া ঘটবে যার ফলস্বরূপ রক্ত জমাট বেঁধে যাবে। আর এই প্রক্রিয়াটি-ই হল অ্যাগ্লুটিনেশন। নিঃসন্দেহে এই প্রক্রিয়া প্রকৃতি বিরুদ্ধ। তাই প্রাকৃতিকভাবে কখনোই একই ব্যক্তির রক্তে সমগোত্রীয় অ্যান্টিজেন- অ্যান্টিবডি একত্রে বিরাজ করে না। এখন, খেয়াল করো, অ্যান্টিজেন যেহেতু ইনহেরেন্ট প্রকৃতির সেহেতু স্বভাবতই শিশুর জন্মের পর অ্যান্টিবডি ভিন্ন গোত্রেরটা উৎপত্তি লাভ করবে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, অ্যান্টিবডি কখনোই আপনা-আপনি জন্মায় না, তা সে যে ধরণের-ই হোক না কেন।
অ্যান্টিবডির একটি সাধারণ পরিচয় হল “দেহের বহিরাগত কোন পদার্থের প্রতি সাড়া দিয়ে জন্মানো” জৈব রাসায়নিক বস্তু। যেমন কারো শরীরে যদি কোন রোগের জীবাণু প্রবেশ করে তবে সেই জীবাণুকে ধ্বংসের উদ্দেশ্য মানবদেহে পরিপূরক অ্যান্টিবডির সৃষ্টি হয়। একই রকমভাবে রক্তের নিজস্ব অ্যান্টিজেন ব্যতীত ভিন্ন অ্যান্টিজেন যদি কোনভাবে মানব রক্তে প্রবেশ করে তবেই সেই অ্যান্টিজেনের বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি তৈরি হবে এবং তা হবে সমগোত্রীয় (অর্থাৎ বহিরাগত অ্যান্টিজেন A এর জন্য অ্যান্টিবডি A জন্মাবে)। মনে রেখো, যেই প্রকৃতির অ্যান্টিজেন রক্তের নিজস্ব, তার বিরুদ্ধে কিন্তু কখনোই তার সমগোত্রীয় অ্যান্টিবডি রক্তে সৃষ্টি হবে না। কারণ, এমন-টা হলে তখনই অ্যাগ্লুটিনেশন হয়ে রক্ত জমাট বেঁধে যেত!! রক্ত-সঞ্চারণ জনিত কোন ঘটনা ঘটেনি এমন ব্যক্তির রক্তে নিজস্ব অ্যান্টিজেন ছাড়া ভিন্নটা আসে কীভাবে যার প্রভাবে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়? উত্তরটা হচ্ছে – খুব অল্প পরিমাণ অ্যান্টিজেন A ও অ্যান্টিজেন B উভয়ই খাদ্য, ব্যাকটেরিয়া কিংবা অন্য যে কোন উপায়ে শিশুর দেহে প্রবেশ করে। সাথে সাথেই দেহের আদর্শ প্রতিরক্ষা সিস্টেম তৎপর হয়ে উঠে সংশ্লিষ্ট অ্যান্টিবডি তৈরি করত।
..করতে যাতে নতুন আগত অ্যান্টিজেন সমূলে ধ্বংস হয়ে যায় ( অ্যান্টিবডিকে কিন্তু বডিগার্ড হিসেবেও অভিহিত করা হ য়ে থাকে!)। কিন্তু ঐ অল্প পরিমাণ নির্দিষ্ট বহিরাগত অ্যান্টিজেনের বিরুদ্ধে দেহ এত বেশি সংখ্যক পরিপূরক অ্যান্টিবডি সৃষ্টি করে যে, সেই অ্যান্টিজেন (বহিরাগত) সব ধ্বংস হওয়ার পরও অতিরিক্ত অনেক অ্যান্টিবডি দেহে থেকে যায়। এই হচ্ছে, মানব দেহে অ্যান্টিবডির উৎপত্তি। তুমি খেয়াল করলে এখন বুঝবে, একজন ব্যক্তির রক্তে আল্টিমেটলিলি যে-ই গোত্রের অ্যান্টিজেন( A অথবা B) থাকে, অ্যান্টিবডি থাকে সর্বদাই তার বিপরীত গোত্রের (যথাক্রমে b অথবা a)। সব কিছুর উদ্দেশ্য একটাই….আর তা হল – অ্যাগ্লুটিনেশন এড়ানো। শিশুর জন্মের ২ থেকে ৮ মাস পর থেকে এই অ্যান্টিবডি উৎপাদন প্রক্রিয়া চলতে থাকে এবং উৎপাদনের শীর্ষে পৌঁছে ৮-১০ বছর বয়সে। আর জীবনের বাকি সময়ে এই অ্যান্টিবডির সংখ্যা ধীরে ধীরে কমতে থাকে।
এখন জানা দরকার অ্যাগ্লুটিনোজেন ও অ্যাগ্লুটিনিন বলতে কী বোঝায়? আগেই বলেছি, অ্যাগ্লুটিনোজেন মূলত অ্যান্টিজেন গুলোই তবে তা ক্ষেত্র নির্দিষ্ট। একইভাবে, অ্যাগ্লুটিনিনও মূলত অ্যান্টিবডিই এবং এরাও ক্ষেত্র নির্দিষ্ট। ক্ষেত্রটি হচ্ছে ” অ্যাগ্লুটিনেশন”। অর্থাৎ যদি কখনোও রক্তে সমগোত্রীয় অ্যান্টিজেন – অ্যান্টিবডির সমকালীয় উপস্থিতির জন্য লোহিত রক্তকণিকা জমাট বেঁধে যায় তবে ঐ ক্ষেত্রে ঐ নির্দিষ্ট অ্যান্টিজেন ও অ্যান্টিবডিকে যথাক্রমে বলা হয়ে থাকে অ্যাগ্লুটিনোজেন ও অ্যাগ্লুটিনিন। উদাহরণস্বরূপ, ধরে নাও, কারও রক্তে অ্যান্টিজেন A ও অ্যান্টিবডি B বিদ্যমান। কোন কারণে রক্তে অ্যান্টিজেন B প্রবেশ করলে অ্যান্টিজেন B ও অ্যান্টিবডি B (যা আগেই সঞ্চিত ছিল) পারস্পরিক বিরূপ ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার দরুণ অ্যাগ্লুটিনেশন ঘটাবে যার ফলে রক্ত জমাট বেঁধে যাবে। এখন এই অ্যান্টিজেন B হল অ্যাগ্লুটিনোজেন ও অ্যান্টিবডি B হল অ্যাগ্লুটিনিন। কিন্তু এক্ষেত্রে অ্যান্টিজেন A কেবলই অ্যান্টিজেন; অ্যাগ্লুটিনোজেন নয়। বাকি থাকল মানবদেহে এই অ্যান্টিজেন ও অ্যান্টিবডির অবস্থান। অ্যান্টিজেন থাকে লোহিত রক্তকণিকার প্লাজমামেমব্রেন অর্থাৎ কণিকাঝিল্লীতে। অপরদিকে, জন্ম পরবর্তী সময়ে সৃষ্ট অ্যান্টিবডি থাকে প্লাজমা তথা রক্তরসে।
BloodTypes-ABO

লোহিত রক্তকণিকায় গ্রুপভেদে এন্টিজেনসমূহের উপস্থিতি। কৃতজ্ঞতা : dbriers.com